আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় টিনজাত, লবণায়ন এবং ধূমায়িত প্রক্রিয়ায় মাছ সংরক্ষণ – যা মাছ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এর অন্তর্ভুক্ত।
টিনজাত, লবণায়ন এবং ধূমায়িত প্রক্রিয়ায় মাছ সংরক্ষণ
টিনজাতকরণ বা ক্যানিং খাদ্য সংরক্ষণের একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। উন্নত দেশে বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ইত্যাদি দেশে মাছ সংরক্ষণে টিনজাতকরণ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত । মাছ টিনজাতকরণ হলো সংরক্ষণের এমন একটি প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় মাছকে সম্পূর্ণরূপে বায়ুশূন্য পাত্রে আবদ্ধ করে অতি উচ্চ তাপমাত্রা প্রয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয় । বাণিজ্যিকভাবে জীবাণুমুক্তকরণ বলতে বুঝায়, ততটুকু জীবাণুমুক্তকরণ যার ফলে সব ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া মারা যায় বা ধ্বংস হয়।
টিনজাতকরণ বা ক্যানিং -এর উদ্দেশ্য হলো কোনো খাদ্যদ্রব্যকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গুদামজাত করা যাতে ঐ নির্দিষ্ট সময়ের পরেও ঐ খাদ্যদ্রব্য রুচিকর ও খাওয়ার উপযোগী থাকে। এই পদ্ধতিতে মাছকে অতি উচ্চ তাপে বায়ুশূন্য পাত্রে সংরক্ষণ করা হয় বলে মাছের নিজস্ব এনজাইম এবং ব্যাকটেরিয়া মাছকে পচাতে পারে না। ফলে মাছ দীর্ঘদিন সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে। টিনজাতকৃত মাছের গুণগতমান ২-৫ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে ।
টিনজাতকরণ পদ্ধতি :
টিনজাতকরণ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। নিম্নলিখিত ধাপসমূহ সম্পন্ন করার মাধ্যমে মাছ টিনজাত করা হয়।
কাঁচামাল নির্বাচন :
প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত মাছ যত ভালো হবে প্রক্রিয়াজাত দ্রব্য তত ভালো হবে। বড়, মাংসল এবং চর্বিযুক্ত টাটকা মাছ টিনজাতকরণের জন্য বেশি উপযোগী। টিনজাতকরণের পূর্বে মাছের আঁইশ, পাখনা, নাড়িভুঁড়ি, মাথা ইত্যাদি অপসারণের পর মাছকে টুকরা টুকরা করা হয়। বড় মাছের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ড ফেলে দেয়া হয় । কাটা মাছকে ক্লোরিনযুক্ত পানি দ্বারা ধোয়া হয় । ফলে অণুজীবের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং রক্ত ও অন্যান্য ময়লা দূরীভূত হয়। বড় মাছ, যেমন- টুনা মাছের ক্ষেত্রে টিনে ভরার পূর্বে মাছের টুকরাগুলোকে সিদ্ধ করা হয়। এতে মাছ থেকে কিছুটা পানি ও তেল বের হয়ে যায় এবং মাংসপেশি নরম হয়।
টিন বা কৌটা ভর্তিকরণ :
কৌটা হিসেবে টিনের পাত্রের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ্যালুমিনিয়াম বা কাঁচের পাত্র ব্যবহৃত হয়। কৌটাকে হাত দ্বারা বা মেশিনের সাহায্যে পূর্ণ করা হয়। যন্ত্রের চেয়ে হাত দ্বারা কৌটা ভর্তি করলে ভালো হয়। তবে হাত দ্বারা কৌটা ভর্তি শ্রমসাধ্য। খুব সতর্কতার সাথে কৌটার মধ্যে মাছ পূর্ণ করা উচিত যেন কৌটায় কোনো খালি জায়গা না থাকে। সাধারণত কৌটার উপরিভাগে সামান্য পরিমাণ ফাঁকা জায়গা রাখা হয় যাতে পরবর্তী প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় গ্যাস উৎপন্ন হলে ঐ ফাঁকা জায়গায় জমা হয় । সাধারণত নিষ্ক্রিয় গ্যাস দ্বারা এই ফাঁকা জায়গা পূর্ণ করা হয় ।

বিভিন্ন উপাদান সংযোজন :
সাধারণত খাদ্যের বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ বৃদ্ধির জন্য মাছের উপরিভাগে বিভিন্ন ধরনের উপাদান যোগ করা হয়। যেমন- লবণ দ্রবণ, গ্লুটামেট, তেল, টমেটো সস, বিভিন্ন ধরনের মসলা ইত্যাদি ।
বায়ুশূণ্যকরণ ও কৌটাবদ্ধকরণ :
কৌটার স্ফীতি, জারন এবং টিনের ক্ষয়রোধ করার জন্য কৌটাকে বায়ুশূন্যকরণ আবশ্যক । কৌটাকে বায়ুশূন্য ও বদ্ধকরণ একই সাথে করা হয়। সাধারণত দুইভাবে বায়ুশূন্য ও বন্ধ করা হয়।
i) কৌটাস্থিত দ্রব্যকে উত্তপ্ত করে এবং
ii) যান্ত্রিকভাবে ।
ধৌতকরণ :
বদ্ধকৃত কৌটার গায়ে লেগে থাকা ময়লা অপসারণ করার জন্য কৌটা ধৌতকরণ আবশ্যক । সোডিয়াম ফসফেট মিশ্রিত গরম পানির (৮০ ডিগ্রী সে.) মধ্য দিয়ে কৌটাগুলোকে অতিক্রম করার মাধ্যমে ধৌত করা হয়।
প্রক্রিয়াকরণ ও উত্তপ্তকরণ :
তাপ প্রয়োগ এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো কৌটার খাদ্যকে জীবাণুমুক্ত করা । উচ্চ তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে কৌটাস্থিত খাদ্যকে জীবাণুমুক্ত করা হয়। স্টিলের নেটের তৈরি ট্রে-এর উপর কৌটাগুলো রাখা হয়। এখানে আর্দ্র তাপের মাধ্যমে তাপ প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে সব ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে মারার জন্য ১৫ পাউন্ড/ইঞ্চি চাপে ১২০ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় ৪ মিনিট অথবা ১১৫ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় ১০ মিনিট কৌটাগুলোকে উত্তপ্ত করা হয়। তবে কত সময় ধরে তাপ দিতে হবে তা কৌটার আকার ও মাছের টুকরার পুরুত্বের উপর নির্ভর করে। সাধারণত ৩০ মিনিট তাপ দিতে হয়। অধিক সময় ধরে তাপ দিলে মাছের টুকরাগুলো কুঁচকে যেতে পারে অথবা কৌটার গায়ে লেগে থাকা টুকরার অংশ পুড়ে যেতে পারে ।
ঠাণ্ডাকরণ :
তাপ প্রয়োগের সময় কোনো কোনো উপাদানের দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় যা রোধ করার জন্য দ্রুত ঠাণ্ডা করা প্রয়োজন । ঠাণ্ডা বায়ু বা ঠাণ্ডা পানি প্রবাহ দ্বারা ঠাণ্ডাকরণ করা হয়। তবে এক্ষেত্রে পানিই উত্তম ।
লেবেলিং :
ঠাণ্ডা করার পর কৌটাতে লেবেল লাগানো হয়। লেবেলিং অবশ্যই খাদ্য আইন অনুসারে করা উচিত। টিনজাত দ্রব্যকে সঠিকভাবে এবং সহজেই চেনার জন্য কৌটা লেবেলিং করা হয়। কৌটার লেবেলে নিচে লিখিত বিষয় গুলো উল্লেখ থাকা উচিত ।
(i) দ্রব্যের নাম
(ii) কোড নম্বর
(iii) দ্রব্যের গুণাগুণ
(iv) কৌটাজাতকরণের তারিখ
(v)দ্রব্যের পরিমাণ
(vi) মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ
(vii) কৌটার আকার
(viii) ব্যবহারের নিয়ম
(ix) কোম্পানির নাম
গুদামজাতকরণ :
কৌটাজাতকরণের পর পরই তাৎক্ষণিকভাবে তা বাজারজাত করা উচিত নয় । বেশ কিছু দিন মজুদ করে রাখা উচিত। সংযুক্ত দানাদার লবণ এবং অন্যান্য উপাদান মাছে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ার জন্য কিছু সময় প্রয়োজন। কাঙ্ক্ষিত স্বাদ এবং গন্ধের উন্নয়নের জন্য কৌটাকে কিছু দিন মজুদ করা উচিত সাধারণত সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য ২-৩ সপ্তাহ পরে পরীক্ষা করা উচিত । নিম্ন তাপমাত্রায় মজুদ করলে দ্রব্যের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে ।
আরও দেখুনঃ