আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – ঘেরে বাগদা চিংড়ি ও মাছের মিশ্র চাষ । যা ” বাগদা চিংড়ির চাষ ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
শিক্ষাক্রম উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণীত পাঠ্যপুস্তকসমূহ পরিবর্তনশীল চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং আত্মকর্মসংস্থানে উদ্যোগী হওয়াসহ উচ্চশিক্ষার পথ সুগম হবে। ফলে রূপকল্প-২০২১ অনুযায়ী জাতিকে বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রশিক্ষিত করে ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে আমরা উজ্জীবিত।
ঘেরে বাগদা চিংড়ি ও মাছের মিশ্র চাষ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তৃত লোনাপানি এলাকায় বিভিন্ন মৌসুমে ব্যাপক লবণাক্ততার পার্থক্য দেখা দেয়। এই লবণাক্ততার তারতম্য এলাকা ভেদে ২৪-১৮ পিপিটি হতে ০ (শূন্য) পিপিটিতে চলে আসে, যা বছরের প্রায় ৩-৭ মাস পর্যন্ত বিরাজমান থাকে।
চিংড়ি ঘের/খামারসমূহে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে সকল স্থানে লবণাক্ততা ১২ পিপিটির নিচে দীর্ঘদিন বিরাজ করে সেই সকল স্থানে বাগদা চিংড়ির সংগে নির্বাচিত লোনা ও মিঠা পানির মাছের মিশ্র চাষ একটি আদর্শ পদ্ধতি হতে পারে।
বর্তমানে এতদঞ্চলের খামারগুলোতে সনাতন পদ্ধতিতে চাষের জন্য শুধুমাত্র বাগদা এবং গলদা চিংড়ির পোনা ব্যাপকভাবে মজুদ করা হয়। খামারগুলোতে পানি প্রবেশ অথবা পরিবর্তনের সময় অপ্রত্যাশিত অনুপ্রবেশের কারণে অন্যান্য প্রজাতির চিংড়ি এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্প্র মাছও একই সংঙ্গে খামারে প্রবেশ করে। ফলে এ সমস্ত মাছ। ও চিংড়ির মিশ্রচাষে অনেক সময় ভালো উৎপাদন পাওয়া যায়।
অনুপ্রবেশকৃত প্রজাতিগুলো হলো:
চিংড়ি: Peneaus indicus, P. Merguiensis, Metapenaeus monoceros, M. Brevicornis, ইত্যাদি।
মাছ: Liza parsia, L. tade, L. Macrocephalus, Mugil cephalus, Rhinomugil corsula, Oreochromis spp, Scatophagus argus, ইত্যাদি।
মাছ/চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর প্রজাতিসমূহ হলো:
Lates calcarifer, Mystus engra, Pomdasys hasta, ইত্যাদি
মিশ্রচাষ পদ্ধতিসমূহ
ক) বাগদা চিংড়ি ও পারসে মাছের মিশ্রচাষ পদ্ধতি, এবং
খ) বাগদা চিংড়ির ঘেরে পানির লবণাক্ততা কমার সাথে সাথে থাই পাঙ্গাস ও গিফট তেলাপিয়া মাছের মিশ্রচাষ একটি নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি হিসেবে নির্বাচন করা যেতে পারে।
মিশ্রচাষের বৈশিষ্ট্যসমূহ
ক) পারসে মাছ দ্রুত সাঁতার দিতে সক্ষম হওয়ায় পানি আলোড়ন সৃষ্টির মাধ্যমে পুঞ্জিভূত পুষ্টি উপাদান
ভালোভাবে মিশ্রিত হয়ে পর্যাপ্ত প্ল্যাংকটনিক খাবার তৈরিতে সহায়তা করে।
খ) থাই পাঙ্গাস ও গিফট তেলাপিয়া ২৪ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহজেই সহ্য করতে পারে এবং ১০ পিপিটিতে দেহ বর্ধন অক্ষুন্ন থাকে।
গ) থাই পাঙ্গাস পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ থাকলে চিংড়ির সংঙ্গে খাবার নিয়ে প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকে। উপরলতু থাই পাঙ্গাস পচনশীল খাবার খেয়ে তলদেশের মাটির উন্নয়ন ঘটায়।
ঘ) মিশ্রচাষের মাধ্যমে খামারের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানগত অবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে রোগ-বালাইয়ের প্রার্দুভাব প্রতরোধ করা সম্ভব হয়।
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতপ্রণালি
ক) জোয়ারের পানি উঠানামা করে এমন ঘের নির্বাচন করতে হবে।
খ) ঘেরের আকার অবশ্যই ১-৪ হেক্টরের মধ্যে হওয়া উচিত।
গ) জোয়ারের পানি হেঁকে প্রবেশ করাতে হবে। পানির গড় গভীরতা ১ মিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ঘ) সূর্যের কিরণে ঘেরের তলদেশের মাটি শুকিয়ে নিতে হবে।
ঙ) মাটির পিএইচ পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী নির্ধারিত মাত্রায় পাথুরে চুন অথবা ডলো চুন প্রয়োগ করতে হবে। যেমন:- পিএইচ মান ৬.০ হলে শতকে ১.৫ কেজি হারে এবং পিএইচ মান ৬.৫ এর ক্ষেত্রে শতকে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
চ) মাটির জৈব উপাদনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে প্রয়োজনবােেধ প্রতি শতকে ২ কেজি সরিষার খৈল পচা গোবর জৈব সার হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ সময় রাসায়নিক সার প্রতি শতকে ২৫-৩০ গ্রাম হারে ইউরিয়া ও ৩০–৩৫ গ্রাম হারে টিএসপি অথবা ৯০ গ্রাম হারে ডিএপি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ছ) সাত দিনের মধ্যে ঘেরের পানিতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হলে পোনা মজুদ করতে হবে।
পোনা সংগ্রহ
ক) নার্সারিতে প্রতিপালনের জন্য হ্যাচারি উৎপাদিত সুস্থ ও সবল বাগদা চিংড়ির পোস্ট লার্ভা বা পিএল (গড়। দৈর্ঘ্য ১.৫ সেমি ও গড় ওজন ০.০০৫ গ্রাম) নির্বাচন করা যেতে পারে।
খ) থাই পাঙ্গাসের বড় পোনা (গড় দৈর্ঘ্য ৫.৫ সেমি ও গড় ওজন ৪.০ গ্রাম) মজুদে ভালো বর্ধন পাওয়া যাবে।
গ) গিফট তেলাপিয়ার পোনা (গড় দৈর্ঘ্য ৫-৭ সেমি ও গড় ওজন ৪.০ গ্রাম) নির্ভরযোগ্য হ্যাচারি হতে সংগ্রহ করে মজুদ করলে কাঙ্খিত বাচার হার ও ভালো উৎপাদন পাওয়া যেতে পারে।
চিংড়ির পোনার নার্সারি প্রতিপালন
ক) ঘের/খামারের পরিচ্ছন্ন স্থানে ঘের প্রস্তুতির সময়েই নাইলনের সূক্ষ্ম মেসের জাল দিয়ে ৪০ বর্গমিটার (এক শতাংশ) এলাকা ঘিরে নিয়ে একটি নার্সারি তৈরি করতে হবে।
খ) পানি মজুদ উপযোগী হলে, প্রতি বর্গমিটারে ৬০০ টি (২৪০০০ টি/শতক) বা এর কম সংখ্যক পোনা মজুদ করতে হবে।
গ) চিংড়ি পোনা ছাড়ার পরদিন থেকে প্রথম সপ্তাহে মোট দেহ ওজনের ১০০% ভাগ হারে বাণিজ্যিক চিংড়ি খাদ্য স্টার্টার-১ দিতে হবে এবং পরবর্তী সপ্তাহে ক্রমাগত কমিয়ে ৫০% ও ৩০% হারে একমাস প্রয়োগ করতে হবে।
ঘ) পোনা প্রতিপালন ২১ দিন হলে ঘেরে ছেড়ে দিতে হবে।
সুবিধা
ক) নার্সারির মধ্যে খাবার প্রয়োগে পোনা সহজেই খাবার খেতে পারে।
খ) বিভিন্ন কারণে পোনা নষ্ট হওয়া বা মৃত্যুর হতে রক্ষা পেয়ে থাকে।
চাষ ব্যবস্থাপনা
চিংড়ি অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রাণী হওয়ায় এর মিশ্রচাষ যথাযথ নিয়মে করা বাঞ্ছনীয়। মজুদকরণ থেকে আহরণ করা পর্যত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পোনা মজুদকরণ
ক) প্রতি হেক্টরে নার্সারিতে ২১ দিনের প্রতিপালিত বাগদা চিংড়ির পোনা (০.২-০.৪ গ্রাম) ২০,০০০ টি (শতকে ৮০ টি)-র সাথে পারসে পোনা (১.০ গ্রাম) ৫,০০০ টি (শতকে ২০ টি) ছাড়া যেতে পারে।
খ) প্রতি হেক্টরে নার্সারিতে প্রতিপালিত ২১ দিনের বাগদা চিংড়ির পোনা (০.২-০.৪ গ্রাম), থাই পাঙ্গাসের পোনা (৪.০-৫.০ গ্রাম) ও গিফট তেলাপিয়ার পোনা (০.৫-১.০ গ্রাম) সমপরিমাণে (১৪১৪১ অনুপাতে) শতকে ৬০ টি হিসেবে প্রতি হেক্টরে মোট ১৫,০০০ টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
খাদ্য প্রয়োগ ও পরিচর্যা
ক) মজুদ পুকুরে/ঘেরে স্থানান্তরের পর স্থানীয়ভাবে প্রান্ড খাদ্য উপাদানসমূহ, যেমন: ফিসমিল- ৩০%, সরিষার খৈল- ২৫% ও চালের কুঁড়া- ৪৫% দিয়ে খাবার তৈরি করে চিংড়ি ও মাছের মোট দেহ ওজনের ৩৫% হারে প্রয়োগ করতে হবে।
খ) খাবার প্রতিদিন ভােের এবং সন্ধ্যায় দু বারে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে ঝাকি জালের সাহায্যে চিংড়ি ও মাছের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
পানি ব্যবস্থাপনা
ক) প্রয়োজন সাপেক্ষে অমাবস্যা-পূর্ণিমার সময় ৩০ শতাংশ পানি প্রবেশ বা পরিবর্তন করে নিতে হবে। এতে করে খামারে পানির গুণগতমান সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
খ) পানির স্বচ্ছতা ৩৫ সেমি এর বেশি হলে, প্রতি হেক্টরে ৩০ কেজি ইউরিয়া ও টিএসপি (৩ঃ১ অনুপাতে) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
গ) এছাড়াও পানির লবণাক্ততা, পিএইচ ও তাপমাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রেখে কোনো ব্যতিক্রম ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঘ) নিয়মিত জলজ আগাছা এবং শেওলা পরিষ্কার করতে হবে।
চিংড়ির আহরণ
ক) তিন-চার মাস লালনের পর অথবা বাজারজাত উপযোগী হলেই চিংড়ি আহরণ শুরু করতে হবে।
খ) সাধারণত গিষ্ট তেলাপিয়া ৪ মাসে এবং পারসে ও পাঙ্গাস মাছ ১০ মাস বা ততািেধক সময়ে বিক্রয়যোগ্য হয়।
গ) এ সময়ে ঘের শুকিয়ে সমুদয় মাছ আহরণ করা বাঞ্ছনীয়।
কোনো স্থানের লবণাক্ততার উপর নির্ভর করে চিংড়ির দ্বিতীয় ফসল চাষ করা যেতে পারে। উপযুক্ত লবণাক্ততা থাকলে, দ্বিতীয় দফায় সমান সংখ্যক বাগদা চিংড়ির পোনা মজুদ করতে হবে এবং প্রথমবারের মতই ঘের ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
উৎপাদন
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায় যে, যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নত মিশ্রচাষ পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ির বাঁচার হার ৬০-৭০% এবং গড় ওজন ৪৫-৬০ গ্রাম হলে হেক্টর প্রতি মোট ১৩৫-২১০ কেজি চিংড়ি আহরণ করা সম্ভব। আহরণের সময় একই সঙ্গে প্রতি হেক্টরে পারসে, থাই পাঙ্গাস ও গিফট তেলাপিয়া যথাক্রমে ৩০০, ১৫০০, ও ৫০০ কেজি মাছ উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।
সমস্যা
ক) চিংড়ির জন্য পরিমিত খাবার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অতিরিক্ত খাবার পানি দূষণের কারণ হতে পারে।
খ) থাই পাঙ্গাস মাছের জন্য পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিত করতে হবে। খাবার ঘাটতি হলে থাই পাঙ্গাসের উৎপাদন ব্যহত হবে।
গ) অতি খরায় অথবা গভীরতা কম থাকলে, পানি অস্বাভাবিক গরম এবং অতিবর্ষণে পানির লবণাক্ততা দ্রুত কমে যেতে পারে।
ঘ) চিংড়ি ও মাছের রোগ দেখা দিতে পারে।
পরামর্শ
- অবশ্যই নিয়মিতভাবে পরিমাণ অনুযায়ী খাবার দিতে হবে।
- প্রয়োজনে পানি পরিবর্তন করতে হবে এবং ঘেরের পানির গভীরতা বজায় রাখতে হবে।
- চিংড়ি এবং মাছের স্বাস্থ্য নিয়মিত পর্যবেণ করতে হবে।
- চিংড়ি বাজারজাতকরণ উপযোগী হওয়া মাত্র সেগুলো আহরণ করতে হবে।
সম্ভাব্য আয়-ব্যয়
বাগদা চিংড়ি ও পারসে মাছের মিশ্রচাষ এবং বাগদা চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের মিশ্রচাষের ফলে হেক্টর প্রতি আয়, ব্যয় ও মুনাফা নিচের সারণিতে দেখানো হলোঃ
মিশ্রচাষ পদ্ধতি | ব্যয় (টাকা) | আয় (টাকা) | মুনাফা (টাকা) | অনুপাত |
বাগদা চিংড়ি ও পারসে মাছ | ৯২,৬০০/- | ৩,২৮,৫০০/- | ২,৩৫,৯০০/- | ১: ২.৫৫ |
বাগদা চিংড়ি, থাই পাঙ্গাস ও গিফট তেলাপিয়া | ৮৪,১০০/- | ১,৯০,৩৭৫/- | ১,০৬,২৭৫/- | ১:২.৫৬ |
ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষ
ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষের সুবিধাসমূহ নিম্নরূপঃ
ক) একই সময়ে একই জমিতে দুটি ফসল পাওয়া যায়।
খ) অল্প শ্রম ও অল্প খরচ হওয়ার ফলে আয় বেশি হয়।
গ) চিংড়ি ধান ক্ষেতের ছোট ছোট আগাছা খেয়ে আগাছা দমনে সহায়তা করে।
ঘ) চিংড়ির মল খানের সার হিসেবে কাজ করে।
ঙ) চিংড়ি ধানের অনেক পোকা খেয়ে কীটনাশক প্রয়োগর ব্যয় কমায় ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখে।
চ) ধানের ফলন শতকরা প্রায় ১০ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
ছ) চিংড়িকে সম্পূরক খাদ্য না দিলেও চলে।
ক. জমি নির্বাচন
সব ধরনের জমিতে ধানের সাথে চিংড়ি চাষ লাভজনক নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে-
ক) জমিতে অন্তত ৩-৪ মাস সব সময় ১০-১৫ সেমি (৪-১৮ ইঞ্চি) পানি থাকতে হবে।
খ) এঁটেল বা দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভালো, কারণ এর পানি ধারণক্ষমতা সবচেয়ে বেশি।
গ) জমিটি বন্যামুক্ত হতে হবে।
ঘ) জমির অবস্থান বাড়ির কাছাকাছি হলে ভালো হয়। কারণ এতে ব্যবস্থাপনায় অনেক সুবিধ বধা হয়।
ঙ) আইল উঁচু করে বাধার কারণে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে অন্য কৃষকের সমস্যা সৃষ্টি হবে কিনা তা বিবেচ- নায় আনতে হবে।
চ) ২/৩ জন কৃষক মিলে এক সাথে ধানক্ষেতে মাছ চাষ করার ক্ষেত্রে শুরুতেই একটি চুক্তি করে নেয়া উচিত।
খ. জমি প্রস্তুতকরণ
ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষের জন্য জমির প্রস্তুতি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জমির প্রতি যত ভালো হবে, তত বেশি ধান ও চিংড়ি উৎপাদন হবে। জমির প্রস্তুতির সময় যে বিষয়গুলো মনে রাখা প্রয়োজন তা হলোঃ
ক) জমির আয়তন: ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষের জন্য জমির আয়তন ৩০-১০০ শতক হলে ভালো হয়।
খ) আইল উঁচু স্থানীয়ভাবে বন্যায় যে পরিমাণ পানি হয় তার চেয়ে ১২-১৮ ইঞ্চি উঁচু করে আইল বাঁধতে হবে। জমির আইল অবশ্যই মজবুত হওয়া প্রয়োজন যাতে পানির চাপে ভেঙে না যায়।
গ. গর্ত ও নালা খনন
ক) জমিতে আগে থেকেই বদি গর্ত না থাকে তবে নতুন করে পর্ত করতে হবে। জমিয় যে দিকে ঢালু সেদিকে এক কোণে গর্ত করা সুবিধাজনক।
খ) মোট জমির শতকরা ৪-৬ ভাগের বেশি গর্ত হওয়া উচিত নয়। যেমন- ৫০ শতাংশের একটি জমির জন্য ২-৩ শতাংশ গর্ত হলেই যথেষ্ট।
গ) গর্তের পভীরতা ২-৩ ফুটের বেশি হওয়া উচিত নয়। গভীরতা বেশি হলে চিংড়ি গর্ত থেকে ধান ক্ষেতে যাবে না, ফলে চিংড়ির বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কম হবে।
ঘ) সমস্ত ক্ষেতে চিংড়ি চলাচল করার জন্য এক বা একাধিক নালা করা প্রয়োজন। নালার সাথে পর্তের। সরাসরি সংযাগে থাকতে হবে।
ঙ) নালাগুলো ১-১.৫ ফুট চওড়া এবং ১-১.৫ ফুট গভীর হতে হবে।
জমিতে গর্ত ও নালা করার উদ্দেশ্যসমূহ হলোঃ
ক) ক্ষেতে সব সময় চিংড়ির জন্য পানি ধরে রাখা। কোনো কারণে ক্ষেতে পানি কমে পেলে চিংড়িগুলো নালার সাহায্যে গর্তে এসে আশ্রয় নিতে পারবে।
খ) ক্ষেতের পানি খুব গরম হয়ে পেলে চিংড়ি নালা ও গর্তের ঠান্ডা পানিতে আশ্রয় নিতে পারবে।
গ) ধান ক্ষেতে খুব বেশি পোকার আক্রমণ হলে ক্ষেতের পানি শুকিয়ে মাছগুলোকে গর্তে নিয়ে কীটনাশক প্রয়োগ করা যায়।
ঘ) চিংড়ি ধরার সময় চিংড়িকে একত্রিত করার জন্য নালা ও গর্ত ব্যবহৃত হয়।
ঘ. ধান ব্যবস্থাপনা
মূলত জমি প্রস্তুতির উপর ধান ও চিংড়ির ফলন নির্ভর করে। ব্যবস্থাপনা যত বেশি কার্যকর ও ফলপ্রসূ হবে, ফলন তত ভালো হবে। সুতরাং ধান ও চিংড়ির ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। ধান ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো
ক) ধানের জাত নির্বাচন
সব জাতের ধানের সাথে চিংড়ি চাষ করা যায়, তবে উচ্চ ফলনশীল যে সব জাতের ধান মাঝারি ধরনের লম্বা হয়। সে সব জাতের ধান চিংড়ি চাষের জন্য বেশি সুবিধাজনক। ধানের পানি সহ্য ক্ষমতা বেশি থাকতে হবে। কয়েকটি উপযোগী ধানের জাত হলো- আমন মৌসুমে বিআর-১১, বিআর-৩, বিআর-৩০ এবং বারো েমৌসুমে
খ) জমি আলাহা মুক্তকরণ
ধানের ভালো ফলন পাওয়ার জন্য ধান লাগানোর ৪০-৪৫ দিন পর্যন্ত জমি সম্পূর্ণ আগাছামুক্ত রাখতে হবে। চিংড়ি কচি আগাছার পাতা খেয়ে আগাছা দমনে সহায়তা করে থাকে। তথাপি জমিতে বেশি আগাছা জন্মালে তা অবশ্যই তুলে ফেলতে হবে। আগাছা পরিষ্কারের সময় পানি খুব ভালো হলে অনেক সময় ছোট ছোট চিংড়ি মারা যেতে পারে। তাই সমস্ত জমির আগাজা ১ দিনে না তুলে ২/৩ দিনে ভোলা উচিত।
গ) ধানের পোকা দমন
ধান ক্ষেতে সবসময় কিছু না কিছু পোকা থাকে। এসব পোকার সবগুলাই খানের জন্য ক্ষতিকর নয়। এসব পোকার মধ্যে কিছু উপকারী পোকা লাছে, যেগুলো খানের ক্ষতিকর পোকাকে খেত্রে খালের উপকার করে থাকে। সুতরাং ধান ক্ষেতে কিছু পোকা দেখা মাত্রই, কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত নয়। খানে কি পরিমাণ পোকার আক্রমণ হয়েছে সেটা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। সবসময় চেষ্টা করা উচিত যাতে খালে ক্ষতিকর পোকার উপস্থিতির পরিমাণ কম থাকে। সেজন্য নিচের ব্যবস্থাঞ্চলো গল্প করা যেতে পারে
- ধান ক্ষেতে কঞ্চি বা ভাল পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা।
- রাঙ্কের বেলা আলোর ফাঁদ পাকা।
- পৌকা ধরার জাল বা বাত দিত্রে পোকার ডিম সংগ্রহ করা।
- জমিতে সবসময় পরিমাণ মতো পানি রাখা।
- সুষম ও সঠিক মাত্রায় সায় প্রব্রোগ করা।
- ধান গাছ যখন আইলের চেয়ে ছোট থাকে তখন পানি সেচ দিয়ে ১/২ ঘন্টার জন্য ধান পাছখলোকে ডুবিয়ে দিলে খানের পোকা পানিতে ভেসে উঠবে এবং চিংড়ি সে পোকাগুলো খেতে পারবে।
- যদি পোকার আক্রমণের তীব্রতা খুব বেশি হয় এবং কীটনাশক প্রয়োগ আবশ্যক হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে ক্ষেতের পানি সেচে চিংড়িগুলোকে পর্তে এনে কীটনাশক প্রয়োগ করা যায়। ৫-৬ দিন পর কীটনাশকের বিষক্রিয়া কমে গেলে ক্ষেতে পানি ঢুকিয়ে চিংড়িগুলোকে ক্ষেতে নিতে হবে।
ঙ. চিংড়ি ব্যবস্থাপনা
ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে চিংড়ি ব্যবস্থাপনার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলোঃ
ক) চিংড়ি মজুদ
ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করতে হবে। ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষের জন্য প্রতি বর্গ মিটারে ৩টি করে চিংড়ি মজুদ করা যেতে পারে।
খ) চিংড়ি চাষের সময়
লোনা পানিতে মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যনত চিংড়ি চাষের জন্য সর্বোত্তম সময়।
গ) চিংড়ির সম্পূরক খাদ্য
ধানক্ষেতে চিংড়ি চাষে কোনো বাড়তি খাবার না দিলেও চিংড়ি উৎপাদিত হতে পারে। চিংড়ি ধান ক্ষেতের শেওলা, পোকা-মাকড় ও পচনশীল দ্রবাদি খেয়ে থাকে। তবে কিছু খাবার প্রয়োগ করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এমনকি খাদ্য প্রয়োগের ফলে চিংড়ির উৎপাদন ২ ঋণেরও অধিক করা যেতে পারে।
এর জন্য শুরুতে চালের কুঁড়া ও গোবর ১৪৩ অনুপাতে মিশিয়ে বলের আকারে হেক্টর প্রতি ১০ কেজি পরিমাণে প্রতি ৭ দিন অন্তর অন্তর পরিখা ও গর্তে দিতে হবে। চিংড়ি ছাড়ার মাস খানেক পর থেকে মোট চিংড়ির ওজন অনুমান করে ওজনের ৩-৫ শতাংশ হারে খৈল ও ভূষি বা কুঁড়া ১৪১ অনুপাতে মিশিয়ে ১ দিন ভিজিয়ে রেখে গমের ভুষি বা চাউলের কুঁড়ার সাথে মিশিয়ে বল আকারে বিকেল বেলায় কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে দিতে হবে।
ঘ) চিংড়ির রোগ
সাধারণত ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষ করলে চিংড়ির রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তথাপি রোগ দেখা দিলে চিংড়িগুলোকে গর্তে এনে শতকে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
চ. ধান ও চিংড়ি আহরণ
সাধারণত ১০০-১২০ দিনের মধ্যে ধান কাটা যায়। আর এই সময়ের মধ্যে প্রতিটি চিংড়ির ওজন হয় গ্রাম। এই সময় হাত বা জালযারা সাবধানে চিংড়ি আহরণ করা যেতে পারে।
লবণ উৎপাদন ও চিংড়ি মাছ/ধান চাষ
লবন উৎপাদন ও চিংড়ি মাছ/ধান চাষ প্রখা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় প্রচলিত আছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রণীত বাংলাদেশের উপকূলীয় ঈষৎ লবণাক্ত পানিতে লবণ ও চিংড়ি মাছ/ধান চাষের বর্ষপঞ্জিকা নিচের চিত্রে দেখানো হলো।
আরও দেখুনঃ