আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পেনে মাছচাষ।
পেনে মাছচাষ
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জল সম্পদে সমৃদ্ধ। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর এবং বন্যাপ্লাবিত ৪.৩ মিলিয়ন হেক্টর জলাভূমি নিয়ে প্লাবনভূমি গঠিত। প্লাবনভূমিতে মৎস্য উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পেন বা খের তৈরি করে উল্লেখিত জলাশয়ে নিবিড়/আধা নিবিড় পদ্ধতিতে মাছচাষ করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের খাল, মরা নদী, হাওর, বাঁওড়, বন্যাপ্লাবিত জলাভূমিতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে মাছের উৎপাদন বাড়ানোসহ বেকারত্ব দূর করা সম্ভব।
পেন কালচার :
কোনো উন্মুক্ত বা আবদ্ধ জলাশয়ে এক বা একাধিক দিক থেকে বাঁশ, ৰানা, বেড়া, জাল বা অন্য কোনো উপকরণ দিয়ে ঘিরে উক্ত ঘেরের মধ্যে পোনা মাছ মজুদ করে মাছ চাষ করাকে পেন কালচার বা পেনে মাছচাষ বলে। পেনে মাছ চাষের বৈশিষ্ট্য হলো পেনের ঘের বা বেড়া জলাশয়ের তলার কাদার মধ্যে প্রবেশ করানো থাকে এবং পেনের পানির সাথে বাইরের পানির সংযোগ বা প্রবাহ বিদ্যমান থাকে। ফলে বাইরের পানি বাড়লে বা কমলে পেনের ভিতরের পানি বাড়ে বা কমে ।
পেনে মাছ চাষের সুবিধাসমূহ
- বছরে ৬-৮ মাস পানি থাকে এমন মৌসুমী জলাশয় পেনে মাছ চাষের আওতায় জানা যায় । কম খরচে অব্যবহৃত জলাশয় মাছ চাষের আওতায় আনা যায়।
- বন্যাকবলিত এলাকায় সামরিকভাবে পেনে মাছচাষ করে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা যায়।
- বেকার যুব ও যুব মহিলা, দরিদ্র মৎস্যজীবীকে সংগঠিত করে পেনে মাছ চাষের মাধ্যমে তাদের বেকার সমস্যা দূর করা যায়। পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদনের মাধ্যমে দেশে আমিষের অভাব পূরণ করা যায়।
- যেসব জলাশয়ে একাধিক মালিকানা আছে সেসব জলাশরে পেন তৈরি করার মাধ্যমে মালিকানা সমস্যার সমাধান করা যায় এবং একই জলাশয়ে একাধিক মৎস্যচাষি নিজেদের পছন্দমতো মাছচাষ করতে পারে।
- পেন কালচারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় অধিক মাছ উৎপাদন করা যায়।
পেনে মাছ চাষের অসুবিধাসমূহ
- পানির প্রবাহ বা স্রোত থাকলে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য সার প্রয়োগ সম্ভব হয় না । পেনে মাছ চাষ সংক্রান্ত কারিগরি জ্ঞানের অভাব থাকলে এক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া যায় না । –
- পানির অস্বাভাবিক হ্রাস-বৃদ্ধি পেন কালচারের ক্ষেত্রে তীব্র সমস্যা সৃষ্টি করে ।
- বড় ধরনের পেন কালচারের ক্ষেত্রে প্রায় সময়ই মাছের দৈহিক ওজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সম্পূরক খাদ্য প্রদান সম্ভব হয় না ।
- এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বড় সাইজের পোনা মজুদ করতে হয়। অনেক সময় পেনে মাছ চাষের ফলে নৌকা চলাচলের অসুবিধা হতে পারে ।
- পানি অস্বাভাবিক ঘোলা থাকলে সেখানে পেন কালচার ততটা ফলপ্রসূ হয় না।
স্থান নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয়সমূহ :
পেনে মাছ চাষের জন্য স্থান নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । যেসব বড় জলাশয় সাধারণভাবে নিবিড় মাছ চাষের আওতায় আনা সম্ভব নয় সেসব জলাশয় পেনে মাছ চাষের জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে । নিচে স্থান নির্বাচনের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো-
- জলাশয়ের অগভীর অংশ যেখানে সর্বোচ্চ ২.৫ মিটার পর্যন্ত পানি থাকে এমন স্থান পেন কালচারের জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে।
- পেন নির্মাণের জন্য তলদেশের মাটি অনুকূল হতে হবে যাতে বাঁশের খুঁটি সহজে মাটিতে
- স্থাপন করা যায় এবং তা যেন স্থায়ী হয়, কোনক্রমেই বাতাসে বা ঝড়ে যেন হেলে পড়ে না যায় ।
- নৌকা চলাচলের অসুবিধা হয় এমন স্থান পেন নির্মাণের জন্য না নেয়া ভালো। তবে পেনের ভিতর
- দিয়ে নৌকা চলাচলের সুবিধা রেখেও পেন নির্মাণ করা যেতে পারে।
- যেসব জলাশয়ের তলদেশ অত্যন্ত অসমান, বালি বা পাথর দ্বারা আবৃত, প্রবল স্রোত বিদ্যমান, পানি
- দূষণসহ ঝড়ো হাওয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেসব স্থানে পেন নির্মাণ না করাই ভালো । পেন নির্মাণের উপকরণ, যেমন- বাঁশ, জাল, শ্রমিক ইত্যাদি কাছাকাছি ও সুলভে পাওয়া যায় কিনা তাও বিবেচনা করতে হবে।
- সর্বোপরি পেনে মাছ চাষের ক্ষেত্রে আশপাশের সামাজিক অবস্থা, মাছ চুরি, দলাদলি, কোন্দল ইত্যাদি বিবেচনা করে সব কিছু অনুকূলে থাকলে তবেই সে স্থান পেনে মাছ চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত ।
পেন তৈরির উপকরণ :
পেন তৈরিতে সাধারণত নিম্নোক্ত উপকরণসমূহ ব্যবহৃত হয়। যেমন- পলিইথিলিন বা নাইলনের জাল, বাঁশের খুঁটি, চেরাইকৃত বাঁশের ফালি বা চটা, গাছের সোজা ডাল, নাইলনের অথবা নারিকেলের কয়ের রশি, পেরেক, জিআই তার, দা ইত্যাদি।
পেন তৈরি :
বাঁশ, গাছের ডাল, নাইলনের গিটবিহীন জাল, রশি, খুঁটি, পেরেক প্রভৃতি দিয়ে পেনের বেড়া নির্মাণ করা হয়। বাঁশের বানা বা বেড়া মজবুত খুঁটির সাহায্যে বেড়ার মত দেয়া হয়। বাঁশের বেড়া বা বানা মাটির মধ্যে গেড়ে দিতে হবে যাতে কাদার মধ্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করে সহজে মাছ চলে যেতে না পারে। বেড়ার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে সবচেয়ে কম প্রশস্ত জায়গায় বেড়া স্থাপন করতে হবে। জাল দিয়ে বেড়া দেওয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন জালের ফাঁস ১০ মি.মি. এর চেয়ে বেশি না হয়। এক্ষেত্রে টায়ার কর্ড জাল বা গিটবিহীন (Kont less) পলিইথিলিনের জাল ব্যবহার করা সবচেয়ে উত্তম।
জলাশয়ের ধরনের ওপর পেনের আকার নির্ভর করে। জলাশয়ের মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে ১ হেক্টর হতে ১০ হেক্টর আয়তনের যেকোনো আকৃতির পেন নির্মাণ করা যেতে পারে। পেনের আয়তন খুব বেশি বড় হলে কখনও কখনও ব্যবস্থাপনায় অসুবিধা দেখা দেয়। আবার আয়তন অত্যন্ত ছোট হলে বড় পেনের চেয়ে নির্মাণ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। সাধারণত ১ হেক্টর হতে ৫ হেক্টর আয়তনের পেন মাছ চাষ ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সবচেয়ে ভালো ।
পেন তৈরিতে ব্যবহৃত উপকরণের আয়ুষ্কাল
রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দমন : পেন তৈরির পর বার বার ঘন ফাঁসের জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ (শোল, বোয়াল, আইড়, টাকি, চিতল ইত্যাদি) সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া জলজ আগাছাও সম্পূর্ণরূপে তুলে ফেলতে হবে। পেনে বাইরের প্রবহমান পানির সাথে সংযোগ থাকে বলে বিষ প্রয়োগে অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণ খুব বেশি কার্যকর হয় না। এ কারণে বার বার জাল টেনে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করার ব্যবস্থা করা ।
প্রজাতি নির্বাচন :
পেনে মাছ চাষের জন্য প্রজাতি নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন প্রজাতির এমন সব পোনা ছাড়তে হবে যারা পানির সব স্তরের খাবার খায়, খাদ্য শিকল সংক্ষিপ্ত, পোনা সহজে সংগ্রহ করা যায় এবং অল্প সময়ে চাষ করে বাজারে বিক্রির উপযোগী হয় । এসব দিক বিবেচনা করে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, বিগহেড, গ্রাসকার্প, রাজপুঁটি, তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ ইত্যাদি প্রজাতির মাছ পেনে চাষ করার জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
পোনা মজুদের হার :
অধিক ফলনের জন্য সুস্থ ও সবল পোনা নির্দিষ্ট হারে মজুদ করা প্রয়োজন। পোনা মজুদের সময় পোনার আকার কোনোক্রমেই ৪ ইঞ্চি বা ১০ সেন্টিমিটার এর কম হওয়া উচিত নয়। কারণ ছোট পোনা পেনের বেড়া দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও পেন থেকে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা অনেক সময় সম্ভব হয় না। তাই ৪ ইঞ্চির চেয়ে ছোট আকারের পোনা মজুদ করলে রাক্ষুসে মাছ পোনা খেয়ে ফেলার আশঙ্কা থাকে। পানির গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে প্রতি একরে ৬০০০-৮০০০ টি পোনা নিচে লিখিত হারে মজুদ করা যেতে পারে।
পেনে খাদ্য সরবরাহ :
পেনে মজুদকৃত মাছের দৈহিক ওজনের ১-২% হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। সম্পূরক খাদ্য হিসেবে খৈল, কুঁড়া, ভুসি ও চিটাগুড় ইত্যাদি মিশিয়ে বল খাদ্য তৈরি করে মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে। আবার সহজলভ্যতার উপর ভিত্তি করে এলাকায় প্রাপ্ত খাদ্য উপাদান দিয়েও সম্পূরক খাদ্য তৈরি করা যেতে পারে। ১০০ কেজি সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য কী কী উপকরণ কী অনুপাতে লাগবে তার একটি পরিমাণ নিচে সারণি – ২০ এ দেয়া হলো।
সারণি-২০ : সম্পুরক খাদ্য তৈরির নমুনা (১০০ কেজি)
মাছের নমুনা সংগ্রহ ও খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ :
প্রতি মাসে একবার জাল টেনে প্রত্যেক প্রজাতির কমপক্ষে ৫টি মাছের গড় ওজন জেনে নিয়ে মোট মজুদকৃত মাছের সংখ্যা দ্বারা গুণ করে মাছের মোট জীবভর (Biomass) নির্ণয় করতে হবে। মোট জীবভরের ওপর ভিত্তি করে সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ সমন্বয় করে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। মাছের কোনো প্রকার রোগবালাই বা দৈহিক বৃদ্ধির সমস্যা দেখা দিলে তা প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পেন পরিচর্যা :
পেনের বেড়া বা জালে কোনোরূপ ক্ষতি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। অনেক সময় পেনের বেড়া ও জালে ময়লা আবর্জনা জমে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরূপ অবস্থায় বেড়া ও জাল পরিষ্কার করা না হলে পানির চাপে জাল ছিঁড়ে যেতে পারে বা বেড়া ভেঙে যেতে পারে। মাছ সংরক্ষণ, সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ ও পেন পরিচর্যার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে পেন সংলগ্ন এলাকায় পাহাড়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার।
মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ :
বর্ণিত ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পালন করলে ৬-৭ মাসের মধ্যেই মাছ বিক্রির উপযোগী হয়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে উলেখিত সময়ে হেক্টর প্রতি ৩-৩.৫ মে.টন মাছ উৎপাদিত হতে পারে ।
আরও দেখুনঃ