আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-প্রণোদিত প্রজননের জন্য ব্রুড মাছ লালন পালন
প্রণোদিত প্রজননের জন্য ব্রুড মাছ লালন পালন
ব্রুড মাছ বলতে প্রজনন উপযোগী বয়োপ্রাপ্ত স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে বুঝায় । প্রণোদিত প্রজননের মাধ্যমে উন্নত মাছের পোনা উৎপাদনে ব্রুড মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশে ষাটের দশকে কৃত্ৰিম উপায়ে হ্যাচারিতে মাছের পোনা উৎপাদন শুরু হয়। তবে আশির দশকে এটা ব্যাপক প্রসার লাভ করে ।
বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক উৎসের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার উপরই এদেশের মৎস্য চাষ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে মৎস্য চাষ সম্প্রসারণে উন্নত পোনার অভাব যথেষ্ট লক্ষণীয়। বর্তমানে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা থেকে মাছের উৎপাদন আশানুরূপ হয় না । কারণ হিসেবে অন্তঃপ্রজনন সমস্যা, প্রজননে ছোট আকৃতির ক্রুডের ব্যবহার এবং বিভিন্ন প্রজাতির সংকরায়ণই প্রধানতঃ দায়ী। এ সমস্যা নিরসনে অন্তঃপ্রজননমুক্ত উন্নত ব্রুড নির্বাচন ও সঠিক ব্যবস্থাপনা একান্ত প্রয়োজন ।
প্রণোদিত প্রজননে ব্রুড মাছের গুরুত্ব :
প্রণোদিত প্রজননে সফলতার প্রধান সোপান হচ্ছে ব্রুড মাছ। ব্রুড মাছকে হ্যাচারির প্রাণ বলা হয়ে থাকে কারণ প্রণোদিত প্রজননের সফলতার পুরোটাই নির্ভর করে মাছের প্রজনন পরিচর্যা ও রক্ষণবেক্ষণের উপর । তাছাড়া যত্নের উপর প্রজননকারী মাছের পরিপক্বতা, ডিম্বাশয় ও শুক্রাশয়ের বৃদ্ধি এবং প্রণোদিত প্রজননে সাড়া দেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে ।
শুধু তাই নয়, মাছের ডিম ছাড়ার হার, নিষেকের হার, ডিম ফোটার হার এবং পোনার বেঁচে থাকার হারও প্রজননকারী মাছের যত্ন ও পরিচর্যার উপর নির্ভরশীল। ব্রুড মাছ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা যায়। তবে স্ত্রী ও পুরুষ ব্রুড মাছ ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা উচিত । সুস্থ, সবল, বড় আকারের দ্রুতবর্ধনশীল মাছ ব্রুড হিসেবে নির্বাচন করা উচিত ।
ব্রুড মাছের ব্যবস্থাপনাকে প্রধানত ৩টি ধাপে ভাগ করা যায় :
১। মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা
২। মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা
৩। মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
১ । মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা :
ক) পুকুর নির্বাচন ।
ব্রুড মাছের পুকুরের আয়তন ০.৫০ একর থেকে ১ একর হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুকুরে পানির গভীরতা ১.৫-২ মিঃ (৫-৭ ফুট) থাকতে হবে। পুকুরে পানি সরবরাহ ও নির্গমনের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। পুকুরের তলদেশের মাটি এঁটেল বা দোঁআশ এবং কাঁদার পরিমাণ ১০-১৫ সে.মি. হওয়া উচিত। পুকুর এমন জায়গায় হতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকে। জাল টানার সুবিধার জন্য আয়তকার পুকুর অর্থাৎ দৈর্ঘ্য প্রস্থের চেয়ে বেশি হওয়া ভালো ।
খ) পাড় মেরামত ও তলদেশের কাদা তোলা :
পুকুরে অতিরিক্ত কাদা নিম্নলিখিত সমস্যা সৃষ্টি করে
i) পুকুরের তলদেশে ক্ষতিকর গ্যাস সৃষ্টি হয় ।
ii) পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন হ্রাস পায় ।
iii) পানি দুর্গন্ধ হয়ে যেতে পারে।
iv) স্ত্রী মাছের ডিম্বকোষ বৃদ্ধিতে ক্ষতি সাধন করে ।
v) পুরুষ মাছের শুক্রাণু সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করে ।
vi) মাছ আহরণে সমস্যা হয় ।
পুকুরে পাড় ভাঙা থাকলে নিম্নলিখিত সমস্যা সৃষ্টি করে :
i) পাড় ভাঙা থাকলে, মাছ বের হয়ে যেতে পারে । ii) বিষাক্ত পানি ঢুকে মাছ মারা যেতে পারে ।
iii) বাহির থেকে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ পুকুরে ঢুকতে পারে
iv) মৎস্যভুক প্রাণী সহজে ঢুকতে পারে ইত্যাদি ।
গ) জলজ আগাছা দূর করা।
জলজ আগাছা নিম্নোক্ত সমস্যা সৃষ্টি করে :
i) জলজ আগাছা পুকুরে থাকলে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না, ফলে প্রাকৃতিক খাদ্য কম তৈরি হয় ।
ii) ক্ষতিকর প্রাণী যেমন: সাপ, ব্যাঙ, গুইসাপ ইত্যাদি আশ্রয় নিতে পারে ।
iii) জলজ আগাছা পুকুরের পুষ্টিকর দ্রব্য শোষণ করে নেয় ।
iv) জলজ আগাছা ব্রুড মাছের চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তাই সব ধরনের জলজ আগাছা দূর করতে হবে ।
ঘ) রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা :
রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ পুকুরে থাকলে নিম্নলিখিত সমস্যার সৃষ্টি হয় :
i) চাষকৃত মাছের খাদ্য খেয়ে ফেলে।
ii) চাষকৃত মাছের জায়গা দখল করে নেয় ।
iii) প্রজনন করে মাছের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে ফেলে ।
iv) মাছকে আহত করতে পারে ।
দমন পদ্ধতি :
রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ তিন ভাবে দমন করা যায়-
i) বার বার জাল টেনে : বারবার জাল টেনে জলাশয়ের ৮৫-৯০% রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ দমন করা সম্ভব ।
ii) রোটেনন প্রয়োগ করে : প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট পানির জন্য ৩০-৩৫ গ্রাম রোটেনন প্রয়োগ করতে হয় ।
iii) পুকুর শুকিয়ে : ইহা রাক্ষুসে অবাঞ্ছিত মাছ দূর করার সর্বাপেক্ষা উত্তম পদ্ধতি । এ ক্ষেত্রে পুকুর রোগ জীবাণুমুক্ত হয়, উর্বরতা বৃদ্ধি পায় । এই কাজ ফাল্গুন-চৈত্র মাসে করলে খরচ কম হয় ।
৩) চুন প্রয়োগ
চুন প্রয়োগে নিম্নলিখিত উপকার হয় :
i) চুন মাটিতে ক্যালসিয়ামের অভাব দূর করে।
ii) মাটি ও পানির অম্লত্ব দূর করে।
iii) জৈব পদার্থের পচন তরান্বিত করে ।
iv) মাটি হতে ক্ষতিকর গ্যাস দূর করে দেয়।
v) মাটির পিএইচ ওঠা-নামাকে নিয়ন্ত্রণ করে ।
vi) রোগ-জীবাণু ধ্বংস করে ।
পুকুর শুকানোর পরপরই প্রতি শতাংশে
১ কেজি হারে চুন আগের দিন ভিজিয়ে রেখে পরের দিন রৌদ্রোজ্জ্বল সময়ে পাড়সহ সমস্ত পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে । চুন প্রয়োগের পরপরই পুকুরে পানি সরবরাহ করতে হবে ।
চ) সার প্রয়োগ :
পুকুর প্রস্তুতকালে
চুন প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর রাসায়নিক সার ও গোবর উপরোক্ত মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে । এর ৪- ৫ দিন পর হররা বা জাল টেনে তলদেশের মাটি নড়াচড়া করে ভেজানো খৈল পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
ছ) প্রকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা :
সার প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় । এক্ষেত্রে পানির রং হালকা সবুজ অথবা বাদামি হতে পারে। পানিতে ফাইটোপ্লাংটন বেশি থাকলে পানির রং হালকা সবুজ হয় এবং পানিতে জুপ্লাংক্টন বেশি থাকলে পানির রং বাদামি হয়। তিনভাবে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা করা যায়।
(i) গামছা-গ্লাস পদ্ধতি
(ii) সেকিডিস্ক পদ্ধতি (ii) হাত পদ্ধতি
জ) পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা।
পুকুরে রোটেননের সাহায্যে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা হলে এর বিষাক্ততা সাধারণত ৭ দিন পর্যন্ত থাকে। এর পরও সাবধনতা অবলম্বনের জন্য মাছ ছাড়ার আগে কিছু পরিমাণ মাছ ঐ পানিতে ২৪ ঘণ্টা রেখে পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করা যায় ।
ঝ) হররা বা জাল টানা : পুকুরের তলদেশের বিষাক্ত বা ক্ষতিকর গ্যাস দূর করার জন্য হররা বা জাল টানতে হয়।
২। মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা :
ক) প্রজাতি নির্বাচন :
কৃত্রিম প্রজননের সফলতা বহুলাংশে ব্রুড মাছের সঠিক প্রজাতি নির্বাচনের উপর নির্ভরশীল। সাধারণত হ্যাচারিতে বাণিজ্যিকভাবে কার্প জাতীয় মাছ যেমন- কাতলা, রুই, সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প, গ্রাস কার্প, কার্পিও এবং থাই স্বরপুঁটি মাছের প্রজনন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বিভিন্ন হ্যাচারিতে পাঙাশ মাছের প্রজনন করানো হয়ে থাকে । এলাকা ভিত্তিক রেণুর চাহিদার উপর ভিত্তি করে ব্রুডের প্রজাতি নির্বাচন করা উচিত ।
খ) ব্রুড মাছ সংগ্ৰহ :
(i) প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহ।
প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত ব্রুড অন্তঃপ্রজনন মুক্ত, স্বাস্থ্যবান, দ্রুত বর্ধনশীল ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন হয় । সংগৃহীত প্রাকৃতিক উৎসের মজুদ থেকে সঠিকভাবে ব্রুড বাছাই ও প্রতিপালনের পর কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে যে পোনা পাওয়া যায় সেগুলো দ্রুত বর্ধনশীল উন্নত মানের পোনা।
প্রাকৃতিক উৎস থেকে রেণুপোনা সংগ্রহ করেও ব্রুড তৈরি করা যায়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত রেণুপোনা অসংখ্য পৃথক পিতা-মাতা থেকে উৎপাদিত বিধায় উন্নত গুণগত মান বজায় থাকে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিভিন্ন সময়ে রেণুপোনা সংগ্রহ করে সেখান থেকে স্বাস্থ্যবান দ্রুত বর্ধনশীল পোনা বাছাই করে উন্নত ব্রুড স্টক তৈরি করা যায় । ব্রুড স্টক তৈরি করার জন্য পোনাগুলোকে আলাদাভাবে প্রতিপালন করে তার মধ্যে থেকেই দ্রুত বর্ধনশীল এবং স্বাস্থ্যবান পোনাকে বাছাই করতে হবে।
কোনো অবস্থাতেই একই ব্রুড স্টককে ৪-৫ বছরেরবেশি প্রজননে ব্যবহার করা উচিত নয়। শুরু থেকেই এ সকল কাজগুলো গুরুত্ব সহকারে সতর্কতার সাথে আন্তরিকভাবে সম্পাদন করা উচিত।
(ii) পুকুর থেকে সংগ্রহঅন্তঃপ্রজননযুক্ত উন্নত ব্রুড হতে হ্যাচারিতে উৎপাদিত নিজস্ব পোনা থেকে বিক্রয়ের পূর্বে স্বাস্থ্যবান এবং দ্রুত বর্ধনশীল পোনা বাছাই করে ব্রুড স্টক তৈরির জন্য রাখা উচিত। সংগৃহীত পোনা যেন ভাই-বোন বা নিকট আত্মীয় না হয় এ দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। পরবর্তীতে এদের মধ্যে যারা দ্রুত বর্ধনশীল হবে তাদেরকে পর্যায়ক্রমিকভাবে এক বছর বয়সের মাছ থেকে উন্নত মাছগুলোকে ব্রুড স্টক তৈরিতে ব্যবহৃত করা হয়। বয়স্ক, রোগগ্রস্থ, স্বাস্থ্যহীন ব্রুড স্টককে প্রজননের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এদের থেকে উৎপাদিত মাছের পোনা গুণগত বৈশিষ্ট্য খুবই নিম্নমানের হবে এবং পরবর্তীতে ব্যাপক কৌলিতাত্ত্বিক অবক্ষয় হবে ।
(iii) ব্রুড প্রতিস্থাপন
ব্রুড মাছ ব্যবহারের ফলে প্রতি বছরই কিছু না কিছু ব্রুড নষ্ট হয়। এগুলো পূরণের জন্য ২/১টি পুকুরে প্রাকৃতিক উৎসের কিংবা অন্য কোনো দূরবর্তী স্থান থেকে সংগৃহীত মান সম্মত পোনা প্রতিপালনের সংস্থান রাখতে হবে । এই পোনা থেকে দ্রুতবর্ধনশীল ও স্বাস্থ্যবান মাছগুলো পরিত্যক্ত ব্রুড মাছের বদলে নিয়মিত ব্যবহার করা হয় । বিদেশি প্রজাতির মাছগুলো দীর্ঘদিন আগে এদেশে আনা হয়েছে। এগুলোর অন্তঃপ্রজনন ঘটার ফলে গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কিংবা সরকারের সহায়তায় বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশ থেকে নতুন ব্রুড মাছ আনার ব্যবস্থা করা অতীব জরুরি।
(iv) ব্রুড ব্যাংক থেকে
ব্রুড ব্যাংক হলো এমন একটি স্থান যেখানে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছ বা উন্নত জাতের পোনা উৎপাদনের জন্য বিপুল সংখ্যক মাছকে প্রাকৃতিক উৎস হতে, বিদেশ থেকে আমদানি করে অথবা পুকুরে বা হ্যাচারিতে অতি যত্ন সহকারে প্রতিপালন করে কৌলিতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হয়। যেখান থেকে হ্যাচারি মালিকগণ তাদের চাহিদা অনুযায়ী পোনা সংগ্রহ করতে পারে সেই স্থানকে ব্রুড ব্যাংক বলে ।
গ) টেকসইকরণ:
মাছকে প্রতিকূল অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়াকে টেকসইকরণ বলে। ব্রুড মাছ পরিবহনের সময় মাছ তার পেটের ভিতরের খাদ্য মলত্যাগ বা বমি করে পানি যেন দূষিত করতে না পারে সেজন্য পরিবহনের আগে মাছকে জাল টেনে হাপা বা হাউজে রেখে, পানির ঝাপটা দিয়ে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত মাছকে অভুক্ত রেখে টেকসইকরণ করতে হয় ।
ঘ) ব্রুড মাছ পরিবহ
ব্রুড মাছ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিবহন করা উচিত। পরিবহনের সময় মাছ যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়। ব্রুড মাছ পরিবহনের আগে টেকসইকরণ জরুরি। এক্ষেত্রে জাল টেনে পানির ঝাঁপটা দিয়ে এবং ব্রুড মাছকে ৪৮ ঘণ্টা অভুক্ত রেখে টেকসইকরণ করা যেতে পারে। পরিবহনের বেশি প্রজননে ব্যবহার করা উচিত নয়। শুরু থেকেই এ সকল কাজগুলো গুরুত্ব সহকারে সতর্কতার সাথে আন্তরিকভাবে সম্পাদন করা উচিত।
পূর্বে মাছ বাছাইয়ের কাজটি সকালবেলা সেরে ফেলা ভালো কারণ তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায় । ফলে মাছ বাছাইয়ের সময় বেশিক্ষণ উচ্চ তাপমাত্রায় পানিতে থাকার ফলে মাছের দেহে চাপ পড়ে। এতে করে প্রজননে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। দুই ধরনের পদ্ধতিতে ব্রুড মাছ পরিবহন করা হয় যেমন :
১। উন্মুক্ত বা খোলা পদ্ধতি
২। বদ্ধ পদ্ধতি
১। উন্মুক্ত পদ্ধতি : এই পদ্ধতিতে পাত্রের উপরের দিক বা মুখ খোলা থাকে। এক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকতেও পারে আবার নাও পারে। প্রয়োজনে সময় সময় পানি বদল করে
ফিশ কালচার অ্যান্ড ব্রিডিং-২
দেওয়া যায়। পুকুর হতে হ্যাচারি দূরবর্তী স্থানে হলে পরিবহন ট্যাংকের মাধ্যমে ব্রুড মাছ পরিবহন করা উচিত। সাধারণত ট্রলি বা খোলা জীপের ওপর ট্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে ব্রুড মাছ পরিবহন অত্যন্ত নিরাপদ । মাছ পরিবহনের সময় পরিবহন ট্যাংকের ভিতরে পলিথিন ব্যাগ ঢুকিয়ে তার মধ্যে মাছ পরিবহন করা উচিত ।
তাছাড়াও কোনো কোনো স্থানে মোটা কাপড় বা ত্রিপলের তৈরি বিভিন্ন আকারের উন্মুক্ত পাত্র বিশেষ ধরনের ধাতব নির্মিত ফ্রেমে আটকিয়ে রেখে ব্রুড মাছ পরিবহন করা হয়। এ সময় ব্যাটারিচালিত এরেটর-এর সাহায্যে পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয় । এভাবে ব্রুড মাছ পরিবহনের সুবিধা হলো মাছ কম আহত হয় এবং পানি তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা থাকে। সাধারণত এ ধরনের পাত্রের আকার এক মিটার ব্যাস এবং ১.২৫ মিটার গভীর হয়ে থাকে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই পদ্ধতিতে ব্রুড মাছ পরিবহন করা হয় ।
২। বদ্ধ পদ্ধতি : সাধারণত স্বল্প দূরত্বের ব্রুড মাছ পরিবহনের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় । এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরে ব্রুড মাছ স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে পলিথিন ব্যাগে পরিমিত পরিমাণ পানি নিয়ে ৫-৬ কেজি ব্রুড মাছ রাখা হয়। মাছের মাথা পলিথিন ব্যাগের নিচের দিকে রাখতে হবে। তারপর মাছসহ পলিথিন ব্যাগে ভেজা বস্তার ভিতর ঢুকিয়ে অতি দ্রুত পরিবহনের কাজ সমাধা করতে হবে।
তাছাড়া দূরবর্তী স্থানে ব্রুড মাছ পরিবহনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আকারের পাত্রের নকশা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ধরনের একটি পাত্রে একত্রে ৬০ কেজি ব্রুড মাছ পরিবহন করা যায়। পারে প্রতি কেজি মাছ পরিবহনের জন্য ৪-৫ লিটার পানি থাকতে হবে । সাধারণত মাছগুলোকে মোটা পলিথিন ব্যাগে করে পরিবহন করা হয়। ব্যাগ যাতে ফেটে না যায় সেজন্য কাঠের বা মোটা কাগজের তৈরি বাক্সে ব্যাগটি রাখা হয়। পরিবহনকালে প্রয়োজনে জরুরি অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা থাকে ।
ব্রুড মাছ পরিবহনকালে ব্যবহৃত অবচেতনকারী ওষুধসমূহ।
ব্রুড মাছ পরিবহনের ক্ষেত্রে মাছকে অবচেতন করা আবশ্যক। সাম্প্রতিককালে ব্রুড মাছ পরিবহনের সময় মাছকে অবচেতন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয়। নিম্নলিখিত সুবিধার
কারণে এ সকল দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয় ।
১। মাছের ওপর সামগ্রিক চাপ হ্রাস পায় ।
২। অক্সিজেন গ্রহণের হার হ্রাস পায় এবং একইভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থে
নিঃসরণ হ্রাস পায়।
৩। মাছের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রিত হয় ফলে দৈহিক ক্ষত কম হয় ।
৪। ব্রুড মাছ সুস্থ ও সবল থাকে।
রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করে কম খরচে মাছকে পরিবহন করার সহজ পদ্ধতি হচ্ছে পরিবহনের সময় পানির তাপমাত্রা ৫-১° সে. এর মধ্যে রাখা। কিন্তু উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা সম্ভব নয় কারণ পরিবহনকালে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তবে যদি পরিবহন মাধ্যম হিসাবে ঠাণ্ডা পানির সরবরাহ পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে রাসায়নিক অবচেতনকারী দ্রব্যাদি ব্যবহার করা উচিত ।
উপরোক্ত রাসায়নিক দ্রব্যাদির মধ্যে কুইনালডিন এবং এমএস ২২২ মাছকে অবচেতন করার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কুইনালডিন বিষাক্ত হওয়ার ব্যবহারের সময় সতকর্তা অবলম্বন করা উচিত । সাধারণত বৃহৎ আয়তনের পানিতে মাছকে অবচেতন করার কাজে কুইনালডিন ব্যবহৃত হয়। এম এস ২২২ দ্বারা ব্রুড মাছ অবচেতন করার সময় নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। প্রথমে ব্রুড মাছকে ১ঃ ২০০০০ মাত্রার এম এস ২২২ দ্রবণে রাখা হয়। ১৫-২০ মিনিট পর মাছ যখন সম্পূর্ণভাবে অবচেতন হয় তখন উক্ত দ্রবণে পানি যোগ করে দ্রবণের ঘনত্ব কমানো হয় । কমন কার্প এবং বিগহেড কার্পের ক্ষেত্রে সুপারিশকৃত ঘনত্ব হ্রাসের মাত্রা ২ গুণ ( ১ঃ ৪০০০০) গ্রাস কার্প মাছের ক্ষেত্রে ২-২.৫ গুণ (১৪৫০০০০) এবং সিলভার কার্প মাছের ক্ষেত্রে ৫ গুণ ( ১ঃ ১০০০০০)।
৬) শোধন:
পুকুরে ব্রুড মাছ ছাড়ার আগে মাছকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য শোধন করে নেওয়া হয়। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা লবণ দিয়ে ব্রুড মাছকে শোধন করতে হয়।
ব্রুড মজুদ
ব্রুড মাছ মজুদের হার ও ঘনত্ব কৃত্রিম প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ । অধিক ঘনত্বে মাছ মজুদ করলে মাছের ডিমের পরিপক্বতা বিলম্বে আসে এবং প্রজননকাল ক্ষণস্থায়ী হয়। এতে মৌসুম শুরুতে রেণু উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় পরবর্তীতে রেণুর মূল্য কমে যাওয়ায় হ্যাচারি মালিকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। মজুদ যোগ্য ব্রুডের পরিমাণ নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভরশীল।
i) প্রজাতির প্রকার
ii) মাটির গুণাগুণ
iii) পানির গুণাগুণ
iv) পানিতে উৎপাদনক্ষম প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রকৃতি ও পরিমাণ ।
মজুদ হার প্রতি শতকে ৮.০ কেজি হতে ১২.০ কেজি। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পরিপ্রেক্ষিতে এ হার কমানো বা
বাড়ানো যেতে পারে ।
নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে প্রজননকারী ব্রুড মাছ পুকুরে মজুদ করা যেতে পারে :
i) সব প্রজাতির স্ত্রী ও পুরুষ ব্রুড মাছ একত্রে মজুদ করা । ii) দুই প্রজাতির স্ত্রী ও পুরুষ ব্রুড মাছ একত্রে মজুদ করা ।
iii) একই প্রজাতির স্ত্রী ও পুরুষ ব্রুড মাছ একত্রে মজুদ করা ।
iv) একই প্রজাতির স্ত্রী ও পুরুষ ব্রুড মাছ ভিন্ন পুকুরে মজুদ করা ।
কার্পিও মাছের মতো যে সব মাছ পুকুরে ডিম দেয় সে সব মাছ স্ত্রী ও পুরুষকে একত্রে এক পুকুরে রাখলে প্রজননের কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন হতে পারে । এক্ষেত্রে কার্পিও মাছের সাথে অন্য প্রজাতির মাছ না রাখাই ভালো ।
যেহেতু সব প্রজাতির মাছের পুষ্টি চাহিদা এক রকম নয় সেজন্য প্রজাতি ভিত্তিক যত্ন নেয়ার উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন পুকুরের ব্যবস্থা করা উচিত।
সম্ভব হলে একই প্রজাতির স্ত্রী পুরুষ মাছকে আলাদা করে রাখা উচিত । এতে করে স্ত্রী-পুরুষের আলাদা যত্ন নেয়া সম্ভব। হ্যাচারির সাফল্য নির্ভর করে পরিপক্ব স্ত্রী ব্রুড মাছের উপর। তাই পুরুষের চেয়ে স্ত্রী ব্রুড মাছের যত্ন নেয়া প্রয়োজন ।
যদি পুকুরের অভাব হয় তাহলে একাধিক প্রজাতির মাছ নিম্নের মিশ্রণে একসাথে রাখা যেতে পারে-
i) রুই ও সিলভার কার্প
ii) গ্রাস কার্প ও কাতলা
iii) গ্রাস কার্প ও বিগহেড কার্প
iv) রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউস ।
যদি পুকুরের খুব বেশি অভাব থাকে তবে সব প্রজাতির মাছ নিয়ে এক পুকুরে রাখা যেতে পারে ।
সিলভার কার্প
বিগহেড কার্প
২৪%
১২%
কাতলা
১২%
মৃগেল
রুই
১২%
২০%
গ্রাস কার্প
২০%
মোট- ১০০%
যদিও একই পুকুরে সকল প্রজাতির মাছ মজুদ করা হয়। তা সত্ত্বেও নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত :
১. একই পুকুরে সিলভার কার্প, রুই অথবা কার্পিও এক সাথে মজুদ করা যেতে পারে কিন্তু রুই এবং কার্পিও এর সাথে একত্রে সিলভার কার্প মজুদ করা উচিত নয় ।
২. একই পুকুরে গ্রাস কার্প, কাতলা অথবা বিগহেড কার্পের এক সাথে মজুদ করা যেতে পারে কিন্তু কাতলা এবং বিগহেড কার্পের সাথে একত্রে গ্রাস কার্প মজুদ করা উচিত নয় ।
৩. যেহেতু বিগহেড কার্প, কাতলা এবং সিলভার কার্পের খাদ্যাভ্যাস একই রকম সেহেতু এদের কখনো একই পুকুরে একত্রে মজুদ করা উচিত নয় ।
৩। মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা :
ক) মাছের মৃত্যুহার দেখা মাছ ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার পর থেকে পর দিন পর্যন্ত পুকুর পাড়ের চারপাশে ঘুরে দেখতে হবে কোনো মাছ মরে পানির উপরে ভেসে উঠেছে কি না । যদি কোনো মাছ মারা যায় সে
ক্ষেত্রে সেই পরিমাণ মাছ পুনরায় পুকুরে ছাড়তে হবে।
খ) প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা ও সার প্রয়োগ : পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের পর্যাপ্ততা বজায় রাখার জন্য নিয়মিত ভাবে সার প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয় । সাধারণভাবে প্রতি সপ্তাহে শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ১০০ গ্রাম টি.এস.পি ও ৩-৪ কেজি গোবর গুলিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত এক বার প্রাকৃতিক খাদ্যের মাত্রা হাত, গামছা-গ্লাস বা সেকিডিস্ক, যে কোনো একটা পদ্ধতিতে পরীক্ষা করতে হবে ।
গ) সম্পূরক খাদ্যে প্রয়োগ : পুকুর বা জলাশয়ের মাটি ও পানির স্বাভাবিক উর্বরতায় পুকুরে যে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদিত হয় তা দিয়ে মাছের খাদ্য চাহিদা পূরণ হয় না। সেজন্য মাছের পুষ্টি চাহিদা পুরোপুরি মেটানোর জন্য বাইরে থেকে খাদ্যে সরবরাহ করা হয় পুকুরের বাইরে থেকে মাছকে দেয়া এসব খাদ্য দ্রব্যকে সম্পূরক খাদ্য বলা হয় ।
সম্পূরক খাদ্যের গুরুত্ব :
i) মাছ পুষ্টির অভাবজনিত রোগ থেকে মুক্ত থাকে ।
ii) মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।
iii) ব্রুড মাছের গোনাডের দ্রুত পরিপক্বতা আসে । iv) ব্রুড মাছের প্রজননকাল দীর্ঘস্থায়ী হয় ।
v) মাছের ডিমের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ।
vi) পোনা মৃত্যুহার সর্বনিম্ন হয় ।
ব্রুড মাছের খাদ্যে নিম্নের ছক অনুযায়ী প্রোটিন সরবরাহ করা বাঞ্ছনীয়
ব্রুড মাছের ওপর পুষ্টি চাহিদার প্রভাব :
ব্রুড মাছের গোনাডের পরিপক্বতা সরবারহকৃত খাদ্যে বিদ্যমান প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ ও মানের
উপর নির্ভরশীল। ব্রুড মাছের খাদ্যে উপযুক্ত পরিমাণ পুষ্টির অভাব হলে নিম্নলিখিত ক্ষতিকর প্রভাব
পরিলক্ষিত হয়।
i) ব্রুড মাছ দেরিতে পরিপক্বতা লাভ করে ।
ii) মাছের ডিমের সংখ্যা হ্রাস পায়
iii) ডিমের আকার ছোট হয় ।
।iv) ডিমের গুণাগুণ নষ্ট হয় যেমন: রাসায়নিক উপাদান, লার্ভার বাঁচার হার, পরিস্ফুটন ক্ষমতা ইত্যাদি ।
ব্রুড মাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান:
ব্রুড মাছের খাদ্যে পুষ্টি উপাদন প্রোটিন, চর্বি, শর্করা ইত্যাদি ছাড়াও বিশেষ কিছু পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন যেগুলো মাছের গোনাডের পরিপকৃতা, ডিম পরিস্ফুটনের হার ও ডিমের বঞ্চিত হওয়াকে ত্বরান্বিত করে। নিম্নে ব্রুড মাছের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ পুষ্টি উপাদানের নাম ও কার্যাবলি বর্ণনা করা হলো ।
i) অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড মাছের শুক্রাণুর গুণাগুণ বৃদ্ধি করে এবং ভিমের ভেসে থাকার হার বাড়ায় ।
ii) ফসফরাস মাছের প্রজনন সফলতা বাড়িয়ে দেয় ৷
iii) ভিটামিন-ই ডিমের পরিস্ফুটন ও লার্ভার বেঁচে থাকার হার বৃদ্ধি করে ।
সম্পূরক খাদ্য তৈরি ও প্রয়োগ পদ্ধতি :
যেহেতু ব্রুড মাছের প্রোটিন চাহিদা একই প্রজাতির মাছের সর্বানুকাল বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের সমান, সেহেতু মাছের মজুদ পুকুরে ব্যবহৃত সম্পূরক খাদ্যেই ব্রুড মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে ব্রুড মাছের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই ফিশ মিল থাকতে হবে। কারণ ফিশ মিলে বিদ্যমান বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান মাছের প্রজনন সফলতায় সাহায্য করে । নিম্নে ব্রুড মাছের জন্য ৩০% প্রোটিনসমৃদ্ধ একটি খাদ্যসূত্র দেয়া হলো ।
যেহেতু বিশেষ বিশেষ পুষ্টি উপাদান ব্রুড মাছের গোনাডের পরিপক্বতা, ডিমের পরিস্ফুটন, হার এবং লাভার বেঁচে থাকার হারকে ত্বরান্বিত করে সেহেতু এসব উপাদান উক্ত খাদ্যের সাথে মিশালেই চলবে। যেমন- প্রতি কেজি খাবারে ভিটামিন-এ ১০০০০-২০০০০ IU এবং ৩৪ মি. গ্রাম ভিটামিন-ই মিশাতে হবে ।
মাছের বিশেষ খাদ্য পরিচর্যা :
নিম্নে ব্রুড মাছের বিশেষ খাদ্য পরিচর্যার বর্ণনা দেওয়া হলো :
১. গ্রাস কার্প
গমের ভুসি, চালের কুঁড়া, ভুট্টো ও তিলের খৈলের সমানুপাতের মিশ্রণ খাদ্য হিসেবে দিতে হবে । খাদ্য দিনে দুইবার দেহের ওজনের ৩-৫% হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এর সাথে প্রতিদিন দেহের ওজনের ১০০ ভাগ ঘাস ব্যবহার করতে হবে।
২. বিগহেড ও সিলভার কার্প :
পুকুরে প্রতি দশ দিন অন্তর ১.৫-২.০ টন/হেক্টর হারে জৈব সার দিতে হবে । যদি কোনো কারণে ডিম্বাশয় ভালোভাবে বৃদ্ধি না পায় তাহলে শিমের খৈল, বাদামের খৈল, গমের ভুসি বা চালের কুঁড়ার সমানুপাতের মিশ্রণ খাদ্য হিসাবে প্রতিদিন দেহের ওজনের ৩-৫% হারে দিতে হবে ।
৩. কাতলা
পুকুরে কাভলাকে এককভাবে রাখতে হবে। গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ইত্যাদি প্রয়োগ করে জুপ্লাঙ্কটনের ঘনত্ব ৩০-৫০ মি. লি/১০০ লিটার বাড়াতে হবে। সয়াবিন বা ফিশমিল, চালের কুঁড়া, গমের ভুসি ইত্যাদি একত্রে মিশিয়ে খাদ্য তৈরি করতে হবে। এতে প্রোটিনের পরিমাণ কমপক্ষে ২৫% থাকবে । খাদ্যে সরিষার খৈল না থাকাই ভালো, প্রতিদিন মাছের দেহের ওজনের ৩-৫% খাদ্য দিতে হবে ।
৪. মৃগেল, রুই ও কার্পিও : সমান হারে সয়াবিন মিল, চালের কুঁড়া, গমের ভুসি এবং সরিষার খৈল একত্রে মিশিয়ে খাদ্য তৈরি করতে হবে অথবা গমের ভুসি, সরিষার খৈল দানাদার গমের ভুসি এবং ফিশমিল ৪ঃ ৪ঃ ১:১ অনুপাতে মিশিয়ে মাছের দেহের ওজনের ৩-৫% হারে প্রতিদিন দুইবার করে প্রয়োগ করতে হবে। সরিষার খৈল সারা রাত ভিজিয়ে ব্যবহার করা উচিত।
গ) পানির গুণাগুণ রক্ষা করা :
ব্রুড মাছের পরিপক্বতা পুকুরের পানির ও মাটির গুনাগুনের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই পুকুরের পানি মাঝে মধ্যে আংশিক পরিবর্তন অর্থাৎ (১৫-২৫%) করে দিলে ভালো হয় । পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারলে মাছের পরিপক্বতা দ্রুত আসে।
পুকুরের পানি পরিবর্তন একদিকে যেমন পানির আপেক্ষিক পরিবাহিতা কমিয়ে দেয়, অন্যদিকে পানিতে মুক্ত আয়ন যেমন Na+, K, Ca++ও cl এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় ফলে গোনাডের পানি/আয়ন সরবরাহ বৃদ্ধি পায় যার ফলে গোনাডের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় । ব্রুড মাছের পুকুরে পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ এবং তাদের সর্বানুকুল মাত্রা নিম্নে দেওয়া হলো :
ঘ. হররা টানা : সপ্তাহে একবার জাল বা হররা টেনে পুকুরের তলদেশের জমাকৃত বিষাক্ত গ্যাসসমূহ দূর করে ব্রুড মাছের সর্বানুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করে যথাসময়ে পরিপক্বতা আনয়নের মাধ্যমে সুস্থ-সবল ব্রুড মাছ তথা উন্নত মানের রেণু উৎপাদনে সহায়তা করা ।
৫) স্বাস্থ্য পরিচর্যা :
ব্রুড মাছ রোগাক্রান্ত হলে তার ডিমের পরিপক্বতার উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে তাই মাছ যেন রোগাক্রান্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত । সাধারণত ব্রুড মাছ আরগুলাস নামক এক ধরনের পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখা যায় যাকে মাছের উকুন বলে এবং তা রুই জাতীয় মাছের বেলায় ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। আরগুলাস দ্বারা মাছ আক্রান্ত হলে যথাশীঘ্র সম্ভব এর প্রতিকার করা বাঞ্ছনীয় । এই রোগ প্রতিকারের জন্য ০.৫ পি. পি. এম হারে ডিপটারেক্স বা ০.১ পি পি এম সুমিথিয়ন তিন দিন অন্তর সপ্তাহে দু’বার ছিটিয়ে দিতে হবে।
এছাড়া হ্যাচারিতে মাছ পরিবহন ও স্থানান্তরের সময় বিভিন্নভাবে মাছের দেহে ক্ষতের সৃষ্টি হয় । এই ক্ষেত্রে পরবর্তীতে ব্যাকটেরিয়াজনিত আক্রমণে নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি হতে পারে। এ সমস্যা নিরসনকল্পে মজুদের পূর্বে ভালোভাবে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে প্রয়োজনে মজুদের আগে ব্রুড মাছকে শোধন করা যেতে পারে । আর ক্ষতের পরিমাণ বেশি মাছগুলোকে ১৫ মি.গ্রাম/কেজি হারে টেরামাইসিন ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে ।
ব্রুড ব্যবস্থাপনা সকল ধাপগুলো সঠিকভাবে অনুশীলন করা হ্যাচারি পরিচালনার পূর্বশর্ত। কোনো কারণে ব্রুড ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি হলে হ্যাচারি পরিচালনা সম্পূর্ণ অলাভজনক হয়ে উঠতে পারে।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় হ্যাচারির উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী যে পরিমাণ ব্রুড মাছ প্রতিপালন করা প্রয়োজন তা অনেক হ্যাচারিতেই না করে আশপাশের মাছ চাষের পুকুর থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এনে প্রজনন ঘটানো হয় ।
এ অবস্থায় মাছের আকার, স্বাস্থ্য, পরিপক্বতা, বয়স, বংশগতি, উৎপত্তির ইতিহাস কিছুই বিবেচনা করা হয় না। কেবল পেটে ডিম আছে কিনা কিংবা পুরুষগুলোর মিল্ট আছে কিনা তা নিশ্চিত হয়েই প্রজনন ঘটানোর জন্য সংগ্রহ করা হয় ।
এছাড়া হ্যাচারির পুকুরে যে সব ব্রুড মাছ প্রতিপালন করা হয় সেগুলোর অধিকাংশই ২/৪ জোড়া ব্রুড থেকে উৎপাদিত পোনা থেকেই তৈরি ব্রুড। পরবর্তীতে ও বার বার প্রজননকৃত একই ব্রুডের বংশধরদের ব্রুড পরিণত করা হয় । ফলে অন্তঃপ্রজননের বিরূপ
প্রতিক্রিয়া ২-৩ বংশগতিতেই (Generation) দেখা যায় ।বড় আকারের ব্রুড মাছের ডিমের পরিমাণ ছোট আকারের মাছের তুলনায় কম। তাই হ্যাচারি ব্যবস্থাপকেরা তাদের ব্রুড মাছ ছোট করে রাখতে আগ্রহী । তাছাড়া মাছের প্রজনন ঘটানোও সহজ এবং ডিম পাড়ার হারও বেশি । তাই বাণিজ্যিক সফলতার উদ্দেশ্যে গুণগতমান গৌণ হয়ে পড়ে ।
হ্যাচারিতে ব্রুড ব্যবস্থাপনার ছক হ্যাচারিতে ব্রুড ব্যবস্থাপনা ছক নিম্নের চিত্রে দেখানো হলো-
প্রজননের জন্য ব্রুড মাছ নির্বাচনের কৌশল ব্রুড মাছের সঠিক নির্বাচনের উপর কৃত্রিম প্রজননের সফলতা নির্ভর করে । প্রজনন কার্যক্রম শুরুর আগে মাছ প্রজনন উপযোগী হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার দরকার। আমাদের দেশে যেসব প্রজাতির মাছ প্রজননের জন্য হ্যাচারিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তাদের প্রজননকাল সাধারণত মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিস্তৃত ।
অনেক সময় ক্যাথেটারের সাহায্যে ডিম্বাশয় থেকে ডিম সংগ্রহ করে। পরিপত্ত্ব স্ত্রী মাছ শনাক্ত করা গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখে পুরুষ ও স্ত্রী ব্রুড মাছ শনাক্ত করা হয়। প্রজনন মৌসুমে প্রজননে প্রস্তুত মাছের লক্ষণাদি প্রায় সব প্রজাতির মাছের ক্ষেত্রে একই ধরনের হয়। লক্ষণগুলো নিম্নরূপ :
প্রজাতি নির্বাচন । কৃত্রিম প্রজননের সফলতা বহুলাংশে ব্রুড মাছের সঠিক নির্বাচনের উপর নির্ভরশীল। ব্রুড মাছ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা যায়। যেমন: নদী অথবা সরকারি ও বেসরকারি মৎস্য খামার থেকে । সাধারণত কার্প জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে ২-৪ বছর বয়সের ১-৫ কেজি ওজনের স্বাস্থ্যসম্পন্ন ব্রুড মাছ ব্যবহার করা হয়।
তবে অনেক সময় প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহকৃত ব্রুড মাছের সঠিক বয়স নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া এসব মাছ অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। পুরুষ ও স্ত্রী মাছ ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা উচিত এবং এক্ষেত্রে সুস্থ্য-সবল ও বড় আকারের দ্রুত বর্ধনশীল মাছকেই ব্রুড মাছ হিসাবে নির্বাচন করা উচিত ।
সাধারণত হ্যাচারিতে বাণিজ্যিকভাবে কার্প জাতীয় মাছ যেমন:- রুই, কাতলা, • সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প, গ্রাস কার্প, কার্পিও এবং থাই সরপুঁটি মাছের প্রজনন করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো হ্যাচারিতে ক্যাটফিশ
প্রণোদিত প্রজননের জন্য ব্রুড মাছ লালন-পালন
জাতীয় মাছ যেমন: শিং দেশি মাগুর, অক্সিজেন মাগুর এবং পাঙ্গাশ মাছের প্রজনন করানো হয়ে থাকে । নিম্নে বিভিন্ন প্রজাতির ব্রুড মাছের প্রজাতি নির্বাচনের তথ্যাদি প্রদত্ত হলো:
কাতলা : কাতলা মাছ ৪৫-৫৫ সে.মি. লম্বা হলে প্রজননের জন্য তৈরি হয় । তিন থেকে চার বছর বয়সের
স্ত্রী মাছ এবং ২-৩ বছর বয়সের পুরুষ মাছ নির্বাচন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ওজনের
কাতলা মাছ থেকে ২০০০০০-২৪৬০০০ টি ডিম পাওয়া যায় ।
রুই : সাধারণত ১-৩ কেজি ওজনের রুই মাছ প্রজননক্ষম হয়। চাষের পুকুরে রুই মাছ ২ বছর বয়সে প্রজননের জন্য তৈরি হয়ে যায় এসময় পুরুষ ও স্ত্রী মাছের দৈর্ঘ্য থাকে যথাক্রমে ৪৬-৬৫ সে. মি. এবং ৫০- ৭০ সে. মি. এর মধ্যে প্রতিকেজি দেহ ওজনের রুই মাছ ১০০০০০-৪০০০০০ টি ডিম দেয় ।
মৃগেল : মৃগেল মাছ ১-৩ কেজি ওজনে প্রজননক্ষম হয়। মৃগেল ২ বছর বয়সে প্রজননের জন্য তৈরি হয়।
প্রতি কেজি দেহ ওজনের মৃগেল ৩০০০০-২৫০০০০ টি ডিম দেয় ।
সিলভার কার্প : সিলভার কার্প ২-৩ বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয় এসময় এদের ওজন ২-৫ কেজি হয়ে থাকে । এরা প্রতি কেজি দেহ ওজনে ১৬০০০০-৩০০০০০ টি ডিম দেয় ।
বিগহেড কার্প: সাধারণত বিগহেড কার্প ২-৩ বছরে প্রজননক্ষম হয়। এ সময় এদের ওজন হয়ে থাকে ৩-৭
কেজি । এর প্রতি কেজি দেহ ওজনে আনুমানিক ১২৬০০০ টি ডিম দেয় । গ্রাস কার্প: গ্রাস কার্প ২-৩ বছরে প্রজননের জন্য তৈরি হয়। এসময় এদের ওজন থাকে ১.৫-৪.০ কেজি।
এরা প্রতি কেজি দেহ ওজনে ৪৪০০০-১১৫০০০ টি ডিম উৎপাদন করে ।
কার্পিও : কার্পিও মাছ ১ বছর বয়সেই প্রজননক্ষম হয়ে থাকে। সাধারণত এরা প্রতি কেজি দেহ ওজনে ১০০০০০ থেকে ২০০০০০ টি ডিম দেয় ।
থাই সরপুঁটি : এরা সাধারণত ১ বছর বয়সেই প্রজননক্ষম হয়ে থাকে। প্রতি কেজি দেহ ওজনে এরা ২০০০০০-৩০০০০০টি ডিম দেয়।
দেশি মাগুর : দেশি মাগুর ১ বছর বয়সে প্রজননের জন্য তৈরি হয়। এরা প্রতি ১০০ গ্রাম দেহ ওজনে ৩০০০-৫০০০টি ডিম উৎপাদন করে।
পাঙ্গাস : সাধারণত পাঙ্গাস মাছ ৩ বছর বয়সে প্রজননের জন্য তৈরি হয়। এরা প্রতি কেজি দেহ ওজনে ৬০০০০-১০০০০০ টি ডিম দেয়।
আরও দেখুন: