সুস্থ মাছের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় সুস্থ মাছের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ – যা চাষযোগ্য মাছের সাধারণ রোগ, রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকার বা চিকিৎসা এর অন্তর্ভুক্ত।

সুস্থ মাছের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ

 

সুস্থ মাছের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ

 

সুস্থ মাছের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ

  • মাছের বৃদ্ধির হার স্বাভাবিক থাকবে অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে মাছ কাঙ্ক্ষিত আকার ও ওজন অর্জন করবে;
  • বিভিন্ন অঙ্গের আকারগত অনুপাত ঠিক থাকবে। যেমন- দেহের তুলনায় মাথা মানানসই দেখাবে;
  • লম্বার তুলনায় প্রশস্থতা যথাযথ থাকবে;
  • ত্বক বা আঁইশের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য বজায় থাকবে;
  • দেহের কোন অংশে ঘা, ক্ষত বা রক্তক্ষরণ থাকবে না;
  • পাখনা দুমড়ানো বা পাখনা ও ফুলকায় পচন দেখা যাবে না;
  • দেহের কোথাও কোন পরজীবী থাকবে না;
  • মাছ স্বাভাবিকভাবে খাদ্য গ্রহণ করবে এবং স্বাভাবিক আচরণ দেখাবে ;
  • মাছ পানির উপর ভেসে বা পাড়ের কাছে দীর্ঘ সময় বসে থাকবে না ও
  • ভয় পেলে মাছ দ্রুত পানির নিচে চলে যাবে।

রোগাক্রান্ত মাছের লক্ষণসমূহ :

একটি রোগাক্রান্ত মাছে বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ শারীরিক বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। রোগাক্রান্ত মাছের লক্ষণ সমূহকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে ।

ক. আচরণগত অসঙ্গতি ও
খ. শারীরিক বৈশিষ্ট্যগত লক্ষণ ।

ক. আচরণগত অসঙ্গতি :

বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মাছ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আচরণগত অসঙ্গতি প্রকাশ করে । যেমন-

  • মাছ খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। এমনকি সম্পূরক খাদ্য গ্রহণেও অনীহা দেখায়;
  • শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে;
  • পানির উপর অলসভাবে ভেসে থাকে;
  • দ্রুত গতিতে ও অস্থিরভাবে সাঁতার কাটে ও
  • মাছ পুকুরে অবস্থিত শক্ত কোন কিছুতে গা ঘষতে থাকে ।

খ. শারীরিক বৈশিষ্ট্যগত লক্ষণ :

রোগাক্রান্ত মাছে নিম্নলিখিত শারীরবৃত্তীয় লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। যেমন-

  • দেহের তুলনায় মাথা বড় দেখাতে পারে;
  • মাছের দেহ হতে অতিরিক্ত পিচ্ছিল পদার্থ (Mucus) নির্গত হতে পারে;
  • প্রয়োজনীয় মিউকাসের অভাবে মাছের দেহ খসখসে হতে পারে; মাছ তার স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলে;
  • আঁইশ, ত্বক বা পাখনায় এবং ফুলকায় ক্ষত বা পচন দেখা দেয়;
  • আঁইশ ফুলে উঠে বা খসে পড়ে;
  • আঁইশের গোড়া, ত্বক, পায়ুপথ, ফুলকায় রক্তক্ষরণ হয়;
  • মাছের ত্বক বা পাখনায় বিন্দুর মতো সাদা দাগ দেখা দেয়;
  • মাছের দেহে, পাখনায়, ফুলকায় পরজীবী বা সিষ্ট পরিলক্ষিত হয়;
  • মাছের দেহে সূক্ষ্ম সূতার মত বস্তু দেখা দেয়;
  • মাছের দেহ গহ্বরে ঘোলাটে, সাদা বা পরিষ্কার তরল জমা হয়;
  • পায়ুপথ বা ফুলকায় প্রদাহ হয়;
  • ফুলকার বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে ফ্যাকাশে বা রক্তাভ বর্ণ ধারণ করে;
  • মাছের চোখ অক্ষিকোঠর থেকে বেরিয়ে আসে;
  • পরিশেষে হঠাৎ ব্যাপক হারে মাছে মড়ক দেখা দেয় ।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

বাহ্যিক লক্ষণ দেখে মাছের রোগ নির্ণয় :

বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মাছ বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ প্রদর্শন করে থাকে । এসব লক্ষণ দেখে মাছ কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছে তা নির্ণয় করা যায়। লক্ষণ দেখে কীভাবে মাছের রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি রোগের মাত্রা নির্ণয় করা যেতে পারে নিচে তার জন্য অনুসরণীয় পদক্ষেপসমূহ দেয়া হলো ।

১. পুকুর পর্যবেক্ষণ;
২. আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং
৩. মাছের দৈহিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ।

১. পুকুর পর্যবেক্ষণ :

পুকুর পর্যবেক্ষণকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করা যায় । যেমন-

ক. পানির গুণাবলি পরীক্ষা:

এ ক্ষেত্রে পানির বিভিন্ন গুণাবলি, যেমন- দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, অ্যামোনিয়া, তাপমাত্রা, মোট ক্ষারত্ব প্রভৃতি মাছচাষের অনুকূলে আছে কি না তা নিয়মিত পরীক্ষা করা প্রয়োজন ।

খ. মাছের মৃত্যুর প্রকৃতি যাচাই :

মাছের রোগ মড়ক হিসেবে দেখা দিলে বিশেষ কোনো প্রজাতির মাছ মারা যাচ্ছে, নাকি সব প্রজাতির মাছই মারা যাচ্ছে ইত্যাদি বিষয় পরিবীক্ষণ করা উচিত। সাধারণত পরিবেশগত পীড়নে এবং ভাইরাসজনিত রোগে মাছের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে ।

গ. পুকুরের ইতিহাস পর্যালোচনা :

কীভাবে পুকুর সৃষ্টি হয়েছে বা কী কারণে পুকুর কাটা হয়েছে, পুকুরের বয়স কত? সারা বছর পুকুরে পানি থাকে না বছরের কয়েক মাস পানি থাকে, পুকুর শুকানো হয়েছিল কি না? পুকুরের তলদেশে কাদার অবস্থা কেমন? ইত্যাদি বিষয় পুকুরে বিদ্যমান প্রাণী ও অণুজীব সম্পর্কে ধারণা দেয়, যা মাছের রোগের প্রকৃতি নির্ণয়ে সহায়তা করে।

ঘ. উৎপাদন উপকরণ যাচাই করা :

পানি, পোনা, খাদ্য প্রভৃতির উৎস, খাদ্য গুদামজাতকরণের অবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় মাছের রোগের প্রকৃতি নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ।

২. আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ :

সাধারণত মাছের ত্বক, ফুলকা, অস্ত্র, চোখ ইত্যাদির আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হয়। মৃত মাছের চেয়ে জীবিত মাছ পর্যবেক্ষণ অধিকতর কার্যকর ফল দেয়। আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণের দ্বারা রোগজীবাণু শনাক্তকরণের মাধ্যমে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা যায় ।

৩. মাছের দৈহিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ :

  • এক্ষেত্রে মাছের আচরণ এবং বিভিন্ন অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যের অসঙ্গতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেমন-
  • নির্দিষ্ট সময় অন্তর মাছ প্রত্যাশিত আকার এবং ওজন অর্জন করেছে কি না?
  • মাছের বিভিন্ন অঙ্গের আকারগত অনুপাত, যেমন- মাথার তুলনায় দেহ স্বাভাবিক কি না? দেহের তুলনায় মাথা বড় দেখাচ্ছে কি না?
  • মাছের কোন অঙ্গ, যেমন- লেজ, পাখনা, আঁইশ, ফুলকা ইত্যাদির কোন বিকৃতি দেখা যায় কি না?
  • মাছের দেহের কোন একটি বিশেষ অঙ্গে ঘা, ক্ষত বা পচন দেখা দিয়েছে কি না? দেখা দিলে তার বিস্তৃতি ও প্রকৃতি কীরূপ?
  • মাছ স্বাভাবিক মাত্রায় খাদ্য গ্রহণ করছে, না কী খাদ্য গ্রহণে অনীহা বা মন্থরতা প্রদর্শন করছে?
  • মানুষের উপস্থিতিতে মাছ দ্রুত পানির নিচে চলে যায় কি না?
  • মাছের স্বাভাবিক বর্ণ ফ্যাকাশে দেখায় কি না?
  • মাছ অস্বাভাবিক আচরণ, যেমন- দ্রুত সাঁতার কাটা, একাকী থাকা, শক্ত কোনো কিছুতে গা ঘষা, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে কি না এসব আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

 

সুস্থ মাছের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও আচরণ

 

উল্লেখিত বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে লক্ষণ দেখে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মাছের স্বাভাবিক আচরণ ও আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য তুলনা করে মাছ কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছে তা নিশ্চিত হয়ে সে অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা করা যায়।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment