আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা
হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা
অনেক মাছ বিশেষ করে রুই জাতীয় মাছ ও বিদেশি (Exotic Carp) কার্প মাছগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় পুকুরে প্রজনন করে না। ফলে তাদের রেণু পুকুরে পাওয়া সম্ভব নয়। এসব মাছের প্রজনন সাধারণত প্রাকৃতিক উৎসে ঘটে থাকে, কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থায় নদীতে যে প্রজনন হয় তাতে অনেক সমস্যা পরিলক্ষিত হয় । যেমন ।
বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনার মিশ্রণ, রাক্ষুসে মাছের পোনার মিশ্রণ, রোগ জীবাণুর উপস্থিতি, যথাসময়ে একই জাতের, একই আকারের এবং একই বয়সের পোনা না পাওয়া ইত্যাদি । তাছাড়া প্রাকৃতিক ও মানুষ সৃষ্ট নানা কারণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন বিনষ্ট হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে পোনার উৎপাদন কমে গেছে । পরিবেশের এসব প্রতিকূলতা রক্ষার জন্য মৎস্য হ্যাচারি স্থাপনের গুরুত্ব অপরিসীম ।
হ্যাচারি
যে প্রক্রিয়ায় পরিপত্ত্ব পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রণোদিত করে ডিম ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয় এবং সে ডিম ফুটিয়ে রেণু উৎপাদন করা হয়, তাকে প্রণোদিত প্রজনন বলা হয়। এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে অবকাঠামো ব্যবহার করা হয় তাকে হ্যাচারি হিসেবে গণ্য করা হয় । অর্থাৎ হ্যাচারি হলো একটি নিয়জিত পরিবেশ বা যেখানে মাছের প্রণোদিত প্রজননের সকল অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে মাছকে প্রজননে বাধ্য করা হয় ।
হ্যাচারির প্রকারভেদ:
পোনা উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে হ্যাচারি সাধারণত তিন ধরনের । যথা-
i) ছোট বা মিনি হ্যাচারি
ii) মাঝারি হ্যাচারি
iii) বড় হ্যাচারি
i) ছোট হ্যাচারি । এ ধরনের হ্যাচারি সাধারণত পরিবারের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে
একজন টেকনিশিয়ান এবং দুইজন শ্রমিক হলেই যথেষ্ট ।
ii) মাঝারি হ্যাচারি। এ ধরনের হ্যাচারি সাধারণত কোম্পানি, সমবায় এবং হ্যাচারিতে নিযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হয় । এক্ষেত্রে তিনজন টেকনিশিয়ান এবং তিন-চার জন শ্রমিক হলেই যথেষ্ট ।
iii) বড় হ্যাচারি । এ ধরনের হ্যাচারি সাধারণত লিঃ কোম্পানি, সমবায় এবং হ্যাচারি নিযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। এ ধরনের হ্যাচারি পরিচালনার জন্য তিন-ছয় জন টেকনিশিয়ান এবং ছয়-দশ জন শ্রমিক প্রয়োজন হয়।
হ্যাচারির প্রয়োজনীয়তা :
পরিবেশগত বিপর্যায়ের কারণে প্রাকৃতিক উৎসে রেণু পোনা উৎপাদন ও প্রাপ্তি কমে যাওয়ায় ক্রমবর্ধমান রেপু পোনার চাহিদা পূরণের জন্য হ্যাচারি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। উল্লেখ্য, অধিক পরিমাণ উন্নত জাতের একই প্রজাতির একই বয়সের রেণু পোনা পাওয়ার জন্য হ্যাচারির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বিরল প্রজাতির বা প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির মাছের প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে মাছের বিলুপ্তি রোধ করা যায় ।
হ্যাচারির জন্য স্থান নির্বাচন :
হ্যাচারি স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হ্যাচারির সফলতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করে স্থান নির্বাচনের উপর। হ্যাচারির স্থান নির্বাচনের জন্য নিম্নে বর্ণিত বিষয়াবলি বিবেচনায় রাখা আবশ্যক ।
ক. বাজারজাতকরণ সুবিধা :
উৎপাদিত রেণু ও মাছ সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে না পারলে হ্যাচারি অলাভজনক হয়ে পড়ে । তাই হ্যাচারির স্থান নির্বাচনের সময় অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে যেন ঐ স্থানে বাজারজাতকরণের সুব্যবস্থা থাকে । এক্ষেত্রে প্রথমে একটি জরিপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকায় চাষযোগ্য পুকুর, দীঘি ও জলাশয়ের পরিমাণ এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ মাছ চাষে আগ্রহী কিনা জেনে নেওয়া ।
খ. মাটির প্রকৃতি :
স্থান নির্বাচনের সময় মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করা অতীব জরুরি । উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন মাটি না হলে পোনা উৎপাদন ও ব্রুড মাছ পালনের অসুবিধা সৃষ্টি হয়। পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ মাটির উপর নির্ভরশীল । উর্বর মাটির পুকুরে মাছের উৎপাদন অধিক হয় । বালিযুক্ত মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা থাকে না, ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখা যায় না। লাল মাটিতে পুকুর তৈরি করলে পানি ঘোলা থাকে । মাছ চাষের জন্য দো-আঁশ মাটি উত্তম । মাটির পি. এইচ ৬.৫ থেকে ৭.৫ থাকা উচিত ।
গ. সাংবাৎসরিক পানির উৎস :
হ্যাচারি পরিচালনায় পানি সরবরাহ অতীব জরুরি বিষয়। হ্যাচারির পানি অবশ্যই আয়রনমুক্ত হতে হবে । হ্যাচারির জন্য স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেসব এলাকায় পুকুরসহ সকল গভীর ও অগভীর নলকূপে সারা বছর পানি থাকে, সেসব স্থানই হ্যাচারির জন্য উত্তম । হ্যাচারিতে ব্যবহার্য পানিতে নিম্নের গুণাবলি থাকা বাঞ্ছনীয় ।
অক্সিজেন
২৪°-৩০° সেলসিয়াস
তাপমাত্রা
পিএইচ
৭.৫-৮.৫
অ্যামোনিয়া
০.৫ মি.গ্রাম/লিটার
কার্বন ডাই-অক্সাইড
এলকালিনিটি
১০ মি.গ্রাম/লিটার
৭৫ মি.গ্রাম/লিটার এর বেশি
হার্ডনেস
৬০ মি.গ্রাম/লিটার এর বেশি
ক্লোরাইড
৬ মি.গ্রাম/লিটার এর বেশি
লৌহ
২ মি.গ্রাম/লিটার
ঘ) হ্যাচারি নির্মাণ ও পুকুর তৈরির খরচ :
হ্যাচারির স্থান নির্বাচন করার সময় লক্ষ্য রাখা উচিত যেন ঐ স্থানে জমির মূল্য তুলনামূলকভাবে কম হয় এবং পুকুর খনন ব্যয়ও কম থাকে। এক্ষেত্রে তুলনামূলক নিম্নভূমি নির্বাচন করা যেতে পারে। হ্যাচারির স্থান নির্বাচন করার সময় অবশ্যই দেখতে হবে যেন হ্যাচারি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও উপকরণ সহজেই কাছাকাছি পাওয়া যায় এবং নির্মাণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলের সহজলভ্যতা থাকে ।
ঙ) বিদ্যুৎ ব্যবস্থা :
মৎস্য প্রজনন হ্যাচারির জন্য বিদ্যুতের সরবরাহ থাকা আবশ্যক। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য পাম্প চালানো, রেফ্রিজারেটর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি যেমন: সেন্ট্রিফিউজ মেশিন, বৈদ্যুতিক করাত, ইলেকট্রিক ব্যালেন্স চালানোর জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন । বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা থাকলে মাছ চুরি রোধ করা যায় ।
চ) যোগাযোগ ব্যবস্থা
হ্যাচারি উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রয় ও স্থানান্তর এবং হ্যাচারিতে মাছ ও মাছের খাবার সরবরাহ করার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়া বাঞ্ছনীয় । অর্থাৎ খারাপ বা দুর্গম রাস্তার কারণে অনেক ক্রেতা হ্যাচারিতে পোনা কিনতে আসতে চাইবে না। তাই হ্যাচারির স্থান নির্বাচনের সময় যোগাযোগের ব্যবস্থার কথা বিবেচনা
করা দরকার।
ছ) বন্যা ও দূষণমুক্ত এলাকা :
হ্যাচারি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে লাভবান হতে হলে হ্যাচারির ব্রুড মাছ, রেণু ও পোনার জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ এবং বন্যামুক্ত এলাকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ।
সার ও কাঁচামালের সহজলভ্যতা :
হ্যাচারির প্রাণ হলো ব্রুড মাছ । আর সেই ব্রুড ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের পর্যাপ্ততা বজায় রাখতে হলে নিয়মিতভাবে হ্যাচারির পুকুরগুলোতে সার প্রয়োগ করার দরকার হয় । অপরপক্ষে
প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত সম্পূরক খাদ্যও প্রদান করতে হয় । তাই সার, মাছের খাবার প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং হ্যাচারি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সহজেই পাওয়া যায় এমন জায়গায় হ্যাচারি স্থাপন করা উচিত।
হ্যাচারির বিভিন্ন অংশ
প্রজননযোগ্য মাছকে লালন-পালন করে উপযুক্ত পরিপক্ক করে তোলা, পরিপক্ব মাছকে ইনজেকশন দেওয়া, ডিম সংগ্রহ, ফোটানো এবং রেণু লালন-পালন করা হ্যাচারির প্রধান কাজ। এজন্য একটি হ্যাচারিতে দুটি প্রধান অংশ থাকে, যথা :
১। পুকুর অংশ
২। হ্যাচারি অংশ
১। পুকুর অংশ :
সফলতার সাথে হ্যাচারি পরিচালনার জন্য এক জায়গায় একত্রে কয়েকটি ছোট-বড় পুকুর থাকা প্রয়োজন । এসব পুকুরে প্রজননযোগ্য মাছকে লালন-পালন ও পোনা প্রতিপালন করা হয়। হ্যাচারির সুবিধার জন্য যে ধরনের পুকুর থাকা দরকার সেগুলো হচ্ছে
ক) ব্রুড মাছ পালন পুকুর (Brood Pond )
খ) প্রজননোত্তর মাছের পালন পুকুর (Spent Fish Pond )
গ) লালন পুকুর (Rearing Pond )
ঘ) আঁতুড় পুকুর (Nursury Pond )
ক. ব্রুড মাছ পালন পুকুর (Brood Pond) :
একটি বড় আকারের মৎস্য হ্যাচারিতে বিভিন্ন প্রজাতির ব্রুড মাছ লালন-পালনের জন্য বিভিন্ন আকারের পুকুর থাকা একান্ত প্রয়োজন । সারাবছর কমপক্ষে ২ মিটার পানি থাকে এমন পুকুরে প্রজননক্ষম মাছ প্রতিপালন করা উচিত । প্রজননক্ষম মাছের পুকুরের আয়তন ৩৩ শতাংশ থেকে ১ একরের মধ্যে হলে ভালো হয় ।
খ. প্রজননোত্তর মাছের পালন পুকুর (Spent Fish Pond )
প্রজনন শুরু করার পর প্রজনন সম্পন্ন করেছে এমন মাছকে পৃথকভাবে পালন করার জন্য আলাদা পুকুর রাখা হয়। হ্যাচারিতে এরকম একটি পুকুর থাকলেই চলে। এ ধরনের পুকুর ও ব্রুড পালন পুকুরের আকার ও গভীরতা একই হওয়া দরকার । কারণ সদ্য প্রজননকৃত মাছগুলো খুবই দুর্বল ও নাজুক থাকার কারণে তাদের নিবিড় তদারকি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ।
গ. লালন পুকুর (Rearing Pond )
এলাকায় উন্নত জাতের মাছের পোনা সরবরাহের উৎস হিসেবে প্রতিটি হ্যাচারি কাজ করে। সে কারণে হ্যাচারিতে কয়েকটি লালন পুকুর রাখা হয়। লালন পুকুরে ধানী পোনা ছেড়ে আঙ্গুলী পোনা তৈরি করা হয় এবং আগ্রহী পুকুর মালিকদের কাছে বিক্রি করা হয়। লালন পুকুর ১.০ মিটার থেকে ১.৫ মিটার গভীর হওয়া দরকার ।
ঘ. আঁতুড় পুকুর (Nursury Pond ) :
আঁতুড় পুকুর হচ্ছে ছোট আকারের অগভীর পুকুর যেখানে রেণু পোনা লালন করা হয় । অনেক সময়
হ্যাচারিতে উৎপন্ন রেণু সময়মতো বিক্রি করা সম্ভব হয় না। এমন অবস্থায় উৎপাদিত রেণুপোনা হ্যাচারির আঁতুড় পুকুরে মজুদ করা হয়। সেখানে ১৫-২০ দিন পালনের পর ধানী আকারের পোনা লালন পুকুরে স্থানান্তর করা হয়, অথবা ধানী হিসেবে অন্য কোথাও বিক্রি করে দেওয়া হয় । হ্যাচারির পুকুর অংশের প্রতিটি পুকুর পরস্পর পাইপ বা ড্রেন দ্বারা যুক্ত থাকলে ভালো হয়। তাতে পুকুরে পানি সরবাহ ও নিষ্কাশনে খুবই সুবিধা হয় এবং পুকুরে বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি দূর করা যায় ।
২। হ্যাচারি অংশ :
প্রণোদিত প্রজনন স্থান বা হ্যাচারির অভ্যন্তরীণ অংশ ছাদ বা চালের নিচে পাকা করে তৈরি করা হয় । একটি আধুনিক হ্যাচারিতে নিম্নবর্ণিত অংশগুলো বিদ্যমান :
ক. ওভারহেড ট্যাংক
খ. ব্রুড মাছের চৌবাচ্চা
গ. রেণু পোনার চৌবাচ্চা
ঘ. প্রজনন ট্যাংক
ঙ. হ্যাচিং জার
চ. ইনকুবেশন ট্যাংক
ছ. গভীর ও অগভীর নলকূপ
জ. হ্যাচারি ঘর
ঝ. অফিস ঘর ও ল্যাবরেটরি
ঞ. গুদাম ঘর
ট. পাম্প ঘর
ঠ. যানবাহন
ক) ওভারহেড ট্যাংক :
একটি মৎস্য হ্যাচারি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়। হ্যাচারিতে পানি সরবরাহের পূর্বে পানিকে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য যে উঁচু জলাধার নির্মাণ করা হয়, তাকে ওভারহেড ট্যাংক বা উচ্চ জলাধার বলা হয়। এ জলাধরকে সার্কুলার ট্যাংক থেকে অর্থাৎ ভূমি থেকে কমপক্ষে তিন মিটার উঁচুতে স্থাপন করলে হ্যাচারিতে পানি সরবরাহ সহজতর হয়। হ্যাচারির উৎপাদন ক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রেখে ওভারহেড ট্যাংক নির্মাণ করা উচিত ।
সাধারণত দেখা যায় ১০০ কেজি রেণু উৎপাদনক্ষম হ্যাচারির জন্য ৫৪০০০ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি উচ্চ জলাধার নির্মাণ করা হলে ৬-৮ ঘণ্টা ব্যবধানে পানি উত্তোলন করার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ রেণু উৎপাদনের একটি ধাপে ১০-১২ বার পানি উত্তোলন করলেই চলে । এতে হ্যাচারিতে পানি সরবরাহের ঝুঁকি কমে যায়। পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি এবং লৌহমুক্ত করার জন্য ট্যাংকের উপরে পানির প্রবেশপথে ছিদ্রযুক্ত স্টিল তাক বা টিনের প্লাটফর্ম নির্মাণ করা হয়ে থাকে । পানির অক্সিজেন মাত্রা বৃদ্ধির জন্য এয়ার রোয়ার চালানো যেতে পারে ।
খ) ব্রুড মাছের চৌবাচ্চা
পুকুর থেকে নির্বাচনের পর এ চৌবাচ্চায় নির্বাচিত মাছকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া হয় এবং হ্যাচারির পানির সাথে এদের অভ্যন্ত করে নেওয়া হয়। এখানে মাছকে ৪-৭ ঘণ্টা পর্যন্ত বিশ্রাম দেওয়া হয়। যদি চাপ প্রয়োগ পদ্ধতিতে ডিম নিষিক্ত করা হয় তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় ইনজেকশন দিয়ে মাছকে ব্রুড মাছের চৌবাচ্চায় হাপা স্থাপন করে পরিচর্যা করা হয়। পোনা পরিবহনের জন্য প্রস্তুতকরণ, রেণু পরিচর্যাসহ অন্যান্য কাজেও ব্রুড মাছের চৌবাচ্চা ব্যবহৃত হয় ।
গ) রেণু পোনার চৌবাচ্চা
এ ধরনের চৌবাচ্চা ব্রুড মাছের চৌবাচ্চার মতোই শুধু আকারে একটু ছোট হয়। হ্যাচিং বোতল ও সার্কুলার ট্যাংক থেকে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে এসব চৌবাচ্চায় হাপার মধ্যে ঐ সব রেণুপোনা বা বাচ্চা রাখা হয় । এখানেও অনবরত পানির প্রবাহ বজায় রাখা হয় । রেণুপোনা রাখা ছাড়াও হ্যাচারিতে উৎপন্ন ধানী পোনা ও আঙ্গুলী পোনা বিক্রির জন্য পাকা করা বা কন্ডিশনিং করার জন্য এসব চৌবাচ্চা ব্যবহার করা হয় ।
ঘ) প্রজনন ট্যাংক :
ইহা সিমেন্টের তৈরি গোলাকার চৌবাচ্চা যার ব্যাস ২.৫ থেকে ৩ মিটার এবং উচ্চতা ১ মিটার হতে পারে । প্রজনন ট্যাংকে ব্রুড মাছ ইনজেকশন দিয়ে রাখা এবং সেখানে পানির কৃত্রিম স্রোত সৃষ্টির মাধ্যমে মাছকে কোর্টশিপ (Courtship)-এর মাধ্যমে সুযোগ সৃষ্টি করতে সহজাতভাবে ডিম দেওয়ার পরিবেশ তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয় । কার্প জাতীয় মাছের এবং সরপুঁটির প্রজননের জন্য প্রজনন ট্যাংক বেশি উপযোগী । এ ট্যাংকে পানির প্রবাহের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। প্রয়োজনে উপর হতে ঝর্ণার সাহায্যে পানি দেয়া যেতে পারে। এটা অনেক সময় পোনা কন্ডিশনের কাজে ব্যবহৃত হয় ।
৬) হ্যাচিং জার :
হ্যাচিং জার একটি ফানেল আকৃতির সিমেন্ট, স্টিল বা ফাইবার গ্লাসের দ্বারা তৈরি পাত্র বিশেষ। হ্যাচারিতে যে পাত্রে নিষিক্ত ডিম রেখে ফুটিয়ে রেণু পোনায় পরিণত হওয়ার পরও ৩-৪ দিন পর্যন্ত রাখা হয়, সে পাত্রকে হ্যাচিং জার বলা হয় । ২৫০-৩০০ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন হ্যাচিং জারে ৩০০-৫০০ গ্রাম রেণু উৎপাদন করা যায়।
এ ক্ষেত্রে পানির প্রবাহ মাত্রা ১৫-২০ লিটার প্রতি মিনিটে হওয়া বাঞ্ছনীয়। হ্যাচিং জারে পানি ধারণ ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে রেণু উৎপাদন কম-বেশি হয়। হ্যাচিং জারের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত রেণু উৎপাদন করা উচিত নয় । এতে রেণুর গুণগতমান কমে যাওয়াসহ হঠাৎ করে সমস্ত রেণু মারা যেতে পারে ।
গভির ও অগভীর
একটি সদস্য হ্যাচারি পরিচালনার জন্য পানি সরবরাহ অতীব জরুরি বিষয়। স্বচ্ছ, পর্যাপ্ত অক্সিজেনযুক্ত এবং আয়রণযুক্ত পানি হ্যাচারির জন্য প্রয়োজন। হ্যারির পানিতে ০.০৩ নিমুতাংশের বেশি সৌহ থাকলে হেৰু মাপ্তির হার কম হয় ।
কাচারি পরিচালনায় নিম্নলিখিত গুণাগুণ সম্পন্ন পানির প্রয়োজন হয়
হ্যাচারির মূল অবকাঠামোকে রোদ, বৃষ্টি ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য ন্যাচারির উপর যে ছাল বা ভাল নির্মাণ করা হয়ে থাকে, তাকে হ্যাচারি ঘর বলে। হ্যাচারির পর সাধার
পাকা, আধাপাকা বা কাঁচা হয়ে থাকে। হ্যাচারি ঘরটি এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন হ্যাচারিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো ও বাতাস চলাচল করতে পারে। কিন্তু সরাসরি সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না ।
ক) অফিস ঘর ও ল্যাবরেটরি।
একটি হ্যাচারির জন্য ছোট একটি অফিস ঘর থাকা প্রয়োজন। এই ঘরটিকেই ল্যাবরেটরি বা পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যবহার করা যায় । এখানে প্রজননের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্যাদি, বিভিন্ন বই- পুস্তক, হিসাব-নিকাশের খাতাপত্র প্রভৃতি সংরক্ষণ করা হয় ।
ঞ) দাম ঘরহ্যাচারির জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল, বড় ধরনের যন্ত্রপাতি, জাল, হাঁড়ি, ব্যারেল ইত্যাদি রাখার জন্য একটি গুদাম ঘর থাকে । এরকম গুদামে হ্যাচারির পুকুরে সারা বছর ব্যবহারের জন্য চুন, সার, খৈল, মাছের খাদ্য প্রভৃতি মজুদ করে রাখা হয় ।
ট) পাম্প ঘর :হ্যাচারির পাম্প সুষ্ঠুভাবে চালানো, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য একটি পাম্প ঘরের প্রয়োজন হয় ।
ঠ) যানবাহন । হ্যাচারির জন্য যানবাহন থাকা আবশ্যক। বড় ধরনের হ্যাচারির জন্য ট্রাক ও হ্যাচারির মাঝারি পিকআপ গাড়ি থাকলে ভালো হয়। ছোট হ্যাচারির জন্য অগত্যা রিক্সাভ্যান থাকলেও কাজ চলতে পারে। এসব যানবাহন হাচারি থেকে রেণু, পোনা ও ব্রুড মাছ অন্যান্য স্থানে আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয় ।
মাছের প্রজনন প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণের বর্ণনা। সুষ্ঠুভাবে হ্যাচারি পরিচালনার জন্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ও
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির নাম ও সেগুলোর ব্যবহার নিম্নে দেওয়া হলো :
প্রশ্নমালা-৩
এক কথায় উত্তর দাও :
১। হ্যাচারি কাকে বলে?
২। ইনকুবেশন ট্যাংক কী ?
৩। হ্যাচারি স্থাপনের স্থান নির্বাচনে বিবেচনা করা হয় এমন দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্যর নাম লেখ ।
৪। পিজি বলতে কী বুঝায়?
৫ । হ্যাচারির স্থানে পুকুর স্থাপনের সময় বেলে মাটির স্তর পেলে কী অসুবিধা হয়?
৬। হ্যাচারির পানির উৎস কী কী হতে পারে?
৭ । নিন্মভূমিতে পুকুর নির্মাণে কী অসুবিধা দেখা যায় ?
৮ । হ্যাচারিতে বিদ্যুতের দুইটি ব্যবহার লেখ।
৯ । হ্যাচারি ব্যবস্থাপনার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ কেন?
১০ । মৎস্য প্রজনন হ্যাচারিতে প্রধানত কয়টি অংশ থাকে?
১১ । হ্যাচারি পরিচালনার সুবিধার জন্য কয় প্রকার পুকুর থাকা প্রয়োজন?
১২। ব্রুড মাছের পুকুর কতটুকু হলে ভালো হয় ?
১৩ । লালন পুকুর কী কাজে ব্যবহার করা হয়?
১৪ । হ্যাচারির আঁতুড় পুকুরে কতদিন রেণু পোনা পালন করা হয়?
১৫ । হ্যাচারির প্রতিটি পুকুর পাইপ দ্বারা সংযুক্ত থাকলে কী সুবিধা পাওয়া যায় ?
১৬ । পানির ট্যাংকের উচ্চতা কতটুকু হওয়া উচিত?
১৭। পানির ট্যাংকের আয়তন কত বড় হতে পারে ?
১৮। ব্রুড মাছের আকার কত বড় হওয়া দরকার?
১৯ । পানির লৌহ ডিমের কী ক্ষতি করে ?
২০। ব্রিডিং ট্যাংকের ব্যাস কতটুকু রাখা হয়?
২১ । একটি হ্যাচিং বোতলে কতটুকু ডিম ফোটানো হয়?
২২। ডিম ছাড়া মাছের পালন পুকুর বলতে কী বুঝায়?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন :
১। মৎস্য হ্যাচারি বলতে কী বুঝায় ?
২। হ্যাচারি স্থান নির্বাচনে কী কী বিষয় বিবেচনা করা হয়? ৩। ব্রুড মাছ পালনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
৪ । মৎস্য প্রজননের হ্যাচারি অংশের অবকাঠামোগুলো কী কী?
৫। সার্কুলার ট্যাংক সম্পর্কে বিবরণ দাও ।
৬ । প্রজননের পর মাছের ডিম ফুটানোর জন্য হ্যাচিং বোতলের ভূমিকা লেখ ।
৭। একটি হ্যাচারিতে ল্যাবরেটরির কাজ কী?
৮ । হ্যাচারিতে মাছের মাথা থেকে পিটুইটারি গ্রন্থি সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির নাম ও ব্যবহার
লেখ।
৯ । মাছকে ইনজেকশন দেয়ার জন্য কী কী যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হতে পারে ?
১০ । রেণু বিক্রয়ের জন্য কী কী সরঞ্জাম দরকার হয় বর্ণনা দাও ।
বর্ণনামূলক প্রশ্ন :
১। হ্যাচারি স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচনের বিবেচ্য বিষয়গুলো বর্ণনা কর ।
২। মৎস্য প্রজনন হ্যাচারির বিভিন্ন অংশের বিবরণ দাও ।
৩। হ্যাচারির পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলি বর্ণনা কর ।
আরও দেখুন: