আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – গলদা চিংড়ির জীববিদ্যা । যা ” গলদা চিংড়ির জীববিদ্যা ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
গলদা চিংড়ির জীববিদ্যা
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চিংড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এদেশে প্রায় ২৭ প্রজাতির মিঠা পানির চিংড়ি এবং ৩৬ প্রজাতির লোনা পানির চিংড়ি পাওয়া যায় । মিঠা পানির বিভিন্ন চিংড়ির মধ্যে গলদা চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । মিঠা পানির এই চিংড়ি বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ জলাশয় যেমন- পুকুর, ডোবা, দীঘি, খাল-বিল, ধানক্ষেত ও নদীতে বাস করে ।
গলদা চিংড়ি ডিম ছাড়ার সময় মোহনায় চলে আসে এবং সেখানেই কিশোর চিংড়িতে পরিণত হয় । পূর্ণাঙ্গ কিশোর চিংড়ি উজান বেয়ে মিঠা পানির দিকে অগ্রসর হয় এবং মিঠা পানিতেই এরা পরিপক্বতা লাভ করে । এরা নদী মোহনা হতে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত পরিভ্রমণ করে থাকে ।
চিংড়ি চাষ প্রযুক্তিনির্ভর বিধায় চিংড়ির জীববিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ গলদা চিংড়ি চাষ করতে হলে এর অঙ্গসংস্থান, প্রকৃতি বা আচার আচরণ, পরিবেশ ও পরিবেশীয় উপাদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার।
গলদা চিংড়ি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গ্রীষ্মমন্ডল ও ক্রান্তীয়মন্ডলের কাছাকাছি বেশি পাওয়া যায়। এ সমস্ত অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কাম্পুচিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন গুরুত্বপূর্ণ।
এ সমস্ত দেশের নদী, হ্রদ, প্লাবনভূমি, হাওর-বাঁওড় ইত্যাদি এদের প্রাকৃতিক বাসস্থান। এরা নদী মোহনা হতে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত পরিভ্রমণ করতে পারে।
চিংড়ির উপাদসমূহ
চিংড়ির দেহে সর্বমোট ১৯ জোড়া উপাঙ্গ রয়েছে । এর মধ্যে ১৩ জোড়া উপাঙ্গ শিরোবক্ষ অংশে এবং ৬ জোড়া উদর অংশে অবস্থিত । তবে একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় পাঁচ জোড়া শিরোদেশে (Cephalic), আটি ঘোড়া বক্ষদেশে (Thoracic) এবং হয় জোড়া উপাঙ্গ উদর অঞ্চলে অবস্থিত । উপাদগুলো সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে; যথা-
১. ইউনিরেমাস (Uniramous )
২. বাইরেমাস (Biramous)
৩. মাল্টিরেমাস বা ফলিওরেমাস (Folioramous)
তবে গলদা চিংড়ির প্রথম উপাদ ছাড়া অন্য সবগুলো দ্বিবাহু বিশিষ্ট । মূল অংশটি দেহের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে যা প্রটোপোডাইট নামে পরিচিত। প্রটোপোডাইট (Protopodite) দুটি পডোমেরিস দ্বারা যুক্ত থাকে। নিচেরটিকে কক্সোপোভাইট এবং উপরের টিকে রেলোপোডাইট বলে। প্রটোপোডাইট দুটি শাখায় বিভক্ত; ভিতরের শাখাটিকে এন্ডোপোডাইট এবং বাইরের শাখাটিকে এক্সোপোডাইট বলে। চিংড়ির উপাঙ্গসমূহ সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথা- স্টেনোপোডিয়াম (Stenopodium) বা সরু পা এবং ফাইলোপোডিয়াম (Phylopodium) বা চ্যাপ্টা আকৃতির পা।
চিংড়ির শিরোপাল
১. গুঙ্গাণু (Antenmule)
২. (Antenna)
৩. ম্যান্ডিবুল (Mandible)
8. ম্যাক্সিলুলা (Maxilula) ও
৫. ম্যাক্সিলা (Maxila)

১. প্রদাণু (Antennule):
দেহের প্রথম জোড়া উপাঙ্গকে শুঙ্গাণু বলে। ওঙ্গাণু প্রটোপোডাইট দ্বারা গঠিত এবং এটা সাধারণত প্রি-কক্সা, কক্সা ও বেসিস নামক তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রি-কক্সা অংশটি বড় এবং এই অংশে চিংড়ির ভারসাম্য রক্ষার অঙ্গ স্ট্যাটোসিস্ট অবস্থিত।
২. অঙ্গাণু (Antenna):
অঙ্গাণুর ঠিক নিচে এবং পিছনস্থল থেকে ওদের উৎপত্তি হয়েছে। তা চিংড়ির দ্বিতীয় জোড়া শিরোপাজ। শুঙ্গ কব্জা ও বেসিস নামক দুটি অংশে বিভক্ত। এই উপাঙ্গের এপোডাইট বড় এবং এডোপোডাইট লম্বা। এন্ডোপোডাইটে অবস্থিত স্কোয়ামা (Squama) সাঁতার কাটার সময় চিংড়ির দেহের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে থাকে।
৩. ম্যান্ডিবুল (Mandible):
ম্যান্ডিবুল বা চোয়াল মুখের দুই পার্শ্বে অবস্থিত একজোড়া শক্ত উপাঙ্গ । ম্যান্ডিবুলের কক্সা অংশে চামচ আকৃতির এপাফাইসিস এবং মূল অংশে মোলার প্রসেস (Molar process) ইনসিজর প্রসেস (Incisor process) অবস্থিত। মোলার প্রসেসে ৫-৬ টি ডেস্টাল প্লেইট এবং ইনসিজর প্রসেসে ৩টি দাঁত থাকে। ম্যান্ডিবুলের সাহায্যে চিংড়ি খাদ্যবস্তু গ্রহণ ও পেষণ করে থাকে ।
8. ম্যাক্সিগুলা (Marihula):
চিংড়ির উপাঙ্গগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোট উগানটির নাম ম্যাক্সিলুলা । এই উপালটি লেবিয়ামের পিছনে অবস্থিত এবং পাতলা আইশের ন্যার তিনটি অংশ যারা গঠিত। এর কিনারা ছোট ছোট সিটা দ্বারা আবৃত থাকে। ম্যাক্সিলুলার এন্ডোপোডাইট বাকানো এবং অগ্রভাগ সুভাগে বিভক্ত। কিন্তু এর কোনো এক্সোপোডাইট নেই। এই উপাঙ্গ খাদ্যবস্তু টুকরো টুকরো করে মুখের ভেতরে প্রবেশ করাতে সহায়তা করে থাকে।

৫. ম্যাক্সিলা (Maxila):
এই উপাঙ্গ জোড়া পাতলা আইশের মত এবং ম্যাক্সিলুলার পিছনে অবস্থিত। এই উপাদের কব্জা বেশ বড় এবং বেসিস দুভাগে বিভক্ত হয়ে দেখোবেসে পরিণত হয়। ম্যাক্সিলা খাদ্য গ্রহণ শ্বসন কাজে সাহায্য করে থাকে।
চিংড়ির বক্ষ উপাঙ্গসমূহ (Thoracic Appendnges)
চিংড়ির বক্ষদেশে মোট আট জোড়া উপাদ অবস্থিত। এর মধ্যে প্রথম তিন জোড়া উপালকে ম্যাক্সিলিপেড (Maxilliped) এবং পরবর্তী পাঁচ জোড়াকে চলনপদ (Walking.legs) বলে।
১. প্রথম ম্যাক্সিলিপেড
এই উপাঙ্গগুলো সর্বাপেক্ষা ছোট। প্রথম ম্যাক্সিনিপের পাতলা এবং ফাইলোপডিয়াম ধরনের। প্রথম ম্যাক্সিলিপেড খাদ্য ধরতে এবং শ্বসনকার্যে ব্যবহৃত হয় ।
২. দ্বিতীয় ম্যাক্সিপিডো
দ্বিতীয় ম্যাক্সিলিপেডের কক্সা ছোট এবং বাইরের দিকে এপিপডাইট ও ফুলকা অবস্থিত। এক্সোপডাইট লম্বা এবং সরু। দ্বিতীয় ম্যাক্সিলিপেড স্পর্শ ইন্দ্রিয়, খাদ্য ধারণ ও শ্বসনের কাজে ব্যবহৃত হয় ।
৩. তৃতীয় ম্যারিলিপেড
এই উপাঙ্গটি আকারে বেশ বড় এবং দেখতে অনেকটা চলন উপাদের মত। তৃতীয় ম্যাক্সিলিপেড চিংড়ির স্পর্শ ইন্দ্রিয়, খাদ্য ধরা এবং শ্বসন কাজে ব্যবহৃত হয় ।

চলনপদ (Walking legs):
চিংড়ির দেহে পাঁচ জোড়া চলনপদ আছে। চলন পদের কোনোটি চিমটাযুক্ত এবং কোনটি চিমটাবিহীন । চিংড়ির চতুর্থ চলনপদকে আদর্শ চলনপদ বলা হয়। সন্ধিযুক্ত প্রপোডাইট এবং পাঁচটি সন্ধিযুক্ত এন্ডোপোডাইট নিয়ে চলনপদ গঠিত। চিংড়ির চলনপদে এক্সোগোডাইট ও এপিপডাইট থাকে না ।
প্রথম ও দ্বিতীয় চলন পদ চিমটাযুক্ত। এই উপাঙ্গের প্রোপডাস লম্বা করে ডেকটাইলাসের শেষ প্রান্তে চিমটার আকার ধারণ করে । এই চিমটার অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ নখযুক্ত। পলদা চিংড়ি ১ম ও ২য় পদের চিমটার সাহায্যে খাদ্য ধরা, আত্মরক্ষা ও আক্রমণমূলক কাজ করে থাকে।
তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম চলনপদ সাধারণ ধরনের এবং চিমটাবিহীন হয়ে থাকে। স্ত্রী চিংড়ির তৃতীয় চলন উপাঙ্গের গোড়ায় কব্জা নামক অংশে স্ত্রী জনন ছিদ্র এবং পুরুষ চিংড়ির পঞ্চম চলন উপাঙ্গের কক্সার গোড়ায় পুজেমন ছিদ্র অবস্থিত। একই বয়সের পুরুষ চিংড়ির দ্বিতীয় চলনগন স্ত্রী চিংড়ির তুলনায় বেশি উজ্জ্বল, আকারে বড় এবং চিমটা অংশে বেশি কাঁটা দেখা যায় ।
উদর উপাঙ্গ (Abdominal appendages):
শিরোবক্ষের পরের দেহ অংশকে উদর বলা হয়। উপরের শেষ ভাগ ক্রমশ সরু হয়ে শেষ হয় । চিংড়ির উদরে মোট ছয় জোড়া উপাঙ্গ আছে। উদরের সব কয়টি উপাঙ্গই সাঁতার কাটার কাজে ব্যবহৃত হয় বলে এদেরকে সত্তরাপদ (Swimmerets) বলা হয়। এরা প্লিওপড (Pleopods) নামেও পরিচিত।
আরও দেখুনঃ