লবণায়নের মাধ্যমে মাছ সংরক্ষণ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় লবণায়নের মাধ্যমে মাছ সংরক্ষণ – যা মাছ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এর অন্তর্ভুক্ত।

লবণায়নের মাধ্যমে মাছ সংরক্ষণ

 

লবণায়নের মাধ্যমে মাছ সংরক্ষণ

 

লবণজাত প্রক্রিয়ায় মাছ সংরক্ষণ একটি সহজ এবং দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি। এ পদ্ধতি চর্বিযুক্ত মাছ, যেমন- ইলিশ সংরক্ষণ করার জন্য খুবই উপযোগী। আমাদের দেশে ভরা মৌসুমে যখন প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ে তখন দাম খুব কমে যায়।

এ সময় লবণায়নের মাধ্যমে ইলিশ মাছ সংরক্ষণ করা যায়। লবণায়নের মাধ্যমে মাছ সংরক্ষণ পদ্ধতিতে অভিশ্রবণ প্রক্রিয়ায় মাছের দেহে লবণ প্রবেশ করানো হয়। ফলে মাছের দেহ থেকে পানি বের হয়ে আসে। পানি বের হয়ে আসে বিধায় মাছে লবণের ঘনত্ব বেড়ে যায় যা অণুজীবের জন্ম এবং বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে মাছ সংরক্ষিত হয়। লবণায়নের ফলে মাছের দেহের গঠনের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন এবং আকর্ষণীয় গন্ধের সৃষ্টি হয়। এভাবে সংরক্ষিত মাছ তাজা মাছের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে ।

লবণায়নের প্রকারভেদ :

লবণায়ন পদ্ধতিকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায় ৷

১. শুষ্ক লবণায়ন :

এই পদ্ধতিতে মাছের আঁইশ, পাখনা, নাড়িভুঁড়ি অপসারণ করে ধোয়ার পর দানাদার লবণ মাছের দেহে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে লাগিয়ে দেয়া হয়। এর প্রভাবে অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় মাছের দেহ থেকে পানি নির্গত হয়ে একটি শুষ্ক লবণ দ্রবণে পরিণত হয় এবং ব্যাপন প্রক্রিয়ায় দ্রবণ হতে লবণ মাছের দেহে প্রবেশ করতে থাকে, আর দেহ থেকে পানি বের হতে থাকে ।

একটা সাম্যাবস্থায় উপনীত না হওয়া পর্যন্ত এরূপ চলতে থাকে । মাছকে শুষ্ক লবণায়ন করার পর কাঠের বা বাঁশের মাচায় বিছিয়ে মাদুর বা চট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। মাছ ছোট আকারের হলে টুকরা করার প্রয়োজন হয় না। তবে বড় আকারের হলে অবশ্যই পাতলা ফালি বা ছোট টুকরা করতে হয়। ৭-১০ দিনের মধ্যে মাছ পরিপক্ক হয় বা মাছের লবণায়ন প্রক্রিয়া শেষ হয়। বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে প্রধানত ইলিশ মাছ লবণায়ন করা হয় ।

সুবিধা

  • লবণ ব্যাকটেরিয়ার জন্ম ও বৃদ্ধি প্রতিহত করে;
  • লবণের পানিগ্রাহী গুণের কারণে মাছের কোষ হতে সরাসরি পানি শোষণ করে। ফলে মাছকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করা যায় ।

অসুবিধা

  • উৎপাদিত পণ্যে লবণের পরিমাণ খুব বেশি হয়।
  • মাছের দেহে লবণ সমভাবে মিশতে পারে না। ফলে সংরক্ষণ ভালো হয় না ।
  • নির্গত পানি পরিবেশ দূষিত করে।
  • মাছের শারীরিক গঠন নষ্ট হয়, কুঁচকে যায় এবং রঙের পরিবর্তন ঘটে।

২. আর্দ্র লবণায়ন : এই পদ্ধতিতে মাছকে তাৎক্ষণিকভাবে ধৌত করে আঁইশ, পাখনা ও নাড়িভুঁড়ি ছাড়ানোর পর সুবিধামতো টুকরা করে পূর্বে তৈরিকৃত লবণ দ্রবণে ডুবিয়ে রাখা হয় । মাছকে কতক্ষণ লবণ দ্রবণে ডুবিয়ে রাখতে হবে তা অভিজ্ঞতা দ্বারা নির্ণয় করা হয়। মাছের দেহে লবণ প্রবেশ করে এবং দেহ থেকে পানি বেরিয়ে আসে। ফলে লবণ দ্রবণের ঘনত্ব কমে যায়। এজন্য দ্রবণের ঘনত্ব সমান রাখার জন্য লবণ দ্রবণে বার বার লবণ যোগ করতে হয়।

সুবিধা

  • মাছের দেহের সর্বত্র সমানভাবে লবণ ঢোকে ;
  • দৈহিক আকারের কোনো পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ মাছের দেহ কুঁচকে যায় না ।

অসুবিধা

  • মাছের টুকরা লবণ দ্রবণে ভেসে ওঠে বলে বাতাসের সংস্পর্শে এসে চর্বির জারণ ঘটে পণ্যের গুণাগুণ নষ্ট হয় ।
  • প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাত্র খোলা যায় না। তাই পরিপক্বতার মাত্রা বুঝা যায় না,
  • মাছের দেহ হতে অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় পানি বের হয়ে লবণ দ্রবণের ঘনত্ব কমিয়ে দেয় ।

৩. মিশ্র লবণায়ন :

এটা এমন একটা পদ্ধতি যেখানে মাছকে শুষ্ক লবণ ও লবণ দ্রবণের সাহায্যে একত্রে লবণ- জাতকরণ করা হয় । এটা আর্দ্র লবণায়ন অপেক্ষা ভালো পদ্ধতি। মাছের আঁইশ, পাখনা, ও নাড়িভুঁড়ি ছাড়ানোর পর টুকরা করে শুকনো লবণ ভালোভাবে ঘষে ঘষে মাছের দেহে লাগানো হয়। অতঃপর টুকরোগুলো লবণ দ্রবণে ডুবিয়ে দেয়া হয়। শুষ্ক লবণ লাগানোর ফলে মাছের দেহ হতে পূর্বেই পানি বের হয়ে যায়। ফলে মাছের দেহের পানি লবণ দ্রবণকে পাতলা করতে পারে না ।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

সুবিধা

  • পূর্বেই শুষ্ক লবণায়ন করার ফলে মাছের দেহ নিঃসৃত পানি দ্বারা লবণ দ্রবণ পাতলা হতে পারে না ।
  • মাছের শারীরিক গঠনে তেমন কোন পরিবর্তন হয় না ।
  • মাছের দেহের সর্বত্র সমানভাবে লবণ প্রবেশ করে ।

অসুবিধা

  • এ ক্ষেত্রেও মাছের টুকরা লবণ দ্রবণে ভেসে ওঠে চর্বির জারণ ঘটায়।

লবণায়িত মাছের পরিপক্বতা (Ripening) :

লবণায়িত মাছের পরিপক্বতা হচ্ছে পণ্যের গঠন, বর্ণ ও গন্ধের একটি বিশেষ অবস্থা যা গুণাগুণের পরিপূর্ণতা নির্দেশ করে। মাছের দেহ কলায় বিভিন্ন রাসায়নিক এবং ভৌত-রাসায়নিক পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে এই পরিপক্বতা অর্জিত হয়। এসব পরিবর্তন সাধারণত দেহস্থিত পাচক রস ও ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক নিঃসৃত পাচকরস দ্বারা ঘটে থাকে যা আমিষ ও চর্বিকে ভেঙে ফেলে।

ফলে কিছু পরিমাণ অ-নাইট্রোজেন ঘটিত পদার্থ মাছের দেহ হতে ব্যাপিত হয়ে বাইরের লবণ দ্রবণে চলে আসে। লবণজাত পণ্যে এগুলোর পরিমাণ কমলে পণ্যের স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ ও টেকচারের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সাধিত হয় । মাছের পরিপক্বতার হার নিচে লিখিত বিষয়গুলোর ওপর নির্ভর করে ।

  • মাছের রাসায়নিক গঠন;
  • লবণের সংযুক্তির ওপর;
  • তাপমাত্রা
  • মাছের দেহ কলায় লবণের পরিমাণ
  • নাড়িভুঁড়ির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি ।

লবণারনের মাধ্যমে ইলিশ মাছ সংরক্ষণ :

আমাদের দেশে শুষ্ক লবণায়নের মাধ্যমে বেশির ভাগ ইলিশ মাছ সংরক্ষণ করা হয়। ইলিশ মাছ অধিক চর্বিযুক্ত মাছ। তাই একে শুটকিকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যায় না। বরফায়ন যেহেতু একটি স্বল্প মেয়াদি সংরক্ষণ পদ্ধতি তাই এই পদ্ধতিতে ইলিশ মাছকে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। অন্য দিকে হিমায়ন একটি ব্যয় বহুল পদ্ধতি যার ব্যবহার আমাদের দেশের জন্য উপযোগী নয় ৷ ভরা মৌসুমে যখন প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ে তখন লাম খুবই কমে যায় এবং মাছ সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই সময় লণায়নের মাধ্যমে জেলেরা বেশির ভাগ ইলিশ সংরক্ষণ করে থাকে।

সংরক্ষণ পদ্ধতি :

এই পদ্ধতিতে প্রথমে মাছের আঁইশ, পাখনা, ফুলকা, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি ফেলে দেয়া হয়। প্রায়শই কাটা মাছকে পানি দিয়ে ধৌত করা হয় না। মাথার পিছনে ঘাড়ের দিকের ত্রিকোণাকার ছোট একটি টুকরা কেটে ফেলা হয়। ফলে মাছের দেহে লবণ দিতে ও মাছ বাঁকা ও চন্দ্রাকৃতি করে বিছিয়ে দিতে সুবিধা হয়। এরপর মাছকে বটিতে ফেলে পৃষ্ঠদেশ থেকে অঙ্কীয় দিকে গ্রন্থ বরাবর আড়াআড়িভাবে কাটা হয় যেন মাছ অংকীয় দেশে লেগে থাকে। অবশ্য কোনো কোনো এলাকায় অৰ্কীয় দেশ থেকে পৃষ্ঠ দিকে কাটা হয়। মাছের ওজনের এক-চতুর্থাংশ লবণ দ্বারা সারা পায়ে এবং চোখ, ফুলকা, উদর-গহ্বর ও টুকরার ভাঁজে ভাঁজে ঘষে ঘে লাগানো হয়।

অতপর লবণজাত মাছকে একটি ছিদ্রযুক্ত পাত্রে রাখা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহার করা হয়। মাছ রাখার আগে বুড়ির ভিতর চতুপাৰে লবণ ছিটিয়ে দেয়া হয় যাতে ঝুড়িতে থাকা সব ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। এবার ইলিশ মাছ একটি একটি করে এমনভাবে রাখা হয় যেন মাছের অঙ্কীয় দেশ উপরের দিকে থাকে। অয় দেশে (পেটের মাংশপেশিতে) মজুদ চর্বি নির্গত পানির সাথে বের হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য এরূপ করা হয়ে থাকে। সবশেষে হোগলা, চট বা মাদুর দিয়ে ঝুড়িকে ঢেকে দেয়া হয়।

 

লবণায়নের মাধ্যমে মাছ সংরক্ষণ
চিত্র-২১: লবণায়নের মাধ্যমে ইলিশ মাছ সংরক্ষণ

 

প্রচলিত পদ্ধতিতে ইলিশ মাছে লবণ প্রয়োগের জন্য কোনো আদর্শ অনুপাত অনুসরণ করা হয় না। অঞ্চলভেদে ও মাছের আকারের উপর ভিত্তি করে এই অনুপাত পরিবর্তিত হয় বা অভিজ্ঞতার দ্বারা নির্ধারিত হয়। সাধারণত মাছ ও লবণের অনুপাত ৪:১ হরে থাকে। লবণ মাছের দেহে প্রবেশ করে এবং দেহ হতে পানি বের হয়ে আসে এবং একটি সাম্যাবস্থায় না আসা পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকে। আকৃতিভেদে ১০-১২ দিনের মধ্যে মাছের পরিপক্বতা আসে। এ সময় নবগায়িত মাছ উজ্জ্বল বর্ণ ও সুন্দর গন্ধ লাভ করে। পরিপক্ক লবণায়িত মাছকে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রায় শুকনো ও শীতল স্থানে সংরক্ষণ করা হয়।

লবণায়নের সুবিধা

  • ইলিশ চর্বিযুক্ত মাছ। তাই রৌদ্রে শুকিয়ে সংরক্ষণ সম্ভব নয়। লবণায়নের মাধ্যমে ইলিশ মাছ সংরক্ষণ সম্ভব;
  • এই পদ্ধতি সহজ এবং জেলেদের নিকট প্রচলিত;
  • এই পদ্ধতিতে সংরক্ষিত মাছের পুষ্টিমানের কোনো পরিবর্তন হয় না ।

অসুবিধা

  • অনেক সময় এই পদ্ধতিতে মাছ ও লবণের অনুপাত ঠিক রাখা হয় না ফলে কাঙ্ক্ষিত গুণগতমান বজায় রাখা যায় না;
  • লবণায়নের পর যদি মাছ খোলা অবস্থায় রাখা হয় তখন মাছের চর্বি বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে জারণের ফলে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয় এবং উৎপাদের গুণগতমান খারাপ হওয়ার ফলে চাহিদা কমে যায় ৷

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment