আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মাছচাষে প্রভাব বিস্তারকারী ভৌত নিয়ামকসমূহ – যা মাছচাষে প্রতিবেশের বিভিন্ন নিয়ামকের প্রভাব এর অন্তর্ভুক্ত।
মাছচাষে প্রভাব বিস্তারকারী ভৌত নিয়ামকসমূহ
মাছচাষে প্রভাব বিস্তার করে প্রতিবেশের এমন ভৌত নিয়ামক সমূহ হলো—
ক. পানির বর্ণ বা রং
খ. পানির স্বচ্ছতা ও ঘোলাত্ব
ঘ. তাপমাত্রা ও
গ. আলো
ঙ. পানির গভীরতা
ক. পানির বর্ণ :
পানির নিজস্ব কোন বর্ণ বা রঙ নেই। পানিতে যখন যে পদার্থের আধিক্য বেশি থাকে তখন পানি সে রঙ ধারণ করে। যেমন- পানিতে সবুজ কণিকা বা উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন বেশি থাকলে উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনের বর্ণ সবুজ বিধায় পানি সবুজ বর্ণ ধারণ করে। আবার ফসফরাসের পরিমাণ কম থাকলে পানি কালচে রঙ ধারণ করে।
হলুদাভ রঙের পানিতে নাইট্রেটের পরিমাণ কম থাকে। পানি যদি খুব বেশি স্বচ্ছ হয় তাহলেও সে পানিতে মাছের প্রাকৃতিক খাবার অনুপস্থিত। আবার পানি যদি খুব বেশি সবুজ হয় তাহলেও সে পানিতে অতিরিক্ত উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন বিদ্যমান থাকে বিধায় এটাও মাছচাষের জন্য তত বেশি উপযোগী নয়। মাছচাষের জন্য উপযোগী পানির বর্ণ হলো হালকা সবুজ অথবা বাদামি। সেকিডিস্ক রিডিং ১ ফুট বা ৩০ সে.মি. পর্যন্ত মাছচাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
খ. পানির স্বচ্ছতা ও ঘোলাত্ব :
পানিতে ভাসমান কোন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদার্থ অতিরিক্ত পরিমাণে থাকলে পানি অস্বচ্ছ দেখায়। আবার পানিতে অতিরিক্ত উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনের উৎপাদনের ফলেও পানির স্বচ্ছতা কমে যেতে পারে । ঘোলাত্ব সৃষ্টিকারী কণিকাসমূহের আধিক্যের কারণেও পানি ঘোলা হতে পারে। এঁটেল ও লাল মাটির পুকুরের পানিতে অতি সূক্ষ্ণ মাটির কণা ভাসমান থাকে বলে প্রায় সময়ই এ ধরনের পুকুরের পানি ঘোলা থাকে । ঘোলা পানিতে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। ফলে সূর্যালোকের অভাবে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন ব্যহত হয়।
আবার অনেক সময় ঘোলাত্ব সৃষ্টিকারী কণিকাসমূহ মাছের ফুলকায় আটকে গিয়ে মাছের শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে মাছ ঘোলা পানিতে বসবাস করলে ফুলকা পচে যেতে পারে । ঘোলাত্ব দূরীকরণে শতাংশ প্রতি ১ কেজি চুন অথবা জিপসাম ব্যবহার করা যেতে পারে । আবার অনেক সময় কচুরিপানা, খড়ের আটি, ডালপালা প্রভৃতি সাময়িক সময়ের জন্য পুকুরে রেখেও অনেক সময় ঘোলাত্ব দূর করা যেতে পারে। এছাড়া নিয়মিত গোবর গুলিয়ে পুকুরে প্রয়োগ করেও ঘোলাত্ব দূর করা যেতে পারে। একটি আদর্শ পুকুরের পানির স্বচ্ছতার সহনীয় পরিমাপ হলো ১ ফুট বা ৩০ সেন্টিমিটার।
গ. আলো :
পুকুরের পানিতে পর্যাপ্ত সূর্যালোকের ব্যবস্থা থাকা দরকার । কারণ সূর্যালোকের উপস্থিতিতে জলজ পরিবেশে বিদ্যমান সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শর্করা জাতীয় খাদ্য তৈরি করে। সালোকসংশ্লেষনের জন্য প্রায় ১ মিটার গভীরতা পর্যন্ত সূর্যের আলো প্রবেশ করা প্রয়োজন।
এ জন্য সমগ্র পুকুরের কমপক্ষে ৫০% জায়গায় দৈনিক অন্তত ৮ ঘণ্টা সূর্যের আলো পড়া প্রয়োজন। সূর্যালোকের অভাবে সালোকসংশ্লেষণে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে পুকুরের পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য বা প্ল্যাংকটন তৈরি হবে না । পুকুরের যে গভীরতা পর্যন্ত কার্যকরী সূর্যালোক (কমপক্ষে ১%) পৌঁছায় সেই গভীরতা পর্যন্ত অঞ্চলকে ফোটিক জোন ( Photic Zone) বা আলোকিত অঞ্চল বলে ।
ঘ. তাপমাত্রা :
জলজ পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলো তাপমাত্রা। মাছ শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণী বিধায় তাপমাত্রার সাথে বিপাকীয় কার্যক্রমের সরাসরি একটি সম্পর্ক রয়েছে। তাপমাত্রা বাড়লে মাছের বিপাকীয় কার্যক্রমের হার বেড়ে যায় ফলে খাদ্য চাহিদাও বেড়ে যায়। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা পর্যন্ত প্রতি ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য মাছের খাদ্য চাহিদা ১০% বৃদ্ধি পায় ৷ যথাযথ তাপমাত্রায় অধিক খাদ্য গ্রহণের সাথে সাথে হজমক্রিয়া ও পাচকরস নিঃসরণে কম সময় ব্যয় হয়। ফলে অধিক পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয় তাই মাছের বৃদ্ধি দ্রুততর হয়।
তাপমাত্রা কমে গেলে মাছের খাদ্য গ্রহণের হার কমে যায়। এ জন্য শীতকালে খাদ্যের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দিতে হয়। পানির তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে গেলে কার্পজাতীয় মাছ এবং ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে গেলে তেলাপিয়া মাছ খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। কার্পজাতীয় মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য অনুকূল তাপমাত্রা হলো ২৫ ডিগ্রী হতে ৩১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তাই কোনো কারণে পুকুরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বা কমে গেলে তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
পুকুরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বাহির থেকে ঠান্ডা পানি সরবরাহ করে বা সাময়িক সময়ের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করে পুকুরের পানির অতিরিক্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এজন্য টোপা পানা, কচুরিপানা বা কলমিলতা দ্বারা সাময়িক সময়ের জন্য পুকুরের আয়তনের ১০% স্থানে ছায়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ঙ. পানির গভীরতা :
পানির গভীরতার ওপর উৎপাদনশীলতা নির্ভর করে। পানির গভীরতা খুব কম হলে মিশ্রচাষের ক্ষেত্রে সকল প্রকার মাছের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ স্থান বিদ্যমান থাকে না। আবার পানির গভীরতা কম থাকে বলে মাছের চলাফেরার সময় পাখনা দ্বারা তলদেশের মাটি এবং পানি আন্দোলিত হয়। ফলে পানি সবসময় ঘোলা থাকে। অল্প গভীর এবং ঘোলাত্বের কারণে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় । আবার পানি ঘোলা হলে পানির ঘনত্ব বেড়ে যায়।
ফলে স্বচ্ছ পানির চেয়ে ঘোলা পানিতে চলাফেরার সময় মাছের অনেক বেশি শক্তি ব্যয় হয়। এ ধরনের ঘোলাত্ব সৃষ্টিকারী পুকুরে কোনো ক্রমেই পর্যাপ্ত পরিমাণ চুন ব্যবহার করেও পানির ঘোলাত্ব দূর করা যায় না। আবার পানি যদি খুব বেশি গভীর হয় তাহলেও পুকুরের তলদেশ পর্যন্ত প্রকৃত সূর্যালোক পৌঁছাবে না ফলে সালোকসংশ্লেষণের অভাবে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হবে না। আবার অধিক গভীরতা সম্পন্ন পুকুরে পচনকারী জীবের কর্মতৎপরতা কম থাকে বলে জৈব ভৌত রাসায়নিক চক্র ঠিকমতো সম্পন্ন হয় না।
তাই তলদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকারক উপাদানসমূহ মাটি থেকে পানিতে মিশতে পারে না বিধায় ঐ ধরনের পুকুর তত বেশি উর্বর হয় না। গভীরতার সাথে পানির চাপেরও একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। গভীরতা যত বেশি হবে পানির চাপ ততই বেড়ে যাবে। তাই পুকুরের পানির গভীরতা যদি খুব বেশি হয় এবং সেসব পুকুরে রেণুপোনা লালন- পালন করা হয় তাহলে পানির চাপের ফলে অনেক পোনা মারা যায় বা অতিরিক্ত চাপের কারণে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মাছকে যথেষ্ট শক্তি ব্যয় করতে হয়। ফলে মাছের বৃদ্ধির হার কমে যায় । একটি আদর্শ নার্সারি পুকুরের গভীরতা ৩ ফুট এবং মজুদ পুকুরের গভীরতা ৬ ফুট।
আরও দেখুন: