আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – গলদা চিংড়ি হ্যাচারির ভৌত অবকাঠামো নির্মান । যা ” গলদা চিংড়ির প্রজনন ও হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
গলদা চিংড়ি হ্যাচারির ভৌত অবকাঠামো নির্মান
গলদা চিংড়ি হ্যাচারির ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ
গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে সঠিকভাবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপন, ধারণক্ষমতা ও ব্যবহারের উপযািেগতার উপর এর উৎপাদন সফলতা নির্ভর করে। হ্যাচারির ধরন, হ্যাচারি পরিচালনা পদ্ধতি, উৎপাদন ক্ষমতা এবং উৎপাদন এলাকার পরিবেশের সাথে অবকাঠামোর পার্থক্য বা পরিবর্তন হতে পারে।
সুতরাং একটি হ্যাচারি নির্মাণের পূর্বে সংশিষ্ট এলাকার পরিবেশগত বিষয়সমূহ বিবেচনায় রেখে অভিজ্ঞ নকশাকার দিয়ে এর নকশা তৈরি করে নিতে হবে। নকশা তৈরির সময় নিম্নেক্ত বিষয়সমূহের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
১. নির্বাচিত এলাকার ভৌগলিক সুবিধা।
২. পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ।
৩. উপকরণ সংগ্রহের সুবিধা
৪. স্থানীয় জনগনের গ্রহনযোগ্যতা ও সম্পৃক্ততা
৫. হ্যাচারিতে কর্মরত শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা
৬. হ্যাচারি পরিচালনার ঝুঁকিসমূহ অপসারণ বা কমানোর সুবিধা
৭. হ্যাচারির বর্জ্য নিষ্কাশন ও আবর্জনা অপসারণের সুবিধা
৮. জীব নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সুবিধা
গলদা চিংড়ি হ্যাচারির ভৌত অবকাঠামো
গলদা চিংড়ি হ্যাচারির ভৌত অবকাঠামো সঠিকভাবে এবং সঠিক ধারণক্ষমতা সম্পন্নভাবে নির্মাণ করা না হলে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে এবং হ্যাচারি পরিচালনায় বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। হ্যাচারিতে কর্মরত কর্মচারীদের ব্যবহার উপযািেগতার কথা বিবেচনায় রেখে সঠিক ডিজাইন এবং আয়তনের অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। গলদা চিংড়ি হ্যাচারির ভৌত অবকাঠামোর ডিজাইন এবং আয়তন নিম্নলিখিত বিষয়ের উপরে নির্ভর করে
১. ভূমির আকার, আয়তন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও অবস্থানগত সুবিধা =
২. মূলধন বিনিয়োগের সামর্থ্য
৩. উৎপাদনযোগ্য চিংড়ির প্রজাতি
৪. হ্যাচারির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা, পানের বাজার ও ব্রড চিংড়ির প্রাপ্যতা
৫. হ্যাচারি পরিচালনায় দক্ষ জনবল
উপরািেলখিত বিষয়াদির প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিকভিত্তিতে পরিচালিত একটি আদর্শ গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে নিম্নলিখিত ভৌত সুবিধা থাকা প্রয়োজনঃ
হ্যাচারি ভবন: গলদা চিংড়ি হ্যাচারির ভবনটি খোলামেলা হওয়া প্রয়োজন। ইটের সাধারণ গাঁথুনির উপরে অ্যাসবেস্টস অথবা ফাইবার শিটের ছাউনী দেয়া হলে ভবনের অভ্যন্তরে পরিচালিত উৎপাদন কাজে পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে লার্ভা প্রতিপালনের ট্যাংকে প্রচুর আলো পড়ার প্রয়োজন হয়। তাই অ্যাসবেস্টসের ছাউনীর ক্ষেত্রে এলআরটি-এর ঠিক উপরে স্বচ্ছ ফাইবার শিট স্থাপন করে ট্যাংকে আলো পড়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
হ্যাচারি ভবনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন উৎপাদন ট্যাংকসমূহ ছাড়াও আর্টিমিয়া হ্যাচিংএর ব্যবস্থা, ল্যাবরেটরি, অফিস, স্টোর, ফিডরুম, ওয়াশরুম ইত্যাদির সংস্থান রাখতে হবে। তাই নির্মাণকালে এমনভাবে এর নকশা প্রণয়ন করতে হয় যেন বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যাতায়াতে কোনো সমস্যা না হয়, অথচ হ্যাচারির জীব-নিরাপত্তা ব্যাহত হয় না।
ব্রাইন মজুদের ট্যাংক: গলদা চিংড়ির হ্যাচারি পরিচালনা করতে হলে সারা মৌসুমেই লবণ পানির প্রয়োজন হয়। তাই প্রথমেই লবণ পানি মজুদ করে রাখতে হয়। যে সব এলাকায় কেবলমাত্র বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ব্রাইন পাওয়া যায় (লবণ তৈরির মাঠ বা বিশেষ ভাবে হ্যাচারিতে ব্যবহারের জন্য উৎপাদিত ব্রাইন) সে এলাকা থেকে ব্রাইন সংগ্রহ করে মজুদ ট্যাংকে রাখতে হয়।
এ ট্যাংক মাটির উপরে বা মাটির নিচে বা অর্ধেক মাটির নিচে স্থাপন করা যায়। এ ট্যাংক সিমেন্ট-কংক্রিটের দ্বারা নির্মাণ করে পানি প্রবেশ ও বাহির এবং পরিষ্কার করার পাইপলাইন রাখতে হবে। স্বাদু পানির টিউবওয়েল, পাম্প মেশিন এবং পাম্প হাউস: ভূগর্ভস্থ পানি দ্বারা গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে স্বাদু পানির চাহিদা মিটানো হয়। এ জন্য টিউবওয়েল, পাম্পমেশিন ও পাম্প হাউস প্রয়াজন। হ্যাচারির দৈনিক পানির চাহিদার উপরে নির্ভর করে টিউবওয়েলের ব্যাস, পাম্পের শক্তি ও পাম্প হাউসের আয়তন নির্ধারণ করা যেতে পারে।
পানি মিশ্রিতকরণ ও শোধন ট্যাংক: এ ট্যাংকে স্বাদু পানির সাথে ব্রাইন মিশ্রিত করে নির্ধারিত লবণাক্ততা সম্পন্ন পানি তৈরি করা হয় এবং বিচিং পাউডার মিশ্রিত করে পানি শোধন করা হয়। এ ট্যাংকের আয়তন ও সংখ্যা হ্যাচারি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার উপর নির্ভরশীল।
হ্যাচারিতে দৈনিক পানি ব্যবহারের চাহিদার উপরে নির্ভর করে অন্তত ৫ দিনের চাহিদা মিটাতে পারে এরূপ আয়তনের পানি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন শোধন ট্যাংক নির্মাণ করা উচিত। ব্যবস্থাপনা সুবিধার জন্য ১৫-২০ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ট্যাংকই উপযোগী। এ ট্যাংক মূল হ্যাচারি ঘরের বাইরে থাকতে পারে। মিশ্রণ ট্যাংক RCC ঢালাই নির্মিত হলে ভালো হয়। খরচ কমানোর জন্য ইটের গাথুনি দিয়েও এ ট্যাংক নির্মাণ করা যেতে পারে।
বালির ফিল্টার ট্যাংকঃ এ ট্যাংকে বালি, কাঠকয়লা, কাঁকর, নুড়িপাথর, ঝিনুক, ইত্যাদি দিয়ে পানি ছাকনি বা ফিল্টার তৈরি করা হয়। পানিতে উপস্থিত সকল প্রকার অদ্রবণীয় কণা, ভাসমান পদার্থ, বিভিন্ন প্রাণীর ডিম, লার্ভা ইত্যাদি এমনকি সকল প্রোটোজোয়া, ফাংগাস এবং অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া এ ফিল্টারের সাহায্যে পৃথক করা সম্ভব। হ্যাচারির পানির চাহিদানুযায়ী প্রতি ঘণ্টায় কতটুকু পানি ফিল্টার করতে হবে তা নির্ধারণ করে এর আয়তন এবং ধারণক্ষমতা ও সংখ্যা নির্ণয় করতে হয়।
পরিশ্রুত পানি জমা করার ট্যাংকঃ হ্যাচারির উৎপাদন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে এর উৎপাদন ট্যাংকে একবারে অনেক পানি সরবরাহের প্রয়োজন হতে পারে। তাই প্রয়োজনের সময় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে শোধিত ও পরিশ্রত পানি প্রয়োজনীয় পরিমাণে জমা রাখার জন্য এ ধরনের ট্যাংকের প্রয়োজন হয়। হ্যাচারিতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় পানির ৩-৫ গুণ পানি এ সমস্ত ট্যাংকে মজুদ রাখলে হ্যাচারি পরিচালনা সহজতর হয়।
ওভারহেড ট্যাংকঃ শোধিত ও পরিশ্রুত মিশ্রিত পানি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাহায্যে সহজে উৎপাদন ট্যাংকে প্রবাহিত করার জন্য ওভারহেড ট্যাংকের প্রয়োজন হয়। এ ধরনের ট্যাংক সাধারণত সিমেন্ট-কংক্রিটের নির্মিত হয়ে থাকে এবং এর নির্মাণ ব্যয় কিছুটা ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। ওভারহেড ট্যাংকের সাহায্যে গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে দৈনিক পানি পরিবর্তনকালে এলআরটিতে পানি সঞ্চালনের গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।
ব্রড শোধন ট্যাংকঃ বাইরে থেকে সংগৃহীত ব্রুড বা ডিমওয়ালা চিংড়ি এ ট্যাংকে শোধন করা হয়। সাধারণত ০.৫-১ টন ধারণক্ষম- তা। সম্পন্ন ট্যাংক এ কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কাজের সুবিধার্থে স্থায়ী অবকাঠামো অপেক্ষা ফাইবার গ্লাস বা প্লাস্টিকের স্থানান্তরযোগ্য ট্যাংক এ কাজে ব্যবহার করা হয়।
ব্রড চিংড়ি হোল্ডিং ও ম্যাচুরেশান ট্যাংকঃ ডিম ফুটে লার্ভা বের হওয়া পর্যন্ত পরিপক্ক স্ত্রী গলদা চিংড়িকে এ ট্যাংকে রেখে প্রতিপালন করা হয়। হোল্ডিং ট্যাংক ২ ধরনের হয়ে থাকে। প্রথমত বাইরে থেকে ডিমওয়ালা চিংড়ি এনে একটি পৃথক চৌবাচ্চায় রাখতে হয়। পরে এ চৌবাচ্চা থেকে যেসব চিংড়ির ডিম ধূসর বর্ণের হবে সেই চিংড়ি দ্বিতীয় হোল্ডিং ট্যাংকে রাখা হয়। একটি ট্যাংকেও এ কার্যক্রম সম্পাদন করা যায় তবে পৃথক ট্যাংক ব্যবহার হ্যাচারি পরিচালনা সহায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত।
হ্যাচিং ট্যাংকঃ এ ট্যাংকে পরিপক্ক স্ত্রী গলদা চিংড়ি রাখা হয় এবং এখানে এর ডিম ফুটে লার্ভা হয়। অনেক হ্যাচারিতে ব্রড হোল্ডিং ট্যাংককে হ্যাচিং ট্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে আলাদা হ্যাচিং ট্যাংক ব্যবহার করা স্বাস্থ্যসম্মত। এ কাজে স্থায়ী অবকাঠামো অপেক্ষা ঋজচ ট্যাংক ব্যবহার করা সুবিধাজনক। হ্যাচিং ট্যাংক লম্বাকৃতি বা গোলাকার হতে পারে। এখানে ডিম ফুটার পরে লার্ভা সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সংযোগ করা যায়। এর ধারণক্ষমতা ৫০০ লিটার থেকে ১ টনের মধ্যে হলে ভালো হয়।
লার্ভা প্রতিপালনের ট্যাংক বা এলআরটিঃ এই সমস্ত ট্যাংকে সদ্য ফোটা লার্ভা মজুদ করা হয় এবং পিএল হওয়ার পূর্ব সময় পর্যন্ত প্রতিপালন করা হয়। ট্যাংকের আকার উপ-বৃত্তাকার, গোলাকার অথবা বর্গাকার হতে পারে। ট্যাংক পরিষ্কার করা ও তাতে খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য গোলাকার ট্যাংক অধিকতর সুবিধাজনক।
এ ধরনের ট্যাংকের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে খাদ্য পরিবেশন করা এবং পরিষ্কার করা সহজতর। ব্যবস্থাপনা সুবিধার জন্য গলদা চিংড়ি হ্যাচারির লার্ভা প্রতিপালনের ট্যাংক সাধারণত ৩ টন থেকে ৫ টনের মধ্যে হয়ে থাকে। ছোট হ্যাচারির জন্য ১-২ টন পানিধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ফাইবার গ্লাস বা প্লাস্টিক ট্যাংকও ব্যবহার করা যায়।
বায়োফিল্টার ট্যাংকঃ পুনঃসঞ্চালন পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি হ্যাচারি পরিচালনাকালে এলআরটি-এর সাথে বায়োফিল্টার ট্যাংক নির্মাণ করতে হবে। এলআরটি সংলগ্ন বায়োফিল্টার ট্যাংক সাধারণত এলআরটি-এর আয়তনের ২৫% হয়ে থাকে। এ ট্যাংক নির্মাণকালে এলআরটি-এর সাথে বায়াফিল্টার ট্যাংকের মধ্যে পানি পুনঃসঞ্চালনের বিভিন্ন সুবিধার সংস্থান রাখতে হবে।
প্রতিটি এলআরটি-এর জন্য পৃথক বায়োফিল্টার ট্যাংক নির্মাণ করতে হবে। বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে সম্প্রতি বায়োফিল্টারের মাধ্যমে পানি পুনঃসঞ্চালন পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি হ্যাচারি পরিচালনা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বিধায় অধিকাংশ আধুনিক হ্যাচারিতে এ ট্যাংক নির্মাণ করা হয় না।
নার্সারি ট্যাংকঃ লার্ভা পিএল পর্যায়ে রূপান্তরিত হওয়ার পরে এদের প্রতিপালনের পদ্ধতি পরিবর্তন হয়ে যায় বিধায় তখন এদের পৃথক নার্সারি ট্যাংকে প্রতিপালন করার প্রয়োজন হয়। এ কাজে স্থায়ী অবকাঠামো ব্যবহার করা যায়। তবে এলআরটি হিসেবে ব্যবহৃত ট্যাংকও পরিষ্কার করে নিয়ে এ কাজে ব্যবহার করা যায়। নার্সারি ট্যাংকের ডিজাইন ও আয়তন এলআরটি-এর অনুরূপ হতে পারে।
ট্যাংকে এ্যাপক্সি রংকরণঃ হ্যাচারিতে উৎপাদন কাজের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে এমন ট্যাংক সিমেন্ট-কংক্রিটের তৈরি হলে এসব ট্যাংকের ভিতরের গায়ে মেরিন এ্যাপক্সি পেইন্টের প্রলেপ লাগানো প্রয়োজন। অন্যথায় সিমেন্টের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছিদ্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজোয়া পরবর্তীতে ট্যাংকের পানিতে এসে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এর ফলে যে কোনো সময় উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
এসব ক্ষতিকর রোগজীবাণু যাতে ট্যাংকের পানির সংস্পর্শে এসে কোনো প্রকার সংক্রমণের সৃষ্টি করতে না পারে সে উদ্দেশ্যে উৎপাদন-ট্যাংকের ভিতরের অংশে এ্যাপক্সি-মেরিন পেইন্টের প্রলেপ দেয়া হয়। খেয়াল রাখতে হবে যেন ট্যাংকের কোথাও এ রঙের প্রলেপ উঠে না যায়। এমন হলে সম্পূর্ণ ট্যাংকের এ্যাপক্সি প্রলেপ তুলে ফেলে নতুনভাবে পেইন্ট করতে হবে।
ফিড রুম/সার্ভিস রুমঃ গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে লার্ভা ও পিএল-এর খাদ্য প্রস্তুত, সংরক্ষণ ও অন্যান্য কাজের জন্য একটি পৃথক কক্ষ থাকা আবশ্যক। এ কক্ষটি আলো-বাতাসযুক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ল্যাবরেটরিঃ গলদা চিংড়ির লার্ভার রূপান্তর এবং এলআরটি-তে বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণু পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের উপযোগিতা পরীক্ষা ও সংরক্ষণ, আর্টিমিয়া পর্যবেক্ষণ এবং অনুরূপ অন্যান্য পরীক্ষামূলক কাজের জন্য অবশ্যই একটি ল্যাবরেটরি ইউনিট থাকা প্রয়াজন।
আর্টিমিয়া হ্যাচিং ট্যাংকঃ গলদা চিংড়ির লার্ভাকে প্রতিদিন খাদ্য হিসেবে আর্টিমিয়া নপ্লি সরবরাহ করতে হয়। তাই চাহিদা অনুযায়ী আর্টিমিয়া নপ্পি হ্যাচিং-এর জন্য আর্টিমিয়া ট্যাংক ব্যবহার করতে হয়। এ জাতীয় ট্যাংক সিমেন্ট-কংক্রিটের হতে পারে। তবে ফাইবার গ্লাস বা প্লাস্টিকের স্থানান্তরযোগ্য ট্যাংক হলে তা পরিষ্কার করা এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সংরক্ষণ করা সহজ হয় ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখা সুবিধাজনক হয়।
প্যাকিং এবং বাজারজাতকরণের শেডঃ এখানে পিএল বিক্রির আগে তাকে খাপ খাওয়ানো এবং পরিবহনের উদ্দেশ্যে উপযুক্তভাবে প্যাকিং করার জন্য আলাদা একটি শেড থাকতে হবে। তাছাড়া এ শেডে বিক্রয়ের জন্য পিএল রাখার সুবিধা, প্যাকিং এর জন্য প্রয়োজনীয় পানি রাখার সুবিধা, পোনা ও অক্সিজেন দেয়ার সুবিধা, ক্রেতার বিশ্রাম এবং বসার সুবিধা ইত্যাদি থাকা প্রয়োজন। এ এলাকায় ট্রাক বা অন্য কোনো যানবাহন সহজে যাতায়াত করতে পারে সেজন্য রাস্তা ও অন্যান্য ভৌত সুবিধা নির্মাণ করতে হবে।
পানি নিষ্কাশন এবং বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনাঃ হ্যাচারির সামগ্রিক হাইজিন রক্ষার উদ্দেশ্যে এর উপযোগী নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি উৎপাদন ইউনিট থেকে ব্যপানি সঠিকভাবে নিষ্কাশন করা না হলে হ্যাচারির জীব-নিরাপত্তা ব্যাহত হবে এবং এ ক্ষেত্রে উন্নত গুণগতমাণ সম্পন্ন স্বাস্থ্যবান পিএল উৎপাদন করা সম্ভব হবে না।
হ্যাচারির প্রত্যেকটি উৎপাদন ইউনিট থেকে ব্যপানি নিষ্কাশনের জন্য উপযুক্ত ঢালসম্পন্ন নর্দমা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে একটি কেন্দ্রীয় নর্দমায় মিলিত হয় এবং এখান থেকে সম্পূর্ণ হ্যাচারির বর্জ্য পানি একটি পৃথক ট্যাংকে শশাধনের জন্য জমা হয়। জমাকৃত ব্যপানি এ ট্যাংকে শাধেনের পূর্বে বাইরে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা যাবে না।
মেকানিক্যাল ইউনিটঃ হ্যাচারির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি এ ইউনিটে স্থাপনপূর্বক পরিচালনা করা হয়। এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে। বোয়ার, জেনারেটর, সাবমার্সিবল হিটারের জন্য অটো থার্মো-কন্ট্রোল প্যানেল বোর্ড, ইউভি স্টেরিলাইজার, কার্টিজ ফিল্টার, বিদ্যুতের মিটার ও প্রধান সুইচ ইত্যাদি।
হ্যাচারিতে শব্দদূষণ এবং ডিজেল ও অন্যান্য জ্বালানির কারণে দূষণের সম্ভাব্যতা পরিহার করার উদ্দেশ্যে জেনারেটারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি স্থাপনের বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। হ্যাচারির বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামোর সাথে মানানসই অবস্থানে পরিকল্পিতভাবে এসব যন্ত্রপাতি স্থাপন করা না হলে হ্যাচারি পরিচালনার কাজ জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
সাধারণ/প্রশাসনিক ইউনিটঃএকটি বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে উন্নত গুণগতমাণ সম্পন্ন পিএল উৎপাদন ও বিক্রয়ের কাজকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে আরও কিছু ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা প্রয়োজন। এসব অবকাঠামো সরাসরি উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত না হলেও হ্যাচারির সার্বিক বাণিজ্যিক উৎকর্ষ সাধনে এসব অবকাঠামোর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
এসব অবকাঠামোগুলো হচ্ছে (১) অফিস রুম, (২) স্টোর রুম, (৩) রেস্ট রুম বা গেস্ট হাউস, (৪) কর্মচারী, টেকনিশিয়ান এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জন্য পৃথক পৃথক আবাসিক সুবিধা এবং আবাসিক ইউনিটসমূহের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক নর্দমা ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা, (৫) গার্ড শেড, (৬) গ্যারেজ এবং গাড়ি পার্কিং এর স্থান, (৭) গেইট, সীমানা প্রাচীর, অভ্যন্তরীণ রাতা ও প্রাঙ্গণ বিদ্যুতায়ন ইত্যাদি।
এসব অবকাঠামোর ডিজাইন, আয়তন ও অন্যান্য সুবিধা সংযাজেনের বিষয়টি হ্যাচারির চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার উপরে ভিত্তি করে নির্মাণ করতে হবে।
বহিরাঙ্গন ব্রডপালন ও নার্সারি পুকুর
যে সকল হ্যাচারির আঙিনায় পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে সে সকল হ্যাচারিতে এ ধরনের পুকুর নির্মাণ ও ব্যবহার হ্যাচারি, পরিচালনার জন্য সুবিধাজনক এবং এতে হ্যাচারি পরিচালনা বেশ লাভজনক। হ্যাচারি সংলগ্ন স্থানে ব্রড পালনের পুকুর থাকলে যথাসময়ে নিজস্ব হ্যাচারিতে ব্যবহারের জন্য ব্রড চিংড়ি পাওয়া নিশ্চিত করা যায়। তাছাড়া অবিক্রীত পিএল হ্যাচারি সংলগ্ন নার্সারি পুকুরে প্রতিপালন করে জুভেনাইল পর্যায়ে বিক্রয় করে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
নার্সারি পুকুরের আয়তন ১০-২০ শতক হতে পারে এবং পানির গড় গভীরতা ৬০-৭০ সেমি রাখা যেতে পারে। ব্রড পালন পুকুরের আয়তনও হ্যাচারিতে ব্রড চিংড়ির চাহিদা এবং ব্যবস্থাপনা কৌশলের উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করতে হবে। এ সকল পুকুরের পানির গড় গভীরতা ১-১.৫ মিটার পর্যন্ত রাখা যেতে পারে।
গলদা হ্যাচারি পরিচালনায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি
আধুনিক গলদা চিংড়ি হ্যাচারি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন প্রকার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ সকল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির স্পেসিফিকেশন, মডেল, কার্যক্ষমতা, আকার আকৃতি ও ব্যবহার পদ্ধতির উপর সম্যক ধারণা না থাকলে সুষ্ঠুভাবে হ্যাচারি পরিচালনা করা সম্ভব নয়। গলদা হ্যাচারিতে বহুল ব্যবহৃত ও অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির পরিচিতি, স্পেসিফিকেশন ও ব্যবহারবিধি/কাজ নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
জ. রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও ঔষধপত্র
জীবমাত্রই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। অন্যান্য প্রাণীর মত চিংড়ির পিএলও বিভিন্ন Causative Agent-এর মাধ্যমে রোগাক্রান্ত হতে পারে। Causative Agent-গুলোর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও এককোষী প্রাণী উল্লেখযোগ্য। হ্যাচারিতে রোগ বলতে ডিমওয়ালা চিংড়ি, লার্ভা ও পিএল-এর রোগকেই বুঝায়।
হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কীয় এটি ও অপরিচ্ছন্নতার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তাই হ্যাচারি পরি সর্বদা মনে রাখতে হবে যে “রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগ প্রতিরোধই উত্তম”। সে জন্য হ্যাচারির অভ্যন্তরে মূলত পানি, যন্ত্রপাতি, সরঞ্জামাদি এবং সরবরাহকৃত খাদ্যের গুণগতমান বজায় রাখা ও জীবাণুমুক্ত রাখা একান্ত আবশ্যক।
রোগ প্রতিরোধে গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও ঔষধপত্রের নাম নিচে দেয়া হলো: • বিচিং পাউডার (৬০-৬৫% ক্লোরিন)
- সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড (তরল)
- ফরমালিন (ল্যাব গ্রেড)
- সোডিয়াম থায়োসালফেট
- সোডিয়াম বাই-কার্বনেট
- অক্সিটেট্রাসাইক্লিন
- ট্রেফলন
- প্রিফুরান
- ভঃরপধ (Ethylene Di-amino Tetra acetic Acid)
- এ্যাকোয়াকালচার প্রোবায়োটিক
- জুমসাইড/প্রোটোজুয়াসাইড
- মিথিলিন ক
- ভিটামিন প্রিমিক্স/মাল্টিভিটামিন/ভিটামিন সি
ঝ. খাদ্য ও খাদ্য উপকরণঃ
লার্ভা ও পিএল-এর দ্রুত বৃদ্ধি, দেহের ক্ষয়পূরণ ও পুষ্টির অভাবজনিত রোগ নিরাময়ের জন্য সময়মতো সঠিক পরিমাণে সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার করা হয়। হ্যাচারিতে ব্যবহৃত সম্পূরক খাদ্য প্রধানত দুই প্রকার। যথা-
১. জীবিত খাদ্য: আটিমিয়া।
২. তৈরি খাদ্য: কাস্টার্ড ও ফরমুলেটেড (এনক্যাপসুলেটেড) ফিড
১. আর্টিমিয়া: আর্টিমিয়া এক প্রকার ক্ষুদ্র প্রাণীকণা প্রোটিন ও ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ ক্রাস্টিসয়া যা চিংড়ির। লার্ভার জন্য জীবন্ত প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
২. কাস্টার্ড: কাস্টার্ড হলো বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে তৈরি এক প্রকার সম্পূরক খাবার যা জীবিত খাবার আর্টিমিয়ার পাশাপাশি লার্ভার জন্য সরবরাহ করা হয়।
১ কেজি কাস্টার্ড তৈরির ফর্মুলা নিচে দেয়া হলো:
উপকরণ-পরিমাণ
গুড়া দুধ-৩০০ গ্রাম
ডিম-৩৫০ গ্রাম
কর্ণ ফ্লাওয়ার-১০০ গ্রাম
মাছ/চিংড়ি/ শ্রিম্প মিট-২১০ গ্রাম
কড লিভার অয়েল-১৭ মিলি
ভিটামিন প্রিমিক্স-১২ গ্রাম
আগার পাউডার-১০ গ্রাম
অক্সিটেট্রাসাইক্লিন-১ গ্রাম
ফরমুলেটেড খাদ্য
বর্তমানে গলদা চিংড়ির লার্ভার জন্য উপযোগী বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতকৃত ফরমুলেটেড খাদ্য বাজারে পাওয়া যায়। এর মধ্যে পিলেট খাদ্য, মাইক্রো-পার্টিকুলেট খাদ্য এবং মাইক্রো-এ্যানক্যাপসুলেটেড খাদ্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ ও পদ্ধতি সম্পর্কে কৌটার গায়ে নির্দেশাবলি অনুসরণ করা উচিত।
এসব খাদ্যের মধ্যে মাইক্রো-এ্যানক্যাপসুলেটেড খাদ্য ট্যাংকে প্রয়োগের পর দীর্ঘসময় এর অভ্যন্তরস্থ পুষ্টি উপাদান ধরে রাখতে সক্ষম। তাছাড়া এসব খাদ্যের দ্বারা ট্যাংকের পানির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। গলদা চিংড়ি লার্ভার জন্য প্রস্তুতকৃত ফরমুলেটেড খাদ্য নির্বাচনের সময় খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি লার্ভার বয়স এবং মুখবিব্বরের মাপের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সতর্কতার সাথে খাদ্যকণার আকার নির্ধারণ করতে হবে।
হোল্ডিং ট্যাংক ব্যবস্থাপনা
কমলা বর্ণের ডিমওয়ালা চিংড়িকে হোল্ডিং ট্যাংকে রাখা হয়। স্ত্রী গলদা চিংড়ির ডিমের রং প্রথমে কমলা থাকে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ডিম ফুটার সময় হলে কালচে বা ধূসর বর্ণ ধারণ করে। ধূসর বর্ণের ডিমওয়ালা চিংড়ি সংগ্রহ করলে পরিবহনের সময় অনেক ডিম নষ্ট হতে পারে। তাই ডিমওয়ালা চিংড়ি সংগ্রহ করার ৫-৭ দিন পর ডিম ফুটবে এমন স্ত্রী গলদা চিংড়ি সংগ্রহ করা দরকার।
উপযুক্ত ডিমওয়ালা স্ত্রী গলদা চিংড়ি সংগ্রহ করার পর সতর্কতার সাথে ডিমওয়ালা চিংড়ির আকার, ওজন, সংখ্যা, সময় এবং দূরত্ব বিবেচনা করে পরিবহন করা হয়। পরিবহনকালে পানির তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখার বিষয়টি বিবেচনায় এনে সকাল ও বিকালে ডিমওয়ালা চিংড়ি পরিবহন করা উত্তম।
প্লাস্টিকের হাফ ড্রামে ৫০ লিটার পানিতে দূরত্ব অনুযায়ী ২৫-৩০টি চিংড়ি পরিবহন করা যায়। পরিবহনের সময় পানি পরিবর্তন ও ব্যাটারি চালিত এরেটরের সাহায্যে বাতাসের ব্যবস্থা করা হয়। এতে চিংড়ির উপর পরিবেশগত পীড়নের সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়।
ডিমওয়ালা চিংড়ি পরিশোধন: প্রকৃতির অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে সংগৃহীত ডিমওয়ালা চিংড়ির শরীরে বিভিন্ন রোগজীবাণু থাকে। এসব ডিমওয়ালা চিংড়ি হ্যাচারিতে প্রবেশ করানোর পূর্বে পরিশোধন করা খুবই জরুরি। ২০-২৫ পিপিএম ফরমালিন দ্রবণে ৪০-৪৫টি চিংড়ির ৩০ মিনিট বায়ু সঞ্চালনের মাধ্যমে গাছেল করিয়ে পরিশোধন করতে হয়। এর ফলে চিংড়ির শরীরে বাহ্যিকভাবে থাকা রাগজীবাণু দূর করা সম্ভব হয়।
খাপ খাওয়ানো: হ্যাচারির পানির তাপমাত্রা ও অন্যান্য প্যারামিটারের সাথে ডিমওয়ালা চিংড়িকে খাপ খাওয়ানো হলে এদের মৃত্যুহার কমে যায়। অন্যথায় এসব ডিমওয়ালা চিংড়ি থেকে সুস্থ সবল লার্ভা পাওয়া সম্ভব হয় না। চিংড়ি খাপ খাওয়ানোর সময় নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা উচিতঃ
- হোল্ডিং ট্যাংকে অধিক ঘনত্বে চিংড়ি মজুদ করা ঠিক নয়। কারণ অধিক ঘনত্বে খাদ্যগ্রহণ ও চলাচলে অসুবিধা হয়, জাতিভািেজতা বেড়ে যায় এবং পানির গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে।
- মজুদের পর পরই হোল্ডিং ট্যাংকে আশ্রয়স্থল হিসেবে পিভিসি পাইপ ব্যবহার করতে হবে।
- দুর্বল, অসুস্থ ও কম ডিমওয়ালা বা ছোট আকৃতির চিংড়ি মজুদ করা যাবে না।
হোল্ডিং ট্যাংকে খাদ্য প্রয়োগ: হোল্ডিং ট্যাংকে মাদার চিংড়িকে নিয়মিত গুণগতমাণসম্পন্ন খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। যে সব খাদ্য প্রয়োগ করা যায় তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
ক) চাউল বা গম
খ) ভাত
গ) ঝিনুকের মাংস
ঘ) শামুক
ঙ) গুড়া চিংড়ি
চ) পূর্ণ বয়স্ক আর্টিমিয়া
উল্লেখ্য যে, ঝিনুকের মাংস, শামুক ও গুড়া চিংড়ি ব্যবহারে পানি বেশি নষ্ট হয়। তাই এগুলো টুকরো টুকরো করে গরম পানিতে হালকা সিদ্ধ করে প্রয়োগ করা উচিত। ইদানিং বাজারে বিভিন্ন ব্রান্ডের ফরমুলেটেড পিলেট খাবার পাওয়া যায়। ডিমওয়ালা চিংড়িকে প্রতিদিন মোট দৈহিক ওজনের ৫% হারে খাবার দিতে হয়। হোল্ডিং ট্যাংক থেকে উচ্ছিষ্ট খাবার প্রতিদিন ২বার সাইফনিং করে পরিষ্কার করতে হবে।
হ্যাচিং ট্যাংক ব্যবস্থাপনা
ডিমের বর্ণ কালচে ধূসর বা ছাই বর্ণের হলে হ্যাচিং ট্যাংকে স্থানান্তর করা হয়। হ্যাচিং ট্যাংকের পানির গুণাগুণ নিম্নরূপ হতে হবে।
তাপমাত্রাঃ ২৮-৩১° সেলসিয়াস
পিএইচঃ ৭.৫-৮.৫
লৌহঃ ০.০ পিপিএম
ক্লোরিনঃ ০.০ পিপিএম
দ্রবীভূত অক্সিজেনঃ ৪-৫ পিপিএম
নাইট্রাইট নাইট্রোজেনঃ ০.১ পিপিএম এর কম
অ্যামোনিয়াঃ ০.১ পিপিএম এর কম
হাইড্রোজেন সালফাইডঃ ০.০ পিপিএম
হ্যাচিং ট্যাংকে প্রতি বর্গমিটারে ৩-৪টি ডিমওয়ালা চিংড়ি মজুদ রাখতে হবে। হ্যাচিং ট্যাংকে উপযুক্ত ডিমওয়ালা চিংড়ি স্থানান্তরের পর পরিশোধনকৃত ১২ পিপিটি লবণাক্ত পানির সাথে স্বাদু পানি মিশিয়ে হ্যাচিং ট্যাংকের পানির লবণাক্ততা ৪-৫ পিপিটি করতে হবে। হ্যাচিং ট্যাংকের পানিতে ১০ পিপিএম ইডিটিএ এবং ০.০৫ পিপিএম ট্রাফলান প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ডিমওয়ালা চিংড়ির আশ্রয়স্থল হিসেবে হ্যাচিং ট্যাংকে ৬-৮ ইঞ্চি লম্বা সাইজের ছিদ্রযুক্ত পিভিসি পাইপ পরিমাণমত দেয়া যেতে পারে। পানির উচ্চতা ১.৫-২ ফুট রাখতে হবে। হ্যাচিং ট্যাংকে খাদ্য সরবরাহ করা ঠিক নয়। কারণ খাদ্যের মাধ্যমে লার্ভার শরীরে জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
হ্যাচিং ট্যাংক থেকে লার্ভা সংগ্রহ ও পরিশোধন
গলদা চিংড়ির ডিম সর্বদা রাতের বেলায় ফুটে, কখনও দিনের বেলায় ফুটে না। সকাল বেলা ১২০ মিলি মাইক্রন কুপ নেটের সাহায্যে হ্যাচিং ট্যাংক থেকে লার্ভা সংগ্রহ করতে হয়। হ্যাচিং ট্যাংক থেকে লার্ভা সংগ্রহ করার জন্য ২০-৫০ মিলি আয়তনের কয়েকটি বীকার, ৪-৫ পিপিটি মাত্রার পরিশ্রুত ও জীবাণুমুক্ত পানি, বালতি, মগ, গামলা, ফরমালিন ইত্যাদি উপকরণ প্রয়োজন হয়।
লার্ভা সংগ্রহ করার পূর্বে কালো পলিথিন দিয়ে হ্যাচিং ট্যাংক ঢেকে দিতে হবে। হ্যাচিং ট্যাংকের বায়ুসঞ্চালন বন্ধ করে এক পার্শ্বে একটি বাল্ব জ্বালিয়ে দিলে লার্ভাগুলো আলোর কাছে চলে আসবে। এরপর খুব ধীরে ধীরে কুপ নেটের সাহায্যে লার্ভা সংগ্রহ করে গামলার পানিতে ছাড়তে হবে।
প্রয়োজন অনুযায়ী বার বার এ প্রক্রিয়া চালিয়ে লার্ভা পৃথক করতে হবে। অতঃপর ২৫-৩০ লিটার পরিমাপের গামলায় হ্যাচিং ট্যাংক থেকে ৮-১০ লিটার পানি নিয়ে বায়ুসঞ্চালন দিয়ে সংগৃহীত লার্ভা রাখতে হবে। লার্ভা সংগ্রহের কাজ শেষ হলে প্রথমে গামলায় সংগৃহীত লার্ভি থেকে সাইনিং করে ময়লা দূর করতে হবে।
তারপর গামলার ভিতরে ১২ পিপিটি লবণাক্ততা সম্পন্ন পানি ১ থেকে ২ মগ ছিটিয়ে দিতে হবে অথবা সরু পাইপের সাহায্যে সরবরাহ করতে হবে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আধা ঘণ্টা পর পর ১২ পিপিটি লবণাক্ততা সম্পন্ন পানি গামলায় সরবরাহ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে ৫-৭ ঘণ্টার মধ্যে গামলা পানির লবণাক্ততা ১২ পিপিটি আনতে হবে।
১২ পিপিটি লবণাক্ততায় আসার পর উক্ত লার্ভার গামলায় ২০০-২৫০ পিপিএম ফরমালিন (প্রতি ২৫ লিটার পানিতে ৫ মিলি) প্রয়োগ করে আধাঘণ্টা বায়ু সঞ্চালনপূর্বক পরিশোধন করতে হবে। আধাঘণ্টা পর ৫০% পানি ফেলে দিয়ে পুনরায় ২ মঙ্গ ১২ পিপিটি পানি গামলায় আস্তে আস্তে ঢালতে হবে।
প্রতি ২৫-৩০ লিটারের পামলায় ১,০০,০০০-১,৫০,০০০টি লার্তা রাখা যায়। এভাবে সংগৃহীত লার্ভা এলআরটি-তে নির্ধারিত ঘনত্বে মজুদ করতে হয়। প্রতিপালন ট্যাংকে ১ টন পানিতে সাধারণত ১ লক্ষ লার্ভা মজুদ করা যায়। সেজন্য লার্তা গণনা করা প্রয়োজন। প্রথমে লার্তাসহ পামলার মোট পানির পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে।
একটি ছোট বীকারে গামলা থেকে লার্ভাসহ অল্প পানি নিয়ে তার পরিমাণ জেনে লার্ভার সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। লার্ভার সংখ্যা = (ছোট বীকারে লার্ভার সংখ্যা = ছোট বীকারের পানির আয়তন) গামলার পানির মোট আয়তন। এলআরটি-তে লার্ভা মঞ্জুদের সময় এদেরকে এলআরটি-এর পানির সাথে ভালোভাবে খাপখাইয়ে মজুদ করা প্রয়োজন।
এ লক্ষ্যে প্রথমে পরিশাধিত লার্ভার গামলাটি ফরমালিন মিশ্রিত পানি দিয়ে তলাসহ চতুর্দিক পরিষ্কার করতে হবে। অতঃপর লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংকের সাথে লার্ভা ভর্তি গামলার পানির তাপমাত্রা ঠিক করার জন্য এলআরটি-এর পানি দুই মগ করে লার্ভার গামলায় ১০ মিনিট পর পর ছিটিয়ে অথবা পাইপের সাহায্যে ধীরে ধীরে সরবরাহ করতে হবে এবং পামলাটি লার্ভা এলআরটি-এর পানিতে ভাসিয়ে রাখতে হবে। উত্তয় পানির তাপমাত্রা সমান হলে আস্তে আস্তে প্রতিপালন ট্যাংকের পানিতে লার্ভা ছাড়তে হবে। রাত ৮.০০ টা থেকে ৯.০০ টার মধ্যে এলআরটি-তে লার্ভা ছাড়ার কাজ সম্পন্ন করা ভাল।
লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংক ব্যবস্থাপনা
হ্যাচিং ট্যাংক থেকে সদ্যফুটা লার্ভা সংগ্রহ, শশাধন ও গণনাপূর্বক নির্ধারিত মজুদ ঘনত্বে লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংক বা এলআরটি-তে মজুদ করা হয়। এ ট্যাংকেই লার্ভার ১১টি পর্যায় অতিক্রম করে এরা পোস্টলার্তা পিএল-এ রূপান্তরিত হয়। এর জন্য পানির তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও অন্যান্য বিষয়াদির উপরে নির্ভর করে প্রায় ৩০-৪০ দিন সময়ের মধ্যে লার্ভা সিএল-এ রূপান্তরিত হয়। এই সময়টি লার্ভার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। উৎপাদন কর্মকাণ্ডের সর্বাপেক্ষা সংবেদনশীল অংশ এখানে অনুশীলন করা হয়।
গলদা চিংড়ির লার্ভা প্রতিপালনে এলআরটি ব্যবস্থাপনায় নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডগুলো সম্পন্ন করা হয়ঃ
১. এলআরটি-তে নির্দিষ্ট সংখ্যক লার্ভা সঠিক পদ্ধতিতে শোধনপূর্বক এলআরটি-এর পানির সাথে ভালোভাবে খাপ খাওয়ানোর পর মজুদ করা।
২. লার্ভার জন্য জীবিত প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে আর্টিমিয়া নপি সরবরাহ করা এবং এজন্য নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরিমাণ আর্টিমিয়া সিস্ট হ্যাচিং-এর ব্যবস্থা করা।
৩. নির্ধারিত সময় থেকে লার্ভার জন্য পরিমিত পরিমাণে কাস্টার্ড খাদ্য সরবরাহ করা এবং এজন্য নিয়মিত, প্রয়োজনীয় পরিমাণ কাস্টার্ড খাদ্য তৈরি করা।
৪. কাস্টার্ড খাদ্য প্রয়োগের পাশাপাশি এ খাদ্যের মোট চাহিদা ও কাস্টার্ড সরবরাহের পরিমাণের সাথে সমন্বয় সাধন করে লার্ভার জন্য নিয়মিত ফরমুলেটেড খাদ্য পরিবেশন করা।
৫. এলআরটি থেকে লার্ভার পরিত্যক্ত উচ্ছিষ্ট খাদ্য দৈনিক ১ অথবা ২ বেলা সাইফনের সাহায্যে নিয়মিত অপসারণ করা।
৬. এলআরটি-এর দেয়াল ও মেঝেতে জমে থাকা ময়লা নিয়মিত ব্রাশ করে পরিষ্কার করা এবং সাইফনের সাহায্যে অপসারণ করা।
৭. পুনঃসঞ্চালন পদ্ধতিতে পরিচালিত হ্যাচারিতে পানি পুনঃসঞ্চালনের উদ্দেশ্যে বায়োফিল্টার স্থাপন, বায়োফিল্টার সক্রিয়করণ, এলআরটি-এর সাথে বায়োফিল্টারের সংযোগ স্থাপন এবং বায়াফিল্টার পরিচালনা করা।
৮. বায়োফিল্টার পরিচালিত হতে থাকলে নিয়মিত এলআরটি-এর পানিতে আয়নিত ও অনায়নিত অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট ও নাইট্রেটের পরিমাণ নির্ধারণ এবং এলআরটি-এর পানিতে এসবের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৯. খোলা-পানি পদ্ধতিতে পরিচালিত হ্যাচারিতে প্রতিদিন সমগুণাবলি সম্পন্ন পানি দ্বারা এলআরটি-এর ২৫। ৩০% পানি পরিবর্তন করা।
১০. এলআরটিতে পানির গভীরতা, তাপমাত্রা, পি.এইচ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি, পানিতে ফেনা সৃষ্টি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা।
১১. পানিতে বায়সঞ্চালন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা।
১২. লার্ভার রূপান্তর প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা।
১৩. নিয়মিত লার্ভার স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা, এর চলাফেরা, নড়াচড়া, খাদ্যগ্রহণের প্রবণতা ও অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করা।
১৪. লার্ভার নিয়মিত আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে এর শরীরে ক্ষতিকর রোগজীবাণু আছে কিনা পরীক্ষা করা।
১৫. এলআরটি-এর পানিতে ক্ষতিকর রোগজীবাণুর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা।
১৬. লার্ভার রোগজীবাণু প্রতিরোধে নিয়মিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে উপযুক্ত রাসায়নিক সামগ্রী ও ঔষধপত্র নির্ধারিত মাত্রায় ব্যবহার করা।
১৭. লার্ভার রোগ শনাক্ত হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৮. লার্ভার রোগ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেলে ক্ষতিগ্রত ট্যাংকে উচ্চ ক্লোরিন প্রয়োগপূর্বক সম্পূর্ণ ট্যাংকের রোগাক্রান্ত লার্ভা ধ্বংস করে সতর্কতার সাথে নিষ্কাশন করা এবং ট্যাংকটি জীবাণুমুক্ত করে ধুয়ে রাখা।
১৯. এলআরটি-তে প্রোবায়ািেটক ব্যবহার করা হলে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা।
২০. এলআরটি ইউনিটের মেঝে, নর্দমা, পাইপলাইন ও অন্যান্য অবকাঠামো নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করে পরিষ্কার করা।
২১. এলআরটি থেকে পোনা পর্যবেক্ষণের জন্য স্থাপিত বিকার ও পাত্রের পানি নিয়মিত পরিবর্তন করা।
২২. এলআরটি ইউনিটে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি ও তৈজসপত্র নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করে ধৌত করা।
গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে এলআরটি ব্যবস্থাপনা কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে কাজের ধরন অনুযায়ী উপরািেলখিত বিষয়গুলোকে কয়েকটি প্রধান শিরানোমের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যেমন-
১. এলআরটি-তে লার্ভার খাদ্য ব্যবস্থাপনা
২. এলআরটি-এর পানি ব্যবস্থাপনা
৩. এলআরটি পরিষ্কারকরণ
৪. লার্ভার স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণ
৫. লার্ভা প্রতিপালন ইউনিটের স্যানিটেশান এবং হাইজিন রক্ষা
(১) এলআরটি-তে গলদা চিংড়ি লার্ভার খাদ্য ব্যবস্থাপনা
এলআরটি-তে লার্ভার নিরবচ্ছিন্ন পুষ্টি অর্জন এবং বৃদ্ধি সাধনের জন্য নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। হ্যাচারিতে লার্ভার জন্য এলআরটি-তে নিম্নলিখিত কয়েক ধরনের খাদ্য প্রয়োগ করা হয়
১. জীবিত প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে আর্টিমিয়া নপ্নি
২. প্রস্তুতকৃত খাদ্য
১. গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে জীবিত প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে আর্টিমিয়ার ব্যবহার
আর্টিমিয়া বা ব্রাইন শ্রিম্প চিংড়ির মত ক্লাসটাসিয়া শ্রেণীভুক্ত এক প্রকার ক্ষুদ্রাকৃতির জলজ সন্ধিপদ প্রাণী। লবণাক্ত পানির হ্রদ বা অনুরূপ প্রাকৃতিক জলাশয়ে এরা বসবাস করে। গলদা চিংড়ির লার্ভা এবং পিএল পর্যায়ে বিকল্পহীন প্রাকৃতিক জীবিত খাদ্য হিসেবে আর্টিমিয়া নপির গুরুত্ব অপরিসীম। গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে আর্টিমিয়া নগ্নি ব্যবহারের উপযািেগতাসমূহ নিম্নরূপ
- সাধারণ সমুদ্রের পানি অথবা কৃত্রিম লবণাক্ত পানিতে সহজ পদ্ধতিতে আর্টিমিয়া নলি ফুটানো এবং এলআরটি-তে সরবরাহ করা যায়।
- আর্টিমিয়া সিস্ট সংরক্ষণ, পরিবহন ও প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করা সুবিধাজনক।
- সদ্য ফুটা আর্টিমিয়া নগ্নি তাৎক্ষণিকভাবে লার্ভার খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করা যায়, আবার হিমায়িত বা সিদ্ধ করে সংরক্ষণ করা হলে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করা যায়।
- আর্টিমিয়া নপ্পি লবণাক্ততার ব্যাপক পরিবর্তন সহ্য করে বেঁচে থাকতে পারে।
- আর্টিমিয়া নপ্লি ট্যাংকের পানির গুণাগুণ নষ্ট করেনা, বরং পানির গুণাগুণ উন্নয়নে সহায়তা করে।
- উন্নতমানের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও অন্যান্য দুষপ্রাপ্য পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতির কারণে বিকল্পহীন খাদ্য হিসাবে আর্টিমিয়া নপির উপযোগিতা রয়েছে।
- নির্ধারিত সময়ের ব্যবধানে অর্টিমিয়া নপির পুষ্টিমান কমে গেলে এদেরকে পুনরায় পুষ্টিমানে সমৃদ্ধ (Enrichment) করা যায়।
- ডিমওয়ালা চিংড়ি বা পোনার জন্য বিশেষ বা নির্ধারিত কোনো পুষ্টি উপাদান বাহক (Carrier) হিসেবে আর্টিমিয়া নপির মাধ্যমে সরবরাহ করা যায়।
১৫-১০০ পিপিটি লবণাক্ততায় আর্টিমিয়ার ডিম স্বল্প সময়ের মধ্যে ফুটে যায়। কিনতু ১৫০ পিপিটি লবণাক্ততায় ডিমটি একটি শক্ত কৃত্তিকাবরণী বা ঈড়হ্রড়হ দ্বারা বেষ্টিত হয়ে বাদামি বর্ণের সিস্টে পরিণত হয়। অভ্যন্তরস্থ ভুণের মান অপরিবর্তিত রেখে শুল্ক সিস্টকে বায়ুশূন্য অবস্থায় দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
পরবর্তীতে উপযুক্ত পরিবেশে অভ্যন্তরস্থ ডিম ফুটে পিয়াসে রূপান্তরিত হতে পারে। ৫০-৭০ পিপিটি লবণাক্ত পানির সংস্পর্শে এলে অল্প সময়ে সিস্টের উপরের খোলস ফেটে সন্তরণশীল পিয়াস লার্ভা বা নপ্তি বের হয়ে আসে। এদের কুসুম থলিতে উচ্চমানের লিপিড ও বিভিন্ন ধরনের ফ্যাট সামগ্রীর উপস্থিতির কারণে পির বর্ণ উজ্জ্বল কমলা বা সানোলি হয়ে থাকে।
সিস্ট এবং আর্টিমিয়া পির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপঃ
১. সিস্টের গড় ব্যাসঃ২০০-৩০০ মাইক্রন
২. সিস্টের গড় ওজনঃ৩.৫ মাইক্রোগ্রাম
৩. প্রতি গ্রাম ওজনে সিস্টের গড় সংখ্যাঃ১,৯০,০০০-৩,৫০,০০০ টি
৪. সদ্য ফুটা নপ্লির গড় দৈর্ঘ্যঃ৪০০-৬০০ মাইক্রন (০.৪ মিমি)
৫. সদ্য ফুটা নপ্লির গড় ওজনঃ০.০০২ মিলিগ্রাম
৬. ১ গ্রাম ওজনে সদ্য ফুটা পির গড় সংখ্যাঃ ১,৪০,০০০-৩,২০,০০০ টি
৭. পূর্ণ বয়ষ্ক আর্টিমিয়ার গড় দৈর্ঘ্যঃ ৬৫০-১,০০০ মাইক্রন (১০-১৫ মিমি)
আর্টিমিয়া সিস্ট থেকে নগ্নি উৎপাদন
আর্টিমিয়া সিস্ট থেকে হ্যাচারিতে দুভাবে নপ্পি উৎপাদন করা যায়। যেমন-
ক. সিস্টের খোসা না ছড়িয়ে সরাসরি নপ্পি উৎপাদন
খ. সিস্টের খোসা ছড়িয়ে নপ্পি উৎপাদন
ক. সিস্টের খোসা না ছড়িয়ে সরাসরি নপ্পি উৎপাদন করার পদ্ধতি
- আর্টিমিয়া সিস্টের সাথে বিভিন্ন ক্ষতিকর রোগজীবাণু থাকে। উত্তমরূপে ধৌত করা না হলে এসব রোগজীবাণু দ্বারা হ্যাচারির জীব-নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। হ্যাচারিতে সাধারণত ১০ পিপিএম ক্লোরিনের দ্রবণে সম্পৃক্ত করে আর্টিমিয়া সিস্টকে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এর পাশাপাশি ক্লোরিনের প্রভাবে সিস্টের উপরের কৃত্তিকাবরণী বা ঈড়হ্রড়হ অনেকটা নরম হয়ে হ্যাচিং সহজতর হয় এবং হ্যাচিং এর হার বৃদ্ধি পায়।
- আর্টিমিয়া সিস্ট থেকে নপ্লি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে প্রথমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ আর্টিমিয়া সিস্ট ওজন করে নেয়া হয়। বিচিং পাউডার অথবা অন্য যে কোনো ক্লোরিন সামগ্রী ব্যবহারে ১০ পিপিএম ক্লোরিন দ্রবণ প্রস্তুত করা হয়। এ দ্রবণে আর্টিমিয়া সিস্ট রেখে মাঝারি গতিতে ১-১.৫ ঘণ্টা বায়ু সঞ্চালন করে প্রতিটি সিস্টকে ক্লোরিন দ্রবণে উত্তমরূপে সম্পৃক্ত করত জীবাণুমুক্ত করা হয়। ১০০ মেস স্কুপ-নেটে উক্ত আর্টিমিয়া সিস্ট সংগ্রহ করা হয় এবং চলমান স্বাদু পানির নিচে ৪/৫ মিনিট রেখে ধৌত করত ক্লোরিন মুক্ত করা হয়।
- ইতোমধ্যে আর্টিমিয়া হ্যাচিং এর জন্য নির্ধারিত ট্যাংক ভালোভাবে ধৌত ও জীবাণুমুক্ত করে পূর্ব থেকে প্রস্তুত রাখা হয়। সাথে সাথে অন্যান্য সরঞ্জাম (এয়ার স্টোন, লীড ওয়েট, এয়ার হাসে, থার্মোমিটার, হীটার, থার্মেস্ট্যাট-সেন্সর, বালতি, গামলা, মগ, কুপ নেট ইত্যাদি) জীবাণুমুক্ত করে ধৌত করা হয়।
- অতঃপর হ্যাচিং ট্যাংকে পরিমাণমত পরিশ্রুত ও জীবাণুমুক্ত সমুদ্রের পানি (২০-২৫ পিপিটি) সরবরাহ করা হয়।
- হ্যাচিং ট্যাংকে মাঝারি গতিতে সার্বক্ষণিক বায়ু সঞ্চালন করা হয়। এর ফলে আর্টিমিয়া সিস্ট তৃপিকৃত না হয়ে সর্বদা ট্যাংকের পানিতে ঝুলন্ত অবস্থায় উঠানামা করতে থাকে। এ জন্য হ্যাচিং ট্যাংকের তলদেশ সমতল না হয়ে ফানেল সদৃশ হলে ভালো হয়।
- হ্যাচিং ট্যাংকের পানির তাপমাত্রা সর্বদা ৩০-৩১° সে. মাত্রায় স্থির রাখতে হবে। অন্যথায় হ্যাচিং এল ফলাফল ভালো না হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
- আর্টিমিয়া সিস্ট হ্যাচিং-এর প্রাথমিক পর্যায়ে আলোর উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই হ্যাচিং ট্যাংকে ১,৭০০ ২,০০০ লাক্স আলো পড়া নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য হ্যাচিং ট্যাংকের উপরে দু’টি ৮০ ওয়াট ফ্লোরোগেন্ট টিউব লাইটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
- অতঃপর হ্যাচিং ট্যাংকের পানি জীবাণুমুক্ত করে ধৌত করা আর্টিমিয়া সিস্ট হ্যাচিং-এর জন্য ছেড়ে দেয়া হয়।
- হ্যাচিং ট্যাংকে আর্টিমিয়া সিস্টের ঘনত্ব ১.৫-২ গ্রাম/লিটার এর মধ্যে রাখতে হবে। অন্যথায় হ্যাচিং এর হার কমে যেতে পারে বা এছাড়া জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে।
- পানির লবণাক্ততা, তাপমাত্রা, আলো, বায়ু প্রবাহ এবং অন্যান্য গুণাগুণের উপরে নির্ভর করে পানিতে ভিজানোর (Hydration) ৮ ঘণ্টার মধ্যে আর্টিমিয়া সিস্ট এর হ্যাচিং শুরু হতে পারে। আদর্শ পরিবেশে ১৬-২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৭০%-৮০% সিস্ট ফুটে যায়। তবে আরও ভালো ফলাফল প্রাপ্তির জন্য ১৮ ঘণ্টা পরে প্রথমবার নগ্নি সংগ্রহ করে পুনরায় হ্যাচিং চালানো এবং ২৪ ঘণ্টা পরে ২য় বার নপ্লি সংগ্রহ করা ভাল।
- আর্টিমিয়া নপ্পি আহরণের কাজ শুরু করার অন্তত ৩০ মিনিট পূর্বে হ্যাচিং ট্যাংকের বায়ু সঞ্চালন বন্ধ করে দিয়ে পানিকে স্থির হতে দেয়া হয় এবং ট্যাংকটি কালো পলিথিন দ্বারা ঢেকে দিয়ে শুধুমাত্র নিচের দিকে একটি উজ্জ্বল আলো রাখা হয়। এর ফলে নপ্লি ট্যাংকের নিম্নাংশে জমা হয় এবং সিস্ট ও সিস্টের খোসা পানির উপরে ভেসে উঠে। এ অবস্থায় ট্যাংকের নিম্নাংশের গেইট-বালু খুলে অথবা সাইফন পাইপের সাহায্যে ১০০ মেস ফুপ-নেটে নপ্পি আহরণ করা হয় এবং অন্যান্য অবাঞ্ছিত হালকা পদার্থ ট্যাংকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। আহরিত নপ্নি পরিষ্কার লবণাক্ত পানিতে ধৌত করে মৃদু বাকু সঞ্চালনসহ পৃথক পরিষ্কার পাত্রে রাখা হয়।
- নরি সাথে অবাঞ্ছিত সিস্ট বা খাসোর পরিমাণ বেশি মনে হলে সংগ্রহের ট্যাংকে বায়ু সঞ্চালন বন্ধ করে পুনরায় তে নপ্পি আহরণ করা হয়। এভাবে পর পর দুবার আহরণ করা হলে পরিত্যক্ত সিস বা খাসোর পরিমাণ একেবারে কমে যায়। এখান থেকে আর্টিমিয়া নপ্পি ধৌত করে প্রতিপালন ট্যাংকে সরবরাহ করা হয়।
- আর্টিমিয়া নপ্পি সংগ্রহের ট্যাংকের প্রতি ৩০ লিটার আয়তনের জন্য ১২৫ মিলি হারে তরল হাইড্রোজেন-পার অক্সাইড (৫০%) যোগ করে মৃদু বায়ু সঞ্চালন করা হলে ট্যাংকে প্রচুর বুদবুদ সৃষ্টি হয়ে ফেনার উদ্ভব ঘটে এবং নপির সাথে অবস্থিত সিস্ট ও খোসা উক্ত ফেনার সাথে উঠে আসে। তখন বায়ু সঞ্চালন বন্ধ করে কুপ নেটের সাহায্যে উপর থেকে ফেনা দূর করা হলে আটিমিয়া নপ্নি সম্পূর্ণরুপে সিস্ট-মুক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে সিস্ট দূর করার পরে পুনরায় পরিশ্রত স্বাদু পানির সাহায্যে উত্তমরূপে ধৌত করে আর্টিমিয়া নপ্নি পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয়।
- ভিবরিও জাতের অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া দ্বাদু পানি সহ্য করতে পারেনা। তাই স্বাদু পানি দ্বারা ধৌত করা হলে আর্টিমিয়া নঙ্গি অনেকাংশে জীবাণুমুক্ত হয়ে যায়।
খ. আর্টিমিয়া সিস্টের খোসা ছড়ানোর পদ্ধতি
আর্টিমিয়া সিস্টের খোসা ছাড়িয়ে ফুটানোর ব্যবস্থা করা হলে হ্যাচিং এর হার বৃদ্ধি পায় এবং খোসা ও অন্যান্য অবাঞ্ছিত সামগ্রী পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা কমে যায়। তাছাড়া খোসা না থাকার কারণে হ্যাচিং ট্যাংক থেকে নগ্নি সংগ্রহের কাজ সহজে সম্পন্ন করা যায়। নিম্নলিখিত কর্মপদ্ধতিতে আর্টিমিয়া সিস্টের খোসা যেতে পারে-
আর্টিমিয়া সিস্ট থেকে খোসা ছড়িয়ে নপি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে প্রথমে কৌটা খুলে প্রয়োজনীয় পরিমাণ আর্টিমিয়া সিস্ট ওজন করে একটি পরিষ্কার প্লাস্টিকের পাত্রে ৩-৪ লিটার পরিষ্কার স্বাদু পানিতে ভিজানো (Hydration) হয়। ১ ঘণ্টা পরে ভিজানো আর্টিমিয়া সিস্ট ৬০-৮০ মাইক্রন স্কুপ-নেটে নিয়ে পরিশ্রুত চলমান স্বাদু পানিতে উত্তমরুপে ধৌত করা হয়।
সিস্টের খোসা ছড়ানারে পরবর্তী কাজ দুটি পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা যায়ঃ
১ম পদ্ধতিঃ প্রতি ১ কেজি সিস্টের সাথে পরিষ্কার প্লাস্টিকের পাত্রে পর্যায়ক্রমে ৪০ গ্রাম সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH), ৪ লিটার সোডিয়াম হাইপাক্লোরাইট দ্রবণ (৪° সে. তাপমাত্রা) এবং ৪ লিটার পরিশ্রুত ও জীবাণুমুক্ত সমুদ্রের পানি (৪° সে. তাপমাত্রা যোগ করে দ্রবণটিকে অবিরাম নাড়াচাড়া করতে থাকলে ৫-১০ মিনিটের মধ্যে সিস্টের খোসা (Corion) দ্রবীভূত হওয়া শুরু হয় এবং সম্পূর্ণ দ্রবণটি উজ্জ্বল কমলা বর্ণ ধারণ করে। এ বিক্রিয়ার ফলে তাপ উৎপন্ন হয়ে দ্রবণের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে থাকে। দ্রবণের সাথে বরফ যোগ করে এর তাপমাত্রা ১৮ ২৫° সে.-এর মধ্যে রাখা হলে অধিকতর ভালো ফল পাওয়া যায়।
২য় পদ্ধতি: একটি পরিষ্কার প্লাস্টিকের পাত্রে ১ কেজি ভিজানো আর্টিমিয়া সিস্টের সাথে ৭ লিটার লবণাক্ত পানি যোগ করা হয় এবং বরফ প্রয়োগ করে এর তাপমাত্রা ২০° সে.-এ এনে স্থির রাখা হয়। উক্ত দ্রবণের সাথে ১২৫ গ্রাম পাথুরে চুন (Cao) যোগ করে ভালোভাবে মিশ্রিত হওয়া পর্যন্ত নাড়াচাড়া করা হয়।
অতঃপর এর সাথে ২৭৫ গ্রাম ক্যালসিয়াম হাইপােেক্লারাইট দ্রবণ যোগ করে অবিরাম নাড়াচাড়া করা হয়। এ সময়ে দ্রবণের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে পরিমাণমত বরফ যাগ করে এর তাপমাত্রা ৪০° সে. মাত্রায় স্থির রাখা হয়। ৫/৭ মিনিট নাড়াচাড়া করার পর দ্রবণের তাপমাত্রা ৩০° সে, মাত্রায় নামানোর জন্য কিছু অতিরিক্ত বরফ যোগ করা হয়।
অতঃপর এর সাথে পুনরায় উপরািেলখিত মাত্রায় পাথুরে চুন এবং ক্যালসিয়াম হাইপাক্লোরাইট দ্রবণ যোগ করে অনবরত নাড়াচাড়া করা হয়। ১০ মিনিটের মধ্যে সিস্টের খোলস দ্রবীভূত হওয়া শুরু হয় এবং দ্রবণটি গাঢ় কমলা বর্ণ ধারণ করে। সম্পূর্ণ কাজটি ১৫ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়।
যে পদ্ধতিতেই হাকে না কেন, খোসামুক্ত হওয়ার পর ৬০-৮০ মাইক্রন কুপ-নেটে ডিমগুলো নিয়ে প্রথমে চলমান স্বাদু পানিতে ধৌত করা হয়। পরে ১০০ পিপিএম সোডিয়াম থায়োসালফেট দ্রবণে ২/৩ মিনিট ধুয়ে খোসা ছড়ানারে বিক্রিয়া বন্ধ করা হয় এবং ক্লোরিনের অবশিষ্টাংশ দূর করা হয়।
অতঃপর ডিমগুলো স্বচ্ছ ও পরিষ্কার স্বাদু বা লবণাক্ত পানিতে রাখা হলে খোসামুক্ত ডিম পাত্রের তলায় গিয়ে জমা হয় এবং খাসোযুক্ত সিস্ট পানির উপরে ভাসতে থাকে। পাত্রের তলা থেকে খাসামুক্ত ডিম সাইফনের সাহায্যে সংগ্রহ করে হ্যাচিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে হ্যাচিং-এর প্রয়োজন না হলে খোসামুক্ত ডিম সংরক্ষণ করা যায়।
রেফ্রিজারেটারে ৩-৪° সে, তাপমাত্রায় খোসামুক্ত ডিম ৩/৪ দিন সংরক্ষণ করা যায়। কিনতু উল্লিখিত তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেট- ারে খোসামুক্ত ডিম লবণের সম্পৃক্ত দ্রবণে দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণ করা যায়। ১ লিটার পানিতে ৩০০ গ্রাম সাধারণ লবণ (NaCl) মিশ্রিত করে লবণের সম্পৃক্ত দ্রবণ তৈরি করা হয়।
উক্ত দ্রবণে খোসামুক্ত ডিম মৃদু বায়ু সঞ্চালন সহ ৩/৪ ঘণ্টা রেখে দেয়া হয়। এ অবস্থায় অভিস্রবণ (Osmosis) পদ্ধতিতে ডিমের অভ্যন্তরস্থ পানি বের হয়ে আসে। ১৫০ মাইক্রন চালুনীর সাহায্যে ডিম সংগ্রহ করে রেফ্রিজারেটারে ৬-৭ সপ্তাহ পর্যন্ত উক্ত ডিম সংরক্ষণ করা সম্ভব। প্রত্যক্ষ সূর্যালোকের নিচে খাসামুক্ত ডিমের কার্যকারিতা দ্রুত লাপে পায়।
হাইপোক্লোরা- ইট দ্রবণের বিক্রিয়ার ফলে খোসা ছাড়ানো ডিম স্বাভাবিকভাবেই জীবাণুমুক্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া এর সাথে কোনো প্রকার ময়লা থাকে না বিধায় সহজে এবং কম সময়ে হ্যাচিং করানো যায়। খোসা ছাড়ানো আর্টিমিয়া ডিম এলআরটি-তে সরাসরি সরবরাহ করা যায়।
এলআরটি-তে আর্টিমিয়া নপ্লি সরবরাহের মাত্রা
পরিপূর্ণ পুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এলআরটি-তে প্রতিটি লার্ভার জন্য দৈনিক ৪০-৫০ টি হারে আর্টিমিয়া নপ্লি সরবরাহ করা প্রয়োজন। লার্ভা মজুদ করার পরবর্তী দিবস থেকে এলআরটি-তে আর্টিমিয়া নগ্নি সরবরাহ করা প্রয়োজন হয়। ধৌত ও জীবাণুমুক্ত সদ্য ফুটা আর্টিমিয়া নপ্লি গণনা করে এলআরটি-এর পোনার সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরবরাহ করা উচিত।
সাধারণত এলআরটি-এর প্রতি টন আয়তনের জন্য দৈনিক ১০ গ্রাম হারে আর্টিমিয়া সিস্ট (৯০% হ্যাচিংযোগ্য) সরবরাহ করা হলে উপরাক্তে সংখ্যা বজায় রাখা সম্ভব হয়। তাই এলআরটি-তে প্রতিদিন একবারে প্রতি টনে ১০ গ্রাম অথবা ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে দৈনিক ২ বারের প্রতিবারে প্রতি টনে ৫ গ্রাম হারে আর্টিমিয়া সিস্ট সরবরাহ ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
আর্টিমিয়ার সিস্ট ফুটে সন্তরণশীল নপ্লি বের হয়ে আসার পরবর্তী পর্যায়কে ইনস্টার-১ বলা হয়। ১২ ঘণ্টা পরে এরা প্রথম খোলস পরিবর্তন করে ইনস্টার-২ পর্যায়ে রূপান্তরিত হয়। এ পর্যায়ে আর্টিমিয়া নপ্লির দেহস্থিত পুষ্টি উপাদান কমে যায় এবং এরা বাহ্যিক খাদ্য গ্রহণ শুরু করে। ইনস্টার-২ ভক্ষণে চিংড়ি পোনার পুষ্টি অর্জন হয় না।
তাই এলআরটি-তে আর্টিমিয়া নপ্তি ইনস্টার-১ পর্যায়ের মধ্যে সরবরাহ নিশ্চিত করা উচিত। অন্যথায় এদের পুষ্টিমাণ সমৃদ্ধকরণের (Enrichment) প্রয়োজন পর ইনস্টার-২ অথবা এর পরবর্তী পর্যায়ে যখন এরা বাহ্যিক খাদ্য গ্রহণ করা শুরু করে তখন বিশেষ পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য সরবরাহ করে অর্টিমিয়া নপিকে সমৃদ্ধকরণপূর্বক পুনরায় এলআর- টি-তে সরবরাহ করা যায়।
হ্যাচারির জীব-নিরাপত্তার অন্যতম ঝুঁকি হিসেবে আর্টিমিয়ার ভূমিকা রয়েছে। মুহূর্তের অসাবধানতায় আর্টিমিয়া নলির মাধ্যমে হ্যাচারিতে ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া বা ফাংগাসের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। তাই হ্যাচারিতে আর্টিমিয়া সিস্টের হ্যাচিং ও অন্যান্য ব্যবহারবিধিতে চরম সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি প্রতি ব্যাচের আর্টিমিয়া সিস্ট ব্যবহার শুরু করার পূর্বে নমুনা গ্রহণ করে পর্যবেক্ষণের সাহায্যে এর সাথে বিভিন্ন রোগজীবাণুর অনুপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
২. প্রস্তুতকৃত খাদ্য
হ্যাচারিতে গলদা চিংড়ি লার্ভা প্রতিপালনে এলআরটি-তে লার্ভার জন্য জীবিত প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে আর্টি-ি ময়া নপ্পি সরবরাহ করা হলেও এর মাধ্যমে লার্ভার সম্পূর্ণ পুষ্টি অর্জন হয় না। তাই আর্টিমিয়া নলির পাশাপাশি লার্ভার জন্য নিয়মিত প্রস্তুতকৃত খাদ্য সরবরাহের প্রয়োজন হয়। হ্যাচারিতে সাধারণত দুই ধরনের প্রস্তুতকৃত খাদ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে। যেমন
ক. কাস্টার্ড খাদ্য ও
খ. ফরমুলেটেড খাদ্য
ক. কাস্টার্ড খাদ্য
কাস্টার্ড প্রোটিন সমৃদ্ধ বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি এক প্রকার কৃত্রিম খাবার। জৈবিক খাবারের (আর্টিমিয়া) এর পাশাপাশি এলআরটি-তে লার্ভার জন্য পরিমিত পরিমাণে কাস্টার্ড খাদ্য নিয়মিত সরবরাহ করা হয়। লার্ভা ও পিএল-এর বৃদ্ধির প্রত্যাশিত হার বিবেচনায় রেখে ব্যয়বহুল জৈবিক খাবারের পরিমাণ কমিয়ে প্রোটিন ও বিভিন্ন খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ কাস্টার্ড খাবার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
প্রস্তুতপ্রণালি: কাস্টার্ড প্রস্তুতের বিভিন্ন উপাদানসমূহ নিম্নরূপ-
১. গুড়া দুধ : ৩০০ গ্রাম
২. ডিম : ১০ টি
৩. কর্নফ্লাওয়ার : ১০০ গ্রাম
৪. গুড়া চিংড়ি : ২১০ গ্রাম
৫. কডলিভার অয়েল: ১৭ মিলিলিটার
৬. ভিটামিন প্রিমিক্স : ১০ গ্রাম
৭. আগার পাউডার : ২০ গ্রাম
৮. অক্সিটেট্রাসাইক্লিন : ২০ গ্রাম
এসব উপকরণ একসাথে বেন্ডার মেশিনে মিশ্রণ করতে হবে। উত্তমরূপে মিশ্রিত হওয়ার পর এ মিশ্রণ বাষ্পী- য়তাপে সিদ্ধ ও শুষ্ক করে কেক প্রস্তুত করতে হবে।
প্রয়োগ মাত্রা: সাধারণত এলআরটি-তে লার্ভা মজুদের পরবর্তী ৫ম দিবস থেকে কাস্টার্ড খাদ্য সরবরাহ শুরু করা হয়। এ সময় থেকে তৈরিকৃত কেকগুলো লার্ভা/পিএল-এর বয়সানুসারে বিভিন্ন মেস সাইজের চালুনির মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকৃতির কণা তৈরি করে সরবরাহ করা হয়।
লার্ভার ৫ দিন বয়স হতে ১০ দিন বয়স পর্যন্ত ২০০ মাইক্রন আকারের চালুনি দিয়ে কাস্টার্ড কণা তৈরি করতে হবে। পরবর্তীতে লার্ভা। পিএল-এর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ১০-২০ দিন পর্যন্ত ২৫০ মাইক্রন এবং ২১ দিন থেকে অবশিষ্ট লার্ভা পর্যায় ও পিএল বিক্রয়ের পূর্ব পর্যন্ত ৩৫০ মাইক্রন আকারের চালুনি দ্বারা কাস্টার্ড কণা তৈরি করতে হবে।
প্রথমদিকে একটি ৫ টন এলআরটি-তে ২৫-৩০ গ্রাম কাস্টার্ড দৈনিক ১ বার সরবরাহ করতে হবে। লার্ভার বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে কাস্টার্ড সরবরাহের পরিমাণও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করতে হবে। শেষ পর্যায়ে ৫ টন ট্যাংকে দৈনিক ২/৩ বার এবং প্রতিবারে সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম কাস্টার্ড সরবরাহ করা হবে।
লার্ভার খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করে কাস্টার্ড প্রয়োগের পরিমাণ সমন্বয় করতে হবে। খাদ্যের পরিমাণ প্রয়োজন অপেক্ষা কম বা বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। অতিরিক্ত খাদ্য ট্যাংকের পানিকে দূষিত করে লার্ভার মৃত্যু ঘটাতে পারে। আবার খাদ্যের পরিমাণ কম হলে স্বজাতিভক্ষণ এবং পুষ্টিহীনতার সম্ভাবনা থাকে।
কাস্টার্ড প্রয়োগের পূর্বে নিয়মিত এর গুণগতমান যাচাই করা উচিত। ট্যাংকে কাস্টার্ড প্রয়োগের সময় বায়ুসঞ্চা- লন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। অন্যথায় লার্ভা খাদ্য কণা গ্রহণে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। উচ্ছিষ্ট খাদ্য ট্যাংকের তলায় জমা হবে। নিয়মিত সাইফন করে এ উচ্ছিষ্টাংশ ট্যাংক থেকে অপসারণ করা না হলে ট্যাংকের পানি দূষিত হয়ে লার্ভার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। কাস্টার্ড খাদ্য প্রস্তুতি, প্রয়োগ ও সংরক্ষণের সময় এর গুণগতমান ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
খ. ফরমুলেটেড খাদ্য
গলদা চিংড়ির লার্ভার জন্য উপযোগী বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতকৃত ফরমুলেটেড খাদ্য বাজারে পাওয়া যায়। এর মধ্যে পিলেট খাদ্য, মাইক্রোপার্টিকুলেট খাদ্য এবং মাইক্রো-এ্যানক্যাপসুলেটেড খাদ্য বিশেষভাবে উল্লেখযে- াগ্য। এ খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ ও পদ্ধতি সম্পর্কে কৌটার গায়ে নির্দেশাবলি অনুসরণ করা উচিত।
এসব খাদ্যের মধ্যে মাইক্রো-এ্যানক্যাপসুলেটেড খাদ্য ট্যাংকে প্রয়োগের পর দীর্ঘসময় এর অভ্যন্তরস্থ পুষ্টি উপাদান ধরে রাখতে সক্ষম। তাছাড়া এসব খাদ্যের দ্বারা ট্যাংকের পানির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। গলদা চিংড়ি লার্ভার জন্য প্রস্তুতকৃত ফরমুলেটেড খাদ্য নির্বাচনের সময় খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি লার্ভার বয়স এবং মুখবিবরের মাপের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সতর্কতার সাথে খাদ্যকণার আকার নির্ধারণ করতে হবে।
(২) এলআরটিতে পানি ব্যবস্থাপনা
এলআরটি-তে এর পূর্ণ আয়তনের ৫০% পানিতে নির্ধারিত সংখ্যক লার্ভা মজুদ করা হয়। এরপর শুধুমাত্র নিয়মিত ১০-২০% পানি যোগ করে চতুর্থদিনে ট্যাংকের আয়তন পূর্ণ করা হয়। ৫ম দিন থেকে নিয়মিত ১০-২০% পানি পরিবর্তন করা হয়। প্রতি সপ্তাহে ২/১ দিন ৫০% পানি পরিবর্তন করা হয়।
বিশেষক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে ১০০% পানি পরিবর্তন অর্থাৎ সম্পূর্ণ নতুন ট্যাংকে পোনা স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পানি পরিবর্তনকালে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যেন সরবরাহকৃত পানির সকল গুণাবলি (বিশেষত লবণাক্ততা, তাপমাত্রা, পিএইচ ইত্যাদি) এলআরটি-এর পানির গুণাগুণের অনুরূপ থাকে।
তাছাড়া শোধিত পানিতে ক্লোরিনের অনুপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ পানিতে ক্লোরিনের উপস্থিতি লার্ভার ব্যাপক হারে মৃত্যু ঘটাতে পারে। এলআরটিতে পানি প্রবেশকালে এর গতিসীমা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেন লার্ভার শরীরে পীড়ন সৃষ্টি হতে না পারে। এ উদ্দেশ্যে পানি প্রবেশের পাইপের মুখে পলিপ্রাপোইলিন ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩) লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংক পরিষ্কারকরণ
লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংকে খাদ্য হিসেবে সরবরাহকৃত আর্টিমিয়া নল্পি ও কাস্টার্ডের সবটুকু লার্ভা গ্রহণ করতে পারে। ফলে অতিরিক্ত খাদ্য ট্যাংকের তলায় জমা হতে থাকে। অতিরিক্ত খাদ্য ছাড়াও ট্যাংকের তলায় সাধার- ণত লার্ভার খোলস, আর্টিমিয়ার খোলস, লার্ভার মৃতদেহ ইত্যাদিও জমা হতে দেখা যায়।
এসবের দ্বারা পানির গুণাগুণ নষ্ট হয়। এ কারণে নিয়মিতভাবে প্রতিদিন ট্যাংক কমপক্ষে ২/৩ বার পরিষ্কার করা উচিত। কাস্টার্ড প্রয়োগের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে দৈনিক ১বার অর্থাৎ সকাল ৭.০০-৮.০০ টার মধ্যে এবং কাস্টার্ড প্রয়োগ শুরু করার পর থেকে প্রতিদিন দৈনিক ২বার অর্থাৎ সকাল ৭.০০-৮.০০টার মধ্যে ও বিকাল ৪.০০-৫.০০টার মধ্যে সাইফনিং-এর মাধ্যমে ট্যাংকের তলায় জমে থাকা অবাঞ্ছিত সামগ্রী পরিষ্কার করতে হবে।
সাইফনিং শুরু করার পূর্বে ট্যাংকের বায়ুসঞ্চালন ১০ মিনিটকাল বন্ধ রাখলে সব ময়লা ট্যাংকের তলায় জমা হবে। তখন ধীরে ধীরে ট্যাংকের চারপাশ ঘুরে সাইফন পাইপের সাহায্যে ট্যাংকের তলা থেকে জমাকৃত ময়লা পরিষ্কার করে তুলে নিতে হবে। সাইফন করার সময় ময়লার সাথে যে পরিমাণ পানি বেরিয়ে যায়, একই গুণাবলি সম্পন্ন সমপরিমাণ পরিশোধিত পানি সরাসরি ট্যাংকে ভরতে হবে।
এলআরটি-তে জীবাণুমুক্তকরণ
লার্ভাকে প্রতিদিন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অসুস্থ লার্ভা দুর্বল অবস্থায় ট্যাংকের তলায় জড়া েহয়ে পড়ে থাকে। অনেক সময় লার্ভা বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে। এসময়ে এরা খাদ্য গ্রহণ করে না। অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পর্যবেক্ষণ করা হলে লার্ভার পরিপাকনালী খালি থাকতে দেখা যায়।
রোগজীবাণুর সংক্রমণ, খাদ্যে পুষ্টির অভাব অথবা পানির কোন গুণাগুণের তারতম্যের ফলে সৃষ্ট পীড়নে এরূপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এ ধরনের ঘটনা রাধেকল্পে প্রয়াজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রোগজীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে (পানি পরিবর্তনের পরে) এলআরটি-এর পানিতে ২০-২৫ পিপিএম ফরমালিন, ০.০৫ পিপিএম ট্রাফলান ও ৫-৬ পিপিএম অক্সিটেট্রাসাইক্লিন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
কিনতু পুনঃসঞ্চালন পদ্ধতিতে পরিচালিত এলআরটি-এর পানিতে এসব রাসায়নিক সামগ্রী প্রয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। লার্ভা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি এলআরটি-এর পানি ও পরিবেশও পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
(৪) লার্ভার স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণ
রোগজীবাণু ও পারিবেশিক পীড়নের পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়ায় প্রাণীর শরীরে সৃষ্ট অস্বাভাবিক অবস্থাকে রোগ বলা হয় যা বিশেষ কিছু লক্ষণ দ্বারা প্রকাশ পায়। জলজ-পরিবেশের চাপ, রোগজীবাণু এবং চিংড়ির অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলে রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। চিংড়ির লার্ভা ও পিএল রোগ- াক্রান্ত হওয়ার পিছনে এখন পর্যন্ত যে সমস্ত কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
(ক) Idiophathic Muscle Necrosis (IMN)
রোগের লক্ষণ : Muscle mvv, Muscle ক্ষত হওয়া এ রোগের লক্ষণ।
রোগের কারণ : পরিবেশগত সমস্যা এবং লবণাক্ততা ও তাপমাত্রার হঠাৎ তারতম্য ও অধিক ঘনত্বে লার্ভা মজুদের কারণে এ রাগে হয়ে থাকে।
প্রতিকার : তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা হঠাৎ পরিবর্তন না করে এবং লার্ভার ঘনত্ব ঠিক ও প্রয়োজনীয় পানি পরিবর্তন করে এ রোগের প্রতিরোধ করা যায়।
(খ) Larval Mid Cycle Diseases (MCD)
রোগের লক্ষণ :ক্ষুদা মন্দা, সবল লার্ভা দুর্বল লার্ভাকে খেতে থাকে। রোগাক্রান্ত লার্ভা দেখতে ধূসর নীল রং এর দেখায়। দুর্বলভাবে সাঁতার কাটে ও বাঁকানো দেখায় Muscle ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
প্রতিকার : গুণগত মান সম্পন্ন খাবার ও গুণগত মানসম্পন্ন আর্টিমিয়া ব্যবহার করে এবং Proper Sanitation করে এ রোগের প্রতিকার করা যায়। ১০ পিপিএম এ্যাকুয়াকালচার প্রাবোয়ািেটক ব্যবহারসহ ১০ ২০% পানি পরিবর্তন করেও এর প্রতিকার করা যায়।
(গ) Bacterial Necrosis
রোগের লক্ষণঃএ রোগে আক্রান্ত লার্ভা নীলাভ ও কালো রং ধারণ করে এবং খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। শরীরের অভ্যন্তরস্থ অনত্রগুলো ফাঁকা হয়ে যায়। লার্ভা দুর্বল হয়ে ট্যাংকের তলায় জমা হয়।
রোগের কারণ : ট্যাংকের পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে, সরবরাহকৃত খাবার স্বাস্থ্যসম্মত না হলে এবং ত্রুটিপূর্ণ ও অপরিচ্ছন্ন হ্যাচারি পরিচালনা করলে এ রোগের সৃষ্টি হয়।
প্রতিকার: নিচের যে কোনো একটি রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করে এ রোগের নিরাময় করা যায়ঃ
– ২ পিপিএম Bi Peniciline Streptomycin
– 1 PPM Fruanel – 0.65
– 1 PPM Erythromycin
– 1 PPM Prefuran
– 0.25-0.5 PPM Cutrin Plus (4-8 Hrs)
– 0.1 PPM Cutrin Plus (24 Hrs)
– 10 PPM Aquaculture Probiotic (7-8 days interval)
(ঘ) Exuvia Entrapment Disease (EFD)
রোগের লক্ষণ : Last stage Larvae & Early Post larvae-তে এ রোগ দেখা যায়। একে। Meta morphosis molt mortality syndrome ও বলা হয়। উপাঙ্গ, চক্ষু ও রোস্ট্রীম খসে পড়ে যায় এবং খোলস পরিবর্তনে সমস্যা দেখা দেয়।
রোগের কারণ : পানির গুণাগুণ ভালো না থাকলে এবং গুণগত মানসম্পন্ন খাবারের অভাবে এ রোগ হয়ে থাকে।
প্রতিকার : পানির গুণাগুণ ভালো রাখতে পারলে এবং গুণগত মানসম্পন্ন খাবার সরবরাহের মাধ্যমে এ রোগের প্রতিকার সম্ভব।
(ঙ) Protozoan Disease
এটি একটি এককোষী প্রােেটাজোয়াজনিত রোগ। লার্ভা-এর বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন প্রোটোজোয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। প্রোটোজোয়া আক্রান্তের ফলে লার্ভা খোলস পাল্টাতে পারে না। যার ফলে দৈহিক বৃদ্ধিতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। গলদা চিংড়ির হ্যাচারিতে যে সমস্ত প্রোটোজোয়া বেশি আক্রান্ত করে তার মধ্যে কয়েকটি হলোঃ
– Zoothamnium sp.
– Epiostylis sp.
– Podophyridae sp.
Vorticella sp.
রোগের লক্ষণণ: লার্ভা ও পিএলকে খোলস বদলাতে বাধা সৃষ্টি করে এবং লার্ভা ও পোস্ট লার্ভা বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করার ফলে লার্ভা ও পিএল এর মৃত্যু ঘটে।
রোগের কারণ : পানি এবং খাবারের গুণগতমান খারাপ হলে এ রোগে আক্রান্ত হয়।
প্রতিকার : নিচের যে কোনো একটি প্রয়োগ করে এ রোগের প্রতিকার করা যায়?
– Formalin – 25-30 PPM (12hrs)
-Coper Sulphate – 0.1-1.0 PPM (1hr) সাথে Cutrin Plus
– Cutrin plus – 0.5 PPM (1hr)|
(চ) Fungus Disease
সাধারণত দুই ধরনের Fungus দ্বারা আক্রান্ত হয়।
– Legenedium
– Fusarium
লক্ষণ: লার্ভার ফুলকায় আক্রমণ করে এবং ফুলকা ধীরে ধীরে কালো/বাদামি/তামোট/কমলা বর্ণের হতে থাকে।
রোগের কারণ : সামগ্রিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার জন্য এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
প্রতিকার : নিচের যে কোনো একটি প্রয়োগ করে এ রোগের প্রতিকার করা যায়?
– Treflan-0.05 -0.1 পিপিএম ৩ দিন পরপর
– Sanocare 0.3 PPM ৩ দিন পরপর
– Microcide – 5 PPM ৩ দিন পরপর
গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে সাধারণত ভাইরাসজনিত রোগ দেখা যায় না।
(৫) স্যানিটেশন ও হাইজিন ব্যবস্থাপনা
গলদা চিংড়ির হ্যাচারি পরিচালনার ক্ষেত্রে স্যানিটেশন ও হাইজিন ব্যবস্থা বজায় রাখা খুবই জরুরি। হ্যাচারি পরিচালনার সাফল্য স্যানিটেশন ও হাইজিন ব্যবস্থাপনার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত উপকরণাদির মাধ্যমে যাতে রোগের সংক্রমণ না হতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
হ্যাচারির অবকাঠামো, সরঞ্জামাদি ইত্যাদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি হ্যাচারি পরিচালনার বিভিন্ন ধাপে হ্যাচারি কর্মীদের স্যানিটেশন ও হাইজিন ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে কোনো কারণে দূষণ ঘটে গেলে তা চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হবে। গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপনায় সর্বদাই মনে রাখতে হবে যে “রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই হলো উত্তম ব্যবস্থা”।
রোগের সংক্রমণ নির্মূলে কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা
গলদা হ্যাচারিতে যে সকল স্থানে রোগ সংক্রমণের উৎস নিমূলে কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে তা হলোঃ
- হ্যাচারিতে মাদার প্রবেশ ব্যবস্থা, ডিমওয়ালা চিংড়ির এবং এর রাখার স্থান
- ব্রাইন সংগ্রহ পদ্ধতি, ব্রাইন এবং ব্রাইন রাখার স্থান।
- সরব্রাহকৃত স্বাদু পানি (ভূগর্ভস্থ এবং ভূপৃষ্ঠের উপরের পানি) এবং পানি রাখার স্থান
- হ্যাচারিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি, বালির ফিল্টার, বায়োফিল্টার এবং ফিল্টারে ব্যবহৃত উপকর- ণাদি, হ্যাচারি কর্মীদের হ্যাচারির বাইরে পরিধেয় পোকাক পরিচ্ছদ, জুতা-মোজা/সেন্ডেলসহ যাবতীয় ব্যবহার্য দ্রব্যাদি
- অফিস রুম, সার্ভিস রুম, পিএল বিক্রয়ের স্থান, স্টোর রুম অর্থাৎ যেখানে বাইরের লোকজন আসা যাওয়া করে সে সব স্থান
স্যানিটেশন ও হাইজিন ব্যবস্থা রক্ষায় পদক্ষেপসমূহ
- হ্যাচারিতে প্রবেশকালে ১৫০ পিপিএম বিচিং পাউডার স্বাদু পানিতে মিশিয়ে ফুটবাথ দ্রবণ করে উক্ত পানিতে পায়ের তলা ধৌত করে হ্যাচারিতে প্রবেশ করতে হবে। বাইরে পরিধেয় জুতা/সেন্ডেল পরে হ্যাচারির ভিতরে প্রবেশ করা যাবে না। ফুটবাথের দ্রবণ প্রতিদিন পরিবর্তন করতে হবে।
- হ্যাচারির বাইরে ব্যবহৃত পোকাক পরিচ্ছদ- শার্ট, প্যান্ট, লুঙ্গি, জুতা-মাজো, সেন্ডেল ইত্যাদি হ্যাচারিতে ব্যবহার না করাই উত্তম। সকল পোকাক পরিবর্তন করে নির্দিষ্ট অ্যাপ্রন, গেঞ্জি, প্যান্ট, গাভ ইত্যাদি পরিধান করে হ্যাচারিতে প্রবেশ করতে হবে।
- হ্যাচারিতে কাজের সময় সকল ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি জীবাণুমুক্তকরণের পর ব্যবহার করতে হবে এবং সরঞ্জামাদি, ব্যবহারের সময় হ্যাচারি কর্মীদের হাত কনুই পর্যন্ত ফরমালিনযুক্ত পানি দ্বারা ধৌত করতে হবে।
হ্যাচারির বিভিন্ন ট্যাংক ও অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষেত্রে
- হ্যাচারির মেঝে, নর্দমা ও অন্যান্য স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- সপ্তাহে ২ দিন ১০০-১৫০ পিপিএম বিচিং পাউডার মিশ্রিত পানিতে হ্যাচারির মেঝে, নর্দমা ও অন্যান্য ট্যাংকসমূহের দেয়াল সাবধানে পরিষ্কার করতে হবে।
- লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংক পরিষ্কারের জন্য সাইনিং এর প্রক্রিয়া সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে করতে হবে। কোনো অবস্থায়ই আংশিক সাইফনিং করা যাবে না। এলআরটি সঠিকভাবে পরিষ্কারের উপর লার্ভার সুস্বাস্থ্য অনেকাংশে নির্ভরশীল।
হ্যাচারির উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদির ক্ষেত্রে
- হ্যাচারিতে উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি নিয়মিত ২০০-২৫০ পিপিএম ফরমালিন মিশ্রিত পানিতে ধৌত করতে হবে।
- এলআরটিতে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি ব্যবহারের পর ২০০-২৫০ পিপিএম ফরমালিন অথবা ৫০ পিপিএম বিচিং পাউডারের দ্রবণে জীবাণুমুক্ত করে ধুয়ে শুকিয়ে রাখতে হবে।
- প্রত্যেক এলআরটি-এর জন্য আলাদা আলাদা সরঞ্জামাদি (মগ, গ্লাস, বালতি, সাইফনিং পাইপ, ব্রাশ ইত্যাদি) ব্যবহার করতে হবে।
- অন্যান্য সাধারণ ক্ষেত্রে হ্যাচারির দরজা যতদূর সম্ভব বন্ধ রাখতে হবে
- হ্যাচারিতে ধূমপান করা উচিত নয়।
- হ্যাচারির ভেতরে টয়লেট থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
- হ্যাচারিতে সর্বদা স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত।
- হ্যাচারিতে দর্শনার্থী, অবাঞ্ছিত বা অপ্রয়োজনীয় লোকজনের প্রবেশাধিকার নিরুৎসাহিত করা উচিত। সীমিত পরিসরে দর্শনার্থী হ্যাচারিতে প্রবেশ করার প্রয়োজন হলে খেয়াল রাখতে হবে যেন দর্শনার্থীর মাধ্যমে হ্যাচারির জীব-নিরাপত্তা ব্যাহত না হয়।
হ্যাচারিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
- সংক্রামক রোগ বহনকারী শ্রমিককে হ্যাচারির কাজ হতে বিরত রাখতে হবে।
- নিয়োগ প্রত্যাশী শ্রমিক/কর্মী কোনো প্রকার সংক্রামক রোগে আক্রান্ত কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিয়ােেগর আগে ডাক্তারি সার্টিফিকেট যাচাই করে নিতে হবে।
- পোকা-মাকড়, ইঁদুর-ঘঁচো, কঁকড়া, ব্যাঙ, সাপ, কুকুর, বিড়াল, পাখি ও অন্যান্য অবাঞ্ছিত প্রাণী যেন হ্যাচারির অভ্যন্তরে বা উৎপাদন ইউনিটে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে।
- ইইউ বিধি নিষেধের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের FIQC বিধিমালা/৯৭ মোতাবেক হ্যাচারি পরিচালনা করতে হবে।
- অনুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক, ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার পরিহার করে শুধুমাত্র অনুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক, ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
- হ্যাচারিতে ব্যবহৃত খাদ্য প্রস্তুতকরণ, সংরক্ষণ, ও ব্যবহারে জীবাণুমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে
- হ্যাচারিতে ব্যবহৃত ডিমওয়ালা চিংড়ি, আর্টিমিয়া, খাদ্য, ঔষধপত্র ও রাসায়নিক দ্রব্যাদির উৎস শনাক্তকরণ নিশ্চিত করতে হবে।
- উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করার পূর্বে হ্যাচারি পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
- হ্যাচারিতে উৎপাদন শুরু করার পূর্বে জীবাণুমুক্তকরণ নিশ্চিত করার জন্য ফিউমিগেশন করা যেতে পারে।
- ব্যবহার্য রাসায়নিক দ্রব্যাদি এবং খাদ্যসামগ্রী নিরাপদ স্থানে পৃথকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যেন এসব সামগ্রী অথবা লার্ভা/পিএল কোনোক্রমে সংক্রমিত হতে না পারে।
- মুখ বন্ধ করা যায় এমন প্লাস্টিকের পাত্রে ময়লা-আবর্জনা রাখতে হবে। পাত্রটি মাঝে মাঝে ধৌত ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
- হ্যাচারির ভেতরে ও বাইরে অবস্থিত সকল নর্দমা পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে।
- সমস্ত আবর্জনা স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে অপসারণ করতে হবে। উক্ত আবর্জনা হতে প্রত্যক্ষ বা পরাক্ষেভাবে হ্যাচারিতে সংক্রমণ ঘটতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
- হ্যাচারির বর্জ্য পানি বিধি মোতাবেক শশাধনের পরে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করতে হবে।
গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে পানি ব্যবস্থাপনা
বিশুদ্ধ ও জীবাণুমুক্ত পানি একটি গলদা চিংড়ি হ্যাচারির অন্যতম প্রধান উপাদান। তাই পানির গুণাগুণ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কাজ গলদা চিংড়ি হ্যাচারির অন্যতম প্রধান কাজ হিসেবে স্বীকৃত। হ্যাচারিতে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনের কাজে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি বা ব্রাইন এবং স্বাদু পানি উভয়ের প্রয়োজন রয়েছে।
অনেক সময়ে প্রকৃতি থেকে সংগৃহীত লবণাক্ত পানি বা ব্রাইন এবং স্বাদু পানির বেশকিছু গুণাগুণ গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন কাজের অনুকূল থাকে না। তখন উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে উক্ত পানি উৎপাদন কাজের অনুকূল করে ব্যবহার করা হয়। এসব ব্যবস্থাপনা কাজকে সামগ্রিকভাবে পানি ব্যবস্থাপনা” বলা হয়।
গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে পানি ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
ব্রাইন সংগ্রহ
৮০ পিপিটি অপেক্ষা অধিক লবণাক্ততা সম্পন্ন সমুদ্রের পানিকে ব্রাইন বলা হয়। সাধারণত সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা এ মাত্রা অপেক্ষা কম থাকে। তাই সাধারণত লবণ চাষের ক্ষেত্র থেকে ব্রাইন সংগ্রহ করা হয়। একটি লবণ ক্ষেত্রকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়
১. আধার (Reservoir),
২. ঘনীভবনকারক (Condensor)
৩. ফটিকীকারক (Crystalizer)
গলদা চিংড়ি হ্যাচারি পরিচালনার উদ্দেশ্যে ঘনীভবনকারক ক্ষেত্র থেকে ব্রাইন সংগ্রহ করা হয়। সমুদ্রের পানিকে ঘনীভূত করে লবণ উৎপন করা হয়ে থাকে। ঘনীভবনের সাথে সাথে সমদের পানি থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন অত্যাবশ্যকীয় ট্রেস লবণ, মাইনর লবণ এবং মেজর লবণের উপস্থিতির পরিমাণ কমতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সাধারণ লবণ (NaCI) অবশিষ্ট থাকে।
তাই এ পানি যত ঘনীভূত হতে থাকে, ততই এর মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ ট্রেস লবণের পরিমাণ কমতে থাকে। অথচ গলদা চিংড়ির জীবনচক্রের প্রাথমিক পর্যায়ে এসব ট্রেস লবণের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। তাই গলদা চিংড়ি হ্যাচারি পরিচালনার কাজে ১০০-১২০ পিপিটি অপেক্ষা বেশি লবণাক্ততা সম্পন্ন ব্রাইন ব্যবহার করা উচিত নয়।
ব্রাইনের প্রাপ্তিস্থান
চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলা এবং কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী উপজেলায় সমুদ্রের পানিকে ঘনীভূত করে লবণের চাষ করা হয়। তাই এসব উপজেলার মধ্যে যোগাযোগ সুবিধার উপরে নির্ভর করে চকরিয়া বা বাঁশখালী উপজেলার লবণক্ষেত্র থেকে ব্রাইন সংগ্রহ করা যায়। সম্প্রতি সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলাধীন মুন্সীগঞ্জ থেকেও ১০০ পিপিটি ব্রাইন সগ্রহ করা যায়। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ব্রাইন সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত সময়।
স্বাদুপানি সংগ্রহ
গলদা চিংড়ি হ্যাচারি পরিচালনার জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উপযুক্ত। কিন্তু মাঝে মাঝে ভূগর্ভস্থ পানির খরতা এবং বিভিন্ন প্রকার ধাতব যৌগের উপস্থিতি ব্যবস্থাপনাযোগ্য পর্যায়ে থাকে না। তখন এ পানি পরিত্যাগ করে ভূপৃষ্ঠের পানিকে উপযুক্ত পদ্ধতিতে শোধন করে হ্যাচারি পরিচালনার কাজে ব্যবহার করা যায়।
ব্রাইন ও স্বাদু পানির গুণাগুণ
গলদা চিংড়ি হ্যাচারি পরিচালনার উপযোগী ব্রাইন ও স্বাদু পানির কিছু গুরুত্বপূর্ণ গুণাগুণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
মিশ্রিত/অর্ধলবণাক্ত পানি প্রস্তুতকরণ
গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে ব্রাইনের সাথে পরিমাণমত স্বাদপানি মিশ্রিত করে লার্ভা প্রতিপালন, আর্টিমিয়া হ্যাচিং এবং ব্রড প্রতিপালনের উপযোগী নির্ধারিত লবণাক্ততা সম্পন্ন পানি প্রস্তুত করা হয়। এ কাজে নিম্নলিখিত সূত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
ব্রাইনের পরিমাণ = মিশ্রিত পানির প্রত্যাশিত লবণাক্ততা প্রয়োজনীয় মিশ্রিত পানির পরিমাণ = ব্রাইনের লবণাক্ততা।
উদাহরণ: ১
১০০ পিপিটি লবণাক্ততা সম্পন্ন ব্রাইন থেকে ৬ পিপিটি লবণাক্ততা সম্পন্ন ১০ টন পানি প্রস্তুত করার জন্য ব্রাইন প্রয়োজন = ৬ পিপিটি × ১০ টন = ১০০ পিপিটি = ০.৬ টন
অতএব স্বাদু পানি প্রয়াজন = ১০ টন ০.৬ টন = ৯.৪ টন।
উদাহরণ: ২
১০০ পিপিটি লবণাক্ততা সম্পন্ন ব্রাইন থেকে ১২ পিপিটি লবণাক্ততা সম্পন্ন ১০ টন পানি প্রস্তুত করার জন্য ব্রাইন প্রয়োজন = ১২ পিপিটি × ১০ টন = ১০০ পিপিটি = ১.২ টন।
অতএব স্বাদু পানি প্রয়োজন = ১০ টন ১.২ টন = ৮.৮ টন।
মিশ্রিত পানি শোধন
মিশ্রিত পানি থেকে লৌহ দূর করার পাশাপাশি পানিকে জীবাণুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে এর সাথে ১৫ পিপিএম মাত্রায় বিচিং পাউডার (৬০-৬৫% সক্রিয় ক্লোরিন উপাদান) প্রয়োগ করতে হবে। বিচিং পাউডারে ক্লোরিনের উপস্থিতির কারণে জীবাণু প্রতিরোধে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আবার বিচিং পাউডার একটি শক্তিশালী অক্সিডাইজিং এজেন্ট (Oxidizing agent) হওয়ায় পানি থেকে লৌহ মুক্তকরণে এর ব্যাপক কার্যকারিতা রয়েছে।
ভূ-গর্ভস্থ পানিতে ১৫ পিপিএম মাত্রায় বিচিং পাউডার প্রয়োগ করে উত্তমরূপে বায়ুসঞ্চালন (Strong aeration) করা হলে বিচিং পাউডারের হাইপােেক্লারাইডের সাথে পানিতে থাকা লৌহের বিক্রিয়ায় FeCl2 এবং ঋবঈষ৩ এর ঘন লাল তলানি সৃষ্টি হয়। পরে বায়ু সঞ্চালন বন্ধ করা হলে এ তলানী ধীরে ধীরে তলায় জমা হয় এবং পানি সম্পূর্ণরূপে লৌহমুক্ত হয়ে পড়ে।
সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে ৩-৫ দিন সময়ের প্রয়োজন হয়। এরূপ পদ্ধতিতে লৌহমুক্ত করার পরে উৎপাদন কাজে ব্যবহারের পূর্বে পানিতে ক্লোরিনের অনুপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া এরূপ পদ্ধতিতে লৌহমুক্ত করার পরে পানি উৎপাদন ট্যাংকে সঞ্চা- লনের পূর্বে অধঃক্ষিপ্ত লাল বর্ণের তলানী যেন কোনোভাবেই ট্যাংকে প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য ট্যাংকে পানির প্রবেশমুখে পলিপ্রোপাইলিনের ব্যাগ-ফিল্টার ব্যবহার করা যেতে পারে।
ক্লোরিনের সংস্পর্শে যেমন বিভিন্ন রোগজীবাণুর মৃত্যু ঘটে, তেমনি পানিতে ক্লোরিনের উপস্থিতির কারণে চিংড়ির ডিম, লার্ভা বা পিএল এমনকি ডিমওয়ালা চিংড়ির মৃত্যু হতে পারে, ডিমওয়ালা। চিংড়ির প্রজনন ক্ষমতা কমে যেতে পারে অথবা হ্যাচিং-এর হার কমে যেতে পারে।
তাছাড় অবশিষ্টাংশের উপস্থিতির কারণে গলদা চিংড়ির লার্ভা বা পিএল বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ক্লোরিন মিশ্রিত পানি ব্যবহারের পূর্বে উত্তমরূপে ক্লোরিনযুক্ত করে নেয়া প্রয়োজন। উৎপাদন কাজে ব্যবহারের পূর্বে পানিতে ক্লোরিনের উপস্থিতির মাত্রা পর্যবেক্ষণ করে এর অনুপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে পানিকে ক্লোরিনযুক্ত করা যায়ঃ
১. বায়ু সঞ্চালনের সাহায্যে ক্লোরিন মুক্তকরণ
বিচিং পাউডার/ক্লোরিন মিশ্রিত পানিতে উচ্চগতিতে বায়ু সঞ্চালন করা হলে প্রাথমিকভাবে পানিতে ক্লোরিনের বিষক্রিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বাতাসের অক্সিজেনের সাথে ক্লোরিনের বিক্রিয়ায় পানি ধীরে ধীরে ক্লোরিনমুক্ত হতে থাকে এবং ১-৩ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে ক্লোরিনযুক্ত হয়ে পড়ে
২. সূর্যালোকের সাহায্যে ক্লোরিনমুক্তকরণ
প্রখর সূর্যালোকে ক্লোরিনযুক্ত পানির ক্লোরিনের বিষক্রিয়া বৃদ্ধি পেয়ে রোগজীবাণু দ্রুত ধ্বংস হয়। পরবর্তীতে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ক্লোরিন মুক্তকরণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। সূর্যালোকের উপস্থিতি অপেক্ষা অনুপস্থিতিতে পানি ক্লোরিনমুক্ত হতে অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়।
৩. উভয় পদ্ধতির সমন্বয়ের মাধ্যমে ক্লোরিন মুক্তকরণ
ক্লোরিনযুক্ত পানিকে প্রখর সূর্যালোকের নিচে রেখে উত্তমরূপে বায়ু সঞ্চালন করা হলে ক্লোরিনমুক্ত হওয়ার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। প্রকৃতপক্ষে হ্যাচারিতে এভাবেই ক্লোরিনযুক্ত পানিকে ক্লোরিনযুক্ত করা হয়ে থাকে।
৪. সোডিয়াম থায়োসালফেট (Na,S,0,) ব্যবহারে ক্লোরিন মুক্তকরণ
ক্লোরিনযুক্ত পানিতে সূর্যালাকের উপস্থিতিতে বায়ুসঞ্চালন করে সেখানে উপস্থিত প্রতি ১ পিপিএম ক্লোরিনের জন্য ১ পিপিএম মাত্রায় সোডিয়াম থায়োসালফেট প্রয়োগ করা হলে পানি দ্রুত ক্লোরিনযুক্ত হয়। সোডিয়াম থায়োসালফেট ব্যবহারের ২/৩ ঘণ্টার মধ্যেই উক্ত পানিকে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যায়। তবে লার্ভা/ পিএল-এর উপরে অতিরিক্ত সোডিয়াম থায়াসোলফেটের কিছু ক্ষতিকর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাই সোডিয়াম থায়োসালফেট ব্যবহার করাই উত্তম।
বালির ফিল্টারের (Slow Sand Filter) সাহায্যে পানিশোধন
বালির ফিল্টার গলদা চিংড়ি হ্যাচারির জন্য অত্যাবশ্যক। শুধু বালির ফিল্টারের সাহায্যে একটি বাণিজ্যিক চিংড়ি হ্যাচারি পরিচালনা করা সম্ভব। বালির ফিল্টারে ভাইরাস ও কয়েক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া ছাড়া অন্যান্য সকল প্রকার রাগজীবাণু, প্রোটোজোয়া, অদ্রবণীয় ভারী বা হালকা জৈব ও অজৈব কণা, ফাইটোপ্ল্যাংকটন, জুপ্ল্যাংকটন, সামুদ্রিক প্রাণী বা উদ্ভিদ, এদের ডিম, লার্ভা বা অন্য যে কোনো পর্যায়, বালিকণা, কর্দমরেণু ইত্যাদি আটকে যায়।
বালির ফিল্টার স্থাপনের জন্য ১.৫ মিটার উচ্চতার ট্যাংক উপযোগী। বালির ফিল্টারে প্রধান পরিস্রাবক মাধ্যম হিসেবে চিকন বালি (১০-১৫ মাইক্রন) ও কাঠকয়লা এবং পানি সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবে মোটা দানার বালি বা সিলেট স্যান্ড ও নুড়িপাথর ব্যবহার করা হয়। একই ট্যাংকে একটির পরে একটি মাধ্যমের তর সাজিয়ে এ ধরনের ফিল্টার গঠন করা যেতে পারে। আবার বৃহদায়তনের হ্যাচারিতে একসাথে প্রচুর পরিশ্রত পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে সারিবদ্ধ কয়েকটি ট্যাংক ব্যবহার করে বিভিন্ন মাধ্যম পর্যায়ক্রমে সাজানো যেতে পারে।
পরিস্রাবক মাধ্যমের স্তর যত বেশি হয়, পানির পরিস্রাবণও তত ভালো হয়। যেভাবেই সাজানো হাকে না কেন, পর পর সাজানো পরিস্রাবক মাধ্যমের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত ধীর গতিতে (শুধু মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাহায্যে) পানির প্রবাহ সৃষ্টি করে পরিস্রাবণ করাই হলো এর মূল কর্মপদ্ধতি।
এ ফিল্টারে পানি পরিস্রাবণের গতি আরও ধীরে এবং পরিশ্রুত পানির মান অধিকতর নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পরিস্রাবক মাধ্যম-সমূহকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীত দিক থেকে সাজিয়ে ব্যাক-ওয়াশের সাহায্যে পানি প্রবাহিত করা যেতে পারে। পরিশ্রুত পানির চাহিদার উপরে নির্ভর করে বালির ফিল্টারের আকার ছোট বা বড় করা যায়।
আবার একটি মাত্র ফিল্টারের পরিবর্তে একাধিক ফিল্টার নির্মাণ করে পর্যায়ক্রমে একটির পরে একটি ব্যবহার করা যায়। নলকূপ থেকে সংগৃহীত ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্রাবণের জন্য বালির ফিল্টার ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। স্বাদু পানির উৎস হিসেবে ভূপৃষ্ঠের পানি (নদী, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদি) ব্যবহার করা হলে তা অবশ্যই বালির ফিল্টারের সাহায্যে পরিস্রাবণ করে ব্যবহার করতে হবে।
ট্রাইটন হাই-রেট প্রেসার (স্যান্ড) ফিল্টার (Triton Hi-Rate Pressure Sand Filter)
এটি একটি বালির ফিল্টার। বর্তুলাকার এফআরপি ট্যাংকের অভ্যন্তরে রক্ষিত বালির মধ্য দিয়ে মানানসই শক্তির পাম্পের সাহায্যে পানি দ্রুত গতিতে প্রবাহিত করে ফিল্টার করা হয়। ২০-৫০ মাইক্রন আকৃতির বালি এ ফিল্টারের একমাত্র পরিশ্রাবক মাধ্যম।
আকার এবং শক্তির তারতম্যের উপরে নির্ভর করে এ ধরনের ফিল্টারের সাহায্যে প্রতি মিনিটে ২৫০-৫০০ লিটার পর্যন্ত পানি ফিল্টার করা সম্ভব। কিছুটা বড় আকৃতির অদ্রবনীয় পার্টিক্যাল, কিছু বিষ্ণু প্রোটোজোয়া, সামুদ্রিক প্ল্যাংকটন, সামুদ্রিক প্রাণীর ডিম, লার্ভা, পোনা ইত্যাদি এ ফিল্টারে আটকা পড়ে।
কিন্তু ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, অধিকাংশ প্রোটোজোয়া, কিছু কিছু সামুদ্রিক প্ল্যাংকটন এ ফিস্টারে আটকায় না। প্রকৃতপক্ষে এসব ফিল্টার সুইমিং পুলের পানি পরিষ্কার রাখার কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চিংড়ি হ্যাচারিতে আগে এ ধরনের ফিল্টারের ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে এ প্রবণতা অনেকটা কমে এসেছে।
কাটিজ ফিল্টার (Cartridge Filter)
হ্যাচারিতে সমুদ্রের পানির মান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ধীয় পতির বালির ফিল্টার-এর পরে কার্টিজ ফিল্টার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ফিল্টারে এফআরপি নির্মিত বাফেটের অভ্যন্তরে ১০-১৫ মাইক্রন আকৃতির কার্টিজ সামগ্রীর সাহায্যে পানি ফিল্টার কন আকৃতির কাজি সামগীর সাহায্যে পানি ফিল্টার করা হয়।
এ ফিল্টারে পানির সর্বোচ্চ ফ্লোরেট ৩,৫০০-৪,৫০০ লিটার/মিনিট। কার্টিজ ফিল্টার সাধারণত ওভারহেড ট্যাংকের সাথে ব্যবহার করা হয়। তবে ফ্লোরেট বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কার্টিজ ফিল্টারের সাথে অনেক সময়ে মানানসই শক্তির পাম্প ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ব্যাগ ফিল্টার (Bag Filter)
পলিয়েস্টার বা অন্যান্য সিনথেটিক ফাইবারের তৈরি (৩০ সেমি×৮৫ সেমি) ১-১০ মাইক্রনের “ব্যাগ ফিল্টার” হ্যাচারিতে ব্যবহার করা হয়। সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাংকটন বা জুপ্ল্যাংকটন, ক্ষুদ্র প্রাণী, ডিম ও লার্ভা, ভাসমান বালিকণা, কর্দমরেণু এবং অন্যান্য ভাসমান অদ্রবণীয় পদার্থ ফিল্টার ব্যাগে আটকা পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষুদ্রাকৃতির প্ল্যাংকটন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বালিকণা, ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজোয়া এ ব্যাগে আটকা পড়ে না।
ফিল্টার ব্যাগের ফ্লোরেট খুব কম। হঠাৎ করে পানি প্রবাহের গতি বেড়ে পেলে পিছন দিকের খোলা প্রান্ত দিয়ে ব্যাপের ভিতরের পানি বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ পরিশ্রত পানির গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়ার আশঙ্কা থাকে। বড় বা মাঝারি আকারের বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে ব্যাপকভাবে পানি ফিল্টারের ক্ষেত্রে ফিল্টার ব্যাগ ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে সীমিত আঙ্গিকে আর্টিমিয়া হ্যাচিং ট্যাংক, বহিরাঙ্গনে প্যাংকটনের চাষ, নার্সারি বা ডিমওয়ালা ট্যাংকে পরিশ্রত পানি প্রবেশ ইত্যাদি কাজে ফিল্টার ব্যাগইউভি স্টেরিলাইজার ব্যবহার
পানিকে জীবাণুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে ক্লোরিন প্রয়োগের পাশাপাশি ইউভি স্টেরিলাইজার ব্যবহার করা সমীচীন। ইউভি স্টেরিলাইজারের সাহায্যে পানি থেকে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া ও ফাংগাস ইত্যাদি সকল প্রকার জীবাণু সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব।
ইউভি স্টেরিলাইজারের পাইপের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানিতে অতিবেগুনী রশ্মি (Ultra Violet Ray) বিচ্ছুরিত হয়। ফলে এর মধ্যে অবস্থিত সব ধরনের জীব পদার্থের জীবকোষের ডিএনএ অকার্যকর (De-Activated) হয়ে যায় এবং পানি সম্পূর্ণরূপে জীবাণুমুক্ত হয়। ইউভি স্টেরিলাইজারের কার্যকারিতা নিম্নলিখিত ৩টি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে
– জীবাণুর আকৃতি,
– নিঃসৃত বিকিরণের মাত্রা এবং
– প্রবাহিত পানিতে আলট্রাভায়ােেলট রশ্মি সঠিকভাবে প্রবেশ করার নিশ্চয়তা।
পানিতে উপস্থিত জীবাণুর আকৃতি যত বড় হয়, এদের উপরে আলট্রাভায়ােেলট রশ্মির কার্যকারিতাও তত কম হয়ে থাকে। ৩৫,০০০ মাইক্রো-ওয়াট/সেকেন্ড/বর্গ সেমি মাত্রার বিকিরণের সাহায্যে অধিকাংশ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও প্রােেটাজোয়ার জীবাণু নিধন করা সম্ভব। তাই পানিকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে আলট্রাভায়ােেলট রশিার সন্তোষজনক বিকিরণ মাত্রা ১৩৫,০০০ মাইক্রো-ওয়াট সেকেন্ড/বর্গ সেমি হওয়া প্রয়োজন।
আদর্শ পরিস্থিতিতে আলট্রাভায়ালেট রশ্মির বিকিরণ সম্ভবত ৫ সেন্টিমিটার অপেক্ষা অধিক পুরু পানির স্তর ভেদ করতে পারে না। এছাড়া পানিতে ভাসমান অথবা দ্রবীভূত জৈব/অজৈব পদার্থের উপস্থিতি বা ঘোলাত্বের কারণে বিকিরণের মাত্রা আরও কমে যেতে পারে।
তাই একই মাত্রার আলট্রাভায়ােেলট রশ্মির বিকিরণ পরিষ্কার স্বাদু পানি অপেক্ষা অজৈব আয়নের ঘনত্ব সম্পন্ন অর্ধ-লবণাক্ত পানিতে তুলনামূলকভাবে কম কার্যকর হয়ে থাকে। পানিকে জীবাণুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে ইউভি স্টেরিলাইজার ব্যবহার করার সময়ে এসব বিষয়াদির প্রতি লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এলআরটি-এর পানি পুনঃসঞ্চালনে বায়োফিল্টার-এর ব্যবহার
অণুজীবের সাহায্যে এলআরটি-এর পানি পরিশাধেনের উদ্দেশ্যে হ্যাচারিতে বায়োফিল্টারের মাধ্যমে পানি পুনঃসঞ্চালন করা হয়। বদ্ধ-হ্যাচারি পরিচালনা পদ্ধতিতে বায়োফিল্টার অত্যাবশ্যক। বায়োফিল্টার স্থাপনের মাধ্যমে ব্যবহৃত পানিকে পরিশোধন এবং পুনঃসঞ্চালন করে বার বার ব্যবহার করা যায়। ফলে পানির সাশ্রয় হয়।
এলআরটি-এর পানিতে লার্ভার বর্জ্য পদার্থ, অব্যবহৃত খাদ্য ও মৃত লার্ভা, আর্টিমিয়া ইত্যাদির পচনের ফলে পানিতে অনায়নিত অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে পানি লার্ভার জন্য বিষাক্ত হয়ে উঠে। বায়োফিল্টারে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা ক্ষতিকর অনায়নিত অ্যামোনিয়া প্রথমে কম ক্ষতিকর নাইট্রাইটে এবং পরবর্তীতে নিরপেক্ষ নাইট্রেটে রূপান্তরিত হয়। ফলে ট্যাংকের পানি লার্ভার জন্য উপযোগী হয়ে পড়ে। বায়োফিল্টার নিম্নলিখিত কার্যাদি সম্পন্ন করেঃ
১. পানি থেকে অ্যামোনিয়া ও নাইট্রাইট দূর করে
২. পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করে
৩. দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ায়
৪. কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমায়
৫. ট্যাংকের পানিতে উপস্থিত বিভিন্ন অদ্রবণীয় কণা অপসারণ করে
বায়োফিল্টার প্রস্তুতপ্রণালি
বায়োফিল্টারের আয়তন সাধারণত এলআরটি-এর ১০% এবং উচ্চতা এলআরটি-এর সমান হতে হবে। প্রতিটি এলআরটি-এর জন্য পৃথক বায়োফিল্টার প্রয়োজন। এর মোট উচ্চতা এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যেন পানিপূর্ণ অবস্থায় বায়োফিল্টার এবং এলআরটি-এর উপরের ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত খালি থাকে।
জীবাণুমুক্ত করে ধৌত করার পরে ১ মিটার উচ্চতার একটি বায়োফিল্টারে ৮৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা পর্যন্ত মিডিয়া দেয়া যেতে পারে। বায়োফিল্টার স্থাপনের পূর্বে পাথর, ঝিনুক, নেট, ড্রাম, পাইপ, এয়ার স্টোন ইত্যাদি ১৫০ পিপিএম বিচিং পাউডার মিশ্রিত পানিতে ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে পরবর্তীতে জীবাণুমুক্ত স্বাদু পানি দিয়ে ভালাভাবে ধুয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে। বায়োফিল্টারের নিচের দিকে ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ২০ মিলিমিটার সাইজের পাথর দিয়ে পূর্ণ করতে হবে।
২য় স্তরে ১৫ সেমি ঝিনুক, ৩য় স্তরে ২০ সেমি পাথর, ৪র্থ স্তরে ৫ সেমি ঝিনুক, ৫ম স্তরে ২০ সেমি পাথর ও ৬ষ্ঠ স্তরে ১০ সেমি ঝিনুক পর্যায়ক্রমে সাজাতে হবে এবং উপরের ১৫ সেমি খালি জায়গা রাখতে হয় থেকে বায়োফিল্টারে পানি প্রবেশ করার পাইপ স্থাপন করতে হবে এবং বায়োফিল্টার থেকে এলআরটি-তে শোধিত পানি পুনঃসঞ্চালনের জন্য নুড়িপাথরের নিচ পর্যন্ত পাইপ স্থাপন করে বাতাসের পাইপ ও এয়ার স্টোন স্থাপন করতে হবে।
বায়োফিল্টারে পানি সরবরাহ
প্রথমে স্বাদু পানি দিয়ে বায়োফিল্টার ভর্তি করে ২৫০ পিপিএম হারে ফরমালিন দিয়ে ২৪ ঘণ্টা বায়ুসঞ্চালন করার পর সমস্ত পানি ফেলে দিয়ে প্রথমে জীবাণুমুক্ত স্বাদু পানি এবং পরে ১২ পিপিটি লবণাক্ত পানি দিয়ে উত্তমরূপে পরিষ্কার করতে হবে। বায়োফিল্টারে পরিশাধিত ১২ পিপিটি লবণ পানি দিয়ে ঝিনুকের উপর ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত পানি দিয়ে এতে বায়ুসঞ্চালনের ব্যবস্থা করতে হবে। অতঃপর ১.৫ মিলি তরল অ্যামোনিয়া যোগ করতে হবে।
২০-২৫ দিন বায়ুসঞ্চালনের পর পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ পরীক্ষা করতে হবে। যদি এ অবস্থায় অ্যামোনিয়া না পাওয়া যায় তবে পুনরায় এ্যামোনিয়া দিতে হবে এবং ৩-৪ দিন পর পুনরায় এ্যামোনিয় পরীক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে এ্যামোনিয়ার অনুপস্থিতি বায়োফিল্টারের ১০০ ভাগ কার্যক্ষম নির্দেশক। বায়োফিল্টারে অ্যামোনিয়ার অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিলীন না হওয়া পর্যন্ত লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংকের সাথে এর সংযোগ দেয়া যাবে না।
বায়োফিল্টার সক্রিয়করণ
বায়েফিল্টার স্থাপন করে সাথে সাথে তা এলআরটি-এর সাথে সংযুক্ত করা যাবে না। বায়োফিল্টারকে সক্রিয় করার পূর্বে এলআরটি-এর সাথে সংযুক্ত করা হলে প্রতিপালন ট্যাংকের পানি অ্যামোনিয়াজনিত বিষাক্ততা থেকে মুক্ত হবে না বিধায় লার্ভার জন্য বিপদজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তিনটি পদ্ধতিতে বায়োফিল্টার সক্রিয় করা যায়।
প্রথম পদ্ধতি
নতুন বায়োফিল্টারে নুড়ি স্থাপনপূর্বক নির্ধারিত লবণাক্ততা সম্পন্ন পানি প্রবেশের পরে ১.৫ মিলি অ্যামোনিয়া যোগ করতে হবে। এরপর ২০-২৫ দিন বায়ুসঞ্চালন করা হলে নুড়িপাথরের গায়ে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে। হেটারোট্রফিক ব্যাকটেরিয়া জন্মায়। ২০/২৫ দিন পরে পানিতে অ্যামেনিয়ার পরিমাণ কমে গেলে বা অনুপস্থিত থাকলে এদের উপস্থিতির মাধ্যমে বায়োফিল্টারের সক্রিয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
দ্বিতীয় পদ্ধতি
কোনো সক্রিয় বায়োফিল্টার থেকে কিছু নুড়িপাথর এনে নতুনভাবে প্রস্তুতকৃত বায়োফিল্টারে দিয়ে ৮-১০ দিন বায়ুসঞ্চালন করা হলে নুড়িপাথরের গায়ে হেটারাট্রেফিক ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয় এবং বায়োফিল্টার সক্রিয় হয়ে যায়।
তৃতীয় পদ্ধতি
বায়োফিল্টার স্থাপনের পরে এর ১২ পিপিটি লবণাক্ত পানিতে কিছু তেলাপিয়া ছেড়ে ২-৩ সপ্তাহ পালন করা হলে নুড়িপাথরের গায়ে হেটারোট্রপিক ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেবে এবং বায়োফিল্টার সক্রিয় হবে। বায়োফিল্টার সক্রিয় হয়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে নিশ্চিত হলে ট্যাংক থেকে তেলাপিয়া মাছ সরিয়ে নিয়ে। বায়োফিল্টারকে এলআরটি-এর সাথে সংযুক্ত করে দেয়া যাতে পারে।
বায়োফিল্টারের কার্যকারিতা
তিনটি পর্যায়ের মাধ্যমে বায়োফিল্টারের কার্যকারিতা বর্ণনা করা যায়ঃ
১ম পর্যায়: অ্যামোনিফিকেশান বা মিনারেলাইজেশান
বায়োফিল্টারে স্থাপিত নুড়িপাথরের গায়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হেটারোট্রপিক ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। এসব হেটারোট্রপিক ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা এলআরটি-এর পানিতে লার্ভার মৃতদেহ, মলমূত্র, প্রয়োগকৃত খাদ্যের অবশিষ্টাংশ ইত্যাদির পচনের ফলে লার্ভার জন্য চরম ক্ষতিকর আয়নিত ও অনায়নিত অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়। এ প্রক্রিয়াকে অ্যামোনিফিকেশান বা মিনারেলাইজেশান বলা হয়।
২য় পর্যায়: নাইট্রিফিকেশান
১ম পর্যায়ে হেটারোট্রপিক ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট ক্ষতিকর আয়নিত ও অনায়নিত অ্যামোনিয়া নাইট্রোসামোনোস ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে অক্সিডেশান প্রক্রিয়ায় প্রথমে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর নাইট্রাইটে পরিণত হয়। পরবর্তীতে পুনরায় এ নাইট্রাইট আবার নাইট্রোব্যাক্টারের মাধ্যমে সর্বাধিক কম ক্ষতিকর নাইট্রাইটে পরিণত হয়।
এর ফলে এলআরটি-এর পানি ক্ষতিকর অজৈব নাইট্রোজেনজনিত বিষাক্ততা থেকে মুক্ত হয়ে লার্ভার জীবনধারণের উপযোগী হয়। নাইট্রিফিকেশান পদ্ধতি সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য ৬টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ এগুলো নিম্নরূপঃ
১. বায়োফিল্টারের পানিতে যে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেমন অ্যান্টিবায়োটিকের অনুপস্থিতি
২. বায়োফিল্টারের পানির তাপমাত্রা ২৮-৩০° সেন্টিগ্রেড থাকা বাঞ্ছনীয়।
৩. বায়াফিল্টারের পানির পিএইচ ৭.৫-৮.৫ মাত্রার মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়।
৪. বায়োফিল্টারের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৪ পিপিএম এর বেশী থাকা বাঞ্ছনীয়।
৫. বায়োফিল্টারের পানির লবণাক্ততা ১০-১৫ পিপিটি এর মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়।
৬. বায়োফিল্টারে স্থাপিত নুড়িপাথর ও ঝিনুকের পরিমাণ বেশি হলে অধিক পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে এবং নাইট্রিফিকেশানের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। বায়োফিল্টারের প্রত্যাশিত সক্রিয়তা প্রাপ্তির জন্য এসব নুড়িপাথর ও ঝিনুক ছোট আকারের এবং অমসৃণ পৃষ্ঠ সম্পন্ন হলে ভালো হয়।
৩য় পর্যায়: ডিসিমিলেশান বা ডি-নাইট্রিফিকেশান
বায়োফিল্টারের নুড়িপাথরের নিচে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে অ্যানারািেবক ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। এরা পানিতে উপস্থিত নাইট্রেটকে ভেঙে নাইট্রাইট, মুক্ত নাইট্রোজেন, মিথেন, হাইড্রোজেন-সালফাইড ইত্যাদি গ্যাস তৈরি করে। এর ফলে বায়োফিল্টারের পানি দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়ে। এ প্রক্রিয়াকে ডিসিমিলেশান বা ডি-নাইট্রিফিকেশান বলা হয়।
এ প্রক্রিয়ায় পানিতে উপস্থিত নাইট্রেটের পরিমাণ কমলেও বায়োফিল্টারে তা ব্যাপকভাবে চলতে দেয়া ঠিক নয়। কারণ এর ফলে পানিতে ক্ষতিকর অ্যাসিড সৃষ্টি হয়। তাই বায়োফিল্টারে নাইট্রেটের পরিমাণ বেড়ে গেলে কিছু পানি পরিবর্তন করে দেয়া উচিত। বায়োফিল্টারের নুড়িপাথরের নিচে বায়ুসঞ্চালনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ডি নাইট্রিফিকেশানের পরিমাণ কমানো সম্ভব।
গলদা হ্যাচারির ভৌত অবকাঠামো ও উপকরণাদি জীবাণুমুক্তকরণ
হ্যাচারিতে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন কার্যক্রমের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত অবকাঠামো এবং উপকরণসমূহ উৎপাদন কর্মকা- শুরু করার আগে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। উপযুক্ত জীবাণুনাশক দ্রবণের সাহায্যে লার্ভা প্রতিপালন ইউনিটসহ সম্পূর্ণ হ্যাচারি, ট্যাংক, মেঝে, ক্যাচপিট, নর্দমা, পানির প্রতিটি পাইপলাইনের ভেতরের অংশ এবং অন্যান্য সকল উন্মুক্ত অবকাঠামো ও স্থান উত্তমরূপে ধৌত ও জীবাণুমুক্ত করা (Total disinfec- tion) এবং শুকানো প্রয়োজন। বিভিন্নভাবে হ্যাচারিতে দূষণ বা সংক্রমণের সৃষ্টি হতে পারে।
এসব কারণের মধ্যে রয়েছে- (ক) জীবাণুর মাধ্যমে সংক্রমণ, (খ) পরজীবীর মাধ্যমে সংক্রমণ এবং (গ) দূষণের মাধ্যমে উৎপাদন কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি। তাই উৎপাদন কার্যক্রম শুরুর পূর্বে যথাযথভাবে অবকাঠামো ও উপকরণাদি উপযুক্ত জীবাণুনাশক দ্বারা জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
হ্যাচারিকে জীবাণুমুক্ত ও দূষণমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের জৈবিক ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ধৌতকরণ প্রক্রিয়ায়, শুকিয়ে এবং তাপ প্রয়োগের মাধ্যমেও বেশ কিছু অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি জীবাণু মুক্ত করা হয়। অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করে ধৌত করার উদ্দেশ্যে প্রথমে ভালোভাবে ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে ময়লামুক্ত করে ধৌত করা হয়।
এরপরে কোন জীবাণুনাশক সামগ্রীর দ্বারা ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে তা তাপে বা মুক্ত বাতাসে ভালাভাবে শুকিয়ে নিতে হয়। এ কাজে, ১০০ পিপিএম সক্রিয় উপাদান সমৃদ্ধ (সোডিয়াম অথবা ক্যালসিয়াম) হাইপোক্লোরাইট দ্রবণ ব্যবহার করা যেতে পারে। উৎপাদনের ট্যাংক জীবাণুমুক্ত করার কাজে ১০% হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের দ্রবণও ব্যবহার করা যায়। ট্যাংক জীবাণুমুক্ত করার কাজে ফরমালিন ব্যবহার না করাই উত্তম। কারণ এর অবশিষ্টাংশ লার্ভার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
হ্যাচারিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকারের জীবাণুনাশক ও পদ্ধতির মধ্যে বিশেষ কয়েকটি সম্পর্কে নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক. ভৌত (Physical) জীবাণুনাশক
হ্যাচারিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন অবকাঠামো ও উপকরণাদি শুকানো ও তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করার পদ্ধতি বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে জীবাণুর বসবাস ও বংশবিস্তার রোধ হয়। হ্যাচারিতে ব্যবহৃত কাচের ও ধাতুর তৈজসপত্র সিদ্ধ বা গরম জলীয় বাষ্পের সাহায্য জীবাণুমুক্ত করা যায়।
আন্ট্রাভায়ােেলট রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমেও উপকরণাদি জীবাণুমুক্ত করা যায়। এসব ক্ষেত্রে তাপে গলে যায় বা আকৃতি নষ্ট হয় এরূপ সামগ্রীতে তাপ প্রয়োগ করা যায় না। ক্ষতিকর বেশিরভাগ জীবাণু ৬০° সে অপেক্ষা অধিক তাপমাত্রায় মারা যায়।
খ. রাসায়নিক (Chemical) জীবাণুনাশক
রাসায়নিক দ্রবাদি ব্যবহার করে হ্যাচারিতে জীবাণু ও পরজীবী নির্মূল করা বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে বহুল ব্যবহৃত রাসায়নিক জীবাণুনাশক দ্রব্যাদির মধ্যে রয়েছে ক্লোরিন (Bleaching powder), ফরমালিন, আয়োডিন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, ট্রাফলান, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (১০% দ্রবণ) ইত্যাদি।
যে সকল রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ রয়েছে সেসব রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার পরিহার করাই উত্তম। হ্যাচারি জীবাণুমুক্ত করার জন্য অনেক সময়ে এক সাথে দুই বা ততোধিক রাসায়নিক সামগ্রী ব্যবহার করা যেতে পারে। হ্যাচারির বিভিন্ন অবকাঠামো এবং দ্রব্যাদি জীবাণুমুক্ত করার কাজে ব্যবহৃত কয়েকটি বহুল প্রচলিত জীবাণুনাশকের নাম এবং ব্যবহারের মাত্রা সম্পর্কে নিচের ছকে উল্লেখ করা হলো।
গ. জৈবিক (Biological) জীবাণুনাশক
ভেষজ দ্রবাদি থেকে প্রস্তুতকৃত জৈবিক জীবাণুনাশক ব্যবহার বহুল প্রচলিত নয়। নিম দ্রবণ বা পাউডার এ ধরনের একটি জৈবিক জীবাণুনাশক হিসেবে পরিচিত। এছাড়া উপকারী ব্যাকটেরিয়া বা প্রো-বায়োটিক দ্বারাও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দমন করার ব্যবস্থা করা যায়। তবে এ ধরনের উচ্চপর্যায়ের প্রযুক্তি আমাদের দেশে এখনও প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
আরও দেখুনঃ