আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মজুদ পুকুরে ভিয়েতনাম কৈ মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা – যা ভিয়েতনাম কৈ মাছের চাষ প্রযুক্তি এর অন্তর্ভুক্ত।
মজুদ পুকুরে ভিয়েতনাম কৈ মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা
উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনলে ছোট-বড় সব পুকুরেই এ মাছ চাষ করা সম্ভব। তবে পুকুর নির্বাচনের ওপর ভিয়েতনাম কৈ মাছ চাষের সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। পুকুর নির্বাচনের সময় নিচে লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে।
- সাধারণত দোঁআশ ও বেলে দোঁআশ বা কম কাদাযুক্ত মাটির পুকুর ভিয়েতনাম কৈ চাষের জন্য বেশি উপযোগী ;
- যে সমস্ত পুকুরে বন্যার পানি প্রবেশ করে না এবং পুকুরের পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি এরূপ মাঝারি উঁচু পুকুর এ মাছ চাষের জন্য উপযোগী।
- ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য এ মাছ চাষের পুকুর আয়তাকার এবং আকার ৪০-৬০ শতাংশের হলে ভাল হয়। তবে এর চেয়ে বড় বা ছোট পুকুরেও এ মাছ চাষ করা যায় ৷
- পুকুরের গভীরতা ৩-৫ ফুট হলে ভালো হয় ও
- পুকুরের পানি কমিয়ে মাঝে মাঝে গভীর বা অগভীর নলকূপের সাহায্যে পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয় ।
পুকুর প্রস্তুতি :
পুকুর প্রস্তুতির সময় নিচে উল্লিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করা আবশ্যক:
- পুকুরের পাড় ভাঙা থাকলে তা অবশ্যই মেরামত করতে হবে। পুকুরের চারপাশ কমপক্ষে ৩ ফুট উঁচু করে মশারির নেট ও খুঁটি দিয়ে ভালোভাবে ঘিরে দিতে হবে,
- পুকুর পুরাতন হলে তলা অবশ্যই ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। সম্ভব হলে তলায় লাঙ্গল দ্বারা হাল চাষ অথবা কোদাল দ্বারা মাটি উলটপালট করে দিতে হবে। পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে অনুমোদিত মাত্রায় মাছ মারার ঔষধ (রোটেনন- ২৫ গ্রাম/শতাংশ/ফুট পানি) প্রয়োগ করা যেতে পারে;
- ১ কেজি/শতাংশ হারে চুন অথবা ব্লিচিং পাউডার অথবা জিয়োলাইট প্রয়োগ করতে হবে।
- চুন/ব্লিচিং পাউডার/জিয়োলাইট প্রয়োগের ৩ দিন পর বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পুকুর ৩-৫ ফুট পর্যন্ত পূর্ণ করতে হবে।
- এর পর প্রতি শতাংশে ১০০ মি.লি. চিটা গুড়ের সাথে ৫০ গ্রাম আটা মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এতে পানি হালকা বাদামি বর্ণের হবে। অতঃপর ৩ দিন পর আনুপাতিক হারে পোনা মজুদ করতে হবে।
পোনা প্রাপ্তি :
ভিয়েতনাম কৈ মাছের পোনা এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বড় বড় হ্যাচারিতে পাওয়া যায় ।
পোনা মজুদ :
পুকুরে ভিয়েতনাম কৈ একক বা অন্য প্রজাতির সাথে চাষ করা যায়। চাষ পদ্ধতি নির্ভর করবে চাষির কর্মদক্ষতা ও আর্থিক সচ্ছলতার ওপর। পোনা মজুদের ক্ষেত্রে ১-১.৫ ইঞ্চি আকারের ০.১৫ – ০.২০ গ্রাম ওজনের (৬০০০-৫০০০টি/কেজি) সুস্থ সবল পোনা আনুপাতিক হারে পুকুরের পানির সাথে খাপ খাইয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে। সারণি-১২ এ পোনা মজুদের একটি মডেল দেখানো হলো ।
সারণি-১২ : শতাংশ প্রতি পোনা মজুদের মডেল
সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ : বাণিজ্যিকভাবে ভিয়েতনাম কৈ মাছ চাষ করতে হলে মাছকে অবশ্যই চাহিদামতো সুষম সম্পূরক খাবার খাওয়াতে হবে। খাদ্য খাওয়ানোর ওপরই ভিয়েতনাম কৈ মাছের দৈহিক বৃদ্ধির হার প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। খাদ্যে কমপক্ষে ৩০% হজমযোগ্য প্রাণিজ আমিষ থাকতে হবে। ৩০% আমিষ না থাকলে কৈ মাছের বৃদ্ধি আশানুরূপ হবে না। বাজারে বেশ কয়েকটি মৎস্য খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ভিয়েতনাম কৈ মাছের ভাসমান বাণিজ্যিক খাবার পাওয়া যায়। সেগুলো থেকে গুণগতমান সম্পন্ন খাদ্য বাছাই করে মাছকে খাওয়াতে হবে। নিচে মাছের বিভিন্ন বয়সের খাদ্য তালিকা দেয়া হলো ।
সারণি-১৩ : মাছের বয়স অনুয়ায়ী খাদ্য তালিকা
ভিয়েতনাম কৈ মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা :
উচ্চ মজুদ ঘনত্ব ও বদ্ধ জলজ পরিবেশে উচ্ছিষ্ট খাবার, মাছের বিপাকীয় বর্জ্য ও অন্যান্য বর্জ্য পচে পানি দূষিত হয়ে কৈ মাছের রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। খামারে একবার জীবাণু প্রবেশ করলে তাকে নির্মূল করা খুব কঠিন। তাই খামারে জীবাণু প্রবেশের পূর্বেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
- ইনব্রিড / ক্রসব্রিডমুক্ত সুস্থ ও সবল পোনা সংগ্রহ করা ;
- খামার ও মাছ চাষের সকল উপকরণ জীবাণুমুক্ত রাখা;
- এক খামারে ব্যবহৃত জাল জীবাণুমুক্ত না করে অন্য খামারে ব্যবহার না করা ;
- উচ্চ মজুদ ঘনত্ব পরিহার করা ;
- পরিমিত ও সুষম খাবার প্রয়োগ করা ;
- পরিবহনের সময় পোনা আঘাত পেলে ক্ষতরোগের আশাঙ্কা বৃদ্ধি পায়; ক্ষতরোগ প্রতিরোধে শীতের শুরু হতে ১৫ দিন পর পর প্রতি শতাংশে ২৫০ গ্রাম লবণ ও ১৫০ গ্রাম জিয়োলাইট প্রয়োগ করা যেতে পারে; –
- ক্ষতরোগের প্রাদুর্ভাব হলে পুকুরে জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে। এন্টিবায়োটিক হিসেবে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ৫ গ্রাম অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ও ২ গ্রাম ভিটামিন-সি মিশিয়ে নিয়মিত পরপর ১০
দিন খাওয়াতে হবে ।
এডওয়ার্ডসিয়েলোসিস রোগ :
ভিয়েতনাম কৈ মাছ সাধারণত এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এডওয়ার্ডসিয়েলা নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ বিস্তার লাভ করে । পচা জৈবিক পদার্থ সমৃদ্ধ পুকুরে এই জীবাণু সহজেই বংশ
বিস্তার এবং মাছের দেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে ।
রোগের লক্ষণ
- প্রথমে মাছের ত্বকে ক্ষত দেখা যায়; এই ক্ষত দ্রুত মাংসপেশিতে ছড়িয়ে পড়ে;আক্রান্ত স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে যায় এবং উক্ত স্থানে পচন ধরে;
- আক্রান্ত মাছের যকৃৎ ও বৃক্কে পচন ধরে; –
- মাছের আক্রান্ত স্থান থেকে দুর্গন্ধ বের হয়;
- কখনও কখনও মাছের যকৃতে পূঁজ জমতে দেখা যায় ।
প্রতিরোধ
জলাশয়ের পানির গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় রেখে, সঠিক ঘনত্বে মাছচাষ করলে এ রোগ বহুলাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রতিকার
আক্রান্ত মাছকে প্রতি কেজি খাদ্যের সঙ্গে ৫ গ্রাম অক্সিটেট্রাসাইক্লিন মিশিয়ে পর পর ১০ দিন খাওয়াতে হবে, প্রতি কেজি খাদ্যের সঙ্গে ৫ মিলিগ্রাম কট্রিম মিশিয়ে পর পর ১০ দিন মাছকে খাওয়ালে এ রোগে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় ।

অন্যান্য ব্যবস্থাপনা
এক্ষেত্রে যে সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে চলা দরকার তা হলো-
- সপ্তাহে ৬ দিন খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
- একটানা মেঘলা আবহাওয়ায় কিংবা অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে অথবা খাবার সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে।
- ভাসমান পিলেট খাদ্য দিনে ৩ বার সকালে ১০টায় দুপুরে ১টায় এবং বিকেলে ৪টায় সরবরাহ করলে ভালো ফল পাওয়া যায় ।
- মাছের ওজন ১০০টি/কেজি না আসা পর্যন্ত নার্সারি পাউডার খাদ্য মাছকে খাওয়াতে হবে।
- মাছ নিয়মিত খাবার খায় কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
- গ্রীষ্মকালে ৩ দিন অন্তর অন্তর দিনে ১ বার হড়রা টানতে হবে।
- প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর মাছের নমুনায়ন করে দৈহিক বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্যের পরিমাণ সমন্বয় করতে হবে।
- প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর পানির গুণাগুণ যেমন- তাপমাত্রা, অক্সিজেন, পিএইচ, অ্যামোনিয়া ও মোট ক্ষারকত্ব পরীক্ষা করা ভালো।
- পোনা মজুদের ১ মাস পর থেকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর সম্ভব হলে ৫০% পানি পরিবর্তন করে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারলে উৎপাদন অনেক বেড়ে যায় ৷
- পুকুরে মাছের আশ্রয়ের জন্য প্লাস্টিকের ৩-৪ ফুট লম্বা পাইপ বা বাঁশের চোঙ্গা ব্যবহার করা যেতে পারে ।
- পানির গুণাগুণ ঠিক রাখার জন্য প্রতি মাসে ১ বার শতাংশপ্রতি ১৫০ গ্রাম জিয়োলাইট প্রয়োগ করা যেতে পারে ।
- অনেক সময় বক/মাছরাঙা/জলজ পাখি ইত্যাদির মাধ্যমে এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরে রোগজীবাণু ছড়াতে পারে তাই পাখি দূর করতে পুকুরের চারদিকে এক পাড় অন্য পাড়ে আড়াআড়িভাবে রঙিন ফিতা অথবা পলিথিন টানিয়ে দেয়া যেতে পারে।
- ৪ মাস এ পদ্ধতিতে চাষ করার পর পুকুর শুকিয়ে অথবা বেড় জাল দিয়ে সমস্ত মাছ ধরে জীবিত অবস্থায় বাজারজাত করতে হবে।
- প্রতিবার নতুন করে ভিয়েতনাম কৈ চাষ শুরু করার সময় অবশ্যই সম্পূর্ণ পুকুর শুকিয়ে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে।
সারণি-১৪ : ১ একর (১০০ শতাংশ) পুকুরে আয়-ব্যয়ের হিসাব
ব্যয় :
আয় :
কৈ মাছ ২০,০০০টি (৯০% বাঁচার হার)।
গড় ওজন ২০০ গ্রাম এবং প্রতি কেজির গড় মূল্য ২০০ হিসেবে ৪০০০ কেজি মাছের মূল্য
৪০০০ X ২০০ = ৮,০০,০০০ টাকা
সিলভার কার্প ৩০০টি (৯০% বাঁচার হার )
গড় ওজন ১ কেজি এবং প্রতি কেজির গড় মূল্য ৮০ টাকা হিসেবে ২৭০ কেজি মাছের মূল্য
মোট মূল্য ২৭০x৮০ = ২১,৬০০
= ৮,০০,০০০ + ২১,৬০০
= ৮,২১,৬০০
সম্ভাব্য নিট লাভ = ৮,২১,৬০০ – ৫,৭১,২০০ = ২,৫০,৪০০ টাকা
আরও দেখুনঃ