আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মৎস্য অভয়াশ্রমের আয়তন নির্ধারণ – যা মুক্ত জলাশয় ব্যবস্থাপনা এর অন্তর্ভুক্ত।
মৎস্য অভয়াশ্রমের আয়তন নির্ধারণ
অভয়াশ্রমের আয়তন ও সীমানা সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে | জলাশয়ের আয়তনের ওপর ভিত্তি করে মৎস্য অভয়াশ্রমের আয়তন নির্ধারণ করতে হবে। এতে জলাশয়ের ৫-১০% অভয়াশ্রম হতে পারে | নদীর বেলায় অভয়াশ্রমের আকার কত হবে বা কত গুলো হবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেসব মাছ যথেষ্ট চলাচল করে অভয়াশ্রম ছোট হলে তারা অভয়াশ্রমের বাইরে এলে ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে অভয়াশ্রম স্থাপনের উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। আবার অভয়াশ্রম বড় হলে সেখানকার জেলেরা আর্থিক দুরবস্থায় পড়বে।
প্লাবন ভূমিতে পোনা মজুদ :
বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মৎস্য সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত আহরণের কারণে আমাদের দেশে মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য সম্পদ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। অব্যবহৃত প্রাকৃতিক খাদ্য ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মুক্ত জলাশয়ে পোনা মজুদ করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। ইতোমধ্যে সরকারি ও সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেক মুক্ত জলাশয়ে পোনা মজুদ করে বেশ ভাল ফল পাওয়া গেছে।
বিপুল সংখ্যক পোনা মজুদের জন্য প্লাবনভূমি বা বড় বড় বিলের সন্নিকটে পোনা উৎপাদন নার্সারি স্থাপন করা যেতে পারে। এসব নার্সারিতে ২-৩ মাস পোনা লালন পালন করে ৪-৫ ইঞ্চি আকারে পরিণত হলে পরে বর্ষার শুরুতে এসব পোনা প্লাবন ভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে পারবে। ফলে পরবর্তী শুষ্ক মৌসুমের আগে মাছগুলো যথেষ্ট বড় হবে।
মৎস্য আবাসস্থল উন্নয়ন :
মাছের বংশ বিস্তার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এ কার্যক্রমের মুখ্য উদ্দেশ্য । বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পলি জমে জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে সারা দেশে অনেক খাল, বিল, ছোট নদী এবং এদের সংলগ্ন জলাশয়সমূহ মাছের অবাধ বিচরণ ও প্রজননের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব জলাশয়কে সামান্য সংস্কার করে পুনরায় মাছের অবাধ বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত করা যেতে পারে।
ফিশপাস ও মৎস্যবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ :
বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বা পোল্ডার এবং গ্রাম পর্যায়ে অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণের কারণে প্লাবন ভূমিতে মাছের অবাধ বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্রসমূহ আজ হুমকির সম্মুখীন । ফিশপাস বা মৎস্যবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ করে বিল থেকে নদীতে এবং নদী থেকে বিলে মাছের অবাদ যাতায়াত এবং প্রজনন ক্ষেত্রের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে এ সমস্যা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি প্লাবনভূমিতে দেশী প্রজাতির মাছের ব্যাপক বংশবিস্তার ঘটানো সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইলিশ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ :
প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের মধ্যে ইলিশ অন্যতম। প্রতি বছর প্রায় ৩ লক্ষ মে.টনের অধিক ইলিশ আহরিত হয়। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ এবং সামুদ্রিক জলাশয় হতে ৩,৯,৪,৯৫১ মে.টন ইলিশ মাছ আহরিত হয়। অনিয়ন্ত্রিতভাবে জাটকা আহরণ, অপরিকল্পিত ভাবে ডিমওয়ালা ইলিশ নিধন এবং প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট কারণে ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে। তাই এ মৎস্য সম্পদ আজ হুমকির সম্মুখীন। প্রতি বছর অবিবেচিতভাবে আহরিত প্রায় ১৯ হাজার মে. টন জাটকা রক্ষা করা গেলে ৪-৬ মাসের মধ্যে ঐগুলো বড় হয়ে তা থেকে অতিরিক্ত ২ লক্ষ মে.টন খাবার যোগ্য ইলিশ পাওয়া যেতে পারে ।
সমাজভিত্তিক মৎস্য চাষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব :
সমাজভিত্তিক মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা দ্বারা সংশ্লিষ্ট সমাজের অংশ গ্রহণ বুঝায়। কিন্তু ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন পর্যায়ে অংশ গ্রহণের মাত্রা, কার্যকারিতা, ক্ষমতার ভাগাভাগি, ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো ব্যাপক হারে নিশ্চিত করাটাই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় । অন্যভাবে বলা যায়, সমাজভুক্ত লোক দ্বারা সমাজবদ্ধ লোকদের জন্য ও সমাজভুক্ত লোকের সাথে এলাকার হয়ে মৎস্য সম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও স্থায়ীত্বশীল আহরণের নিমিত্তে যে ব্যবস্থাপনা, সেটাই সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ।
সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য হলো মৎস্য সম্পদের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু আহরণ, বিতরণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা যাতে সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হয়। কিছু কিছু কাজ রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রের পক্ষে একা সম্পন্ন করা সম্ভব হলেও সংশ্লিষ্ট জনগণের সত্যিকার ও সার্বিক অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে কোনোটিই সহজভাবে, স্বল্প ব্যয়ে, সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করা সম্ভব নয় । সীমিত জনবল ও সহায়ক যন্ত্রপাতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পক্ষে তা রীতিমতো দুরূহ অথচ সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তা সহজেই সম্পন্ন করা যেতে পারে। নিচে সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব উল্লেখ করা হলো ।
- এতে রাষ্ট্রীয় ব্যয়জনিত অপচয় রোধ হয়;
- প্রশাসনিক ও আইনের প্রায়োগিক ঝামেলা কমে যায়;
- সম্পদ আহরণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটে;
- স্থানীয় নেতৃত্বের সুষ্ঠু বিকাশের পথ ও ধারা সুগম হয়;
- যৌথ মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের গ্রহণ যোগ্যতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়
- সম্পদ আহরণকারীদের এক ধরনের কতর্ব্যবোধ ও দায়িত্ব বৃদ্ধি পায়;
- মৎস্যজীবীদের সামাজিক সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং দীর্ঘ মেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা সূচিত হয়;
- স্থানীয় বাস্তবতার আলোকে কোন গৃহীত পরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়।
আরও দেখুনঃ