লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: মাত্রাতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ফলে অস্বাভাবিক মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটনের হারকে দ্রুততর করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- অনিয়মিত বৃষ্টি, খরা, লবণাক্ততা প্রভৃতি কৃষিকে ক্ষতিগ্রস্ত, বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ফসল উৎপাদনে পানি প্রভাবক হিসেবে সালোকসংশ্লেষণ, প্রস্বেদন ও গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ফসল উৎপাদনে সেচের পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। অত্র এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত বিধায় তা সেচ কাজে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনে প্রধান ভরসা হলো বৃষ্টির পানি।

লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ
লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

নিয়মিত বৃষ্টিপাত ভালো ফসল উৎপাদনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বর্তমান পরিবর্তনশীল জলবায়ুতে নিয়মিত বৃষ্টিপাত আশা করা সম্ভব নয়। বৃষ্টি মৌসুমে কৃষকরা বৃষ্টির পানির সহায়তায় আমন ধান ও অন্যান্য খরিফ ফসল উৎপাদনে সফল হলেও শুকনো মৌসুমে সেচের পানির অভাবে প্রধান ফসল বোরো ও অন্যান্য রবি ফসল উৎপাদন করতে হিমশিম খায়। এ পরিস্থিতিতে উপকূলীয় জেলাগুলোতে কিছু কিছু কৃষক বাড়ির আশপাশে এবং ফসলি জমির এক কোণে ছোট আকারের গর্ত কেটে তাতে বৃষ্টির পানি জমা রেখে তার মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে মাদা ও অন্যান্য রবি ফসল উৎপাদন করে থাকে। জমির কোণে খুবই ছোট আকারের এ গর্তকে স্থানীয় ভাষায় ‘কুনি’ বলে। এর বাইরে হাজার হাজার হেক্টর জমি সেচের পানির অভাবে মৌসুমি পতিত জমিতে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৮.৫ লাখ হেক্টর উপকূলীয় এলাকার মধ্যে প্রায় ১০.৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রার লবণকবলিত। এ লবণাক্ততার কারণে শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে রবি ও খরিফ-১ মৌসুমে ফসল চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ সময়ে মাটির লবণাক্ততা ৮.০ ডিএস/মি. এর উপরে চলে যায়। এছাড়া এ সময়ে নদীর পানির লবণাক্ততা ২৫.০-৩০.০ ডিএস/মি. পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। আবার এ এলাকার খালগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুকনো মৌসুমে ফসল চাষের নিরাপদ পানির সংস্থান কষ্টকর হয়ে পড়ে।

লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ
লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

তাই শুধু মাটি ও পানির লবণাক্ততার কারণে এ এলাকায় বোরো ধান চাষসহ অন্যান্য সবজি চাষ সম্ভব হয় না। লবণাক্ততার পাশাপাশি এ এলাকার আরেকটি প্রধান সমস্যা হলো জমিতে সময়মতো ‘জো’ আসে না। লবণাক্ত মাটিতে যদি নিরাপদ (মিষ্টি) পানি সেচের মাধ্যমে ব্যবহার করা যায়, তাহলে ওই মাটির লবণাক্ততা কমে যায়, ফলে সেখানে সহজেই ফসল চাষ করা সম্ভব হয়। এছাড়া কোন এ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে জমির মাটি উঁচু করা যায় তবে সেখানে সময়মতো ‘জো’ আসবে ফলে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে অর্থাৎ এক ফসলের পরিবর্তে দুই বা তিন ফসল চাষ করা সম্ভব হবে।

জলবায়ুর এরূপ বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন কলাকৌশল রপ্ত করতে হবে যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা ঝুঁকি কমানো যায়। অন্যান্য অভিযোজন কৌশলের পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুমে মাদা ও অন্যান্য ফসলে সেচ প্রদানের জন্য মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় খাপ খাওয়ানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোজন কৌশল। এই পদ্ধতিতে একই সাথে জমিতে ধান, পুকুরে মাছ এবং পাড়ে সবজি চাষ করা যায়।

ফলে শস্যের নিবিড়তা বাড়ে। ফসলি জমির এক-পঞ্চমাংশে কমপক্ষে তিন মিটার গভীরতা এবং একটি পুকুর ওই জমির মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে মৌসুমি সবজি চাষের সুবিধার্থে পুকুর পাড় চওড়া (কমপক্ষে ১ মিটার) হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। অন্যান্য অভিযোজন কৌশল বাস্তবায়নের পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুমে মাদা ও অন্যান্য ফসলে সেচ প্রদানের জন্য মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে পুকুর খনন করা যায়।

লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ
লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

মিনিপুকুর (খামার পুকুর) প্রযুক্তি

মিনিপুকুর এমন একটি প্রযুক্তি যাতে উপকূলীয় এলাকায় ফসলি জমির মধ্যে পুকুর কেটে ওই পুকুরে বর্ষাকালের বৃষ্টির পানি জমিয়ে রেখে সেই পানি দিয়ে শুকনো (রবি ও খরিফ-১) মৌসুমে বিভিন্ন প্রকার মাদা ফসল চাষ করা যায়। এ প্রযুক্তিকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তিও বলা হয়।

মিনিপুকুর প্রবর্তন পদ্ধতি

কোন একটি জমির পাঁচ ভাগের একভাগ জমিতে (মোট জমির শতকরা ২০ ভাগ) মোটামুটি ৬ থেকে ৭ হাত গভীরতার একটি পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে।
জমির যে অংশটা অপেক্ষাকৃত নিচু সে অংশে পুকুরটি খনন হবে।
পুকুরের চারদিকে বাঁধ দিয়ে আটকে রাখতে হবে, যাতে পানি আগমন ও নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
বাঁধের উচ্চতা হবে দুই থেকে আড়াই হাত ও প্রস্থ হবে তিন থেকে চার হাত।

খননকৃত অতিরিক্ত মাটি দিয়ে ওই জমির বাকি চার ভাগ ভরাট করতে হবে। এতে জমিটা প্রায় ১ হাত উঁচু হবে । ফলে ওই জমির নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত হবে এবং রবি মৌসুমে সময়মতো জো আসবে এবং সঠিক সময়ে বীজ বপন করা সম্ভব হবে। সাধারণত যেটা উপকূলীয় এলাকায় সম্ভবপর নয়।

খননকৃত মাটির উপরিস্তর বাকি জমিতে এমনভাবে ফেলতে হবে যাতে উপরের মাটি উপরে থাকে। কারণ উপরের মাটিতে পুষ্টি উপাদান বেশি থাকে। কোনোভাবেই নিচের মাটি যেন উপরে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় কষ মাটির উপস্থিতি আছে। এরূপ ক্ষেত্রে ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য ফসল আবাদ-মাছ চাষ উভয় ক্ষেত্রেই চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে ।

এছাড়াও মাঠের চারিদিকে পাড়-বাঁধ দিতে হবে যাতে বর্ষাকালে মাঠের অতিরিক্ত পানি সহজে পুকুরে এসে জমা হতে পারে।

ভূমি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য জমিটিকে ভালোভাবে সমতল করতে হবে। এতে করে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যাবে। যাতে করে সর্বত্র উদ্ভিদের পানি ও পুষ্টি উপাদানের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা হবে।
এছাড়াও ওই জমির লবণ নিচে চুইয়ে যাবে।

লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ
লবণাক্ত এলাকায় মিনিপুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

মিনিপুকুর প্রযুক্তির সুবিধা

লবণাক্ত এলাকায় শুকনো মৌসুমে নিরাপদ পানির উৎস হিসেবে মিনিপুকুরের বিকল্প নেই।
এছাড়া মিনিপুকুর এলাকার পানি দ্রুত নিষ্কাশন হওয়ার ফলে সঠিক সময়ে রবি ফসল চাষ করা সম্ভব।
বাঁধের উপর/পাশে শাকসবজি/ফলদ/বনজ /ঔষধি গাছ লাগানো যেতে পারে ।
পুকুরে মাছ চাষ/হাঁস পালন এবং উপরিভাগে মুরগির খামার করা যেতে পারে ।

যেহেতু শুকনো মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা সম্ভব হয়, তাই একটি টেকসই ফসল বিন্যাসের মাধ্যমে শস্য নিবিড়তা বাড়ানো সম্ভব।

সতর্কতা

প্রতি মাসে অন্তত একবার পানির লবণাক্ততা পরীক্ষা করতে পারলে ভালো হয় ।

ফসল

রবি মৌসুমে কম সেচ লাগে এমন শস্য যেমন- তরমুজ, সূর্যমুখী, লালশাক, পালং, ওলকপি, মুলা, বরবটি, বিভিন্ন প্রকার মাদা ফসল (মিষ্টিকুমড়া, লাউ, ইত্যাদি) এবং সামান্য পরিমাণের বোরো ধান চাষ করা যায়।

 

আরও পড়ুন:

Leave a Comment