আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় – খাদ্য শৃংখল এবং পরিবেশ
খাদ্য শৃংখল এবং পরিবেশ
খাদ্য শংখল
জীব জগতের সকল উদ্ভিদ, প্রাণী ও অজৈব বস্তুর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া (interaction) এবং দ্রব্যের আদান প্রদানের মধ্য দিয়েই জীবনচক্র অবিরতভাবে চলছে। জীবজগতের কোটি কোটি জীবের মধ্যে একমাত্র সবুজ উদ্ভিদ স্বভোজী। পক্ষান্তরে প্রাণীরা পরভোজী। খাদ্যের জন্য প্রাণী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবুজ উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীতে সকল শক্তির উৎস সূর্যালোক। সবুজ উদ্ভিদ সূর্যালোকের সাহায্যে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের খাদ্য (শর্করা) নিজেরা প্রস্তুত করে থাকে।
সালোকসংশে-ষণের সময় সবুজ উদ্ভিদ জীবের পরিবেশের জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন তৈরি করে। এ প্রক্রিয়ায় আলোক শক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং তা শর্করা খাদ্যে আবদ্ধ থাকে। অর্থাৎ, সবুজ উদ্ভিদের দেহে সৌরশক্তি (radiant energy) স্থিতিশক্তি (potential energy) হিসেবে সঞ্চিত হয়। সবুজ উদ্ভিদ, অর্থাৎ, উৎপাদক তৈরি এ খাদ্যের কিছু অংশ নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে।
অবশিষ্ট অংশ সঞ্চিত খাদ্য (তৃণভোজী প্রাণীর জন্য) হিসেবে উৎপাদকের দেহে জমা থাকে। তৃণভোজী প্রাণী (প্রাথমিক খাদক) উৎপাদককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। আবার মাংসাশী প্রাণী (মাধ্যমিক খানক) তৃণভোজী প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং শেষ পর্যায়ে রাক্ষুসে প্রাণী (চূড়া বাদক) মাংসাশী প্রাণীকে খেয়ে থাকে।
যখন তৃণভোজী প্রাণী সবুজ উদ্ভিদ খায় তখন উদ্ভিদের দেহে সঞ্চিত স্থিতিশক্তি তৃণভোজী প্রাণীর দেহাভ্যন্তরে তাপশক্তিরূপে মুক্ত হয়, যার কিছু অংশ উক্ত প্রাণীর জীবনযাত্রা পরিচালনায় ব্যয় হয়। বাকী অংশ জমা থাকে। পুনরায় এ প্রাণীকে যখন মাংসাশী প্রাণী খায়, তখন অনুরূপভাবে কিছু শক্তি তাপশক্তি হিসেবে ব্যয় হয়। অবশিষ্টাংশ পরবর্তী ভক্ষকের দেহগঠনের জন্য সঞ্চিত থাকে। এ ভাবে এক জীব হতে অন্য জীবে শক্তি স্থানান্তরিত হয়।
অর্থাৎখাদ্যের উৎপাদক থেকে শুরু করে চূড়ান্ত খাদক পর্যন্ত পরস্পরের মধ্যে খাদ্য ও খাদক সম্পর্ক আবর্তিত হয়ে শক্তির স্থানান্তর ঘটে। শক্তি স্থানান্তরের এ প্রক্রিয়াই খাদ্য শৃংখল (food chain)। সুতরাং খাদ্য শৃংখলকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যে প্রক্রিয়ায় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একদল জীবের মাধ্যমে সবুজ উদ্ভিদ উৎস থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে একে অন্যকে খাওয়া ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার মাধ্যমে খাদ্য শক্তির স্থানান্তর ঘটে, সেই পর্যায়ক্রমিক আবর্তকে খাদ্য শৃংখল বলা হয়।
জলীয় পরিবেশে প্রধানত ২ ধরনের খাদ্য শৃংখল রয়েছে। যথা-
- চারণকারী খাদ্য শৃংখল (grazing food chain) এবং
- মৃতজীবভোগী খাদ্য শৃংখল (detritus food chain)।
চারণকারী খাদ্য শৃংখল
এ ধরনের খাদ্য শৃংখল শুরু হয় সবুজ উদ্ভিদ দিয়ে। চারণ খাদ্য-শৃংখলে মৃত জীবভোজী খাদ্য- শৃংখলের একটি উপাদান (অণুজীব) নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। মৃত সবুজ শেওলা, উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন ও জলজ জীব বিয়োজক অণুজীবের ক্রিয়ায় সরল অজৈব পুষ্টি উপাদানে রূপান্তরিত হয়।
একটি চারণ খাদ্য-শৃংখলের উপাদানগুলো নিরূপ :
- প্রাথমিক উৎপাদক উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন এবং ভাসমান এককোষী শেওলা এর অন্তর্ভুক্ত। এরা স্বভোজী ও অজৈব উপাদান পুষ্টি থেকে গ্রহণ করে।
- তৃণভোজী মূলত প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন এ পর্যায়ভুক্ত। কিছু মাছও তৃণভোজী। এরা উদ্ভিদ প্যাঙ্কটন ও শেওলা খেয়ে থাকে।
- প্রথম পর্যায়ের প্রাণীভোজী প্রাণী প্ল্যাঙ্কটনভোগী মাছ ও ছোট মাংসাশী স্বভাবের মাছ এ পর্যায়ভুক্ত। যারা বিভিন্ন ধরনের ছোট প্রাণী খেয়ে থাকে।
- দ্বিতীয় পর্যায়ের মাংসাশী প্রাণী অপেক্ষাকৃত বড় আকারের শিকারী মাছ এ পর্যায়ভুক্ত। এরা মূলত ছোট মাছ ধরে খায়।
- তৃতীয় পর্যায়ের মাংসাশী প্রাণী – বড় আকৃতির রাক্ষুসে মাছ, যারা প্রধানত প্রাণীভোজী মাছ এবং ছোট রাক্ষুসে মাছ খেয়ে থাকে।
মৃতজীবভোজী খাদ্য শৃংখল
এ ধরনের খাদ্য শৃংখলে সাধারণত চারণ খাদ্য শৃংখলের একটি উপাদান (প্রাণীভোজী মাছ) থাকে। মৃত জীবভোজী খাদ্য শৃংখলের শক্তির বাস্তর উৎস মৃত ও পচা জৈব পদার্থ। এ খাদ্য শৃংখলে ম্যানগ্রোভের মরা পাতা ইত্যাদি অগভীর মোহনার তলদেশে জমা হয় এবং অনুজীবের ক্রিয়ায় পচা জৈব পদার্থে রূপান্তরিত হয়। পচা জৈব পদার্থ নানা প্রকার জলজ প্রাণীর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর মাংসাশী মাছ ঐ সকল প্রাণীকে থানা হিসেবে গ্রহণ করে।
মৃতজীবভোজী খাদ্য শৃংখলের পুষ্টি পর্যায়গুলো নিম্নরূপ :
১. ম্যানগ্রোভের পচা পাতা ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীবের ক্রিয়ায় পচা জৈব পদার্থে রূপান্তরিত হয়।
২. বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদে জলজ প্রাণী, যেমন- নেমাটোড, ছোট চিংড়ি, কপিপড, কীটের লার্ভা, শামুক-ঝিনুক ইত্যাদি মাধ্যমিক প্রাণী হিসেবে শৃংখলের মধ্যে উপশৃংখল তৈরি করে।
৩. গ্রেমুলেট, চিংড়ি, কাকড়া প্রভৃতি পচা জৈব পদার্থ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে।
৪. ঘেরাপোনয়েড (theraponoid), কিশোর প্রেডফিন (youth threadfin) এবং সায়ানিজ (sciaenid) ইত্যাদি ক্ষুদে মাংসাশী প্রাণী (primary carnivore) হিসেবে পচা জীবভোজী প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
৫. ভেটকি, বড় সেডফিন এবং সায়ানিও চূড়ান্ত মাংসাশী প্রাণী (larger predatory carnivore) হিসেবে ক্ষুদে মাংসাশী প্রাণীকে খায় এবং এ পর্যায়গুলো শৃংখলাকারে … আবর্তিত হয়। চিত্র ৪ এ মৃত জীবভোজী খাদ্য শৃংখল দেখানো হয়েছে।
পরিবেশ
এ পৃথিবীতে জীবের আবির্ভাবের বহু পূর্ব হতেই জীবের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়। পৃথিবীতে আবির্ভাবের মুহুর্ত হতেই জীব তার পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পরিবেশের মূল উপাদান হলো মাটি, পানি, বায়ু ও সূর্যালোক। এসব উপাদান থেকেই জীবজগত খাদ্য ও আশ্রয় খুঁজে নেয়।
একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, পৃথিবীর সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর সঙ্গে পরিবেশের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এসব উদ্ভিদ ও প্রাণী পরিবেশের জড়বস্তুর সঙ্গে পারস্পরিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া ও প্রব্যাদি আদান প্রদানের মাধ্যমে জীবন যাত্রা পরিচালনা করে থাকে।

বাস্তুসংস্থান
প্রকৃতির যে কোন স্থান যেখানে জৈব প্রাণসত্তা বা জীব (living organism) ও অজৈব বস্তু (non- living substances) রয়েছে এবং এসব জীব ও অজৈব বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া (interaction) ও দ্রব্যের আদান প্রদান ঘটে, তাকেই বাস্তুসংস্থান ( ecosystem) বলা হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বাস্তুসংস্থানের মূল উপাদান ২ প্রকারের
- সজীব উপাদান (biotic component)
- জড় উপাদান (abiotic component)
সজীব উপাদান
প্রকৃতির সকল উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অণুজীব সজীব উপাদানের অন্তর্ভুক্ত। সজীব উপাদানকে আবার ৩ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যথা-
- উৎপাদক (producer)
- খাদক (consumer) এবং
- বিয়োজক (decomposer)
খাদককে আবার ৩ টি উপশ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যথা-
- প্রাথমিক খাদক (primary consumer)
- মধ্যম প রের খাদক (secondary consumer) এবং
- তৃতীয় বা চূড়ান্ত স্তরের খাদক (tertiary consumer )।
জড় উপাদান
পানি, মাটি, সূর্যালোক, বায়ু, পুষ্টি উপাদান (নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম, সংক্ষেপে ঘচক) ও খাদ্যদ্রব্য এর অন্তর্ভুক্ত। পুকুর একটি বন্ধ বাস্তুসংস্থান (closed ecosystem)। পুকুরে বাস্তুসংস্থানের বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি এবং এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া ও দ্রব্যের আদান প্রদানের মাধ্যমে একটি অনুকূল বসবাসরীতি দেখানো গেলেই পুকুরকে একটি বাস্তুসংস্থান হিসেবে প্রমাণ করা যায়।
- পুকুর প্রকৃতির একটি নির্দিষ্ট স্থান বা পরিবেশ।
- পুকুরের জড়বস্তুসমূহ নিম্নরূপ-
অজৈব পদার্থ : পুষ্টি উপাদান, যেমন- নাইট্রোজেন (N), ফসফরাস (P), পটাশ (K). কার্বন (C), অক্সিজেন (O), ক্যালসিয়াম (Ca) ইত্যাদি
খাদ্য উপাদান : শর্করা, আমিষ, তৈলব ইত্যাদি।
ভৌত উপাদান : সূর্যালোক, বাতাস, তাপমাত্রা ইত্যাদি।
- পুকুরের সজীব উপাদানসমূহ নিম্নরূপ –
ক) উৎপাদক : এরা সবাই বিভিন্ন জাতীয় উদ্ভিদ। এরা সূর্যালোকের সাহায্যে সালোকসংশ্লেষণ (photosynthesis) প্রক্রিয়ায় নিজের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে। পুকুরে এ জাতীয় সঞ্জীব উপাদান ২ প্রকারের হয়ে থাকে –
i) অপেক্ষাকৃত বড় শিকড়যুক্ত, ভাসমান বা ডুবন্ত সবুজ উদ্ভিদ, যেমন- কচুরি পানা, চেচরা ইত্যাদি।
ii) ক্ষুদে সবুজ শেওলা, অর্থাৎ উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন। যথা- ডায়াটম, অ্যানাবিনা ইত্যাদি।
খ) খাদক : এরা নিজের খাদ্য নিজে প্রস্তুত করতে পারে না। পুষ্টির জন্য অন্য প্রাণী বা উদ্ভিদকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। খাদ্য গ্রহণের ধরন অনুযায়ী খাদক নিরূপ হয়ে থাকে
i) প্রাথমিক খাদক: প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন, ব্যানথোস ও তৃণভোজী (herbivorous) মাছ প্রাথমিক খাদক। প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন পানিতে ভেসে বেড়ায়। যথা- বসমিনা, রোটিফার (rotifers) ইত্যাদি। ব্যানথোস পানির তলদেশে থাকে। যথা- ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি।
ii) মাধ্যমিক খাদক: এরা দ্বিতীয় স্তরের খাদক। যথা- মাছ, ব্যাঙ ইত্যাদি।
iii) তৃতীয় স্তরের খাদক: এরা চূড়ান্ত পর্যায়ের খাদক। যথা রাক্ষুসে (camivours) মাছ ও শিকারী (predator) মাছ।
iv) পচা জীবভোজী: এরা জীবজন্তুর মৃত পচা জৈব অংশ আহার করে। যথা- ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও অন্যান্য অণুজীব।
পুকুরের জড় বস্তু ও সজীব উপাদানের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নিরূপ –
- জড় বস্তুসমূহ, যথা- ঘ চ ক প্রাথমিক উৎপাদকের পুষ্টি উপাদান এবং সূর্যালোক শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রাথমিক উৎপাদক পুষ্টি উপাদান ও সর্যালোকের সাহায্যে খাদ্য প্রস্তুত করে। ফলে প্রাথমিক উৎপাদকের বংশবৃদ্ধি ঘটে ও প্রাচুর্য দেখা দেয়
- উৎপাদকসমূহ, যথা- উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন, প্রাথমিক খাদক তথা প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন ও তৃণভোজী মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- প্রাথমিক খাদক, যথা- প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন, বেনথোস ইত্যাদিকে মাধ্যমিক খাদক (মাছ) খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
- কিছু কিছু মাধ্যমিক খাদক, যথা- ছোট মাছ তৃতীয় পর্যায়ের খানক (রাক্ষুসে মাছ) কর্তৃক খানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- বিযোজকসমূহ, মৃত উৎপাদকের দেহ (মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্লাঙ্কটন), মৃত মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবদেহ হতে পুষ্টি গ্রহণ করে এবং মৃত দেহাবশেষ এর জটিল জৈব পদার্থকে বিশিষ্ট করে অজৈব তরল পদার্থে (পুষ্টি উপাদান) পরিণত করে, যা হতে প্রাথমিক উৎপাদক পুষ্টি গ্রহণ করে এবং এ চক্র পুকুরে বিরামহীন চলতে থাকে। আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে পুকুর বাস্তুসংস্থানের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আরও দেখুন :