আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-মৎস্য পরিকল্পনা
মৎস্য পরিকল্পনা
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ক্রম বর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণ, বিপুল জনগোষ্ঠীর দারিদ্র বিমোচন এবং আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে মৎস্য সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে । প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোতে অতীতে মৎস্য সম্পদের প্রাচুর্য ছিল বিধায় মৎসচাষি এবং সাধারণ জনগণ আধুনিক প্রযুক্তিতে মাছ চাষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি।
কিন্তু ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মাছের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে । পক্ষান্তরে, মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন ও মাছের প্রাপ্যতা দিন দিন কমছে। আমাদের দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মাছের বর্তমান উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে সরকারি ও বে-সরকারি পর্যায়ে মৎস্য খামার স্থাপন অতীব জরুরি।
এর জন্য সফলভাবে মৎস্য খামার পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি মৎস্য প্রকল্পের ভবিষ্যত কর্মকাণ্ড কখন ও কীভাবে করা হবে, কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও মালামাল কোথা থেকে সংগ্রহ করা হবে ইত্যাদি বিষয় ঠিক করার নামই হচ্ছে কর্মপরিকল্পনা। মৎস্য খামার পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো কী ধরনের খামার স্থাপন করা হবে, কত আয়তনের কতটি পুকুর নির্মাণ করা হবে, এসব পুকুরের কি কি কার্যক্রম থাকবে, এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কোন কোন পর্যায়ে কতজন দক্ষ কর্মী প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা ।
সঠিক পরিকল্পনার শর্ত :
সুষ্ঠু পরিকল্পনার যেকোনো প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। শর্তগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো :
১. বাজরের অবস্থা যাচাই
২. ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ
৩. শ্রমিকের পরিমাণ নির্ণয়
৪. পরিবহন ব্যবস্থা মূল্যায়ন
৫. প্রতিযোগিতা মূল্যায়ন
এই সমস্ত বিচার-বিশ্লেষণ অবশ্যই বাস্তব ভিত্তিক হতে হবে । কোনো অবস্থাতেই অতি উৎসাহী হওয়া ঠিক হবে না। সঠিক পরিকল্পনার জন্য ঝুঁকি এবং অসুবিধাসমূহ গণনায় আনতে হবে ।
পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য :
একটি কর্ম পরিকল্পনার কতগুলো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। যেমন :
১. কর্ম পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্তি : এই স্তরে একটি খামারের বিভিন্ন অঙ্গ সমূহের বিন্যাস, কী কী সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হবে, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কতদূর বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে এসব তথ্য বিস্তারিত উল্লেখ করা ।
২. কর্ম পরিকল্পনার একটি নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ : একটি কর্মপরিকল্পনার ব্যাপ্তি কত সময় ধরে থাকবে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ কার্যক্রমসমূহ কত সময়ের মধ্যে সম্পাদন করা হবে, তা উল্লেখ থাকবে ।
৩. কর্ম পরিকল্পানা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ সমূহের উল্লেখ : কর্ম পরিকল্পনায় বর্ণিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য যেসব উপাদান বা কার্যক্রম উল্লেখ করা হয়েছে তার ধারাবাহিক বাস্তবায়নের পদক্ষেপসমূহ উল্লেখ করা ।
৪. কর্মপরিকল্পনার পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় লোকবলের উপস্থিতি : পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ অনুসারে কে কখন এবং কোন সময়ে কী কী কাজ সমাধান করতে পারে তার পর্যায়ক্রমিক উল্লেখ থাকে ।
একটি আদর্শ খামার পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন অধ্যায়ের তালিকা নিচে দেওয়া হলো ।
১. সার সংক্ষেপ :
ক) ব্যবসায়ের ধরণ :
ক. উৎপাদিত দ্রব্য
গ. প্রতিযোগিতা
খ. সম্ভাব্য বাজার
খ) অর্থ সংক্রান্ত তথ্য
ক. প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ
খ. অর্থের প্রয়োজনের কারণ
গ. কীভাবে ব্যয়কৃত অর্থ ফেরত দেওয়া হবে ।
২. ব্যবসায়ের বর্ণনা :
ক. ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম
খ. প্রতিষ্ঠানের ভৌতিক অবস্থার বর্ণনা
গ. উৎপাদিত পণ্য এবং তার মূল্যমান বা দর নির্ধারণ
ঘ. ঐ প্রতিষ্ঠানের ইতিকথা
ঙ. ব্যবসায়ের লক্ষ্য
৩. বাজার গবেষণা এবং পরিকল্পনা
ক. সম্ভাব্য ক্রেতা
খ. বাজার জরিপ
গ. বাজারের বিস্তৃতি
ঘ. প্রতিযোগিতার উৎসসমূহ
ঙ. বিক্রয় এবং সরবরাহ
চ. বিজ্ঞাপন ও গণসংযোগ
৪. পরিচালনা :
ক. উৎপাদনের পদ্ধতি
গ. সরবরাহকারী
খ. শ্রমিক জোগান
ঘ. প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি
ঙ. সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা
৫. প্রধান ব্যক্তি বর্গ
ক. ব্যবস্থাপক বা ব্যবস্থাপনা পরিষদ
খ. শ্রমদানকারী
গ. আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী ।
ঘ. বহিরাগত পরামর্শ দাতা ও সম্প্রসারণ কর্মী
৬. আর্থিক কর্মসূচি :
ক. অর্থলগ্নির কারণ
খ. লগ্নিকৃত অর্থের পরিমাণ
গ. ঋণ পরিশোধ পরিকল্পনা
৭. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা :
খ. আয়ের সম্ভাব্যতা ও পরিমাণ নির্ধারণ ।
সঠিক কর্মসূচি
৯. দুর্বলতা এবং ঝুঁকি
পরিকল্পনা প্রক্রিয়ার পদক্ষেপসমূহ :
যে কোনো বিষয়ে কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার নিম্ন লিখিত পদক্ষেপসমূহ অনুসরণ করা হয় ।
১. প্রকল্পের উদ্দেশ্য নির্ধারণ ।
২. নির্ধারিত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা ।
৩. বর্তমানে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ।
৪. উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের পথে সহায়ক বিষয়গুলো এবং প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশ্লেষণ করা । ৫. উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য এক বা
একাধিক বিকল্প পদক্ষেপ নির্ধারণ করা ।
১। উদ্দেশ্য নির্ধারণ :
যে কোনো প্রকল্পের উদ্দেশ্যর মধ্যেই তার সামগ্রিক চিত্র ফুটে ওঠে। উদ্দেশ্য যত পরিষ্কার ও স্পষ্ট হবে, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তত সহজ ও সাবলীল হবে। মাছ চাষের প্রকল্প বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন : পুকুরে মাছ চাষ, চিংড়ি চাষ, বিল, বাঁওড়ে মাছ চাষ, নার্সারি ব্যবস্থাপনা, হ্যাচারি স্থাপন, সমন্বিত মৎস্য চাষ, যেমন : ধান ক্ষেতে মৎস্য চাষ, মাছের সাথে হাঁসের চাষ, মাছের সাথে মুরগি চাষ, পেন কালচার, খাঁচায় মাছ চাষ ইত্যাদি ।
তবে প্রকল্পের উদ্দেশ্য নির্ধারণের সময় অবশ্যই সামর্থ্য ও সম্পদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে । যেমন : বাড়ির পাশে বা রাস্তার পাশে যদি ছোট জলাশয় থাকে, যেখানে ৩-৬ মাস পানি থাকে সেখানে পাঙ্গাশ বা রুই, কাতলার চাষ না করে তেলাপিয়া বা রাজপুঁটির চাষ করলে ভালো ফল পাওয়া যায় । আবার পূর্ব অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ ছাড়া হঠাৎ করে মাছের পোনার চাষ ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য সঠিক উদ্দেশ্যের
সাথে প্রকল্পের সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল।
২। নির্ধারিত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ :
সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে প্রকল্প নির্ধারণের পর এর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে। নির্ধারিত জলাশয়ে মাটি, পানি, অবস্থান ব্যবস্থাপনার ধরন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে আয়, ব্যয় ও উৎপাদনের হিসাব করতে হবে যা, যে কোনো খামার পরিচালনার জন্য এটি খুবই জরুরি বিষয় ।
সমতল ভূমির বন্যামুক্ত যে কোনো এলাকায় মিঠা পানির মৎস্য খামার স্থাপন করা যায়। মৎস্য চাষের খামার নির্বাচনে দো-আঁশ এবং এঁটেল মাটি উত্তম এবং উৎপাদনশীলতা বেশি। পিট মাটি এবং বেলেমাটি পরিহার করা উচিত । লাল মাটি এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের শক্ত মাটির পুকুরের উৎপাদনশীলতা কম। মিঠা পানির মৎস্য চাষের খামার নির্বাচনে পানির উৎস হিসেবে লোনামুক্ত এবং বিভিন্ন গ্যাস মুক্ত ও দূষণমুক্ত পানি উত্তম ।
৩। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা :
এ পর্যায়ে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়। যেমন : সমন্বিত মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছের সাথে মুরগি চাষ করা হলে পরবর্তীতে এর সাথে গাভী বা হাস পালন করা যায় কিনা অথবা মৌসুমি পুকুরে তেলাপিয়া বা রাজপুঁটি চাষ করার পর পরবর্তীতে একে আরও গভীর করে বার্ষিক পুকুরে রূপান্তরিত করে রুই, কাতলা, পাঙ্গাশের চাষ করা যায় কিনা বা আশপাশে আরও মাছ চাষের জলাশয়
পাওয়া যায় কিনা, এসব ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। বাজারে কোন মাছের চাহিদা কেমন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন, এছাড়া বিনিয়োগের জন্য মূলধন জোগান কতটুকু আছে, ঋণ নিতে হলে কোন কোন ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে ইত্যাদি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
৪ । উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের পথে সহায়ক বিষয়গুলো এবং প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশ্লেষণ করা :
এ প্রকল্পের নির্ধারিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য অনুকূল ও প্রতিকূল বিষয় সমূহ বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় । অর্থাৎ প্রকল্পের সুবিধার দিক ও দুর্বল এবং ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলো চিহ্নিত করা হয়। যেন সুবিধা থেকে বেশি লাভ নেয়া যায়, আবার দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ দিক থেকে সতর্কতা অবলম্বন করে ক্ষতির ভাগ কমানো যায় ।
যেমন : সুবিধার দিক হতে পারে প্রকল্পের কাছেই ব্রুড ব্যাংক বা পোনা ব্যাংক-এর অবস্থান যেখান থেকে খুব সহজেই মাছ বা পোনা সংগ্রহ করা যায়। আবার উৎপাদিত মাছ সহজেই বাজারে বিক্রি করা যায় । এ ধরনের সুবিধা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে ।
পক্ষান্তরে প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত স্থানে হঠাৎ বন্যার আশঙ্কা থাকা, সামাজিক কোন্দোল বা দলাদলির কারণে মাছ চুরি বা মাছের রোগের কারণে মাছ কমে যাওয়া, নাশকতামূলকভাবে বিষ প্রয়োগের আশঙ্কা থাকলে তা প্রকল্প প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত করতে হবে ।
৫। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য এক বা একাধিক বিকল্প পদক্ষেপ নির্ধারণ করা :
এ পর্যায়ে প্রকল্পের সহায়ক বিষয়গুলো থেকে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার জন্য লাভজনক বিকল্প প্রস্তাব চিহ্নিত করা হয় । যেমন : সরকারি হ্যাচারির সহায়তার উন্নত পোনার জোগান পেলে অধিক লাভবান হওয়া যায় । কিন্তু দেখা গেল দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি । সেক্ষেত্রে ব্র্যাক হ্যাচারি বা ভালো উন্নত গুণসম্পন্ন ব্রুড থেকে পোনা তৈরি করে কিন্তু দাম তুলনামূলকভাবে কম, এমন স্থান থেকে পোনা সংগ্রহ করা যেতে পারে ।
বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে দেখা গেল, যে বাজারে এতদিন মাছ বিক্রি হতো তার চেয়ে পাশের অন্য বাজারে আরও বেশি দাম পাওয়া যায় । সেক্ষেত্রে সেখানেই বিক্রি করতে হবে । আবার আকস্মিক বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পাড় ভালো ভাবে তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনে পাড়ের উপর দিয়ে বাড়তি জালের ব্যবস্থা করতে হবে যেন মাছ বাইরে যেতে না পারে। চুরি রোধের জন্য প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে, পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে এবং পুকুরের মধ্যে বাঁশ, কঞ্চি, পাতা ছাড়া ডাল পুঁতে রাখতে হবে ।
আরও দেখুন: