রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্য, দমন ও প্রতিরোধের নিয়মাবলী

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়- রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্য, দমন ও প্রতিরোধের নিয়মাবলী যা  ইউনিট ৪ রোগের চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ এর অংশ।

এ পাঠ শেষে আপনি-

  • মাছ ও চিংড়ির রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
  • রোগ প্রতিরোধ করার নিয়মাবলী লিখতে ও বলতে পারবেন।
  • রোগ দমন করার নিয়মাবলী বর্ণনা করতে পারবেন।

রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্য, দমন ও প্রতিরোধের নিয়মাবলী

মাছ ও চিংড়ির রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্য

আমাদের দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রাণীজ আমিষের চাহিদা মেটানো এবং অর্থনৈতিক উ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য মাছ ও চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজন। আধুনিক ও লাগসই মাৎস্য চাই প্রযুক্তির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ এ সম্পদের উন্নয়নের সহজ আর কোন বিকল্প নেই।

আর এ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তবে বিগত বছরগুলোতে লক্ষ্য করা গেছে যে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এক দিকে যেমন মাছ ও চিংড়ির উৎপাদন বেড়েছে অন্যদিকে আবার নুতন নুতন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। কাজেই মাছ ও চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এদের পারিবেশিক অবস্থার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রোগ বালাই যাতে না হয় তার জন্য আগাম ব্যবস্থা নেওয়াই হল রোগ প্রতিরোধের প্রধান উদ্দেশ্য।

মৎস্য সেক্টরে মাছের রোগ নিয়ন্ত্রণের একটি সাধারণ মূলনীতি প্রচলিত আছে। তা হচ্ছে, “চিকিৎসা নয়, রোগ প্রতিরোধই উত্তম পন্থা (Prevention is better than cure)। আর এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। যেমন বড় আকারের পুকুরে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় না করে চিকিৎসা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না, তা ছাড়া পারিবেশিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং খরচের পরিমাণও অনেক বেশী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পক্ষান্তরে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মাছ বা চিংড়ির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ সহ নিয়মিতভাবে সাধারণ ব্যবস্থাপনার দিকে সতর্ক থাকলেই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই রোগ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।

রোগ প্রতিরোধের নিয়মাবলী

রোগ প্রতিরোধের প্রধান শর্ত হচ্ছে উত্তম ব্যবস্থাপনা। যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনার দ্বারা মাছ ও চিংড়ি উভয়ের রোগসমস্যা থেকে বাঁচা সময় এখনা পোনা উৎপাদন বা সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাজারে বিক্রয় পর্যন্ত যে সকল ধাপ রয়েছে তার সর্বক্ষেত্রে সতর্কতার সংগে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। চিত্র: ১৪ থেকে ব্যবস্থাপনার ধাপগুলো সহজেই মনে রাখা যাবে।

রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্য, দমন ও প্রতিরোধের নিয়মাবলী

 

উপরিউল্লিখিত ধাপগুলোর জন্য বিশেষ করে হ্যাচারী, নার্সারী এবং মদ্ভুত পুকুর বা জলাশয়ের পারিবেশিক অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণের দ্বারা মনা সুব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে নিম্নলিখিত বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে-

১) পানির গুণাগুণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয়।

২) জলাশয় আগাছামুক্ত রাখা এবং পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ার ব্যবস্থা করা।

৩) ৩/৪ বছর পরপর পুকুর শুকিয়ে উপরের কাদা সরিয়ে ফেলা। চিংড়ি ক্ষেত্রে একাজ প্রতি বছর
করতে পারলে ভাল হয়।

৪) পুকুর থেকে অবাঞ্ছিত প্রাণী অপসারণ করা।

৫) উন্নত জাতের সুস্থ, সবল এবং সঠিক সংখ্যক পোনা মজুত করা।

৬) পুকুরে পরিমিত খাদ্য ও সার সময়মত সরবরাহ করা।

৭) পুকুরে রোগজীবাণু বাহক পাখি বসতে না দেয়া।

৮) রোগাক্রান্ত পুকুরে ব্যবহৃত জীবাণুমুক্ত না করে নূতন পুকুরে ব্যবহার না করা।

এ ছাড়া রোগ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাক্সিন (Vaccine) ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে বর্তমানে পৃথিবীতে এর এখনও বহুল ব্যবহার হয়নি।

মাছের রোগের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া ঘটিক ফুরানকুলোসিস, ডিগ্রিওসিস রোগের ক্ষেত্রে নরওয়ে, বৃটেন, ডেনমার্ক সহ ইউরোপের কিছু দেশে, উত্তর আমেরিকা এবং জাপানে ভ্যাক্সিন ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে সাফল্যজনক ভাবে ব্যাপক প্রচলন এখনও হয়নি। মৎসা রোগ বিশেষজ্ঞগণ কোন কোন ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যাহে ইমিউনোষ্টিমুল্যান্ট ব্যবহার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

 

রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্য, দমন ও প্রতিরোধের নিয়মাবলী

 

রোগ দমনের নিয়মাবলী

প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও যখন রোগ দেখা দেয় তখন তা থেকে মাছ বা চিংড়িকে রক্ষা করার যে সকল ব্যবস্থা হয় তাকেই সাধারণ ভাবে দমন ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। প্রতিকার ব্যবস্থা এর অন্তর্গত। বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসাই হল রোগ দমনের প্রধান নিয়ম। নিম্নে রোগ দমনের নিয়মগুলো ব্যাখ্যা করা হল। প্রতিকারের একটি প্রধান শর্ত রোগের কারণ সঠিকভাবে জানা।

১। রাসায়নিক চিকিৎসা (Chemotherapy)

বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করে যে চিকিৎসা করা হয় তাকেই রাসায়নিক চিকিৎসা বলা হয়। এ সকল রাসায়নিক দ্রব্যাদির মূল্য সহজ লভ্যতা, পানির পরিবেশে প্রভাব, রোগ প্রতিকারের কার্য্যক্ষমতা, মাছ বা চিংড়ির উপর প্রতিক্রিয়া এবং পরবর্তীতে বাজারজাত করণে গ্রহনযোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে এ সকল দ্রব্য চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

সাধারণভাবে বহিঃপরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হলে পোকামারার ঔষধ (Insecticide), ছত্রাক দ্বারা হলে ছত্রাক মারার ঔষধ(Fungicide) আর ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আকান্ত হলে এন্টিবায়োটিক (Antibiotics) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রোগের তীব্রতা, প্রসারতা বা অবস্থার উপর ভিত্তি করে ঔষধ (রাসায়নিক দ্রব্য) প্রয়োগের কতগুলো নিয়ম রয়েছে- এ গুলো নিম্নে দেয়া হলো।

ক) পুকুরে প্রয়োগ (Pond treatment) পুকুরে যখন অল্প মাছে রোগ দেখা দেয় কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাপক হারে রোগ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে তখন সীমিত মাত্রার ঔষধ সমস্ত পুকুরে নিয়মিত ২/৩ দিন অন্তর প্রয়োগ করতে হয়।

খ) গোসল (Bath treatment) রোগাক্রান্ত মাছকে আলাদা করে অন্য ছোট ট্যাংক, চৌবাচ্চা, ড্রাম বা একোরিয়ামে কমপক্ষে আধ ঘন্টা থেকে ১/২ দিন পর্যন্ত ঔষধ দ্রবনে রাখা। এতে তুলনামূলক ঔষধের মাত্রা কম থাকে বা মাছের সহাক্ষমতার মধ্যে থাকে। সময় অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ গোসল করে রোগ প্রতিকার করা যেতে পারে।

গ) চুবানো (Dip treatment) স্বল্প সংখ্যক রোগাক্রান্ত মাছকে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে (১ থেকে ৩ মিনিট) অপেক্ষাকৃত ঘন ঔষধ দ্রবণে ডুবানো। অনেক সময় এতে ভাল ফল পাওয়া যায় ।

ঘ) লাগানো (Topical application) : মাছের শরীরের উপরিভাগে কোন ক্ষত, আঘাতজনিত স্থানে সরাসরি ঔষধ লাগিয়ে দেওয়া।

ঙ) খাবারের মাধ্যমে বা মুখের দ্বারা (Oral administration) : নির্দিষ্ট মাত্রায় খাবারের সাথে মিশে ঔষধ ব্যবহার বিশেষ করে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ খুবই কার্যকরী।

চ) ইনজেকশনের মাধ্যমে ( Injection) : ইনজেকশনের দ্বারা ঔষধ সরাসরি রক্তের মাধ্যমে আক্রান্ত স্থানে পৌঁছে যায় তাই এই পদ্ধতি বেশ কার্যকরী। কিন্তু স্বল্প সংখ্যক বড় মাছ ছাড়া ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করা যায় না। বড় মাছের ক্ষেত্রে পেটের তলদেশে (Interperitoneal) বা ঘাড়ের মাংশপেশীতে (Intermuscular) ইনজেকশন ব্যবহার করা সম্ভব।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

২। সার্জারী (Surgery)/ শৈল্য চিকিৎসা

ঔষধ ছাড়াও কিছু অন্য উপায়ে চিকিৎসা কোন কোন ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে- তার মধ্যে শরীরের উপরিভাগে আক্রান্ত কোন পরজীবী অপসারণ কিংবা আঘাত প্রাপ্ত কোন পাখনা বা বংশানুক্রমিক কোন অতিরিক্ত অথবা অস্বাভাবিক অংগকে অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে।

৩। বিবিধ উপায় (Miscellaneous treatment)

অনেক ক্ষেত্রে সামুদ্রিক পানিকে স্বাদু পানির মাছের রোগ দমনে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কলামনারিস রোগ (ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত), ছত্রাক ঘটিত রোগ এদের মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য। এ ছাড়া পানির তাপমাত্রা পরিবর্তনের দ্বারাও অনেক রোগজীবাণু দমন করা যায়- ফলে রোগ বিস্তার করতে পারে না।

অনুশীলন ( Activity) : মৎস্য চাষে রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্য কি? মাছ ও চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ও দমনের নিয়মাবলী ব্যাখ্যা করুন।

সারমর্ম:

মাছ ও চিংড়ি চাষে রোগ-বালাই একটি প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের প্রধান উপায় হল প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া। মৎস্য চাষে রোগ বালাই থেকে বাঁচার জন্য পারিবেশিক অবস্থার উত্তম ব্যবস্থাপনা, প্রয়োজনে সম্ভব হলে ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে মাছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, পুকুর বা জলাশয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংখ্যক পোনা না ছাড়া ইত্যাদি প্রতিরোধ করার নিয়ম।

এর ফলে রোগের প্রাদুর্ভাব কম হবে, স্বল্প খরচে রোগ নিয়ন্ত্রন করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত মূলনীতি হল, “চিকিৎসা নয়, রোগ প্রতিরোধই উত্তম পন্থা” (Prevention is better | than treatment)। অবশ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও রোগ দেখা দেয় তখন চিকিৎসার মাধ্যমে দমন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

রোগ প্রতিকার করার প্রধান উপায় হল রাসায়নিক দ্রব্যাদি সঠিকভাবে ব্যবহারের দ্বারা চিকিৎসা করা যাকে রাসায়নিক চিকিৎসা (Chemotherapy) বলা হয়। পোকামারা ঔষধ (Insecticide), ছত্রাক মারা ঔষ (Fungicide), এন্টিবায়োটিক সহ বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দ্রব্যাদি সতর্কতার সহিত ব্যবহার করা হয়।

আবার ঔষধ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী পুকুরে প্রয়োগ, গোসল, চুবানো, লাগানো, মুখের দ্বারা এবং ইনজেকশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও শৈল চিকিৎসা, পানির তাপমাত্রায় পরিবর্তন ঘটিয়ে বা সামুদ্রিক পানি ব্যবহার করে অনেক রোগের চিকিৎসা করা যেতে পারে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment