পুকুর খননে স্থান নির্বাচনকালে বিবেচ্য বিষয়সমূহ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পুকুর খননে স্থান নির্বাচনকালে বিবেচ্য বিষয়সমূহ – যা মাছচাষে পুকুরের ধরন ও পুকুর খনন এর অন্তর্ভুক্ত।

পুকুর খননে স্থান নির্বাচনকালে বিবেচ্য বিষয়সমূহ

 

পুকুর খননে স্থান নির্বাচনকালে বিবেচ্য বিষয়সমূহ

 

১. ভূমির প্রকৃতি :

তুলনামূলকভাবে নিচু এলাকায় পুকুর খনন করা উচিত । পাহাড় বা টিলার ঢালে পুকুর খনন ঠিক নয়। কারণ সেখানে পানি ধরে রাখা কঠিন। পুকুর খননের পর পাড় যে পরিমাণ উঁচু হবে তা মাঝারি ধরনের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এমন জায়গা নির্বাচনের ওপর জোর দিতে হবে। নতুবা ভবিষ্যতে বন্যায় বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে । নিচু স্থানে পুকুর খনন করলে ভেজা মাটি দ্বারা ভালোভাবে পাড় নির্মাণ করা যায় এবং কম গভীরতায় যথেষ্ট পানি ধরে রাখা যায় বলে নিচু এবং বন্যামুক্ত স্থান পুকুর খননের জন্য সবচেয়ে ভালো।

২. মাটির বৈশিষ্ট্য :

পুকুর তৈরির জন্য এমন স্থান নির্বাচন করা উচিত যে স্থানের মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি। মাছ চাষের পুকুরে যথেষ্ট পরিমাণ পানি থাকা প্রয়োজন । তাই প্রথমে দেখতে হবে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা কেমন। মোটা কাঁকরযুক্ত মাটি কিংবা বেলে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত কম। লাল মাটির এলাকায় এবং এঁটেল মাটিতে পুকুর খনন করলে পানি প্রায় সময়ই ঘোলা থাকে। কারণ এ ধরনের মাটির কণাগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম যা সহজে থিতায় না। আর পুকুরের পানি ঘোলা থাকলে সূর্যের আলো পানির গভীরে প্রবেশ করতে পারে না।

এতে পুকুরের উর্বরতা শক্তি তথা খাদ্য উৎপাদন কমে যায়। ফলে মাছের ফলনও ভাল হয় না। পুকুর খননের জন্য এঁটেল-দোঁআশ মাটি সবচেয়ে ভালো। এ মাটির উর্বরতা এবং পানি ধারণ ক্ষমতা দু’টোই সন্তোষজনক। তবে এলাকায় নেহায়েত ভালো মাটি পাওয়া না গেলে যে মাটিই পাওয়া যাক না কেন সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার যেমন- গোবর, কম্পোস্ট সার প্রভৃতি ব্যবহার করে তলদেশের উন্নয়ন সাধন তথা মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব ।

৩. বন্যামুক্ত স্থান :

পুকুর খননের জন্য নির্বাচিত স্থান অবশ্যই বন্যামুক্ত হওয়া প্রয়োজন । নিচু এলাকায় বন্যার আশঙ্কা থাকলে সম্মিলিত উদ্যোগে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করতে পারলে পুকুরের পাড় বেশি উঁচু করার প্রয়োজন হয় না ।

৪.পানির উৎস ও গুণাগুণ :

পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায় এমন স্থানে পুকুর খনন করা উচিত। আধুনিক পন্থায় মাছ চাষের জন্য সারা বছর পুকুরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির প্রয়োজন। আমাদের দেশে পুকুরগুলো সাধারণত বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল । কেবলমাত্র মাছচাষের উদ্দেশ্যে নতুন পুকুর করতে হলে তার পাশে নির্ভরযোগ্য পানির উৎস থাকা বাঞ্ছনীয়।

এক্ষেত্রে শুধু পানির পরিমাণই যথেষ্ট নয়, পানির গুণাগুণও সমগুরুত্বপূর্ণ। যে উৎস হতে পুকুরে পানি সরবরাহ করা হবে কোন ক্রমেই সেই উৎস যেন দূষিত না হয় । আবার পানি স্বচ্ছ হওয়া বাঞ্ছনীয়, ঘোলা পানি পুকুরের উৎপাদন শক্তি হ্রাস করে । তাছাড়া ভাসমান সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কণা মাছের ফুলকায় জমে শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি করে। ভাল ফল লাভের ক্ষেত্রে পানির উৎসের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের গুণাগুণও সমভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

৫. আলো বাতাসের ব্যবস্থা :

পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পাওয়া যায় এমন খোলামেলা স্থানে পুকুর খনন করা উচিত। পুকুর পাড়ে ঘন গাছপালা ও ঘরবাড়ি থাকলে অথবা পুকুরে প্রচুর পরিমাণ কচুরিপানা থাকলে আলো-বাতাস বাধা পায় । পুকুরে সূর্যের আলো না পড়লে অথবা কম পড়লে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। অন্য দিকে বাতাসে পানি আন্দোলিত না হলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে এবং এতে মাছের মৃত্যুও ঘটতে পারে। সুতরাং পুকুর খননের জন্য এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-বাতাস পাওয়া যায় ।

৬. যোগাযোগ ব্যবস্থা :

মৎস্য খামার বা পুকুরের সঙ্গে অবশ্যই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা পাকা রাস্তা থাকা প্রয়োজন। তা না হলে অধিকাংশ সময়ই উৎপাদিত পণ্য সঠিকভাবে বাজারজাত করা যায় না। এ ছাড়াও পুকুরে প্রতিনিয়ত কাজের জন্য যেমন- পোনা পরিবহন, খাদ্য, সার, ঔষধপত্র, জালসহ নানারকম জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করতে হয় । যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত না হলে এসব জিনিসপত্র সময়মতো আনা-নেয়া কষ্টকর বা পরিবহন খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। ফলে লাভের অংশ অনেক কমে যাবে। তাই নতুন পুকুর কিংবা খামার নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচনকালে এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

৭. উপকরণের প্রাপ্যতা :

উন্নত পদ্ধতিতে মাছচাষ করতে হলে নানাবিধ জিনিসপত্র যেমন- মাছের পোনা, খাদ্য, সার, রাসায়নিক দ্রব্য, ওষুধপত্র, মাছ আহরণ সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি প্রয়োজন হয়। দেশের একান্তই প্রত্যন্ত অঞ্চলে খামার বা পুকুর খনন করা হলে এবং যেখানে ধারেকাছে এসব উপকরণ পাওয়া না গেলে খামার পরিচালনা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।

তবে বর্তমানে আমাদের দেশে এমন প্রত্যন্ত অঞ্চল খুবই কম, যেখানে মাছ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা কিংবা পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য । তাছাড়া মাছ চাষের জন্য যেসব জিনিস দরকার সেগুলো সচরাচর ধারে-কাছেই পাওয়া যায় ৷ আর কিছু কিছু জিনিস আছে যা বছরে দুই একবার প্রয়োজন হয়। সেগুলো বছরের প্রথমেই কিনে রেখে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে ।

৮. নিরাপত্তা ব্যবস্থা :

মাছ চাষের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সমস্যা দুই ধরনের, পুকুরের মাছসহ অন্যান্য মালামালের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা, অন্যটি হলো বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক সমস্যা। সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বসতবাড়ির কাছাকাছি পুকুর নির্বাচন করা যাতে খুব সহজেই পুকুর বা খামার দেখাশুনা করা যায় । আর বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক সমস্যা সমাধানকল্পে বাঁধ নির্মাণ করা এবং গভীর কিংবা অগভীর নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা করা । সম্ভব হলে এসব ব্যবস্থা নেয়ার পরই কেবল নির্ধারিত স্থানে খামার কিংবা পুকুর নির্মাণের কাজ শুরু করা উচিত ।

৯. বিদ্যুতের ব্যবস্থা :

নিবিড় মাছ চাষের ক্ষেত্রে খামার বা পুকুরে অবশ্যই বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন । সময়মতো পুকুরে পানি পরিবর্তন, আলোর ব্যবস্থাকরণসহ পুকুরের পানিতে কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন বাড়ানোর যন্ত্র চালানোর জন্যও বিদ্যুতের প্রয়োজন। তাই খামার বা পুকুর নির্বাচনের আগে অবশ্যই এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে পরে পুকুর নির্মাণ করতে হবে।

 

পুকুর খননে স্থান নির্বাচনকালে বিবেচ্য বিষয়সমূহ

 

১০. বাজারজাতকরণের সুবিধা :

মাছ দ্রুত পচনশীল পণ্য। একই ওজনের তাজা মাছ আর পচা মাছের বাজার মূল্যে বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে মাছ বাজারজাতকরণ করতে না পারলে অনেক সময় লাভের অংশ কমে যায়। তাই বাজারের চাহিদা অনুযায়ী মাছ বাজারজাতকরণ করতে পারলে লাভের অংশ বেড়ে যায় । বাজারজাতকরণের সুবিধা নেই এমন স্থানে পুকুর বা খামার স্থাপন করে বেশি লাভবান হওয়া যায় না ।

আরও দেখুন:

Leave a Comment