মাছ ধরার ফাঁদ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মাছ ধরার ফাঁদ – যা মৎস্য আহরণের সরঞ্জামাদি তৈরি ও সংরক্ষণ এর অন্তর্ভুক্ত।

মাছ ধরার ফাঁদ

চোলাকৃতি ফাঁদ

ক. ভূগছির :

এটি বাঁশের তৈরি চোঙ্গাকৃতি ফাঁদ। বাঁশের চিকন শলাকা ও বেত বা লতা দ্বারা এ ফাঁদ বোনা হয়। এটি বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। এর ফাঁস ০.৫ সে.মি. থেকে ১.৫ সে.মি. হয়ে থাকে। এটি সাধারণত বিল সংলগ্ন স্থানে বা মাছের চলাচলের পথে পাতা হয়। এগুলো খালে বানা দিয়ে এর ফাঁকে খেজুর বা তালের ডাল পুঁতে দিয়ে ধান ক্ষেতের অইল বরাবর বা বাস দিয়ে আইলের মতো করে কিছু দূরে দূরে পেতে রাখা হয়। এটি যারা ছোট আকারের রুই, কাতলা, মৃগেল, টাকি, বেলে ইত্যাদি মাছ ধরা হয়।

 

মাছ ধরার ফাঁদ
চিত্র- ২৪: ভুগাইর

 

খ. কৈ জুগাইর :

এটিও বাঁশের তৈরি এক ধরনের চোঙ্গাকৃতি ফাঁদ। এ ফাঁদও বাঁশের চিকন শলাকা, বেত ও লতা দ্বারা বোনা হয়। এর ফাঁসের আকার সাধারণত ১ সে.মি. থেকে ২.৫ সে.মি. হয়ে থাকে। এটি জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাচ্চা হয়ে থাকে। এটি যারা কৈ, টাকি, বেলে, পুঁটি, ইত্যাদি মাছ ধরা হয়।

গ. উদরা :

এটি চোঙ্গাকৃতি বাঁশের তৈরি এক ধরনের ফাঁদ। এটিও বাঁশের চিকন শলাকা বা লতা দিয়ে তৈরি করা হয়। ধানক্ষেতের আইলে ও আগাছামুক্ত অগভীর পানিতে এ ফাঁদ পেতে রাখা হয়। উদরা দিয়ে চিংড়ি ও বেলে মাছ ধরা হয়।

ঘ. খাদন :

এটিও চোঙ্গাকৃতি বাঁশের ফাঁদ। খাদম দেখতে অনেকটা ইট (U) আকৃতির। এর ফাঁস সাধারণত ১.৫-২.৫ সে.মি. হয়ে থাকে। বাঁশের চিকন শলাকা বা লতা দ্বারা এটি তৈরি করা হয়। ধান ক্ষেতের আইলে ও আগাছামুক্ত অগভীর পানিতে এ ফাঁদ পেতে রাখা হয়। এটিও খালের মধ্যে ব্যবহার করা যায়। এটি জুলাই থেকে জানুয়ারি এ সময়ের মধ্যে ব্যবহার করা হয়। এ ধরণের ফাঁদের সামনের দিকে ভাব থাকে ফলে একবার মাছ ভিতরে ঢুকলে আর বের হতে পারে না। খাদম দিয়ে বড় আকারের রুইজাতীয় মাছ, শোল, গজার, বোয়াল ইত্যাদি ধরা হয়।

ii) বক্স ফাঁদ :

এই ফাঁদগুলো দেখতে বক্সের ন্যায় বলে এই ফাঁদকে বক্স ফাঁদ বলে। এগুলো হলো-

ক. বিত্তি :

এটি বর্গাকৃতির এক ধরনের ফাঁদ। এটি বাঁশের শলাকা ও লতা দ্বারা তৈরি করা হয়। এর ফাঁস সাধারণত ০.৫-১.০ সে.মি. হয়ে থাকে। এর এক পাশে তিনটি ভাত থাকে। বিভিন্ন দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা যথাক্রমে ৩০ সে.মি., ১৫ সে.মি. এবং ২০ সে.মি. হরে থাকে। এটি সাধারণত স্রোতযুক্ত অগভীর পানিতে ধান ক্ষেতের আইলে রাতে পেতে রাখা হয়। আর মাঝে মাঝে টোপ হিসেবে বিস্তিতে শামুক ব্যবহার করা হয়। বিত্তি দিয়ে প্রধানত টেংরা মাছ ধরা হয়। এটি সাধারণত জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পানি থাকা সাপেক্ষে প্লাবনভূমিতে ব্যবহৃত হয়।

 

মাছ ধরার ফাঁদ
চিত্র-২৫: বিত্তি

 

 

খ. ভাইর :

এটিও বর্গাকৃতি ফাঁদ এবং বাঁশের শলাকা বা লতা দ্বারা তৈরি করা হয়। তবে যে অঞ্চলে পর্যাপ্ত লতা পাওয়া যায় না সেখানে তাল গাছের আঁশ দ্বারাও ইহা তৈরি করা যেতে পারে। এর ফাঁস ২.৫-৩.৫ সে.মি. হরে থাকে। ভাইরের একদিকে মাত্র একটি ভাত থাকে। এর দৈর্ঘ্য, গ্রন্থ ও উচ্চতা যথাক্রমে ৮০ সে. মি., ৬০ সে. মি. এবং ৭০ সে.মি. হয়ে থাকে। খাল, বিল অথবা নদীতে বানা দিয়ে এর ফাঁকে ভাইর স্থাপন করা হয় এবং এটি দ্বারা বোয়াল, আইড় ও পরিণত আকারের রুই, কাতলা, মৃগেল, কার্পিও ইত্যাদি মাছও ধরা হয়।

গ. খৈললুন (খুশি) :

এটি আয়তাকার বক্স আকৃতির । এ ধরনের ফাঁদ বাঁশের চিকন শলাকা ও লতা দিয়ে তৈরি । এর দৈর্ঘ্যের অংশের সামনে ও পিছনে ভাত থাকে। এর ফাঁস সাধারণত ০.২-০.৫ সে.মি. হয়ে থাকে। এটি দ্বারা পুঁটি, চেলা, মলা, ঢেলা, দারকিনা, চান্দা, চিংড়ি ইত্যাদি মাছ ধরা হয়।

ঘ. চারো :

এটিও আয়তকার বক্স আকৃতির একটি ফাঁদ। এটি বাঁশের চিকন শলাকা ও লতা দিয়ে তৈরি করা হয়। এর গ্রন্থের দিকে অর্থাৎ সরু অংশে ভাত থাকে। এর ফাঁস সাধারণত ১.০-১.৫ সে.মি. হয়ে থাকে। চারো দিয়ে কৈ, টেংরা, শিং, মাগুর ইত্যাদি মাছ ধরা হয়। মাছকে আকর্ষণ করার জন্য টোপ হিসেবে চারোর মধ্যে শামুক ব্যবহার করা হয় ।

ঙ.  রামানি :

রামানি বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। এর ফাঁস ১.৫-২.৫ সে.মি. হয়ে থাকে। এটি সাধারণত বিল সংলগ্ন খালে অথবা মাছ চলাচলের পথে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। খালে বানা দিয়ে এর ফাঁকে খেজুর বা ভালের ডাল পুঁতে দিয়ে ধানক্ষেতের আইল বরাবর বা ঘাস দিয়ে আইলের মতো করে কিছু দূরে দূরে ইহা স্থাপন করা হয়। এটি দ্বারা শোল, টাকি, কৈ, পুঁটি ইত্যাদি মাছ ধরা হয়।

চ. টুবো :

এটি আয়তকার বক্স আকৃতির এক ধরনের ফাঁদ। এর গ্রন্থের দিকে অর্থাৎ সরু অংশে ভাত বা একমুখো প্রবেশ পথ থাকে। এর ফাঁস ০.২ সে.মি. থেকে ০.৫ সে.মি. হয়ে থাকে। এটি দ্বারা প্রধানত পুঁটি মাছ ধরা হয়।

ছ. পলো:

এটি বাঁশের শলাকা ও বেত দ্বারা তৈরি এক ধরনের ফাঁদ। এর নিচের দিকের মুখ বড় এবং উপরিভাগের মুখ ছোট। এর উভয় মুখই খোলা থাকে। মাছ আহরণের ক্ষেত্রে পলোর উপরিভাগে হাত দিয়ে ধরে অগভীর পানিতে চাপ দিতে দিতে পর্যায়ক্রমে সামনের দিকে এগোনো হয়। পলোর ফাঁস ১.০-২.০ সে.মি. হয়ে থাকে। মাছ পলোতে আটকা পড়লে শব্দ বা ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। তখন পলোর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাছ ধরা হয়। শিং, মাগুর, কৈ, শোল, টাকি, বোয়াল, রুই, কাতলা, ইত্যাদি মাছ পলোতে ধরা পড়ে।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

জ. উচা :

এটি ঠেলা জালের ন্যায় ত্রিকোণাকৃতি বাঁশের তৈরি এক ধরনের মাৎস্য শিকার সরঞ্জাম। এর মেস সাইজ ১.০-১.৫ সে.মি.। বাঁশের লম্বা হাতলের মাধ্যমে এটি অগভীর পানিতে পরিচালনা করা হয় । উচা দ্বারা ছোট চিংড়ি, বেলে, চান্দা, বজুরী, বইচা, ইত্যাদি ছোট প্রজাতির মাছ ধরা হয় ।

ঝ. হোগরা :

এটি বাঁশের চাটাই নির্মিত ত্রিকোণাকৃতির মাছ ধরার ফাঁদ। এর মধ্যে ডাল পালা দিয়ে অগভীর পানিতে বেশ কয়েকদিন ফেলে রাখা হলে এতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আশ্রয় নেয়। হোগরার সাহায্যে চিংড়ি, শিং, মাগুর, টেংরা, পুঁটি, কৈ, ইত্যাদি মাছ ধরা হয়।

আরও দেখুন:

Leave a Comment