মাছের রোগ দমনে চুন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, ম্যালাকাইট গ্রীন, এন্টিবায়োটিক ইত্যাদির ব্যবহার – “মাছের স্বাস্থ্য পরিচর্যা” কোর্স বইটি বিশেষভাবে স্কুল অব এগ্রিকালচার এন্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট-এর বিএজিএড প্রোগ্রামের ছাত্রদের জন্য লেখা হয়েছে। আপনি জানেন, দূর শিক্ষণে শিক্ষকের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নেই। তাই পাঠের কোনো কঠিন বিষয় যেন আপনার বুঝতে অসুবিধা না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই কোর্স বইটি লেখা হয়েছে। কোর্স বইটির আঙ্গিক ও উপস্থাপনা তাই প্রচলিত পাঠ্যবই থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের। যেহেতু সরাসরি শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই কোর্স বইটি আপনাকে নিজে পড়ে বুঝতে হবে, তাই এটি কীভাবে পড়বেন প্রথমেই তা জেনে নিন। এতে কোর্স বইটি পড়তে ও বুঝতে আপনার সুবিধা হবে।
মাছের রোগ দমনে চুন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, ম্যালাকাইট গ্রীন, এন্টিবায়োটিক ইত্যাদির ব্যবহার
এ পাঠ শেষে আপনি-
- মাছের রোগ দমন করার জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ নির্ণয় করতে পারবেন।
- রোগ দমনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জিনিষ পত্রের তালিকা তৈরি করতে পারবেন।
- মাছের রোগ দমনে চুন ও লবণের ব্যবহার নিজেই করতে পারবেন।
- পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও ম্যালাকাইট গ্রীনের পরিমাপ নির্ণয় করে তা মাছের রোগ দমনে
- প্রয়োগ করতে পারবেন।
- প্রয়োজনে মাছকে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের দ্বারা চিকিৎসা করতে পারবেন।
মাছের রোগ দমনের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ নির্ণয়
প্রয়োজনীয় উপকরণ
রাসায়নিক দ্রব্যাদিঃ
(১) চুন- পাথুরে চুন, Ca CO₃ অথবা কুইক লাইম বা পোড়া চুন, CaO অথবা কলিচুন, Ca (OH)2। তবে মূল্য হিসাবে পাথুরে চুন সুবিধাজনক।

(২) লবণ- খাদ্য লবণ (NaCl) তবে মূল্য কম যা পরিশোধিত না হলেও চলবে।
(৩) পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট KMnO4 কমার্শিয়াল বা বাজারে বিক্রিত পাউডার বা দানাদার।
(৪) ম্যালাকাইট গ্রীন- কমার্শিয়াল, দানাদার বা পাউডার।

(৫) এন্টিবায়োটিক- অক্সিটেট্রাসাইক্লিন অতি সাধারণ তবে বহুল ব্যবহৃত এবং কার্য্যকরী। বর্তমানে একুয়াকালচার করার জন্য কমার্শিয়ালভাবে বিক্রয় হচ্ছে। উদাহরণসরূপ: ARGENT AQUACULTURE এ ছাড়া বাজার থেকে ক্যাপসুল কিনে তা ব্যবহার করা যেতে পারে তবে তা ব্যয় বহুল হবে। অক্সিটেট্রাসাইক্লিন না পেলে টেরামাইসিন ব্যবহার করা যাবে।

সতর্কতাঃ উপরিউল্লিখিত ঔষধ গুলো ব্যবহারের পূর্বে এবং ক্রয় করার পূর্বে কার্য্যকরী তারিখ অবশ্যই দেখে নিতে হবে যাতে পুরান কিংবা কার্য্যকারীতার তারিখ অতিক্রান্ত হয়েছে এমন যেন না হয়।
পরিমাপ করার উপকরণ
(১) রাসায়নিক দ্রব্যাদি/ঔষধ পরিমাপ ও তার উপকরণ
রাসায়নিক দ্রব্যাদি/ঔষধের পরিমাপের জন্য একটি সাধারণ ব্যালান্স (৫০০ গ্রাম থেকে ২০ কেজি পর্যন্ত ওজন মাপার জন্য), 2-প্যান বিশিষ্ট ব্যালান্স (৫ গ্রাম থেকে ১ কেজি পর্যন্ত ওজন মাপার জন্য) ও একটি ইলেকট্রনিক ব্যালান্স (সূক্ষ ওজন নেয়ার জন্য, ০.১ মি.গ্রাম থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন নেয়া যেতে পারে) প্রয়োজন।

(২) পানির পরিমাপ ও তার উপকরণ
- ১ লিটার পর্যন্ত পরিমাপ করার প্লাষ্টিক জ্যার

- ১ লিটার থেকে ১০ লিটার পানি মাপার জন্য ১টি বালতি যা দাগ কেটে চিহ্নিত করে নিতে হবে।

পুকুরের পানি পরিমাপ করার জন্য পানির উপরিভাগের গড় দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং পানির গভীরতার ৭-৮ টি রিডিং নিয়ে গড় গভীরতা দিয়ে গুণ করলে পানির আয়তন পাওয়া যায়। এ সকল ক্ষেত্রে মেট্রিক পদ্ধতিতে পরিমাপ করাই শ্রেয় যা ঔষধ প্রয়োগের মাত্রা ঠিক করা সহজতর হবে। এজন্য একটি মিটার টেপ ও একটি মিটার স্কেল (৫ মি.-৭ মি.) প্রয়োজন।
উপকরণ গুলো যেমন ঔষধ বা রাসায়নিক দ্রব্যাদি, পরিমাপের উপকরণ, ঔষধ প্রয়োগের উপকরণ সর্বদা প্রস্তুত রাখতে হবে।
পানির আয়তন = (দৈর্ঘ্য x প্রস্থ্য গভীরতা) গড়
প্রতি ঘন মিটার আয়তন পানির পরিমাণ ১০০০ লিটার
অবশ্য পুকুরটি গোলাকৃতি হলে তার আয়তন: (Pi) r2 h
= ৩.১৪ × পানির উপরি ভাগের ব্যাসার্ধ্য (r) x গভীরতা (1)
অন্যান্য উপকরণ
(১) পুকুরে ঔষধ/ চুন/ লবণ দিতে হলে সকল স্থানে সমভাবে পড়ে তার জন্য একটি ছোট্ট নৌকা বা ভেলা প্রয়োজন।
(২) চুন ভিজানো পাত্র, ঔষধ তৈরির পাত্র, প্রয়োজনীয় ছোট, বড় প্লাষ্টিক বালতি।
(৩) স্প্রে- মেশিন/বা ঔষধ ছিটানোর পাত্র
(৪) মাছকে খাবারের মাধ্যমে ঔষধ দেওয়ার জন্য কিছু গামলা (ছোট ও বড়) প্রয়োজন।

(৫) কোন কোন সময় মাছকে ইনজেকশনের দ্বারা ঔষধ ব্যবহার করতে হয তার জন্য ৫ মি.লি., ও ২ মি.লি. সিরিন্জ দরকার।

(৬) কোন কোন সময় পানির PH মাপার জন্য PH মিটার (যা মাঠে বহন করা সহজ) প্রয়োজন যার দ্বারা পুকুরের পানি ক্ষারীয় বা অম্লীয় তা নিরীক্ষা করা যায়। এর উপর ভিত্তি করে চুন বা লবণ প্রয়োগ করতে হয়।

(৭) পানির অক্সিজেন পরিমাপের জন্য মাঠে ব্যবহার উপযোগী একটি অক্সিজেন মিটার প্রয়োজন।
(৮) পানির তাপমাত্রা নির্ণয়ের জন্য ০°C ১০০°C পর্যন্ত তাপমাত্রা মাপা যায় এমন একটি থার্মোমিটার অবশ্যই রাখতে হবে।

(৯) জাল: টানা জাল (বেড় জাল) ও খেপলা জাল রাখতে হবে। মাছের নমুনা সংগ্রহের জন্য।
চুন ও লবণের প্রয়োগ পদ্ধতি
চুন ও লবণ ব্যবহারের পূর্বে পুকুরের পানির পি. এইচ. অবশ্যই নির্ণয় করতে হবে। পি. এইচ. ৮ এর উপরে থাকলে চুন দেওয়া ঠিক হবেনা। আবার পি.এইচ, ৬ এর নীচে থাকলে লবণ না দেওয়াই ভাল। এরই উপর ভিত্তি করে চুন ও লবণ আলাদা ভাবে পূর্বেই দ্রবন তৈরি করে তা পুকুরে নির্দিষ্ট পরিমাণে দিতে হবে। যেমন ক্ষত রোগের জন্য চুন ও লবণ একই সংগে প্রয়োগ করলে বেশ উপকার পাওয়, যায়। উভয়ের মাত্রা ১.৫ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট পানিতে প্রতি শতাংশে ১/২- ১ কেজি হারে চুন ও লবণ প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া স্বল্প সংখ্যক রোগক্রান্ত মাছকে ১-২% লবণ দ্রবণে সহ্য করার সময় পর্য্যন্ত গোসল করানো যেতে পারে।
১% লবণ = ১০ গ্রাম লবণ/ ১ লি. পানি

পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের ব্যবহার
পানিতে অক্সিজেন কম হলে, কিংবা ব্যাকটেরিয়া বা প্রোটোজোয়াজনিত রোগ হলে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্ষত রোগের ক্ষেত্রে অনেকে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আক্রান্ত মাছকে ৫ পি.পি.এম (৫ মি.গ্রাম/ লিটার) দ্রবণে সহ্য করার সময় পর্য্যন্ত গোসল করানো যেতে পারে। এ ছাড়া পুকুরে প্রয়োগের জন্য আলাদা দ্রবণ তৈরি করে তা পুকুরে সমভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে যাতে করে পুকুরে এর পরিমাণ ২ পি.পি.এম থেকে ৩ পি.পি.এম হয়। জাল টেনে সমভাবে বিস্তরণের ব্যবস্থা করা, ভাল।
পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, ম্যালাকাইট গ্রীন অথবা এন্টিবায়োটিক যাই প্রয়োগ করা হউক তা এদের মাত্রা সঠিক ভাবে মেপে প্রয়োগ করতে হবে।
ম্যালাকাইট গ্রীনের ব্যবহার
ছত্রাক জাতীয় রোগ জীবানু দ্বারা আক্রান্ত মাছকে ০.৫ পি.পি.এম থেকে ১ পি.পি.এম দ্রবনে ৫-১০ মিনিট ডুবালে আরোগ্য লাভ করে। পুকুরে ০.১৫-০.২০ পি.পি.এম হারে প্রয়োগ করা যেতে পারে। পুকুরে প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুকুরের পানির পরিমাণ নির্ণয় করার পর সর্বমোট প্রয়োজনীয় পরিমাণ ম্যালাকাইট গ্রীনের পাওডার বা ক্রীষ্টাল মেপে তা একটি পাত্রে ঘন দ্রবণ করে নেন। পরে তা পুকুরে সমভাবে ছিটিয়ে দিয়ে জাল হালকাভাবে টেনে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার
সাধারণত: ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ প্রতিকারের জন্য এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। মাছের রোগের ক্ষেত্রে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন (টেরামাইসিন) অধিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে এখনও এন্টিবায়োটিক অন্যান্য উন্নত দেশের চেয়ে খুব কমই ব্যবহৃত হয়। সেই হিসাবে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন মাছ বা চিংড়ির রোগ দমনে বেশ কার্য্যকর। এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ পদ্ধতি হিসাবে খাদ্যের সংগে ব্যবহার করাই উত্তম। এর জন্য প্রত্যহ মোট কত কেজি মাছের জন্য খাবার দেওয়া হচ্ছে তা বের করে সেই হিসাবে খাবারের সংগে মিশিয়ে তা প্রয়োগ করতে হবে।
ধরা যাক- একটি পুকুরে ছোট-বড় মাছ মোট ৩০০০ রয়েছে- যার ওজন গড়ে ১০০০ কেজি। তাহলে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন সকল মাছকে চিকিৎসার জন্য প্রতি কেজি মাছের জন্য ৭৫ মি.গ্রাম হিসেবে ৭৫ গ্রাম অক্সিটেট্রাসাইক্লিন প্রত্যহ প্রয়োজন যা ৭-১০ দিন পর্য্যন্ত প্রয়োগ করতে হবে। এটা ব্যয়বহুল বিধায় আক্রান্ত মাছকে আলাদা করে ছোট ট্যাংকে প্রয়োগ করা আর্থিক সহায়ক। এ ছাড়া বড় বড় মাছ আক্রান্ত হলে ইনজেকশনের মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ খুবই কার্য্যকর।

এজন্য আগে এন্টিবায়োটিক সাসপেনশন তৈরি করে ১০০ মি.গ্রাম/প্রতি কেজি মাছের জন্য প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া ছোট মাছ বা পোনা মাছকে আলাদা করে ছোট ট্যাংক বা একোরিয়ামে ২০-৩০ পি.পি.এম দ্রবণে ১ঘন্টা কালীন গোসল করালে ভাল ফল পাওয়া যায় এবং বহন কৃত রোগ জীবানু (ব্যাকটেষ্টিয়া) আর ক্ষতি করতে পারে না।
অনুশীলন (Activity): কীভাবে মাছের রোগ দমন করার জন্য চুন, লবণ, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, ম্যালাকাইট গ্রীন এবং এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করবেন তা লিপিবদ্ধ করুন।
সারমর্ম: চুন ও লবণ ক্ষত রোগ সহ অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। আলাদাভাবে ভিজিয়ে তা পুকুরে ১/২-১ কেজি হারে এক সংগে বা আলাদা ভাবে ছিটিয়ে দিতে হয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে পানির পি.এইচ. গুরুত্বপূর্ণ। আক্রান্ত মাছকে ১-২% লবণ দ্রবণে আলাদা ভাবে চিকিৎসা করানো যায়। প্রত্যেক ক্ষেত্রে ঔষধের মাত্রা মাছ ও পানির পরিমাণ অনুযায়ী ঠিক করা প্রয়োজন।
কার্য্যকরী তারিখ। পার হওয়া কোন ঔষধ ব্যবহার করা উচিত নয়। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা ম্যালাকাইট দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে গোসল করানো যায়। আবার এ গুলো কম মাত্রায় পুকুরে ব্যবহার করা যায়। এন্টিবায়োটিক হিসেবে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের জন্য খুবই কার্যকর যা খাদ্যের সহিত ব্যবহার করা উত্তম। প্রয়োজনে ইনজেকশন বা গোসল করিয়ে ভাল ফল পাওয়া যায়।
আরও পড়ুনঃ