মৎস্য প্রজনন

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়- মৎস্য প্রজনন

 মৎস্য প্রজনন

প্রজনন হলো একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো জীব বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একই ধরনের বংশধর তৈরি করে থাকে । আর মাছের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে থাকে। মৎস্য প্রজনন বলতে এমন একটি জৈবিক প্রক্রিয়াকে বুঝায় যার মাধ্যমে মাছ বিলুপ্তি হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একই ধরনের মাছ বা বংশধর তৈরি করে।

মাছ যৌন প্রজনন পদ্ধতিতে প্রজনন করে থাকে। সাধারণত সকল মাছই একটি নির্দিষ্ট প্রজনন চক্র অনুসরণ করে । লাভজনকভাবে মাছ চাষের জন্য দরকার গুণগত মানের পোনা । আর পোনা উৎপাদন প্রক্রিয়া জানার জন্য প্রজনন জীববিদ্যা ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে হবে ।

প্রজনন জীববিদ্যা : মৎস্য বিজ্ঞানের যে শাখায় মাছের প্রজনন বয়স, প্রজনন ঋতু, প্রজনন স্থান, প্যারেন্টাল কেয়ার, ফেকান্ডিটি ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়, তাকে প্রজনন জীববিদ্যা বলে । সফল প্রজননের জন্য উপযুক্ত প্রজনন পরিবেশ যেমন- অক্সিজেন, তাপমাত্রা, খাদ্য, স্রোত প্রভৃতির অনুকূল অবস্থা এবং জলজ পরিবেশ শত্রুমুক্ত হওয়া আবশ্যক ।

প্রজনন বয়স : কোনো কোনো মাছ তাড়াতাড়ি প্রজনন পরিপক্ক হয় আবার অনেক মাছ দেরীতে পরিপক্ক হয় । একই প্রজাতির মাছ উষ্ণ মন্ডলীয় এলাকায় অল্প সময়ে আর শীতপ্রধান অঞ্চলে দেরিতে পরিপক্ব হয়। কমনকাৰ্প আমাদের দেশে প্রথম বছরেই প্রজননক্ষম হয়। পক্ষান্তরে ইউরোপে এরা তিন বা চার বছরে প্রজননক্ষম হয় । একইভাবে চাইনিজ কার্প (গ্রাস কার্প সিলভার কার্প) আমাদের উষ্ণ মণ্ডলীয় অঞ্চলে দুই বা তিন বছরে সাধারণত প্রজননক্ষম হয় অথচ ইউরোপে এদের পরিপক্বতা আসতে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লেগে যায় ।

প্রজননের ঋতু : কিছু কিছু মাছ সারা বছর ধরে প্রজনন করে । প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অনুকূল তাপমাত্রা পেলেই তারা প্রজনন করে, যেমন-তেলাপিয়া, পক্ষান্তরে অনেক মাছ আছে যারা শুধু বছরের নির্ধারিত ঋতুতে প্রজনন করে। এসব মাছের প্রজনন অঙ্গ নির্দিষ্ট সময় আসার সাথে সাথে বেড়ে ওঠে এবং একটা পর্যায়ে এসে সুপ্তাবস্থায় থাকে । প্রজনন ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় আবহাওয়ার অপেক্ষায় এ রকম সুপ্ত অবস্থা কয়েক মাস পর্যন্ত বজায় থাকে ।

যখন আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশ (যেমন- তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, অক্সিজেন, স্রোত প্রভৃতি) সৃষ্টি হয়, তখন সুপ্ত অবস্থা থেকে প্রজনন ঘটানোর জন্য মাছের দেহাভ্যন্তরে ডিম ও শুক্রাণু যথেষ্ট পরিপক্ক হয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সফল প্রজনন ঘটে । মৌসুমি প্রজননকারী মাছের মধ্যে এরকম অনেক মাছ আছে যাদের প্রজনন অঙ্গ বছরের প্রজনন মৌসুম এলেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত এসে থেমে থাকে বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে ।

নদীতে ডিম ছাড়ে এমন মাছ পুকুরে রাখলে প্রজননযোগ্য বয়স হলেও বছরের নির্দিষ্ট মৌসুমে এরা ডিম দেওয়ার উপযুক্ত হয়, কিন্তু মুক্ত জলাশয়ের অভাবে এসব মাছের ডিম আস্তে আস্তে শরীরে মিলিয়ে যায়। প্রজননযোগ্য বয়সের মাছে এরকম প্রতি বছর ডিম আসে এবং উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে তা আবার শরীরেই শোষিত হয়ে যায় ।

প্যারেন্টাল কেয়ার: শত্রুর হাত থেকে ডিম ও বাচ্চাকে রক্ষা করার জন্য মাছের পিতা-মাতার মধ্যে যে অভ্যাস গড়ে ওঠে তাকে প্যারেন্টাল কেয়ার বলে। প্যারেন্টাল কেয়ার বা বাচ্চার প্রতি যত্ন সদ্যপ্রসূত ডিম বা পোনার বেঁচে থাকার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস যা অনেক মাছের মধ্যেই দেখা যায়।

বাচ্চা ফুটে বের হওয়ার পর পর যখন এরা খুব নাজুক ও দুর্বল থাকে, তখন প্রজননকারী স্ত্রী-পুরুষ উভয় মাছ একত্রে এসব বাচ্চার পাহারা দেয় এবং শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। অধিকাংশ মাছই তাদের সদ্যপ্রসূত ডিম ও বাচ্চার যত্ন নেয়। তবে কোনো কোনো প্রজাতিতে প্রত্যক্ষ যত্ন নিতে দেখা যায় আবার কোনো কোনো প্রজাতিতে পরোক্ষভাবে কিছু কিছু যত্ন নেয় ।

 

 মৎস্য প্রজনন

 

প্রত্যক্ষ যত্ন । যেসব প্রজাতির মাছের স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে বা যে কোনো একজন ডিম, রেণু, পোনা বা বাচ্চার যত্ন নেয় বা পাহারা দেয়, তাকে প্রত্যক্ষ যত্ন বলে (Direct Parental Care)। যেমন- তেলাপিয়া, শোল, টাকি, গজার ইত্যাদি ।

পরোক্ষ যত্ন : যে-সব প্রজাতির মাছের প্রজননের সময় নিরাপদ স্থানে প্রজনন করে যেমন বাসা তৈরি করে, ডিম ছাড়ে বা এমন অবস্থায় বা জায়গায় ডিম ছাড়ে যাতে শিকারি বা শত্রুর হাত থেকে নিরাপদ থাকে এরকম যত্নকে পরোক্ষ যত্ন বলে। যেমন- গোরামি।
ফেকান্ডিটি : কোনো মাছ একবারে যত ডিম পাড়ে, তার সংখ্যাকে ফেকাভিটি বলে । বিভিন্ন প্রজাতির মাছের
ফেকাভিটি বিভিন্ন রকম যেমন:

 

 মৎস্য প্রজনন

 

প্যারেন্টাল কেয়ারের সাথে মাছের ডিমের সংখ্যার (ফেকান্ডিটির) সম্পর্ক রয়েছে, যেসব মাছ পরোক্ষভাবে তাদের ডিম বা বাচ্চার যত্ন নেয়, তাদের ফেকাভিটি বা ডিমের সংখ্যা প্রত্যক্ষ যত্নকারী মাছের তুলনায় বেশি। প্রত্যক্ষ যত্নকারী মাছের ডিমের সংখ্যা, যেসব মাছের কোনো প্যারেন্টাল কেয়ার নেই, তাদের তুলনায় অনেক কম । প্রজননের পর ডিম বা বাচ্চার যত্ন নেয় না এমন মাছের ফেকাভিটি বেশি ।

 

 মৎস্য প্রজনন

 

ডিম ও শুক্রাণুর বিকাশ: বিভিন্ন প্রকার মাছ বিভিন্ন বয়সে প্রজনন উপযোগী বা পরিপন্থ হয়। পরিপ মাছের দেহে নির্দিষ্ট প্রজনন মৌসুমের প্রাক্কালে ডিম ও অক্রাণু বিকাশ লাভ করে। মাছের ডিম অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে একটা পর্যায়ে পৌঁছে থেমে থাকে বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, অনুকূল আবহাওয়ার প্রভাবে পুরুষ মাছের উপস্থিতিতে, এরকম সুপ্ত ডিম পরবর্তী পর্যায়ে চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করে প্রজনন ঘটায়। অন্যদিকে প্রতিকূল পরিবেশে অর্থাৎ প্রজনন উপযোগী আবহাওয়া না পেলে এবং পুরুষ মাছের অভাবে এরকম সুপ্ত ডিম মাছের দেহে শোষিত হয়ে যায়।

ডিমের ন্যায় শুক্রাণুও প্রজনন পরিপত্ত্ব মাছের দেহে তৈরি হয়ে শুক্রাশয়ে জমা হয় । এরকম শুক্রাণু প্রয়োজনীয় প্রজনন পরিবেশের অভাবে মাছের দেহে সুপ্ত অবস্থায় থাকে, সুপ্ত থাকা শুক্রাণু এমনিতে স্থির, তবে পানির সংস্পর্শে এলেই সচল হয়ে পড়ে।
মাছের ভ্রূণের পরিস্ফুটন ও শুকের বৃদ্ধি

 

 মৎস্য প্রজনন

 

সচল শুক্রাণু পরিপক্ক ডিমকে নিষিক্ত করার জন্য আধা মিনিট থেকে ১ মিনিট সময়ে পানিতে সাঁতার কাটতে পারে । উপযুক্ত পরিবেশে প্রজনন ঘটার পর পরিপক্ক ডিম পানিতে ছাড়ার সাথে সাথে ডিম ফুটতে থাকে এবং এক মিনিটের মধ্যেই ডিমের মুখ বা ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায়। তাই ১ মিনিট পরে আর কোনো শুক্রাণু ডিমের মাঝে প্রবেশ করতে পারে না।

অর্থাৎ প্রজননের সফলতা নির্ভর করেছে শুক্রাণু কর্তৃক দ্রুত ডিমকে খুঁজে পাওয়ার ওপর শুক্রাণু কর্তৃক ডিমকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনাকে নিষিক্তকরণ বলে । উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এক দিন বা তার কম সময়ের মধ্যে নিষিক্ত ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় ।

মাছের প্রণোদিত প্রজনন :

এদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু মাছ চাষের উপযোগী বিধায় অনাদিকাল থেকে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। ফলে মাছ চাষের চেয়ে আহরণই ছিল এদেশের মাছ প্রাপ্তির প্রধান উৎস। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মনুষ্য সৃষ্টি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ উৎপাদন ও প্রাপ্তি আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়নি ।

ফলে মাছ চাষের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। মাছ চাষের ক্ষেত্রে মূলত ধনী শ্রেণির লোকেরা জেলেদের নিকট থেকে আশ্বিন-কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে রুই জাতীয় মাছের পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে মজুদ করত। এ পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন মাছ চাষ হয়ে আসছিল । ষাটের দশকে মাছের প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি পর্যায়ে ১০১টি মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার স্থাপন করা হয়।

এসব খামারে প্রাকৃতিক উৎস যথা- হালদা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মধুমতি, পদ্মা ইত্যাদি প্রাকৃতিক উৎস থেকে রেণু বা ডিম পোনা সংগ্রহ করে এ সমস্ত খামারে প্রতিপালন করা হতো এবং ২-৩ ইঞ্চি আকারের বৃদ্ধি করে মাছ চাষির নিকট সুলভ মূল্যে বিক্রি করা হতো । স্বাধীনতা উত্তরকালে রেণু পোনার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে কিন্তু প্রাকৃতিক উৎসের পোনা প্রাপ্তি কমতে থাকে এর ফলে রেণু প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আশির দশকের শুরুতে বাণিজ্যিকভাবে সরকারি/বেসরকারি হ্যাচারি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

মাছের পিটুইটারি গ্রন্থির নির্যাস বা হরমোন, প্রজনন উপযোগী স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে ইনজেকশন দেবার পরে স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ে ও পুরুষ মাছ শুক্রাণু নিক্ষেপ করে ডিমগুলো নিষিক্ত করে। এভাবে হরমোন ইনজেকশন দিয়ে যে প্ৰজনন করা হয় তাকে প্রণোদিত প্রজনন বলে । অন্যভাবে বলা যায়, যে প্রক্রিয়ার মাছের প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মাছকে প্রজননে বাধ্য করা হয় সেই প্রক্রিয়াকে প্রণোদিত প্রজনন বলে ।

প্রণোদিত প্রজননের উদ্দেশ্য :

১। মাছের পোনার জন্য প্রাকৃতিক উৎসের উপর নির্ভর করতে হয় না ।

২ । প্রয়োজনীয় পরিমাণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন করা যায় ।

৩ । চাহিদা অনুসারে একক প্রজাতির বা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন ও সরবরাহ করা যায় ।

৪ । সুস্থ ও সবল পোনা উৎপাদন করা যায় ।

৫ । বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রজনন মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন করা যায় ।

৬। বিরল প্রজাতির বা প্রায় অবিলুপ্ত প্রজাতির মাছের প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে মাছের বিলুপ্তি রোধ
করা যায়।

৭ । উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায় ।

প্রণোদিত প্রজননের পটভূমি :

মাছ চাষের ইতিহাস এদেশে দীর্ঘদিনের হলেও মাছের কৃত্রিম প্রজননের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয় । আমাদের দেশে যদিও এ যাবত স্বাদু পানির ২৫০ প্রজাতির মাছ চিহ্নিত করা হয়েছে। তন্মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বিধায় রুই জাতীয় মাছের কৃত্রিম প্রজনন জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে। ১৯৬৫ সালে স্বাদু পানি মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র চাঁদপুরে ডঃ মোঃ ইউসুফ আলী (তৎকালীন উপ-পরিচালক পরবর্তীতে সচিব) সর্বপ্রথম এদেশে রুই জাতীয় মাছের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমে প্রাথমিক সফলতা অর্জন করেন।

দীর্ঘদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কৃত্রিম প্রজনন প্রাথমিক সফলতা লাভ করলেও বাণিজ্যিক সফলতা লাভ করতে পারেনি । জাঙ্গালীয়া মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার কুমিল্লায় জনাব হাসান মাহমুদ ও জনাব ওবায়দুল হক (তৎকালীন খামার ব্যবস্থাপক পরবর্তীতে যথাক্রমে উপ-পরিচালক ও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা) কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে স্বল্প পরিমাণ রেণু উৎপাদনে তখনও সফল হননি। অন্যান্য মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার যেমন যশোর, বরিশাল, মাসকান্দা খামারে উদ্যোগ নিয়ে প্রাথমিক সফলতা অর্জিত হলেও বাণিজ্যিক উৎপাদনে সফলতা লাভে বিলম্ব হয় ।

এখানে উল্লেখ্য যে, স্বাদু পানি মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রে বিদেশ থেকে বেশ কিছু সিলভার কার্প মাছের পোনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, এদেশে চাষাবাদের লক্ষ্যে। এ মাছগুলো ১৯৭৫-১৯৭৬ সালে পরিপক্বতা লাভ করে এবং তখন থেকে কৃত্রিম প্রজনন প্রচেষ্টা হাতে নেওয়া হলেও কৃত্রিম প্রজননে সফলতা অর্জন সম্ভব হয়নি ।

১৯৭৭ সালে সর্বপ্রথম জনাব মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদ (তৎকালীন সিনিয়র রিসার্চ অফিসার পরবর্তীতে মহাপরিচালক) এবং জনাব হারুনুর রশিদ ও জনাব তারিকুল আলম সাইদুন্নবী (তৎকালীন এআরও বর্তমানে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা) স্বাদু পানি মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রে সিলভার কার্প মাছের প্রথম সফলভাবে কৃত্রিম প্রজনন ঘটাতে সক্ষম হন। বর্তমানের সারা বাংলাদেশে যেসব সিলভার কার্প পাওয়া যাচ্ছে তার বেশির ভাগই উক্ত প্রজননকৃত মাছ থেকে প্রাপ্ত ।

১৯৭৮-৭৯ সালে চীন সরকারের সাথে ১২০ জন বিভাগীয় কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের জন্য চুক্তি করা হয়। ঐ চুক্তির মধ্যে ১২০ জন কর্মকর্তাকে ৩টি ব্যাচে কৃত্রিম প্রজননের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় । সে সময় স্বাদু পানি মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র চাঁদপুরে জনাব এ. কে. আতাউর রহমান (উপ-পরিচালক পরবর্তীতে মহাপরিচালক) চীন থেকে বাণিজ্যিক হ্যাচারির ১টি নকশা সংগ্রহ করেন। উক্ত নকশার আলোকে স্বাদু পানি মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রে একটি হ্যাচারি স্থাপন করা হয় ।

এ হ্যাচারিটির মডেল প্রণয়ন করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী জনাব রক্ষিত কুমার রায়। হ্যাচারিটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন জনাব মোঃ নাসির আহমেদ (তৎকালীন ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা পরবর্তীতে মহাপরিচালক) এবং জনাব সুখেশ চন্দ্র ধর (তৎকালীন গবেষণা কর্মকর্তা পরবর্তীতে উপ-পরিচালক)। উক্ত হ্যাচারিতে ১৯৮০ সালে প্রথম এ দুইজন কর্মকর্তা অন্যান্য সহকর্মীর সহায়তায় বাণিজ্যিকভাবে রুই জাতীয় মাছের রেণু উৎপাদনে সক্ষম হন । পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ

কেন্দ্র রায়পুর, লক্ষ্মীপুরে ডেরেল ডেপার্ট (বিদেশি বিশেষজ্ঞ) ও জনাব এস.এন. চৌধুরী (তৎকালীন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পরবর্তীতে পিএসও) বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হ্যাচারি পরিচালনায় সফল হন ।১৯৮২ সালে ঝিনাইদহ জেলার বওলহর বাঁওড়ে মিঃ ফ্রানসিস রাজ ও জনাব সুখেশ চন্দ্র ধর রুই জাতীয় মাছের রেণু পোনা উৎপাদনে সফল হন।

এই ৩টি হ্যাচারির সফলতা সরকারি ও বেসরকারি হ্যাচারি উদ্যোক্তাদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। ফলে বিভিন্ন সময়ে সারা দেশে সরকার মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার বা হ্যাচারি স্থাপন করেন এবং সফলতা অর্জন করেন । পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ও উৎসাহিত করা এবং প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। ফলে বর্তমানে প্রায় সরকারি ও বেসরকারি ৯০২টি হ্যাচারি স্থাপিত হয়েছে।

প্রয়োজনীয়তা/গুরুত্ব :

১. প্রজনন একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। প্রতিটি জীবের মতো মাছও বংশ রক্ষা করার জন্য স্বাভাবিক নিয়মে প্রজনন করে থাকে ।

২. মাছ চাষ করতে হলে পুকুরে প্রয়োজনীয় পরিমাণে পোনা মজুদ করতে হয়। আমাদের দেশের রুই, কাতলা জাতীয় মাছ কেবলমাত্র স্রোতস্বিনী নদীতে প্রজনন করে থাকে। এসব মাছ চাষ করতে হলে নদী থেকে পোনা সংগ্রহ করতে হয় বিভিন্ন কারণে কার্প জাতীয় এসব মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বিনষ্ট হচ্ছে, ফলে প্রাকৃতিকভাবে পোনার উৎপাদন অনেক কমে গেছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পোনা পেতে হলে রুই, কাতলা জাতীয় মাছকে তাই প্রণোদিত প্রজনন করতে হয়।

৩. নদী থেকে সংগৃহীত পোনা অনিবার্য কারণেই মিশ্র প্রজাতির হয়ে থাকে। অনেক সময় কোনো কোনো অবাঞ্ছিত বিশেষ করে রাক্ষুসে মাছের পোনাও এই সাথে ধরা পড়ে যেগুলো মাছ চাষে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে । সেজন্য কাঙ্ক্ষিত প্রজাতির পোনা পেতে হলে অবশ্যই প্রণোদিত প্রজননের প্রয়োজন রয়েছে ।

৪. রুই-কাতলা মাছ যত বড়ই হোক না কেন, তারা বদ্ধ জলাশয়ে প্রজনন করে না। প্রজননক্ষম মাছ পুকুরে
মজুদ রেখে প্রজনন মৌসুমে যে কোনো সময়ে প্রয়োজন মাফিক পোনা পাওয়ার জন্য প্রণোদিত প্রজনন প্রয়োজন ।

৫. নদী থেকে সংগৃহীত পোনা সর্বদাই মিশ্র আকারের হয়ে থাকে। মাছ চাষে অধিক সুফল পেতে হলে কোনো নির্দিষ্ট পুকুরে একই আকারের পোনা ছাড়া উচিত। একই বয়সের ও একই আকারের পোনা পাওয়ার জন্য প্রণোদিত প্রজনন দরকার ।

৬. শিং, মাগুর, কই, পাবদা ইত্যাদি অত্যন্ত সুস্বাদু মাছ চাষ এখন লাভজনক হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এসব মাছের পোনা প্রকৃতিতে খুব কমই পাওয়া যায়। কাজেই এ জাতীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাছ চাষে প্রসার ঘটাতে হলে অবশ্যই প্রণোদিত প্রজনন প্রয়োজন।

৭. মনুষ্য সৃষ্ট ও অন্যান্য বিভিন্ন কারণে বৈরী পরিবেশের জন্য অনেক মাছ বিলুপ্ত হওয়ার পথে যেমন মহাশোল মাছ । মাছের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রণোদিত প্রজনন প্রয়োজন ।

প্রজনন প্রভাবক:

মাছের প্রণোদিত প্রজনন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য যেসব উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাকে
প্রজনন প্রভাবক বলে ।
প্রজনন প্রভাবক বা নিয়ামকসমূহ :
মাছের প্রণোদিত প্রজননের সফলতার জন্য বিভিন্ন প্রভাবক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এখানে প্রধান প্রধান কয়েকটি প্রভাবক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। মৎস্য প্রজননের প্রধান প্রধান প্রভাবকগুলো
নিম্নরূপ :

১ । ডিমের পরিপক্বতা
২। তাপমাত্রা
৩ । পানির প্রবাহ
৪ । পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ
৫। পানিতে দ্রবীভূত লৌহ/আয়রন
৬। পানির অন্যান্য ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ ।

১। ডিমের পরিপত্ত্বতা
প্রণোদিত প্রজননে ডিমের পরিপক্বতা একটি অন্যতম গুরত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে । ব্রুড মাছ যথেষ্ট যত্ন সহকারে পালন না করা হলে ডিম যথাযথভাবে পরিপক্ব হয় না। কম বয়সী মাছ, পুষ্টিহীনতা এবং অল্প জায়গায় বেশি মাছ পালন করলে ডিম অপরিপক্ক হয়। ডিম সম্পূর্ণরূপে পরিপক্ক না হলে ডিমের পরিস্ফুটনের হার হ্রাস পায়। হরমোন ইনজেকশন দিয়ে কৃত্রিম প্রজননের সময় হরমোনের মাত্রা অধিক হলে অনেক অপরিপক্ক ডিম বিমুক্ত হয়, সেগুলো ফোটে না ।

২। তাপমাত্রা:
প্রণোদিত প্রজননের ক্ষেত্রে পানির তাপমাত্রা একটি অতি সংবেদনশীল ফ্যাক্টর। তাপমাত্রার সাথে মাছের প্রজনন আচরণ ও ডিম ফুটনের সম্পর্ক রয়েছে। রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, কমন কার্প ও বিগহেড মাছের জন্য ২২°-২৭° সে.। পানির তাপমাত্রা ১৬° সে. নীচে এবং ৩১° উপরে হলে মাছের দেহে হরমোন ক্ষরণ ঠিকমতো হয় না ফলে সঠিক সময়ে ডিম হতে রেণু বের হয় না এবং ডিম নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।

৩। পানির প্রবাহ :
হ্যাচারিতে প্রজননের সময় ডিম ফুটানোর ক্ষেত্রে পানির প্রবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে । বৃত্তাকার হ্যাচারিতে সঠিকভাবে ডিম ফুটানোর জন্য অবিরাম পানির প্রবাহ বজায় রাখতে হয়, নতুবা ডিম তলদেশে জমা হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। ব্রুড মাছকে হরমোন ইনজেকশন দেওয়ার পর এদের শ্বাস- প্রশ্বাস বেড়ে যায় ফলে অক্সিজেনের চাহিদা ও বেড়ে যায়। এ সময় প্রজনন চৌবাচ্চায় পানির প্রবাহ প্রতি মিনিটে ৩০ থেকে ৫০ লিটার রাখা ভালো।
ফিশ কালচার অ্যান্ড ব্রিডিং-২

৪। পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন ।
পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনও ডিম ফুটানোর একটি অন্যতম প্রভাবক। হ্যাচারিতে মৎস্য প্রজননের উদ্দেশ্যে যে পানি রাখা হয়, সে পানিতে পর্যাপ্ত দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন। যেহেতু একটি পাত্র বা হাঁপাতে একসাথে অনেক ডিম রাখা হয় তাই ঐ পানিতে অধিক অক্সিজেনের দরকার হয়। তাছাড়া অক্সিজেনের পরিমাণ কম হলে অনেক ভিম মারা যায় এবং মৃত ডিমগুলো পঁচনের ফলে ঐ পানিতে অক্সিজেন আরো কমে যায়। প্রবাহিত পানিতে ৭৮.৫ পিপিএম দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে সর্বনিম্ন মাত্রা ৫ পিপিএম-এর নিচে হওয়া উচিত নয় ।

৫। পানির দ্রবীভূত আয়রন বা লৌহ

প্রজননের জন্য হ্যাচারির পানি লৌহমুক্ত হওয়া আবশ্যক কারণ পানির মধ্যে বিদ্যমান লৌহ জারিত হয়ে দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘাটতি সৃষ্টি করে। এছাড়া নিষিক্ত ডিমের উপরিভাগে লৌহের আস্তরণ সৃষ্টি হয় ফলে ভিমের মৃত্যুহার বেড়ে যায়। লৌহসমৃদ্ধ পানিপ্রবাহের ফলে ডিম থেকে ফুটে বের হওয়া বাচ্চার ফুলকায় লৌহের আস্তরণ পড়ে, ফলে তাদের শ্বাসকার্য ব্যাহত হয় এবং মৃত্যু হার বেড়ে যায়। হ্যাচারির পানির জন্য লৌহের গ্রহণযোগ্য মাত্রা হচ্ছে ২ মি.লি. গ্রাম/লিটার ।

২ থেকে ৪ মি.লি. গ্রাম/লিটার মাত্রায় লৌহ বা আয়রন থাকলে ঐ পানি প্রজনন কাজে ব্যবহারের আগে এরেশন করে নিতে হবে। পাম্প থেকে পানি ট্যাঙ্কে ঢোকানোর আগেই এরেশন করে নিতে হয়। এরেশনের প্রক্রিয়া হলো চার-পাঁচ ধাপ লোহার জালির তৈরি ট্রের উপর দিয়ে সবেগে পাম্পের পানিকে প্রবাহিত করা ।
মৎস্য প্রজনন

৬। পানির অন্যান্য ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ :

হ্যাচারিতে মৎস্য প্রজননের উদ্দেশ্য ডিম ফুটানোর জন্য যে পাত্রে ডিম রাখা হয় ঐ পাত্রের পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে ।
ছকের সাহায্যে ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ ও গ্রহণযোগ্য মাত্রা দেওয়া হলো:

 

 মৎস্য প্রজনন

 

প্রাকৃতিক প্রজননে পরিবেশ এবং হরমোনের প্রভাব :

স্বাভাবিক পরিবেশে পরিপক্ব মাছের ডিম ও শুক্র মাছের জননাঙ্গ ততক্ষণ পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক পরিবেশ দ্বারা প্রণোদিত না হয়। উপযুক্ত পরিবেশ মাছের মস্তিষ্কের হাইপোথেলামাসকে প্রভাবান্বিত করে এবং গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন নিঃসরণ করে যা পিটুইটারি গ্রন্থির গোনাডাল কোষকে সক্রিয় করে রক্তপ্রবাহেও গোনাডোট্রপিন হরমোন নিঃসরণ করে এবং শুক্রাশয় ডিম্বাশয়ের যাবতীয় গাঠনিক ও কার্যক্রমকে পরিবর্তন করে থাকে। ফলে ডিম্বাশয় থেকে ডিমের বিচ্যুতি ঘটে এবং টেস্টিকুলার কোষ থেকে শুরু বের হয়ে প্রাকৃতিক প্রজনন ঘটায় কিন্তু যখন নদী বা উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছ পুকুর বা বদ্ধ জলাশয়ে থাকে যখন ডিম্ব বা

শুক্রের পরিবর্তন বন্ধ হয়ে থাকে এবং এরা বিশ্রাম অবস্থায় থাকে ও ধীরে ধীরে শরীরে শোষিত হয়ে যায়। এরকম প্রতিকূল পরিবেশে মাছ পিটুইটারি গ্রন্থি হতে নিজস্ব গোনাডো-ট্রপিন হরমোন নিঃসরণ করতে পারে না, তখন বাহির থেকে অন্য কোনো বয়ঃপ্রাপ্ত মাছের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে গোনাডোট্রপিন হরমোনের নির্যাস তৈরি করে নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রজনন উপযোগী পরিপক্ক মাছকে ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়, ফলে মাছের শরীরে জৈবিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় । এ অবস্থায় মাছ ডিম ও শুক্র ছেড়ে দিয়ে প্রজনন কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে ।

 

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

প্রণোদক

যে উত্তেজক দ্রব্য ব্যবহার করে পরিপক্ক ব্রুড মাছে ডিম এবং শুক্র প্রাপ্তি ঘটানো হয় তাকে প্রণোদক বলে । আমাদের দেশে সাধারণত প্রণোদক হিসেবে মাছের পিটুইটারি গ্রন্থির (পিজি) নির্যাস এবং বিভিন্ন ব্র্যান্ডের হিউম্যান করিওনিক গোনাডোট্রপিন হরমোন (এইচসিজি) অথবা বিভিন্ন কৃত্রিম হরমোন ( যেমন সুমাচ অভাগ্রিম ইত্যাদি) ব্যবহৃত হয়।

১। পিটুইটারি গ্লাভ বা পিজি

পিজি সাধারণত মাছের মাথার খুলির নিচে একটা গর্তে থাকে। এই গ্রন্থি দেখতে অনেকটা গোলাকার এবং এটা সাধারণত হালকা গোলাপি রঙের হয়ে থাকে। পরিপত্ব মাছ থেকে পিজি সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয়। এতে পিজির কার্যকারিতা বেশি থাকে। সংগৃহীত পিজি কাচের ছোট বোতলের মধ্যে এসিটোন বা অ্যালকোহলে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে এই সংরক্ষিত পিজি মাছের প্রজনন কাজে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত দেশি রুই জাতীয় মাছের প্রজনন কাজে পিজি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনগুলোর মধ্যে গ্রোথ হরমোন এবং গোনাডোট্রপিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মৎস্য হ্যাচারিতে মৎস্য প্রজননের জন্য পিজি উত্তেজক প্রভাবক বা ইনডিউসিং এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গ্রোথ হরমোন দেহের সার্বিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে এবং গোনাডোট্রপিন হরমোন গোনাড বা যৌন অঙ্গের বৃদ্ধি ও কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

২। এইচসিজি ।

হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন (Human Chorionic Gonadotropin) হরমোনকে সংক্ষেপে এইচসিজি (HCG) বলা হয়। এইচসিজি একপ্রকার গ্লাইকোপ্রোটিন যা ৪০ থেকে ১২০ দিনের গর্ভবতী নারীদের প্রস্রাব সেন্ট্রিফিউজ করে এইচ সিজি প্রস্তুত করা হয়। চাইনিজ কার্পের প্রজননে সাধারণত এইচসিজি ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। দেশি রুই জাতীয় মাছের প্রজনন কাজেও এই হরমোন অনেক সময় ব্যবহার করা হয়ে থাকে ।

প্রণোদকের প্রয়োজনীয়তা :

প্রাকৃতিক পরিবেশের মতো বন্ধ জলাশয়ে বা হ্যাচারির পরিবেশ ও ব্রুড মাছের ডিম ও শুক্র তৈরি, এদের বৃদ্ধি ঘটে এবং পরিপৰ্ব্বতা আসে। কিন্তু বিশ্রামের পর পরিবেশ পরিবর্তনজনিত এবং সংশ্লিষ্ট হরমোনের সমন্বিত প্রভাব প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় অপ্রতুল বিধায়, ব্রুড মাছের ডিম ছাড়ার মতো চূড়ান্ত পর্যায়ের উত্তরণ ঘটে না । মাছকে ডিম ছাড়ার এই চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সময়মতো প্রয়োজন হয় যথার্থ প্রণোদকের ।

প্রণোদক নির্বাচন :

আমাদের দেশে যে সমস্ত মাছকে প্রণোদিত প্রজননের আওতায় আনা হয়েছে, তন্মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিছি এর নির্যাস ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া গেছে। অনেক মাছের প্রজননের ক্ষেত্রে এইচসিজি-এর সাথে পিজি-এর নির্বাস সংমিশ্রণে অধিক কার্যকর বলে প্রমাণিত। পিজি নির্যাস ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সর্বনিম্ন। এসব কারণে মাছের প্রজননের জন্য প্রজাতি ভেসে প্রণোদক নির্বাচনে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া
১. গুভাপ্রিম

২. শুভাক্লিন

৩. শুভাম্যাক

৪.অমপিরিডন

৫. প্রোনিল

৬. প্রেফেসি ইত্যাদি প্রণোদক ও ব্যবহার করা হয় ।

 

 মৎস্য প্রজনন

 

প্রণোদকের মাত্রা

প্রণোদিত প্রজননে প্রজাতি ভেদে প্রণোদকের মাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। আবার একই প্রজাতির মাছের বয়স, স্বাস্থ্যগত অবস্থা, গোনাডের পরিপক্বতা, সর্বোপরি প্রজনন ঋতুর পর্যায় এবং পরিবেশগত নিয়ামকের অবস্থার উপর প্রণোদকের মাত্রা নির্ভরশীল। সঠিক মাত্রার প্রণোদক ব্যবহার খুবই জরুরি এবং তাতেই আশানুরূপ গুণাগুণ স ডিম পাওয়া সম্ভব, যা কীনা পরবর্তীতে উচ্চহারে নিষিক্তকরণ, ডিম স্ফুটন, পোনা বেঁচে থাকার হার এবং শক্ত সাম্য নীরোগ স্বাস্থ্যবান পোনা পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে।

এটা সত্য যে, মাত্রাতিরিক্ত প্রণোদক ব্যবহারে অন্যান্য প্রাণীর মতো মাছেরও গর্ভপাত হতে পারে। একই মাছে একটি নির্দিষ্ট প্রণোদক পরপর একই মাত্রা ব্যবহার করলে পরবর্তীতে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় না। সেজন্য পরবর্তীতে প্রজননের জন্য প্রণোদকের মাত্রা বাড়াতে হবে এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে শরীর বৃত্তিক সকল কর্মকাণ্ড অর্থাৎ ঐ নির্দিষ্ট মাছের প্রজনন প্রতিত্রিনা ঐ নির্দিষ্ট প্রণোদকের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায় এবং এর ফলে পোনার সকল গুণাগুণে দেখা দেয় অবনতি।

বর্তমানে অধিকাংশ হ্যাচারিতে মাত্রতিরিক্ত প্রণোদক ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হ্যাচারি অপারেটরনের ভুল ধারণা জন্মেছে যে, পরিবেশের বৈরিতা, গোনাডের অপরিপবৃত্তা ইত্যকার সকল অপূর্ণতা শুধুমাত্র চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রণোদিত প্রজননের সময় মাত্রাতিরিক্ত প্রণোদক ব্যবহারের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব।

পরিশেষে বলা যেতে পারে ব্রুড মাছের প্রজননের জন্য যথাযথ উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা কাঙ্ক্ষিত নীরোগ স্বাস্থ্যবান পোনা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত। দেশের সার্বিক মৎস্য চাষ নির্ভর করে সঠিক গুণাগুণ সম্পন্ন পোনার উপর তাই ব্রুড স্টকের উন্নয়নের অন্যান্য সকল নিয়ামক বা ব্যবস্থার পাশাপাশি মাছের শারীরবৃত্তিক জৈবিক প্রয়োজনীয়তা মেটানো একান্ত আবশ্যক।

তাছাড়া কৃত্রিম প্রজননের জন্য সঠিক প্রণোদক বা হরমোন প্রয়োগ করতে হবে এবং মাত্রাতিরিক্ত প্রণোদক ব্যবহারের প্রবণতা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। তবেই হ্যাচারি শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে চাহিদা মোতাবেক উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন পোনা উৎপাদন করে মৎস্য সম্পদের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে ।

 

প্রশ্নমালা-২

এক কথায় উত্তর দাও :

১। মাছের সফল প্রজননের জন্য কী কী আবশ্যক?
২। শত্রু থেকে ডিম ও বাচ্চাকে রক্ষায় মাছের অভ্যাসকে কী বলে?
৩। কমন কার্প মাছ আমাদের দেশে কোন বয়সে প্রজনন করে?
৪ । বছরে একাধিক বার প্রজনন করে এমন একটি মাছের নাম লেখ ।
৫। কাতলা মাছ কোন বয়সে প্রজনন করে ?
৬। মাছের প্রজনন অঙ্গ পরিপত্ব হবার পরেও সুপ্তাবস্থায় থাকে কেন?
৭। প্যারেন্টাল কেয়ার কয় ধরনের হতে পারে?
৮। ফেকাভিটি কাকে বলে?
৯। কোন ধরনের মাছের ফেকান্ডিটি সবচেয়ে বেশী?
১০। মাছের দেহে ডিম শোষিত হয় কেন?

১১। মাছের শুক্রাণু কতক্ষণ সাঁতার কাটতে পারে বেঁচে থাকতে পারে?
১২। প্রণোদিত প্রজনন কাকে বলে?
১৩। প্রণোদিত প্রজননের উদ্দেশ্য কী?
১৪। প্রণোদিত প্রজননের গুরুত্ব লেখ?
১৫। প্রজনন প্রভাবক কাকে বলে?
১৬। প্রজনন প্রভাবকগুলো কী কী?

১৭। হ্যাচারিতে পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ কী কী?

১৮ । প্রণোদক কাকে বলে ?

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন :

১। প্রজনন জীববিদ্যা বলতে কী বোঝ ?
২। মাছের প্রজননের বয়স একই মাছে বিভিন্ন হয় কেন?
৩। মিঠাপানির মাছের প্রজনন বয়স ও প্রজননের ঋতু সম্পর্কে আলোচনা কর?

৪। ফেকান্ডটির সাথে প্যারেন্টাল কেয়ারের সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর?
৫। প্রণোদকের প্রয়োজনীয়তা কী

রচনামূলক প্রশ্ন

১ । প্রণোদিত প্রজননের প্রভাব বিস্তারকারী নিয়ামকগুলোর নাম উল্লেখ কর এবং এগুলোর প্রভাব বর্ণনা কর ?
২। ডিম ও শুক্রাণুর বিকাশ কীভাবে হয় বর্ণনা কর অথবা নিষিক্তকরণ পদ্ধতি বর্ণনা কর ।

রও দেখুন:

 

Leave a Comment