Site icon Fisheries Gurukul [ মৎস্য গুরুকুল ] GOLN

মাডক্রাব বা কাঁকড়া চাষের কলাকৌশল

মাডক্রাব বা কাঁকড়া চাষের কলাকৌশল

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মাডক্রাব বা কাঁকড়া চাষের কলাকৌশল – যা কাঁকড়া পালন পদ্ধতি এর অন্তর্ভুক্ত।

মাডক্রাব বা কাঁকড়া চাষের কলাকৌশল

 

 

বাংলাদেশে মাডক্রাব তথা কাঁকড়ার চাষ বলতে প্রকৃতপক্ষে কাঁকড়া ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজাকরণ বোঝায়। অপরিপক্ক কাঁকড়া বা সদ্য খোলস পাল্টানো কাঁকড়া (যা পানি কাঁকড়া বা খোসা কাঁকড়া নামেও পরিচিত) কে ২-৬ সপ্তাহ খাদ্য সরবরাহ ও আবদ্ধ রেখে গোনাড পরিপক্ককরণ ও খোসা শক্তকরণ করা হয়।

এ পদ্ধতিকেই কাঁকড়া ফ্যাটেনিং বলে। জুভেনাইল বা কিশোর/তরুণ (১০-২৫০ গ্রাম) কাঁকড়াকে বাক্স/খাঁচা/পুকুর বা ঘেরে আবদ্ধ রেখে খাদ্য সরবরাহ করে ৩০০-৫০০ গ্রাম আকারে পরিণত করার পর আহরণ করা হয়। এক্ষেত্রে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নরম এবং শক্ত খোসা বিশিষ্ট কাঁকড়া আহরণ করা হয়। সাধারণত নরম খোসা বিশিষ্ট কাঁকড়া হিমায়িত করে এবং শক্ত খোসা বিশিষ্ট কাঁকড়া জীবিত অবস্থায় রপ্তানি করা হয় । নিচে মাড ক্রাব বা কাঁকড়া চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো ৷

পুকুরে চাষ :

শতকরা ৫০ ভাগ কাদা মিশ্রিত বেলে মাটির পুকুর কাঁকড়া চাষের জন্য আদর্শ। পুকুরের আকার ২০-৪০ শতাংশ হলে ব্যবস্থাপনা সুবিধাজনক। পানির গভীরতা ৪-৫ ফুট হলে ভালো হয়। পুকুরে কাঁকড়ার আদর্শ মজুদ ঘনত্ব হলো প্রতি বর্গ মিটারে ২-৩ টি। কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে পুকুরের চারধারে বাঁশের বানা ও নাইলনের নেট দ্বারা ঘিরে দিতে হবে যাতে কাঁকড়া বেরিয়ে যেতে না পারে। এক্ষেত্রে বাঁশের উচ্চতা হবে ১.৫ মিটার যার ০.৫ মিটার মাটির নিচে পুঁতে দিতে হবে।

প্রজাতি নির্বাচনে বিবেচ্য :

পুকুরে কাঁকড়া মজুদের ক্ষেত্রে সুস্থ, সবল ও চলনক্ষম কাঁকড়া মজুদ করতে হবে । মজুদের সময় কাঁকড়ার উপরিভাগের খোলস নরম কিনা তা আঙ্গুল দিয়ে চেপে পরীক্ষা করতে হবে। এভাবে পরীক্ষা করে ১৮০-২০০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া মজুদ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে যে যত বড় কাঁকড়া মজুদ করতে পারবে তার লাভের অংশ তত বেড়ে যাবে ।

বাঁশের খাঁচায় চাষ :

সাধারণত ৯টি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত বাঁশের খাঁচা (১ মি. × ১ মি. x ২০ সেমি.) কাঁকড়া ফ্যাটেনিং এর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। খাঁচার পাশের চটি সমূহের মধ্যে ০.৫ সেমি. এবং উপরের ঢাকনার চটি সমূহের মধ্যে ২.৫ সেমি. ফাঁক রাখতে হবে। কিন্তু কাঁকড়ার চলাচলের সুবিধার্থে খাঁচার নিচের চটি সমূহের মধ্যে কোনো ফাঁক রাখা যাবে না। বাঁশের ফালি বা চটি সমূহের মাঝে এমন ফাঁক রাখতে হবে যাতে কোনো অবস্থাতেই কাঁকড়ার পা ফাঁক দিয়ে ঢুকে ভেঙে না যায়। পানি চলাচলের সুবিধার্থে খাঁচাসমূহ মাঝে মাঝে ব্রাশ দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে।

প্রতিটি প্রকোষ্ঠে একটি অর্থাৎ প্রতি বর্গমিটারে ৯টি কাঁকড়া মজুদ করা যায় । কাঁকড়া মজুদের ৮-১০ দিন পর থেকেই কাঁকড়ার গোনাড (ডিম্বাশয়) পরিপুষ্ট হয়েছে কি না তা প্রতিদিন পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষিত কোনো কাঁকড়ার গোনাড অপরিপক্ক থাকলে তাকে পুনরায় খাঁচার নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে অথবা ঘেরে রেখে পূর্বের নিয়মে খাবার দিতে হবে।

সাধারণত গোনাড পরিপুষ্ট হলে ঘেরে পানি ওঠানোর সময় কাঁকড়া গেটের কাছে চলে আসে। গোনাড পরিপুষ্ট হওয়া মাত্র কাঁকড়া আহরণ করে বাজারজাত করতে হবে। প্রতিদিন খাঁচার ঢাকনা খুলে কাঁকড়ার দেহের ওজনের ১০% হারে খাবার দিতে হবে। প্লাস্টিকের ড্রামের সাহায্যে খাঁচাসমূহ পানিতে ভাসিয়ে রাখা যায় অথবা নির্দিষ্টভাবে খাঁচার আংশিক ডুবিয়ে বেঁধে রাখা যায় ।

 

গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

পেনে কাঁকড়া চাষ :

ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে বাঁশের বানা দিয়ে পেন তৈরি করে করেও কাঁকড়া ফ্যাটেনিং করা যায় । বাঁশের বানা মাটিতে গভীরভাবে গেঁথে রাখতে হবে যাতে গর্ত করে কাঁকড়া পালিয়ে যেতে না পারে । ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ১০০-১৫০ বর্গমিটার এলাকা ঘিরে পেন তৈরি করা যেতে পারে। পেনের ভিতর একটি ০.৩ মিটার গভীর ও ১-২ মিটার ব্যাসের গর্ত করতে হবে যা ভাটার সময় পানি ধারণ করবে।

কোন একটি ম্যানগ্রোভ গাছকে কেন্দ্র করে এ পেন তৈরি করলে প্রখর রোদের সময় কাঁকড়াসমূহ ছায়ায় আশ্রয় নিতে পারবে। জোয়ারের সময় দিনে একবার শামুকের মাংস অথবা কম দামি মাছের টুকরা খাবার হিসেবে সরবরাহ করা যায়। এ চাষ পদ্ধতিতে ৪-৭ মাসের মধ্যেই বাছাই করে কাঁকড়া ধরা হয় ।

ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিকের বাক্সে কাঁকড়া ফ্যাটেনিং :

সারিবদ্ধ বহুতল বিশিষ্ট প্লাষ্টিকের খাঁচায় মৃদু প্রবহমান নোনা পানির ধারা ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠে কাঁকড়া ফ্যাটেনিং করা যায়। এ পদ্ধতিতে প্রতি প্রকোষ্ঠে একটি করে জুভেনাইল/খোসা কাঁকড়া মজুদ করা হয়। কম দামি তাজা মাছ অথবা তৈরি খাদ্য প্রতিদিন কাঁকড়ার দেহের ওজনের ১০% হারে খাদ্য সরবরাহ করা হয় ।

সরবরাকৃত খাদ্যের ৩০% সকালে এবং ৭০% বিকালে সরবরাহ করা হয়। প্রকোষ্ঠের ছিদ্র দ্বারা খাবার সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি কাঁকড়া আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠে থাকে এবং আলাদাভাবে খাদ্য সরবরাহ করা হয় বলে কাঁকড়ার স্বজাতিভোজী স্বভাবের কারণে মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। মায়ানমার, ভারত, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় এ পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ করা হয়ে থাকে । বাংলাদেশে কক্সবাজার ও খুলনা এলাকায় স্বল্প পরিসরে এ পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে।

 

 

চিত্র-৯ : ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিকের বাক্সে কাঁকড়া ফ্যাটেনিং

 

খাদ্য সরবরাহ :

কাঁকড়া সর্বভুক। এরা সাধারণত জীবন্ত খাদ্য খেতে পছন্দ করে। ছোট ছোট মাছ, শামুক, ঝিনুক, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। তবে ময়লা ও পচা জৈব পদার্থ জাতীয় খাবারও এরা পছন্দ করে । খাদ্য হিসেবে ছোট গুঁড়া মাছ, শামুক-ঝিনুকের মাংস, চিংড়ি ও চিংড়ির মাথা, বিভিন্ন প্রকার দেহাবশেষ ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। কাঁকড়ার খোলস তৈরির জন্য ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োজন। তাই মাংসের নরম হা ও মাছের কাঁটাসমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়ানো হয়।

পুকুরে মজুদকৃত কাঁকড়ার ওজনের ৫-৭% হারে সকালে এবং বিকেলে শামুকের মাংস/কমদামি তাজা মাছ টুকরো করে খাদ্য হিসেবে দিতে হবে। কাঁকড়ার খোলস পাল্টানোর সময়ে স্বজাতিভোজী স্বভাৰ (Cannibalism) রোষ করার জন্য পুকুরের কিনারে পানিতে ১.৫ ফুট লম্বা এবং ছয় ইঞ্চি ব্যাসের পর্যাপ্ত পরিমাণ টুকরো পিভিসি পাইপ দিতে হবে।

কড়া জननকान সারা বছর বিভিন্ন আকার ও পরিমাণের কাঁকড়ার পোনা পাওয়া গেলেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস কাঁকড়ার প্রধান প্রজননকাল। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে এসময় বন আইন মোতাবেক সুন্দরবন এলাকায় সকল ধরনের কাঁকড়া আহরণ করা নিষিদ্ধ। কাঁকড়ার বয়স সাধারণত ১৬-১৮ মাসের হলেই এরা প্রজননক্ষম হয়। এ সমর একটি ফাঁকড়ার ওজন হয় ৩০০-৫০০ গ্রাম। স্ত্রী কাঁকড়া গভীর সমুদ্রে নগ্নি ছেড়ে থাকে যা পরবর্তীতে পাঁচটি লার্ভা স্তর পার হয়ে পোস্ট লার্ভা স্তরে উপনীত হয়। একটি স্ত্রী কাঁকড়া ১-৮ মিলিয়ন ভিম দিতে পারে।

কাঁকড়া আহরণ, প্রেডিং ও বাজারজাতকরণ :

দেশের সিংহভাগ মানুষ কাঁকড়া খাওয়ার অভ্যস্ত নয় বিধায় ইতোপূর্বে মাছের সাথে ধরা পড়া হাজার হাজার কাঁকড়া অবহেলায় মেরে ফেলা হতো। অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এবং ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ না হওয়ার অভ্যন্তরীণ বাজারে এবং বিভিন্ন অভিজাত রেস্তোরার কার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের দেশের উপকূলীয় এলাকার জনগণ মাছের সাথে ধরা পড়া কাঁকড়া সবন্ধে সংরক্ষণ করে সংগ্রহকারীদের নিকট অথবা নিকটস্থ কাঁকড়ার ডিপোতে বিক্রি করে থাকেন।

বৃহত্তর খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ কাঁকড়া আহরণ ও চাষকে ইতোমধ্যে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশে ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় রেখা বরাবর প্রায় ৬.২৮ লক্ষ হেক্টর এলাকা থেকে কাঁকড়া আহরণ করা হয়। কাঁকড়ার বাজারমূল্য এর ওজন, লিঙ্গ, ধরন (Soft shell / hard shell) এর উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১২০০ মে. টন কাঁকড়া হংকং, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং ইউরোপ মহাদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। মাঠ পর্যায়ে মৌসুম ও প্রেজ ভেদে প্রতি কেজি কাঁকড়ার বাজার মূল্য ৫০০-১৩০০ টাকা।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version