আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-থাই কৈ মাছের জীবন বৃত্তান্ত
থাই কৈ মাছের জীবন বৃত্তান্ত
সাধারণ নাম : থাই কৈ
বৈজ্ঞানিক নাম : এনাবাস টেস্টোডাইনাস (Anabas testudineus )
দেহের বিবরণ : এ মাছের মাথা বড় ও প্রায় ক্রিকোনাকৃতি বর্ণ কালচে সবুজ বা বাদামি সবুজ। দেহ আঁইশ দিয়ে ঢাকা, দুটো চোয়ালেই দাঁত
আছে। পিঠের পাখনাযুক্ত কাঁটাগুলো ধারালো। থাই কৈ মাছ কানকো দিয়ে মাটিতেও চলাচল করতে পারে। পায়ে কালো ফোঁটা থাকে ।
চাষের সুবিধা :
ক) মাছটি এ দেশের পরিবেশ সহনশীল ।
খ) অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায় ।
গ) গভীর অগভীর ছোট-বড় সব ধরনের জলাতে চাষ করা যায় ।
ঘ) অতিরিক্ত শ্বাস যন্ত্র থাকায় স্বল্প অক্সিজেনেও বেঁচে থাকতে পারে ।
৫) মাছ ধরার পরে অনেক সময় বেঁচে থাকতে পারে বলে জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করা যায় ।
চ) চাষের ৩-৪ মাসের মধ্যে বাজারজাত করা যায়।
ছ) রোগীর পথ্য হিসেবে এ মাছ অত্যন্ত সমাদৃত ।
প্রাপ্তি স্থান :
বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, নেপাল, শ্রীলংকা, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে পাওয়া যায় । বাস স্থান : পুকুর ডোবা নালা, নর্দমা, হাওড়-বাঁওড় ইত্যাদি জলাশয়ে পানির মধ্যে ও নিচু স্তরে বাস করে ।
রোগ বালাই : থাই কৈ মাছের দেহে ও লেজে বিভিন্ন ছত্রাক ও ক্ষত রোগের সৃষ্টি হয় । শীতকালে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করলে গরমে তেমন কোনো রোগ দেখা যায় না ।
খাদ্য :
ইহা ভাসমান পিলেট খাবার বেশি পছন্দ করে । তাবে ছোট অবস্থায় অতি ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী ও তাদের শুককীট, শৈবল এবং পুকুরের তলায় সঞ্চিত জৈব পদার্থ খায় ।
প্রজনন :
থাই কৈ মাছ এক বছরেই প্রজননক্ষম হয়। বর্ষাকাল এ মাছের প্রজনন সময়। এ মাছ ধানক্ষেত
পুকুর, ডোবা নালা, খাল ও বিলে প্রজনন করে। কৃত্রিম উপায়েও মাছের সফল প্রজনন করানো সম্ভব
হয়েছে । কৈ মাছের ডিমের পরিমাণ ৪,০০০ থেকে ১২০০০ হয়ে থাকে ।
আহরণ প্রক্রিয়া :
ফাঁস জাল, খেপলা জাল, ছিপ বড়শি বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ যেমন: চারো, আরিন্দা প্রভৃতি যারা থাই কৈ মাছ আহরণ করা যায়। তবে পুকুর শুকিয়ে আহরণ করাই উত্তম ।
বাজারজাতকরণ :
১০ সে. মি. বড় হলেই কৈ মাছ জালের সাহায্যে অথবা সেচের মাধ্যমে ধরা যায়। এ মাছ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে এবং বিদেশে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায় ।
থাই কৈ মাছের ব্রুড ব্যবস্থাপনা : বর্তমানে থাই কৈ মাছের ব্যাপক চাহিদার কারণে প্রথম দিকে বিদেশ থেকে উচ্চ মূল্যে পোনা আমদানি করা হলেও এখন দেশেই অনেকগুলো হ্যাচারিতে থাই কৈ মাছের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে । দ্রুত বর্ধনশীল ও ভালো গুণ সম্পন্ন পোনা পাওয়ার জন্য ব্রুড মাছের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা অবশ্যক ।
ব্রুড মাছ ব্যবস্থাপনার কৌশল
১. মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা
২. মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা
৩. মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
১। মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা :
ক) থাই কৈ মাছের ব্রুড চাষের ক্ষেত্রে পুকুর নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সহজে পানি সরবরাহ এবং নিষ্কাশন করা যায় এবং তলদেশে জৈব পদার্থের পরিমাণ কম এরূপ বেলে, বেলে-দোঁয়াশ মাটির পুকুর এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হয় । নিজস্ব উর্বরা শক্তি কম আছে এরূপ পুকুরের পানি দূষণ সমস্যা কম হয়ে থাকে । বিশেষ করে ধান ক্ষেতকে অগভীর জলাশয়ে রূপান্তর করে বর্তমানে যে মাছ চাষ করা হচ্ছে, সে ধরনের জলাশয় নির্বাচন করা যেতে পারে। তবে পুকুরটিতে যাতায়াত ব্যবস্থা উত্তম হবে এবং পানিতে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো ও বাতাস প্রবাহের জন্য খোলামেলা স্থানে হতে হবে । মজুদ পুকুর ১০-২০ শতাংশ হলেই ভালো ।
খ) সঠিকভাবে পুকুরের পাড় ও তলা ঠিক করতে হবে । ভারি বর্ষণ হলে যাতে কৈ মাছ বাইরে চলে যেতে না পারে সেজন্য পুকুরের চতুর্দিকে বাঁশের বানা চাটাই বা ঘন মেস সাইজের নাইলন সুতার জাল দিয়ে ২-৩ ফুট উঁচু করে ঘিরে দিতে হবে।
গ) সব ধরনের জলজ আগাছা দূর করতে হবে। পুকুরের পাড়ে বড় গাছ পালা থাকলে তার ডাল ছেঁটে দিতে হবে ।
ঘ) রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করতে হবে। বিভিন্নভাবে এটা দূর করা গেলেও পুকুর শুকালেই ভালো ফল
পাওয়া যায়।
ঙ) চুন প্রয়োগ : পুকুর থেকে পানি নিষ্কাশন করে মাটি ভিজা থাকা অবস্থায় চুন প্রয়োগ করতে হবে । প্রতি শতাংশে
১ কেজি হারে চুন আগের দিন ভিজিয়ে রেখে পরের দিন রৌদ্রময় সময়ে সারা পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে ।
চ) সার প্রয়োগ : পুকুরের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য ও প্রাকৃতিক খাদ্যের জন্য চুন প্রয়োগের ৭ দিন পর নিম্ন বর্ণিত হারে সার প্রয়োগ করতে হয়।
২। মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা :
ক) ব্রুড মাছ সংগ্রহ : সরাসরি থাইল্যান্ড থেকে অথবা ব্রুড ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করতে হয় ।
খ) শোধন করা : থাই কৈ মাছের ব্রুড বাহির থেকে সংগ্রহ করলে পুকুরে মজুদের আগে ১০০-১৫০ পি পি এম পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা লবণ জলে গোসল দিয়ে মজুদ করতে হবে।
গ) মজুদ ঘনত্ব : সুষম পরিপত্ত্ব ব্রুড পেতে হলে প্রতি শতাংশে ৪০-৫০টি থাই কৈ মাছ মজুদ করা যেতে পারে ।
৩। মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা :
ক) প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা ও সার প্রয়োগ :
যদিও থাই কৈ মাছ সাধারণত ভাসমান ও ডুবন্ত পিলেট খাদ্য পছন্দ করে তবুও খরচ কামানোর জন্য প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরির জন্য নিম্নোক্ত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণভাবে প্রতি সপ্তাহে প্রতি শতাংশে ১.৫-২ কেজি গোবর ৪০-৫০ গ্রাম ইউরিয়া ২০-২৫ গ্রাম টিএসপি সার একত্রে গুলে প্রয়োগ করা
যেতে পারে ।
খ) সম্পূরক খাদ্য:
সাধারণত থাই কৈ মাছ চাষে ভাসমান ও ডুবন্ত পিলেট খাবার (৩০-৩৫% আমিষসমৃদ্ধ) প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায় । কারণ থাই কৈ মাছ এই ধরনের খাবার খেতে খুব পছন্দ করে । পিলেট খাবার পানিতে সহজে গলে না খাদ্যের অপচয় কম হয় এবং পানি সহজে নষ্ট হয় না । বাজারের পিলেট খাবারের পুষ্টিমান ঘোষণার সাথে সব সময় ঠিক থাকে না।
মাছের বর্ধন ভালো পেতে খাদ্য উপকরণসমূহ বাজার থেকে কিনে নিজস্ব পিলেট মেশিন দ্বারা খাদ্য তৈরি করা সবচেয়ে নিরাপদ। এ ক্ষেত্রে থাই কৈ মাছের জন্য নিম্ন হারে খাদ্যের উপকরণ (Composition) মিশিয়ে খাদ্য প্রস্তুত করা যেতে পারে :
১. ফিশমিল বা মৎস্য চূর্ণ ৫০%
২. সয়াবিন চূর্ণ-১০%
৩.সরিষার খৈল-১০%
৪. অটোকুঁড়া-২০%
৫. ভুট্টা চূর্ণ-০৯%
৬. ভিটামিন প্রিমিক্স-১%
মজুদকৃত ব্রুড মাছের দৈহিক ওজনের ৫-৬% হারে দিনে ২বার প্রয়োগ করতে হবে।
গ) পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ : যেহেতু থাই কৈ মাছ সম্পূরক খাদ্যের উপর নির্ভরশীল, তাই অনেক সময় পুকুরের পানি দূষিত হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পুকুরের ১৫-২০% পানি পরিবর্তন করে দিলে
ভালো হয় ।
ঘ) হররা টানা : সপ্তাহে একবার জাল বা হররা টেনে পুকুরের তলদেশের গ্যাস দূর করতে হবে ।
ঙ) স্বাস্থ্য পরীক্ষা : মাছ রোগাক্রান্ত হলে তা ডিমের পরিপক্বতার উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। তাই মাছ যাতে রোগাক্রান্ত না হয় সে দিকে লক্ষ রাখা উচিত পানি দূষিত হলে থাই কৈ মাছের দেহে ও বিভিন্ন ছত্রাক ও ক্ষত রোগের সৃষ্টি হয় । ছত্রাকজনিত রোগের জন্য ম্যালাকাইট গ্রীন ২ মিলি গ্রাম/লিটার/সপ্তাহে এভাবে সপ্তাহে একবার মোট তিন সপ্তাহ প্রয়োগ করতে হবে।
ক্ষত রোগের জন্য অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ১০০ মিলি গ্রাম/কেজি খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। তবে রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়াই শ্রেয় । এ ক্ষেত্রে পানি দূষিত হওয়ার সাথে সাথে প্রতি শতাংশে ২৫০ গ্রাম হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে । ব্রড ব্যবস্থাপনার সকল ধাপগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করা সফলভাবে হ্যাচারি পরিচালনার জন্য অপরিহার্য । কোনো কারণে ব্রুড ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি হলে হ্যাচারি পরিচালনা সম্পূর্ণ অলাভজনক হয়ে উঠতে পারে ।
থাই কৈ মাছের প্রণোদিত প্রজনন :
থাই কৈ মাছের প্রণোদিত প্রজননের ধাপসমূহ নিম্নে দেওয়া হলো :
১। ব্রুড মাছ সংগ্রহ : সরাসরি থাইল্যান্ড থেকে অথবা ব্রুড ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করতে হয়। ব্রুড বিনিময়ের মাধ্যমেও ব্রুড সংগ্রহ করা যেতে পারে ।
ব্রড মাছ পালন :
বাছাইকৃত ব্রুড মাছকে ভালো পরিবেশে উৎপাদনশীল পুকুরে যত্ন সহকারে পালন করতে হবে । এক্ষেত্রে পুকুরের আয়তন ২০ শতাংশে হলে ভালো হয় । সুষম ও পরিপত্ত্ব ব্রুড পেতে হলে প্রতি শতাংশে ৪০-৪৫ টি থাই কৈ মজুদ করতে হয় । থাই কৈ মাছ সাধারণত ভাসমান ও ডুবন্ত পিলেট খাবার (৩০-৩৫% আমিষ সমৃদ্ধ) খেতে পছন্দ করে। থাই কৈ মাছের জন্য নিম্ন হারে খাদ্যের উপকরণ (Composition) মিশিয়ে খাদ্য প্রস্তুত করা যেতে পারে ।
১. ফিশমিল বা মৎস্য চূর্ণ-৫০%
২. সয়াবিন চূর্ণ-১০%
৩. সরিষার খৈল-১০% ৪. অটোকুঁড়া-২০%
৫. ভুট্টা চূর্ণ-০৯%
৬. ভিটামিন প্রিমিক্স- ১%
মজুদকৃত ব্রুড মাছের দৈহিক ওজনের ৫-৬% হারে দিনে ২ বার প্রয়োগ করতে হবে ।
ব্রুড মাছ বাছাই: মাছ প্রজনেনর আগে সঠিক ভাবে ব্রুড বাছাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিম্নে পুরুষ ও স্ত্রী মাছের পার্থক্য দেওয়া হলো :
হরমোন : থাই কৈ মাছের প্রণোদিত প্রজননের জন্য সাধারণত পিটুইটারি গ্লান্ড বা পিজি ব্যবহার করা হয়। হরমোনের মাত্রা : পিজি বা হরমোনের মাত্রা নির্ভর করে ব্রুড মাছের ডিম্বাশয়ের পরিপক্বতা প্রজনন ঋতু ও তাপমাত্রার উপর প্রজননের জন্য স্ত্রী মাছের জন্য সাধারণত ৬-৮ মি. গ্রা. কেজি দেহ ওজন ও পুরুষ মাছের জন্য ২ মি. গ্রা. তবে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় কোনো প্রকার হরমোন প্রয়োগ না করলেও তারা ডিম দেয় ।
হরমোনের দ্রবণ তৈরি :
মধ্যম আকারের একটি সংরক্ষিত গ্লান্ডের ওজন ধারা হয় ২.০-২.৫ মি. গ্রাম । মাছের ওজনের আনুপাতিক হারে গ্লান্ড নিতে হবে । গ্লান্ডগুলোকে টিস্যু হোমোজিনাইজার বা মর্টারে ভালোভাবে গুঁড়ো করে ডিস্টিলড ওয়াটার অথবা ০.৫ – ০.৭% লবণ পানি দিয়ে (রাসায়নিকভাবে বিশুদ্ধ ০.৫-০.৭ গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইডে ডিস্টিলড ওয়াটার) মিশিয়ে ১০০ মি. লি. (মি.লি. বা সিসি) করলে ০.৫-০.৭% লবণ দ্রবণ তৈরি হবে) দ্রবণ তৈরি করতে হবে । গ্লান্ডের দ্রবণ পরিমাণ প্রতি কেজি মাছের জন্য ০.২-০.৫ মি. লি. এর বেশি হবে না ।
ইনজেকশন প্রয়োগ :
থাই কৈ মাছের বক্ষ পাখনার গোড়া নরম জায়গায় ইনজেকশন প্রয়োগ করতে হয় ।
প্রজনন :
ইনজেকশন দিয়ে স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে গ্লাসনাইলন কাপড়ের হাপাতে রাখতে হবে এবং ঝর্ণার ব্যবস্থা করতে হবে । ৮-৯ ঘণ্টার মধ্যে স্ত্রী মাছ ডিম দিয়ে থাকে এবং পুরুষ মাছ মিল্ট দিয়ে ডিম নিষিক্ত হয়ে থাকে । ডিমগুলো খুবই ছোট ও পানিতে ভাসমান অবস্থায় থাকে ।
ডিম ফুটানো
সাধারণ ১৬-২০ ঘণ্টা পর ডিম ফুটে রেণুপোনা বেড় হয় । ডিম দেওয়া শেষ হয়ে গেলে মাছগুলোকে হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
থাই কৈ মাছের রেণুর পরিচর্যা ও খাদ্য প্রয়োগ :
ডিম থেকে রেণু বের হওয়ার পর হাপাতেই ২-৩ দিন রেণুগুলোকে রাখতে হবে। রেণুগুলো আকারে খুবই ছোট হয় । প্রথম অবস্থায় হাঁস/মুরগির সিদ্ধ ডিমের কুসুম খাবার হিসেবে দিতে হবে । ২-৩ দিন খাওয়ানোর পর রেণু নার্সারি পুকুরে দিতে হবে । হাপাতে বেশি দিন রাখলে মৃত্যুর হার বেড়ে যায় ।
থাই কৈ মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনা লাভজনকভাবে মাছ চাষ করতে হলে ভালো গুণগতমান সম্পন্ন দ্রুত বর্ধনশীল জাতের পোনা খুবই জরুরি। আর তা পেতে হলে নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ সঠিকভাবে মেনে চলতে হবে ।

(ক) মজুদ পূর্ব ব্যবস্থাপনা :
১. নার্সারি পুকুরের পাড় ও তলা সুন্দরভাবে ঠিক করতে হবে। যাতে ভেতর থেকে বাহিরে পানি না যেতে পারে বা বাহির থেকে পানি না আসতে পারে । নার্সারি পুকুরের আয়তন ১৫-২০ শতাংশ হলেই চলে । বর্ষাকালে যাতে থাই কৈ মাছ বাহিরে চলে যেতে না পারে। সে জন্য পুকুরের চারদিকে জাল দিয়ে রাখতে হবে।
২. জলজ আগাছা দূর করা : জলজ আগাছা সূর্যের আলো পড়তে বাঁধা দেয় ও পুষ্টি শোষণ করে নেয় ।
৩. রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা : তিন ভাবে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা যায়। তবে নার্সারি পুকুরের ক্ষেত্রে, পুকুর শুকালে ভালো হয় ।
৪. পানি সরবরাহ: চুন প্রয়োগের আগে দূষণমুক্ত পানি সরবরাহ করতে হয় ।
৫. চুন প্রয়োগ : প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হয়। পরিমাণমত চুন আগের দিন মাটির চাড়িতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন রৌদ্রোজ্জ্বল সময়ে ছিটিয়ে দিতে হয় ।
৬. সার প্রয়োগ : জৈব সার প্রতি শতাংশে ১০-১৫ কেজি, খৈল প্রতি শতাংশে আধা কেজি প্রয়োগ করতে হবে । কারণ জৈব সার প্রয়াগে প্রচুর জু-প্লাঙ্কটন উৎপাদন হয়, যা পোনার প্রিয় খাদ্য ।
৭. জলজ পোকা দমন : হাঁস পোকা, ক্লাডোসেরা কপিপোডা ও অন্যান্য কয়েক ধরনের জলজ পোকা রেণু পোনার জন্য ক্ষতিকর । রেণু পোনা পুকুরের ছাড়ার ২৪-৪৮ ঘণ্টা পূর্বে প্রতি ঘন মি. পানির জন্য আধা মি.লি. হারে সুমিথিয়ন বা এক গ্রাম হারে ডিপটারেক্স প্রয়োগ করতে হবে ।
২। মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা :
হ্যাচারির থেকে অক্সিজেন ব্যাগেই রেণু পরিবহন করা উচিত। ৯০×৫০ সে. মি. পলিথিন ব্যাগেই ৮-১০ ঘণ্টা দূরত্বে ১২৫ গ্রামের বেশি রেণু পরিবহন করা উচিত। সাধারণত প্রতি প্যাকেটের জন্য ২ টি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা উচিত কোনো কারণে যদি একটি ছিদ্র হয়ে যায় । দ্বিতীয়টি পানি, অক্সিজেন ও পোনা রক্ষা করতে সাহায্য করবে। পরিবহনকালে ব্যাগে যাতে কোনো ধরনের আঘাত না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে ।
আগুনের উৎস থেকে ব্যাগ সাবধান রাখতে হবে। রেণু ছাড়ার পূর্বেও পুকুরের পানির তাপমাত্রার সাথে রেণু বহনকারী ব্যাগে ও বা পাতিলের পানির তাপমাত্রার সমতা আনতে হবে ব্যাগের পানি ও পুকুরের পানি আস্তে আস্তে বদল করে তাপমাত্রার ব্যবধান ধীরে ধীরে কমাতে হবে। এ কাজটি ১৫-২০ মিনিট করতে হবে ।
তাপমাত্রা সমতায় এলে ব্যাগের বা পাতিলের এক অংশ পানিতে ডুবিয়ে বাহির থেকে আস্তে আস্তে ভিতরের দিকে পানির স্রোত দিলে ধীরে ধীরে রেণু স্রোতের বিপরীত বেরিয়ে আসবে। সাধারণত পাড়ের কাছাকাছি রেণু ছাড়তে হয় । ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় রেণু ছাড়তে হয় ।
৩। মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা :
রেণু ছাড়ার পরদিন গামছা দিয়ে টেনে রেণুর বাঁচার হার পর্যবেক্ষণ করতে হবে । পুকুরের পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হওয়ার জন্য নিম্মোক্ত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। সারের মাত্রা নিম্নরূপ :
মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। পোনা ছাড়ার পর প্রতিদিন দৈহিক ওজনের শতকরা ১০-১২% হারে (চালের কুঁড়া ৪০% সরিষার খৈল ৩০% ও ফিস ফিল্ম ৩০% মিশণ করে বল আকারে প্রয়োগ করতে হবে অথবা সৌদি-বাংলা চিংড়ির নার্সারি ফিড) খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সপ্তাহে অন্তত একবার হররা টেনে পুকুরের তলদেশের বিষাক্ত গ্যাস দূর করতে হবে। ২০-২৫ দিন পর পর জাল টেনেমাছের স্বাস্থ্য বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করতে হব।
এক্ষেত্রে পোনাকে জাল টেনে পানির ঝাঁপটা দিয়ে পোনাৰ পেট খালি করে ফেলতে হবে। এবং বিক্রির দুই এক দিন আগে খাদ্যে প্রয়োগে বন্ধ করে দিতে হবে। থাই কৈ মাছ বিশেষত বড় কৈমাদের চাহিদা বিত্তবান শ্রেণির কাছে অত্যন্ত বেশি। রোগীর পথ্য হিসেবে এ মাছের চাহিদা রয়েছে এবং বেশ চড়া দামে থাই কৈ-এর পোনা সরবরাহ করার জন্য উপরোক্ত ধাপগুলো মেনে চলতে হবে ।
শিং মাছের প্রনোদিত
শিং মাছ এদেশের আরেকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মাছ। এটি ও সুস্বাদু, পুষ্টিকর কম চর্বিযুক্ত মাছ। জ্যান্ত অবস্থার এ মাছের বাজারজাত করা হয় বলে রোগীর পথ্য হিসেবে এ মাছের চাহিদা প্রচুর। সাম্প্রতিক সময়ে শিং মাছের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এই প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ার ফলে দেশে শিং মাছের পোনা প্রাপ্তি ও চাষের পথ সুগম হয়েছে।
১। ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা। সাধারণত ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারীর মধ্যে সুস্থ্য সবল ও পরিপত্ব ব্রুড মাছ সংগ্রহ করতে হবে। পুকুরে প্রতি শতাংশে ৫০-৬০ টি ব্রুড পিং রাখা যায়। মাছের মোট ওজনের ৫-৬% সম্পূরক খাবার দিতে হবে ।
২.কৃত্তিম প্রজনন :
জী মাছকে ১০০-১২৫ মিলিগ্রাম পিজি/কেজি হিসেবে একটি ইনজেকশন প্রয়োগ করা যায়। তবে স্ত্রী মাছকে প্রথম ইনজেকশন ৫০ মিলিগ্রাম পিজি/কেজি হিসেবে প্রয়োগ করে ৬-৮ ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছকে ১০০ মিলিগ্রাম পিজি/কেজি হিসাবে ২য় ইনজেকশন প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। স্ত্রী মাছের ২য় ইনজেকশনের সময় পুরুষ মাছকে ৫০ মিলিগ্রম পিজি/কেজি হিসাবে প্রয়োগ করলে অধিক পরিমাণে মিন্ট পাওয়া যায়। জী মাছকে ২য় ইনজেকশন দেওয়ার ৯-১২ ঘণ্টার মধ্যে ডিম দিয়ে থাকে ।
৩। ডিমের পরিচর্যা।
শিং মাছের ডিম আঠাল হওয়ার কারণে ট্রে অথবা সিস্টার্নে ৪-৬ ইঞ্চি পানির গভীরতায় ডিমগুলো ট্রে/ সিস্টানের তলদেশে ঘন মেস সাইজের মশারি কাপড়ের ফ্রেমে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং ঝরনা / ০.৫ ইঞ্চি
প্লাস্টিক পাইপ সূক্ষ্ম ছিদ্র করে বর্ণার ব্যবস্থা করতে হবে। ট্রে/ সিস্টার্নে পানি নির্গমন মুখে গ্রাস নাইলন কাপড় দিয়ে দিতে হবে যাতে ডিম ফুটে রেণু বের হলে চলে যেতে না পারে। রেণু পোনা বের হলে ট্রে/ সিস্টার্নের তলায় ডিমের খোসাসহ অন্যান্য ময়লা সাইফনিং করে পরিষ্কার করে দিতে হবে। ট্রে বা সিস্টার্সে রেণু পোনা যাতে ফাঙ্গাসে আক্রান্ত না হয় সে জন্য মিথিলিন ব্লু বা ম্যালাকাইট গ্রীন ব্যবহার করা যেতে পারে । ২৮-৩২ ঘণ্টা পর নিষিক্ত ডিম ফুটে রেণু পোনা বের হয় ।
৪। পোনার পরিচর্যা :
ডিম ফোটার ৩-৪ দিন পর রেণু পোনাকে ডিমের কুসুম, টিউবিফেক্স, জুপ্লাঙ্কটন বা আর্টিমিয়া খাবার হিসেবে দিতে হবে। ট্রে বা সিস্টার্নের কর্নারের কিছু অংশ কাল পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। কারণ রেণু পোনা অন্ধকার জায়গা পছন্দ করে এবং দিনের বেলায় অন্ধকার জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে। রাতে সমস্ত ট্ৰে ৰা সিস্টার্নে বিচরণ করে এবং রাতে খাবার খেতে বেশি পছন্দ করে। হ্যাচারিতে ৮-১০ দিন যত্ন সহকারে প্রতিপালনের পর ভিম পোনা থেকে ধানী পোনার পরিণত হয় ।
৫। নার্সারির পুকুরের যত্ন
প্রথমে একটি পোনা রাখার নার্সারি পুকুর তৈরি করে রাখতে হবে। ৮-১০ দিনের ধানী পোনা প্রতি শতাংশে ১০-১২ হাজার মজুদ করা যেতে পারে। প্রতিদিন গোনার মোট ওজনের বিগুণ হারে ২-৩ বার নার্সারি খাবার দিতে হবে। ধানী পোনার ছাড়ার ৩০-৪৫ দিনের মধ্যে ২-৩ ইঞ্চি চারা পোনায় পরিণত হয় ।
দেশি মাগুরের প্রণোিদেত প্রজনন
মাগুর মাছ এদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় মাছ। এটি সুস্বাদু পুষ্টিকর, কম চর্বিযুক্ত মাছ। জীবিত অবস্থার বাজারজাত করা হয় বলে এ মাছের বাজার মুল্য তুলনামূলকভাবে বেশি। পূর্বে খাল বিলে পুকুর ডোবা পতিত জলাশয়সমূহে প্রচুর মাগুর মাছ পাওয়ার যেত। কিন্তু বর্তমানে এই মাছটি বিলুপ্তির পথে। প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র সমূহের পরিবেশ বিপর্যয়ই মাগুর মাছের বর্তমান অপ্রতুলতার প্রধান কারণ। বিজ্ঞানীরা দেশীয় মাগুর মাছের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ পদ্ধতির প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফলতা লাভ করেছেন ।
১। প্রজননক্ষম মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা :
‘ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে সুস্থ ও সবল ব্রুড মাছ সংগ্রহ করতে হবে । পুকুরের প্রতি শতাংশে চল্লিশটি মাছ ‘মজুদ করা যায় । মাছের দেহ ওজনের ৫-৬% হারে সম্পূরক খাবার প্রয়োগ করতে হবে ।
মাছের ভ্রূণের পরিস্ফুটন ও শুকের বৃদ্ধি
২। কৃত্রিম প্রজনন ।
স্ত্রী মাছকে ১০০-১২৫ মিলি গ্রাম পিজি / কেজি হিসেবে একটি মাত্র ইনজেকশন প্রয়োগ করা যায়। তবে স্ত্রী মাছকে ১ম ইনজেকশন ৫০মি.গ্রা. পিজি/কেজি হিসেবে প্রয়োগ করে ৬-৮ ঘণ্টা পর ১০০ মি.গ্রা. পিজি/কেজি হিসেবে ২য় ইনজেকশন প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
শ্রী মাছের ২য় ইনজেকশনের সময় পুরুষ মাছকে ৫০ মি.গ্রা. পিজি/কেজি হিসেবে প্রয়োগ করলে অধিক পরিমাণ মিন্ট পাওয়া যায়। স্ত্রী মাছকে ২য় ইনজেকশন দেওয়ার ৯-১২ ঘণ্টার মধ্যে ডিম দিয়ে থাকে। স্ত্রী মাছের ডিম দেওয়ার সময় পুরুষ মাছের পেট কেটে শুক্রশয় বের করে কাচি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ০.৯% লবণ দ্রবণে মিশিয়ে শুক্রাণুর প্রবণ তৈরি করতে হবে। স্ত্রী মাছের পেটে চাপ দিয়ে ডিম বের করে শুকনা খালা বা পাত্রে সংগ্রহ করে তার উপর শুক্রাণুর দ্রবণ মিশিয়ে ঐ ডিম নিধি করা হয়।
৩। ডিমের পরিচর্যা।
মাগুর মাছের ডিম আঠালো হওয়ার কারণে ট্রে অথবা সিস্টার্সে ৪-৬ ইঞ্চি পানির গভীরতায় ডিমগুলো ট্রে বা সিস্টার্নের মধ্যে ড্রেন তৈরি করে ঘন মশারির কাপড়ের নেটে ছড়িয়ে দিতে হয় এবং ডিমগুলোর উপর ঝর্ণার ব্যবস্থা করতে হয়। ট্রে অথবা সিস্টার্নে পানি নির্গমন মুখে গ্লাসনাইলন কাপড় দিয়ে এমনভাবে আটকাতে হবে যাতে ডিম ফুটে রেণু বের হয়ে যেতে না পারে।
রেণু পোনা বের হলে ট্রে অথবা সিস্টার্নের তলায় ডিমের খোসাসহ অনান্য ময়লা সাইফনিং করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। ট্রে বা সিস্টার্নে রেণু পোনা যাকে ফাঙ্গাসে আক্রান্ত না হয় সে জন্য মিথিলিন ব্লু বা ম্যালাকাইট গ্রীন ব্যবহার করা যেতে পারে। ২৮-৩২ ঘণ্টা পর নিষিক্ত ডিম ফুটে রেণু পোনা বের হয় ।
৪। পোনার পরিচর্যা :
ডিম ফোটার ৩-৪ দিন পর রেণু পোনাকে ডিমের কুসুম, টিউৰিফেক্স জুপ্লাঙ্কটন বা আর্টিমিয়া খাবার হিসেবে দিতে হবে। ট্রে বা সিস্টার্নের কর্নারের কিছু কালো পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে কারণ রেণু অন্ধকার জায়গা পছন্দ করে এবং দিনের বেলায় অন্ধকার জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে। রাতে সমস্ত ট্রে বা সিস্টার্নে বিচরণ করে এবং রাতে খাবার খেতে এরা বেশি পছন্দ করে। হ্যাচারিতে ৮-১০ দিন যত্ন সহকারে প্রতিপালনের পর ডিম পোনা থেকে ধানী পোনায় পরিণত হয়।
৫। নার্সারি পুকুরের যত্ন :
প্রথমেই একটি পোনা রাখার নার্সারি তৈরি করে রাখতে হবে। ৮-১০ দিনের ধানী পোনা প্রতি শতাংশে ৮- ১০ হাজার মজুদ করা যেতে পারে। প্রতিদিন গোনার মোট ওজনের দ্বিগুণ হারে ২-৩ বার নার্সারি খাবার দিতে হবে। ধানী পোনা ছাড়ার ৩০-৪৫ দিনের মধ্যে ৩-৪ ইঞ্চি আকারের চারা পোনায় পরিণত হয়।
আরও দেখুন: