আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় খাঁচা স্থাপনের উপযোগী স্থান – যা খাঁচায় মাছচাষ এর অন্তর্ভুক্ত।
খাঁচা স্থাপনের উপযোগী স্থান
খাঁচা স্থাপনের উপযোগী স্থান
১. বড় বড় বিল, হাওর, বাঁওড়, প্লাবনভূমি, প্রবহমান নদী, সেচখাল এমনকি সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের খোলা পানিতে খাঁচা স্থাপন করা যায় ।
২. একমুখী পানির প্রবাহ কিংবা জোয়ার ভাটার শান্তপ্রবাহ বিদ্যমান এমন নদী, যেখানে ৪-৮ ইঞ্চি /সেকেন্ড মাত্রার পানি প্রবাহিত হয় এমন স্থান খাঁচা স্থাপনের জন্য উপযোগী। তবে পানি প্রবাহের এ মাত্রা সর্বোচ্চ ১৬ ইঞ্চি/সেকেন্ড এর বেশি হওয়া উচিত নয় ।
৩. খাঁচা পানিতে ঝুলন্ত রাখার জন্য ন্যূনতম পানির গভীরতা ১০ ফুট হওয়া প্রয়োজন। যদিও প্রবহমান পানিতে তলদেশে বর্জ্য জমে গ্যাস দ্বারা খাঁচার মাছের ক্ষতির আশঙ্খা কম । তথাপি খাঁচার তলদেশ নদীর
নিচের কাদা থেকে ন্যূনতম ৩ ফুট উপরে থাকা প্রয়োজন ।
৪. খাঁচা স্থাপনের স্থানটি লোকালয়ের নিকট হলে সহজে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় ।
৫. খাঁচা স্থাপনের স্থানের সাথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে সহজে মালামাল আনা নেওয়া এবং উৎপাদিত মাছ সহজে বাজারজাত করা যায় ।
৬. খাঁচা স্থাপনের কারণে যাতে কোনোভাবেই নৌ চলাচলের বিঘ্ন না ঘটে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৭. জোয়ার ভাটার স্রোত ও ঘোলাত্বের তীব্রতা নেই এমন নিরাপদ স্থানে খাঁচা স্থাপন করতে হবে ।
৮. সর্বোপরি খাঁচা স্থাপনের স্থানটি এমন হতে হবে যাতে শিল্প বা কলকারখানার বর্জ্য কিংবা পয়ঃনিষ্কাশনের পানি অথবা কৃষি জমি থেকে বন্যা বা বৃষ্টি বিধৌত কীটনাশক মিশ্রিত পানি নদীতে পতিত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে খাঁচার মাছ মারা যেতে না পারে ।
খাঁচা তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ :
খাঁচা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের তালিকা নিচে দেয়া হলো-
১. নাইলন, প্লাস্টিক, টায়ার কর্ড বা পলিইথিলিনের জাল (৩/৪ ইঞ্চি থেকে ১ ইঞ্চি)।
২. খাদ্য আটকানোর বেড় তৈরির জাল ।
৩. খাঁচার তলায় ট্রে হিসেবে ব্যবহার করার জাল।
৪. নাইলনের রশি ।
৫. কভার নেট বা ঢাকনা জাল (পাখির উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য)।
৬. ১ ইঞ্চি জিআই পাইপ/বাঁশ।
৭. ফ্রেম ভাসমান রাখার জন্য ফ্লোট হিসেবে ব্যবহৃত ব্যারেল/ড্রাম।
৮. খাঁচা স্থির রাখার জন্য গেরাপি (অ্যাঙ্কর)।
৯. ফ্রেমের সাথে বাঁধার জন্য মাঝারি আকারের সোজা বাঁশ।
১০. জাল সেলানোর জন্য সুঁই এবং প্লাস্টিক বা নাইলনের রশি ও
১১. Sinker হিসেবে ঝাঁকি জালে ব্যবহৃত লোহার কাঠি ।
খাঁচার ধরন :
খাঁচায় মাছ চাষের জন্য সাধারণত দুই ধরনের খাঁচা ব্যবহার করা হয়। যথা- ক. ভাসমান খাঁচা ও খ. স্থির খাঁচা ।
ক. ভাসমান খাঁচা :
ভাসমান খাঁচা প্রধানত প্রবহমান জলাশয়ে মাছ চাষের জন্য বেশি উপযোগী। কারণ জোয়ার ভাটার কারণে পানির উচ্চতা দ্রুত ওঠানামা করে। এ কারণে ভাসমান খাঁচা প্রবহমান জলাশয়ে ভাসমান কোনো বস্তুর সাথে এমনভাবে স্থাপন করা হয় যাতে খাঁচার ৩/৪ অংশ পানির মধ্যে ডুবে থাকে এবং অবশিষ্ট ১/8 অংশ পানির উপর ভেসে থাকে। খাঁচাকে পানিতে ভাসমান অবস্থায় রাখার জন্য লোহার বা প্লাস্টিকের ড্রাম বা প্লাস্টিকের ভাসমান বস্তুর সাথে শক্ত করে এমনভাবে বাঁধা হয় যাতে বাচার ও অংশ পানির মধ্যে অবস্থান করে এবং জোয়ার-ভাটার সাথে বাঁচার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন না ঘটে।
খ. স্থির খাঁচা :
সাধারণত বদ্ধ জলাশয় যেমন- পুকুর, দিঘি, হাওর, বাঁওড়, লেক প্রভৃতিতে স্থির খাঁচা স্থাপন করে মাছচাষ করা যায়। এক্ষেত্রে বাঁশের খুঁটির সাথে খাঁচা স্থিরভাবে বেঁধে দেয়া হয়। এই পদ্ধতিতেও খাঁচার এক-চতুর্থাংশ পানির উপর এবং বাকি তিন-চতুর্থাংশ পানির নিচে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। পানির উচ্চতার তারতম্যের সাথে সাথে বাঁচার উচ্চতা মাঝে মাঝে কম বেশি করা হয় ।
খাঁচা তৈরির উদ্দেশ্য : উদ্দেশ্য এবং সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে ২ ধরনের খাঁচা তৈরি করা যেতে পারে। যেমন- ক. পারিবারিক প্রয়োজন খ. বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য
ক. পারিবারিক প্রয়োজন :
খাঁচায় মাছ চাষ যদি শুধুমাত্র নিজের পারিবারিক মাছের চাহিদা পুরণের উদ্দেশ্যে করা হয় তাহলে খাঁচার আকার হবে ছোট অর্থাৎ ১ ঘনমিটার (১মি. ১১মি. x১মি.)। এরূপ খাঁচায় ২-৩ ইঞ্চি আকারের ৩০০টি গিফট বা মনোসেক্স তেলাপিয়া অথবা ১০০ টি পাঙ্গাসের পোনা মজুদ করা যেতে পারে। এমন কয়েকটি খাঁচা স্থাপন করলে সাধারণত একটি পরিবারের বাঘারিক মাছের চাহিদা মিটে যাবে। এক্ষেত্রে তেমন কোনো বাড়তি খাদ্যের প্রয়োজন পড়ে না।
রান্নাঘরের উচ্ছিষ্টাংশ, শামুক, ঝিনুক, সবুজ ঘাস, কলাপাতা, ক্ষুদিপানা ইত্যাদির সাথে সামান্য পরিমাণ খৈল-ভুসির বল খাদ্য মাঝে মাঝে প্রয়োগ করেও মাছচাষ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে খাচা তৈরির জন্যও তেমন কোনো পুঁজির প্রয়োজন হয় না। বাঁশ, কাঠ, রশি, ফ্লোটের জন্য পানির খালি বোতল বা তেলের জারিকেন এগুলো ঘরে থাকলে প্রতিটি খাঁচা তৈরিতে আনুমানিক ৮০০-১০০০ টাকা খরচ হয় । যা প্রায় ২ বছর ব্যবহার করা যায়। এরূপ একটি খাচা হতে বছরে ৩০ থেকে ৭০ কেজি পর্যন্ত মাছ পাওয়া যেতে পারে যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৩০০০-৭০০০ টাকা ।
খ. বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য :
খাঁচায় মাছচাষ যদি ৰাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা হয় তবে সে ধরণের খাঁচার আকার-আকৃতি, খাঁচা তৈরি, খাঁচায় পোনা মজুদ, খাদ্য প্রদান সবই পারিবারিক উদ্দেশ্যে নির্মিত খাঁচা থেকে আলাদা হবে। নিচে এ ধরণের খাঁচার বিবরণ দেয়া হলো-
খাঁচার আকার :
খাঁচা যেকোনো আকার বা আকৃতির হতে পারে। তবে আয়তকার খাঁচাই আমাদের দেশে মাছ চাষের জন্য সচরাচর ব্যবহৃত হয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষের উদ্দেশ্যে আমাদের দেশে সচরাচর যে খাচাগুলো ব্যবহৃত হয় এর আয়তন ১২০০ ঘনফুট (২০ ফুট x ১০ ফুট × ৬ ফুট) বা ৩৪ ঘনমিটার। এ ধরণের খাঁচা তৈরিতে ব্যবহৃত জালের ফাঁসের আকার থাকে ও ইঞ্চি। এতে সহজে নদীর পরিষ্কার পানি প্রতিনিয়ত খাচার ভিতরে সঞ্চালিত হতে পারে।
খাঁচার ফ্রেম তৈরি ও জাল স্থাপন :
খাঁচাগুলোর ফ্রেম তৈরি করতে প্রথমত ১ ইঞ্চি জি আই পাইপ দ্বারা আয়ত- কার (২০ফুট × ১০ফুট) ফ্রেম তৈরি করা হয়। আর মাঝে ১০ ফুট আরেকটি পাইপ বসিয়ে ঝালাই করে ফ্রেম তৈরি করা হয়। এতে একটি ফ্রেমে সরাসরি ২০ফুট x ১০ ফুট আকারের খাঁচা বসানো যায় আবার প্রয়োজনবোধে ১০ফুট x ১০ফুট আকারের দুইটি খাঁচা বসানো যায়। প্রতি দুই ফ্রেমের মাঝে ৩টি ড্রাম স্থাপন করে সারিবদ্ধভাবে ফ্রেমগুলো স্থাপন করা হয়। অতঃপর প্রয়োজনীয় সংখ্যক গেরাপি অথবা নোঙর দিয়ে খাঁচাগুলো নদীর নির্দিষ্ট স্থানে শক্তভাবে আটকানো হয়। অতঃপর প্রতিটি ফ্রেমের সাথে পৃথক পৃথক ভাবে জাল সেট করা হয় ।
আরও দেখুনঃ