আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় অ্যাকোয়েরিয়ামে বাহারি মাছ পালন ও পরিচর্যা।
অ্যাকোয়েরিয়ামে বাহারি মাছ পালন ও পরিচর্যা
অ্যাকোয়েরিয়াম হচ্ছে কাঁচের তৈরি কৃত্রিম জলাধার যেখানে প্রায় প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে বিভিন্ন ধরনের বর্ণালি মাছ লালন করা হয়। অন্যভাবে বলা যায় অ্যাকোয়েরিরাম হলো মানুষ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত একটি ভাল বাগান, যেখানে জলজ উদ্ভিদ ও মাছ এমনভাবে অবস্থান করে যা প্রায় প্রকৃতিতে অবস্থানের ন্যায় ।
অ্যাকোয়েরিয়ামের গুরুত্ব :
সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। প্রকৃতির বিচিত্র বর্ণচ্ছটায় বাহারি মাছ যখন স্বচ্ছ কাঁচের জলজ বাগানে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ায় তা দেখে চোখ জুড়ায়। অ্যাকোয়েরিয়াম অফিস এবং ড্রয়িংরুমের সৌন্দর্য বাড়ায়। এছাড়া অ্যাকোরেরিয়ামে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। অ্যাকোয়েরিয়ামের সঠিক ব্যবহার প্রাকৃতিক ইতিহাস, প্রকৃতি সংরক্ষণ ও জীববিদ্যা পাঠকে উপভোগ্য ও সহজবোধ্য করে দিতে পারে। জাপানে অ্যাকোরেরিয়ামে মাছের আকস্মিক ছোটাছুটি দেখে সেখানকার মানুষ আগাম ভূমিকম্প সম্পর্কে জানতে পারে।
দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে অ্যাকোরেরিয়ামের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে মাছের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করলে তার উচ্চ রক্তচাপ অনেকাংশে স্বাভাবিক হয়ে আসে। শুধুমাত্র অ্যাকোয়েরিয়ামে মাছ প্রতিপালনই নয়, মাছের সাথে সাথে অ্যাকোয়েরিরাম সাজানোর কিছু আনুষাঙ্গিক দ্রব্য, যেমন- প্লাস্টিকের ফিডার (খাবার পাত্র), প্লাস্টিকের গাছ, এরেটর, কাঠের ফ্রেম ইত্যাদি তৈরি ও সরবরাহের মাধ্যমে ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষিত ও বেকার যুবক তাদের জীবিকা অর্জন করছে। ক্রমেই এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যত কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই অ্যাকোরেরিয়ামে বাহারি মাছ প্রতিপালনের গুরুত্ব অপরিসী ।

অ্যাকোরেরিয়াম তৈরি :
অ্যাকোয়েরিয়াম সাধারণতঃ কাঁচ বা কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়, যাতে করে সৌন্দর্যঅতি দ্রব্যসমূহ বাহির থেকে সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। অ্যাকোরেরিয়ামটি সাধারণত আরত- কার হয়ে থাকে। তবে বর্গাকার বা অন্যান্য আকারেরও হতে পারে। যে ঘরে স্থাপন করা হবে তার আকারের ওপর নির্ভর করে অ্যাকোয়েরিয়ামের আকার নির্ধারণ করা হয়। তবে ঘরে রাখার জন্য ২৪ 22 আকারের অ্যাকোয়েরিয়ামই উপযুক্ত। আর একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অ্যাকোয়েরিয়াম লম্বায় বা গ্রন্থে যতই বড় হোক না কেন, উচ্চতার যেন ১৮ ইঞ্চির বেশি না হয়।
তার কারণ এসব মাছ অল্প পানিতে বসবাস করে। পানির উচ্চতা বেশি হলে মাছ পানির চাপ সহ্য করতে পারবে না। অবশ্য কোনো কারণে অ্যাকোয়েরিয়ামের উচ্চতা বেশি হলে পানি রাখার সময় সর্বোচ্চ ১৮ ইঞ্চি পরিমাণ পানি রাখলেই চলবে। জ্যাকোয়েরিয়ামে যে কাঁচ ব্যবহার করা হয় তার পুরুত্ব ৬ মি.মি. হলেই চলবে। কাঁচের স্লাইডগুলোকে সিলিকা গাম না উন্নত মানে ঠা দিয়ে জোড়া লাগানো হয়, যাতে করে জোড়া দেওয়া অংশও স্বচ্ছ থাকে এবং দৃষ্টিনন্দন হয়। অ্যাকোয়েরিরামের আকারের সাথে মিল রেখে সুদৃশ্য কাঠের বা টিনের ঢাকনা ব্যবহার করা হয়।
ঢাকনার এক প্রান্ত যাতে প্রয়োজনানুসারে খোলা ও বন্ধ করা যায় তার ব্যবস্থা রাখা উচিত। ঢাকনার মাঝে কিছুটা ফাঁক রাখা হয় যাতে করে বাতাস সুষ্ঠুভাবে চলাচল করতে পারে এবং ক্ষতিকারক গ্যাস বেরিয়ে যেতে পারে।
কৃত্রিম আলোকসজ্জা :
মাছের অবিশ্রান্ত বিচরণ সহজে দেখার জন্য এবং বাহারী মাছের বর্ণিল রূপ দর্শনের জন্য অবশ্যই আলো দরকার। এক্ষেত্রে ২৪”x১২”x১২” আকারের একটি অ্যাকোয়েরিয়ামের জন্য ৬০ ওয়াটের একটি বাল্প দৈনিক অন্তত ৮ ঘণ্টা জ্বালিয়ে রাখা দরকার। অ্যাকোয়েরিয়ামে মাছ রাখার জন্য নিম্নোক্ত কাজগুলো পর্যায়ক্রমে করতে হবে।
ক. পরিষ্কার থিতানো পানি দ্বারা অ্যাকোয়েরিয়ামের ভিতর এবং বাহির পরিষ্কার করে নিতে হবে। কখনও সাবান বা অন্য কোনো ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা যাবে না। তবে লবণের ঘন দ্রবণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
খ. পরিষ্কার মোটা দানার বালি অথবা ছোট ছোট পাথরের নুড়ি সংগ্রহ করে পরিষ্কার পানি দ্বারা ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।
গ. ধৌত করা বালি বা নুড়ি পাথর অ্যাকোয়েরিয়ামের তলদেশে ৪ ইঞ্চি পুরু করে ভালোভাবে বিছিয়ে দিতে হবে।
ঘ. পানি ভর্তি করার আগে অ্যাকোয়েরিয়ামকে বাড়ির একটি নির্দিষ্ট স্থানে সুন্দর একটি কাঠের ফ্রেমের উপর স্থাপন করে সম্ভব হলে যেখানে আংশিক সূর্যালোক পড়ে এমন স্থানে স্থাপন করা উচিত ।
ঙ. এবার থিতানো ও ক্লোরিনমুক্ত পানি দ্বারা অ্যাকোয়েরিয়াম পূর্ণ করতে হবে। পানির উপরিতল অ্যাকোয়েরিয়ামের উপরিতল থেকে ৩ ইঞ্চি বা ৪ ইঞ্চি নিচে হতে হবে।
চ. পানি দ্বারা পূর্ণ করার পরে বড় ধরনের অ্যাকোয়েরিয়ামের ক্ষেত্রে ভেলিসনেরিয়া, অ্যানাকারিস, আমাজন সোর্ড প্রভৃতি জলজ উদ্ভিদ লাগানো যেতে পারে। এসব জলজ উদ্ভিদ একদিকে যেমন- অ্যাকোয়েরিয়ামের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, অন্য দিকে মাছের আশ্রয়স্থল ও শ্বাসকার্যে বিশেষ সহায়তা প্রদান করে থাকে। তবে ছোট ছোট অ্যাকোয়েরিয়ামের ক্ষেত্রে অনেকেই প্লাস্টিকের তৈরি গাছ ব্যবহার করে থাকেন। অনেকে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অ্যাকোয়েরিয়ামে বালি বা নুড়ি পাথরের উপর সুন্দর সুন্দর কোরাল বা ঝিনুকের খোলস ব্যবহার করে থাকেন ।
মাছের প্রজাতি নির্বাচন :
অ্যাকোয়েরিয়ামে মাছ লালন-পালনের ক্ষেত্রে মাছের প্রজাতি নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশী-বিদেশী বাহারি রঙে শোভিত চকচকে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর মাছ অ্যাকোয়েরিয়ামে লালন-পালন করা হয় । আমাদের দেশে অ্যাকোয়েরিয়ামে বাহারি মাছের অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত । নিচে অ্যাকোয়েরিয়ামে পালন যোগ্য কিছু দেশী এবং বিদেশী মাছের নাম দেওয়া হলো ।
মাছের সংখ্যা :
অ্যাকোয়েরিয়ামে অল্প সংখ্যক সুন্দর, সুস্থ ও সবল মাছ ছাড়াই উত্তম। তবে অ্যাকোয়েরিয়ামে কী পরিমাণ বা কত সংখ্যক, কোন প্রজাতির সাথে কোন প্রজাতির মাছ ছাড়া যাবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে অ্যাকোয়েরিয়ামের আকারের ওপর। সাধারণভাবে ১ ইঞ্চি আকারের মাছের জন্য ১ গ্যালন পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। সেই হিসাবে ২৪”x১২”x১২” আকারের একটি অ্যাকোয়েরিয়ামে ১-১.৫ ইঞ্চি আকারের ১০-১২টি মাছ অনায়াসেই বেঁচে থাকতে পারে ।
মাছের খাদ্য :
অ্যাকোয়েরিয়ামে মাছ ছাড়ার পর নিয়মিত মাছের খাদ্য প্রদান করা উচিত। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন এবং পানির তাপমাত্রা মাছের খাদ্য |

গ্রহণকে সরাসরি প্রভাবিত করে। অ্যাকোয়েরিয়ামে সাধারণত সকাল বেলায় মাছকে খাবার দিতে হয়। সকালে অ্যাকোয়েরিয়ামে লাগানো গাছ অক্সিজেন সরবরাহ করে ফলে মাছ খাদ্য গ্রহণে অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠে। অধুনা বাজারে অ্যাকোয়েরিয়াম মাছের বিভিন্ন প্রকার ভাসমান পিলেট জাতীয় খাদ্য পাওয়া যায়। এসব খাদ্য সংগ্রহ করে মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে।
ভাসমান খাদ্য খাওয়ানো হয় বলে মাছ কতটুকু খাদ্য গ্রহণ করছে তা সহজেই লক্ষ্য করা যায়। আবার সহজে পাওয়া যায় এমন খাদ্য যেমন টিউবিফেক্সও মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে। খাবার মাছের দৈহিক ওজনের ৫ শতাংশ হারে দিতে হয়। সম্ভব হলে সকালে এবং বিকেলে ২ বার মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে মাছ যতটুকু খাবার গ্রহণ করে ততটুকু খাবারই প্রয়োজন ছিল বলে ধরে নিতে হবে।
কৃত্রিম ৰায়ু সঞ্চালন ও পানি পরিস্রাবণ :
অ্যাকোয়েরিয়াম মূলত একটি কৃত্রিম পরিবেশ। এই পরিবেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাছ লাগানো সত্ত্বেও অনেক সময় অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। তাই অ্যাকোয়েরিয়ামে এরেটরের সাহায্যে কৃত্রিমভাবে বায়ু সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা হয়। বাজারে বিভিন্ন মানের এবং বিভিন্ন দামের এরেটর পাওয়া যায়। এরেটর দ্বারা বাহিরের বাতাসকে চিকন নলের ভিতর দিয়ে পানিতে চালনা করা হয়। এই নলের অপর প্রান্তে ছিদ্রযুক্ত পাথর থাকে যা বাতাসকে বুঁদবুঁদে রূপান্তরিত করে। অনেক সময় পাথরের পরিবর্তে বিভিন্ন বর্ণের ও রঙের পুতুল, পশু-পাখির আকৃতি সম্বলিত প্লাস্টিকের বা অন্য যেকোনো ধাতব বস্তু দ্বারা এরেটরকে সজ্জিত করে।
অ্যাকোয়েরিয়ামের পানির স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখার জন্য নিয়মিত পানি পরিবর্তন করা আবশ্যক। যদি পানি পরিবর্তন করা সম্ভব না হয়, তবে পানি ফিল্টার করে পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে। সাধারণত পাওয়ার ফিল্টার ও বায়োলজিক্যাল ফিল্টার পানি পরিশোধনের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে ।

আক্রান্ত মাছের চিকিৎসা :
অনেক সময় অ্যাকোয়েরিয়ামের মাছের গায়ে, মুখে এবং ঠোঁটে ঘা হতে পারে। যদি মাছের গায়ে ঘা দেখা দেয় তাহলে আক্রান্ত মাছকে স্কুপনেট দ্বারা অ্যাকোয়েরিয়াম থেকে তুলে নিয়ে ১০ লিটার পানিতে ১ চা চামচ পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট অথবা ২০০ গ্রাম লবণ গুলে নিয়ে সেই পানিতে সহ্য করার মতো সময় (১ মিনিট) মাছকে রেখে পুনরায় অ্যাকোয়েরিয়ামে রেখে দিতে হবে। এভাবে পর পর ৩ সপ্তাহ চিকিৎসা করলে আক্রান্ত মাছ অনেকাংশে ভালো হয়ে যায় ।
আরও দেখুনঃ