আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-মিরর কার্প বা কার্পিও মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন
মিরর কার্প বা কার্পিও মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন
রুই জাতীয় কার্প মাছ বদ্ধ জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন করে না । এসব মাছের প্রাকৃতিক প্রজননের জন্য মৃদু স্রোত প্রয়োজন বদ্ধ জলাশয়ে সে পরিবেশ না থাকায় বদ্ধ জলাশয়ে প্রজনন করে না। কিন্তু কমন বা মিরর কার্পের ব্যাতিক্রম । এরা বদ্ধ জলাশয়ে যেমন- পুকুর, দীঘি, ডোবা, বিল, বাঁওড়ে সামান্য কিছু জলজ আগাছায় প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন করে।
কমন কার্পে এ প্রজনন স্বভাবকে কাজে লাগিয়ে সামান্য কিছু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা বদ্ধ জলাশয়ে এবং ধানক্ষেতের গর্তে রেণু উৎপাদন করতে পারি। বোরো মৌসুমে ধান ক্ষেতে সাধারণত পানির পরিমাণ কম থাকে। ফলে আঙ্গুলী পোনা ছেড়ে বড় আকারের মাছ উৎপাদনের চেয়ে কমন কার্পের রেণু ছেড়ে আঙ্গুলী পোনা উৎপাদন অনেক সহজ।
মাছের পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য :
১. বিদেশি মাছ ।
২. পুকুরেই ডিম দেয় ।
৩. ভালো খাদ্য পেলে বছরে ১-৩ কেজি ওজন হয় ।
৪. পানির নিচের স্তরে বাস করে ।
৫. রুই কাতলা মাছের সাথে মিশ্র চাষ করা যায় ।
৬. গলদা চিংড়ির সাথে মিশ্র চাষ করা যায় না ।
মিরর কার্প ও কার্পিও বা কমন কার্প মাছের পার্থক্যকরণ বৈশিষ্ট্য :
মিরর কার্প :
ক. দেহ ঈষৎ হলদে থেকে সবুজাভ
খ. শরীরে পার্শ্ব রেখা এবং পৃষ্ট পাখনার দিকে অল্প দুই একটা আঁইশ থাকে ।
গ. সাধারণত কার্পিয় মাছের চেয়ে দেহের বৃদ্ধি বেশি হয় ।
২। কার্পিও বা কমন কার্প মাছ :
ক. এদের দেহ সোনালি, হলদে বা লালচে রঙের হয় ।
খ. সমস্ত শরীর আঁইশ দিয়ে আবৃত্ত ।
গ. মিরর কার্পের চেয়ে কিছুটা কম গতিতে বাড়ে।
স্বভাব ও খাদ্য
১. পুকুরের তলায় ও পাড়ের দিকে বিচরণ করে।
২. অনেক সময় পুকুরের পাড় ভেঙে ফেলে।
৩. পুকুরের তলায় কীটপতঙ্গ খেতে পছন্দ করে তবে সম্পূরক খাদ্যও খায় ।
প্রাকৃতিক প্রজনন
প্রজনন ঋতু মূলত দুটি মৌসুমে প্রজনন করে
শীতকালীন প্রজনন : অগ্রহায়ণ, (নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি) থেকে ফাল্গুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত ।
বর্ষাকালীন প্রজনন : জৈষ্ঠের (জুন) মাঝামাঝি থেকে আষাঢ় (জুলাই) পর্যন্ত । প্রজনন সময় : অমাবস্যা অথবা পূর্ণিমার মধ্যে অথবা অমাবস্যা পূর্ণিমার কাছাকাছি সময় । প্রজনন স্থান : পুকুর পাড়ের কাছাকাছি জলজ আগাছা, যেমন : কচুরিপানা, টোপাপোনা ইত্যাদির শিকড়ের মধ্যে ।
প্রজনন কৌশল
১। প্রজননক্ষম ব্রুড মাছ বাছাই করার উপায় ।
পুরুষ মাছ :
১. পার্শ পাখনার ভিতর দিকে খসখসে হবে ।
২. পেটে চাপ দিলে সাদা দুধের মতো মিল্ট বেরিয়ে আসবে ।
৩. দেখতে উজ্জ্বল এবং মোটাসোটা হবে ।

শ্ৰী মাছ
১. পেট বেশ ফোলা ফোলা দেখাবে।
২. নাভীর রং লাল দেখাবে এবং বাইরের দিকে কিছুটা বেরিয়ে থাকে ।
৩. পেটে চাপ দিলে ডিম বেরিয়ে আসে ।
২। বাসা তৈরি :
প্রজনন ঋতুতে পুকুরের অগভীর অংশে একটি খাচার মতো করতে হবে । ৫ ফুট লম্বা ৪টি বাঁশে চৌকোনাকার একটি ভাসমান কাঠামো করতে হবে । কাঠামোটি একটি খুঁটি দিয়ে নিরিবিলি জায়গ অবস্থায় স্থাপন করতে হবে। কাঠামোর মধ্যে কচুরিপানা দেওয়ার সময় ঐগুলো থেকে পচা শিকড় পরিষ্কার করে দিতে হবে । কচুরিপানাগুলোকে ১০ লিটার পানিতে ২০০-৩০০ গ্রাম লবণ চামচ পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট গুলে ৫-১০ মিনিট ভিজিয়ে নিলে ভালো হয়। পুকুরের স পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
৩। মিলন ।
ডিম দেওয়ার চূড়ান্ত সময় হলেই স্ত্রী ও পুরুষ মাছগুলো ঐ বাসার নিচে যেয়ে অবসরে মিলিত হবে।
৪। পর্যবেক্ষণ ।
যদি দেখা যায় পানাগুলো নড়াচড়া করছে এবং ওলটপালট হয়েছে। তবেই বুঝতে হবে মাছের প্রজনন শুরু হয়েছে। এভাবে প্রজনন সারাদিন রাত চলতে পারে। এ অবস্থায় মাছকে কোনো অবস্থাতেই বিরক্ত করা যাবে না।
৫। হাপা স্থাপন
ডিম দেওয়া শেষ হলে, কচুরিপানার বাসার কাছাকাছি জায়গার একটি ঘন/চট জালের ছাপা টানাতে হবে।
৬। পানা স্থানান্তর
ডিমসহ কচুরিপানা হাপাতে রাখতে হবে। পানাগুলো হাপাতে সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পোকামাকড় না থাকে এবং হাপা যেন কাঁকড়ায় কেটে না ফেলে। ১০ লিটার পানিতে ৫ মি. গ্রাম
ম্যালাকাইট গ্রীন মিশিয়ে, ডিমসহ কচুরিপানা ১-২ মিনিট ভিজিয়ে রেখে নিলে ভালো, তাতে রোগ জীবাণু
মুক্ত থাকে ।
৭। ডিম স্ফুটন :
ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে (শীতকালে) প্রায় তিন দিন সময় লাগে। এ অবস্থায় যেকোনো ধরনের পোকা যেন ডিমে না বসে সে জন্য নজর রাখতে হবে। হাপার পরিবর্তে গামলা বা ড্রামে ডিম ফুটালে প্রতি দিন পানি পরিবর্তন করতে হবে।
৮ । কচুরিপানা সরানো
ডিম ফুটলে তারা কচুরিপানার শিকড় ছেড়ে দিয়ে পানিতে কিলবিল করে সাঁতার কাটবে। তখন দেখতে অনেকটা মশার বাচ্চার মতো দেখাবে। এ অবস্থায় সাবধানে কচুরিপানা তুলে ফেলতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন শিকড়ের সাথে পোনা লেগে না থাকে ।
৯। রেণুপোনাকে খাওয়ানো
ডিমপোনার পেটের কুসুম থলি শরীরের সাথে মিশে গেলে বাইরের খাবার খেতে পারে । তখন পোনার বয়স প্রায় ২ দিন হয় । মুরগি বা হাঁসের ডিম ভালোভাবে সিদ্ধ করে কুসুমটি একটি পাতলা কাপড়ে নিয়ে একটি বাটিতে পানি নিয়ে ভালোভাবে গুলতে হবে যাতে বড় কোনো দানা না থাকে। কুসুম গোলা পানি হাপার যেখানে রেণু দেখা যাবে, সেখানে ছিটিয়ে দিতে হবে। দৈনিক ৩-৪ বার খাবার দিতে হয়। ৩-৪ দিন পর এ পোনা পূর্বে প্রস্তুত আঁতুড় পুকুরে ছেড়ে অন্যান্য মাছের পোনার মতো লালন-পালন করা যাবে ।
বিশেষ সতর্কতা
১ । প্রতিদিন ভোরে অব্যশই পোনা পর্যবেক্ষণ করতে হবে ।
২। ভালো পোনা পাওয়ার জন্য নার্সারি পুকুর তৈরির নিয়ম ভালোভাবে অনুসরণ করতে হবে ।
আরও দেখুন: