আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়- মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব যা ইউনিট ২ মাছের স্বাস্থ্য অংশ।
এ পাঠ শেষে আপনি
- মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে পারবেন।
- মাছের স্বাস্থ্য মাছ চাষে কিরূপ প্রভাব ফেলে তা ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
- মাছ চাষে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবেন ।
- জনস্বাস্থ্যের জন্য মাছের রোগ কীভাবে হুমকি হয়ে দেখা দেয় তা বর্ণনা করতে পারবেন।
কৃষির বিভিন্ন উৎপাদনশীল শাখায় বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন চাষ পদ্ধতি রয়েছে। এসব চাষ পদ্ধতির মধ্যে চাষের ক্ষেত্র, ক্ষেত্রের গঠন ও প্রকৃতি, উৎপাদন উপকরণ, চাষযোগ্য ফসল ইত্যাদি বিভিন্ন দিক বিবেচনায় মাছ চাষ কার্যক্রম অনেকটা স্বতন্ত্র প্রকৃতির মাছ শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী।
মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব
জলজ বাস্তুসংস্থান পরিবেশের বিভিন্ন প্রকৃতির অসংখ্য প্রাণী উদ্ভিদ ও জড়বস্তু সমন্বয়ে গঠিত। তাই জলজ বাস্তুসংস্থান জটিল এবং অপেক্ষাকৃত অস্থিতিশীল। জলজ বাস্তুসংস্থানের বিভিন্ন ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণের মাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। এরূপ অবস্থায় জলজ পরিবেশ মাছের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিতে পারে এবং মাছের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধরনের বিঘ্নতা সৃষ্টি করে।
ফলে মাছের বৃদ্ধিহার কমে যায়, মাছ রোগাক্রান্ত হয় এবং উৎপাদন হ্রাস পায়। তাই সফলভাবে মাছ চাষের লক্ষ্যে মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য।
মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হলো-
• স্বাস্থ্যকর জলজ পরিবেশ বজায় রাখা
•সুষ্ঠুভাবে মাছ চাষ কার্যক্রম পরিচালনা করা
• উৎপাদন উপকরণের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা
• প্রতি একক ক্ষেত্র থেকে অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদন করা
• ভাল জাতের পোনা উৎপাদনের জন্য মান সম্পন্ন ব্রুড মাছ উৎপাদন করা
• জলজ পরিবেশের লাগসই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে টেকসই মৎস্য উৎপাদন বজায় রাখা।
অধিক উৎপাদনের প্রধান শর্ত স্বাস্থ্যবান মাছ। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন রোগজীবাণু, পরজীবী এবং জলজ পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামকের কাঙ্ক্ষিত ও ক্ষতিকর মাত্রা সম্পর্কে জানা যায়।
মাছের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বা পরজীবী নির্মূল করা যায় এবং রোগ বিস্তারকারী পরিবেশগত নিয়ামকের মাত্রা সংশোধন করে রোগের প্রকোপ কমানো যায়। অর্থাৎ যথাযথ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে মাছের রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
মাছের সাধরণভাবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে গৌণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এরূপ পদ্ধতিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক পোনা মাছ ছাড়া হয় এবং অন্যান্য উৎপাদন উপকরণ তেমন একটা ব্যবহার করা হয় না।
কিন্তু উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষ অথবা আধানিবিড় বা নিবিড় মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছের মজুত ঘনত্ব বেশি থাকে এবং বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন উপকরণ ব্যবহার করা হয়। ফলে এরূপ চাষ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের রোগ সংক্রমণের আশংকা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে।
অনেক রোগ মাছে ব্যাপক হারে মড়ক ঘণ্টায়, মাছের উৎপাদন কমার এবং মাছ চাষকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। কিন্তু মাছের স্বাস্থ্যগত অবস্থান এবং পরিবেশের অবস্থা জানা থাকলে যথাসময়ে পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামকের যাত্রা কাঙ্খিত পর্যায়ে উন্নীত এবং রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
মাছের স্বাস্থ্যগত অবস্থা জানা থাকলে রোগ সংক্রমণ ও বিস্তার প্রতিরোধ করা যায় এবং যথাযথ রোগ প্রতিকারের মাধ্যমে সংক্রমিত বা রোগাক্রান্ত মাছের মৃত্যুহার কমানো যায়। যদি ব্যবস্থাপনা ত্রুটির জন্য মাছের স্বাস্থ্যহানি ঘটে বা মাছ রোগাক্রান্ত হয়, তবে এরপক্ষেত্রে যথাযথ সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় ।
মাছের স্বাস্থ্যগত অবস্থা পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রোগের ধরন ও উৎস, অর্থাৎ মাছ কোন রোগে আক্রান্ত হয়েছে, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু কোনটি ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায় এবং কার্যকরভাবে রোগ প্রতিরোধ করা যায়। যেমন বাইরের কোন উৎস যথা- সংক্রমিত রেণু পোনা বা ডিমওয়ালা মাছ রোগ সংক্রমণের কারণ হলে নির্বীজকরণ (disinfection) এবং সংগনিরোধ (quarantine ) ব্যবস্থার মাধ্যমে সহজেই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
মাছের অনেক সময় অপুষ্টিজনিত কারণে মাছের বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। অপুষ্টিজনিত রোগে মাছের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং এতে মাছ সহজেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। মাছের স্বাস্থ্যগত অবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অপুষ্টিজনিত লক্ষণ দেখে খাদো কোন উপাদানের অভাব রয়েছে তা জানা যায়। সম্পূরক খাদ্যের সাথে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে পুষ্টিজনিত সমস্যা দূর করে অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়।
জলজ সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম। মাছের রোপ নিয়ন্ত্রণ এবং অধিক উৎপাদনের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সমান গুরুত্বপূর্ণ। মাছ আমাদের পুষ্টির প্রধান উৎস। প্রাণিজ আমিষের সিংহভাগই আসে মাছ থেকে।
মাছ চাষের ক্ষেত্র বদ্ধ জলাশয় মশার বংশবৃদ্ধির জন্য উত্তম প্রজনন ক্ষেত্র। মশা মানুষের ম্যালেরিয়া রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বাহক (Carrier) এবং পোষক (host)। মানুষের দেহ থেকে রক্ত শোষণের সময় স্ত্রী এনেফিলিশ মশা ম্যালেরিয়ার রোগজীবাণু মানুষের দেহে সংক্রমিত করে। ফলে মানুষ ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।
আমাদের মত দরিদ্র দেশে পুকুরের পানি গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করা হয়। এতে করে মানুষ বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগ, যেমন- কলেরা, ডায়রিয়া ইত্যাদি সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ হয়ে দেখা দেয়।
এছাড়াও মাছের রোগ সৃষ্টিকারী অনেক রোগজীবাণু তাদের জীবনচক্র সম্পন্ন করার জন্য মানুষের দেহে মাধ্যমিক পর্যায় অতিবাহিত করে এবং রোগের সংক্রমণ ঘটায়। যেমন- ফিতাকৃমি (Diphyllobothrium latum), কৃমি (Clonarchis sinensis) মাধ্যমিক পোষক (intermediate host) হিসেবে মানুষের দেহে রোগ সৃষ্টি করে। জলজ পরিবেশের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের সুস্বাস্থ্য বজায় রেখে লাভজনকভাবে মাছের উৎপাদনের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের এসব হুমকি দূর করা যায় ।
অনুশীলন ( Activity): মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থানার উদ্দেশ্যসমূহ কী কী?

সারমর্ম:
মাছের- স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য হলো স্বাস্থ্যকর জলজ পরিবেশ বজায় রাখা এবং মাছের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা। মাছের -স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আক্রান্ত মাছের রোগের উৎস ও রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় এবং প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জলজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বৃদ্ধি করা যায় এবং টেকসই উৎপাদন বজায় রাখা যায়। অস্বাস্থ্যকর জলজ পরিবেশ মানুষের রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন জীবাণুর পোষকের উত্তম প্রজনন স্থল।
দূষিত পানি মানুষের দেহে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ সৃষ্টি করে। মাছের রোগ সৃষ্টিকারী অনেক রোগজীবাণু মানুষের দেহে | জীবনচক্রের মাধ্যমিক পর্যায় অতিবাহিত করে ও রোগের সংক্রমণ ঘটায়। তাই জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণেও | মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আরও দেখুনঃ