আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় -বাগদা চিংড়ির ব্রুড সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা। যা ” বাগদা চিংড়ির ব্রুড সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
বাগদা চিংড়ির ব্রুড সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা
প্রাকৃতিক উৎস থেকে ব্রড সংগ্রহের পদ্ধতি
কৃত্রিমভাবে বাগদা চিংড়ির পিএল উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাদার শ্রিম্প-এর গুণগতমান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত ব্রড হতে উৎপাদিত পিএল-এর গুণগতমান ভালো থাকে। তাই প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রজনন উপযোগী ডিমওয়ালা চিংড়ি সংগ্রহ করা উচিত। প্রজননক্ষম পুরুষ ও স্ত্রী বাগদা চিংড়ি মার্চ থেকে নভেম্বর মধ্যে সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা যায়। ডিমওয়ালা চিংড়ি দু’প্রকার, যথা- সমপূর্ণ পরিপত্ত্ব ও প্রাপ্ত বয়স্ক চিংড়ি। সম্পূর্ণ পরিপক্ক চিংড়ি হ্যাচারিতে এনে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করলে আপনা আপনি ডিম ছেড়ে দেয়।
কিন্তু পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী চিংড়ির চক্ষু কর্তন ছাড়া ডিম হয় না। গভীর সমুদ্রে মাছ বা চিংড়ি ধরার কাজে নিয়োজিত ট্রলার থেকে পরিপক্ক চিংড়ি সগ্রহ করা যায়। অন্যদিকে টেকনাফের উপকূলবর্তী এলাকায় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কিছু কিছু পরিপক্ক চিংড়ি পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে পরিপক্ক চিংড়ি পাওয়া না গেলে খামার থেকে পূর্ণবয়স্ক চিংড়ি সগ্রহ করে হ্যাচারিতে ব্যবহার করা যায়। তবে গভীর সমুদ্র থেকে সংগৃহীত চিংড়ি থেকে ভালো ফল পাওয়া যায়। সমপূর্ণ পরিপক চিংড়ি পাওয়া না গেলে কমপক্ষে ৮০ গ্রাম ওজনের স্ত্রী চিংড়ি ও ৫০ গ্রাম ওজনের পুরুষ চিংড়ি সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে পরিপক্ক করতে হবে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত চিংড়ি থেকে পোনা উৎপাদন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি হয়ে থাকে।
মাদার শ্রিম্প পরিবহন পদ্ধতি
মাদার শ্রিম্প পরিবহন পদ্ধতি পূর্ণবয়স্ক চিংড়ির পরিবহনের অনুরূপ হলেও চিংড়ির উদরে ডিমের অবস্থানের কারণে ডিমওয়ালা চিংড়ি পরিবহনে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কেননা একই পাত্রে অনেকগুলো চিংড়ি পরিবহন করার সময় চিংড়ির পায়ের আঘাতে ডিম বেরিয়ে আসতে পারে। এক্ষেত্রে ৩০ সেমি লম্বা এবং ৬ থেকে ৮ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট প্লাস্টিক পাইপের মধ্যে মাদার শ্রিম্প চিংড়ি প্রবেশ করিয়ে পরিবহন করা যেতে পারে। পাইপের গায়ে অবশ্যই ৪০ থেকে ৫০ টি ছিদ্র থাকতে হবে এবং পাইপের মুখ মশারির কাপড় দিয়ে আটকানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
প্রত্যেকটি পাইপে একটি চিংড়ি প্রবেশ করিয়ে অতঃপর পাস্টিকের ব্যাগে অক্সিজেনযুক্ত পানি পূর্ণ করে পরিবহন করা যেতে পারে। এ পদ্ধতি দীর্ঘ সময় পরিবহনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর। এছাড়া অক্সিজেনের সাহায্যে পাস্টিকের ব্যাগের মাধ্যমেও পরিবহন করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্লাস্টিক ব্যাগের পানির তাপমাত্রা অনুকূল অবস্থায় রাখার জন্য প্রতি ২ লিটার পানির জন্য ১০০ গ্রাম ওজনের পৃথক বরফের টুকরা প্লাস্টিক ব্যাগের পানির মধ্যে ভাসিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে চিংড়ির রোস্ট্রামটিতে স্পঞ্জ জাতীয় পদার্থ লাগিয়ে দিতে হবে যাতে আঘাতজনিত কারণে রোস্ট্রামটি ভেঙে না যায়।
যাদার শ্রিম্প প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহ করে হ্যাচারিকে এসে ফরমালিন ২৫ পিপিএম মাত্রায়, ১৫ থেকে ২০ মিনিট অতিবাহিত করে জীবাণুযুক্ত করে বিয়ে হয়। অথবা ৫ সিপিএম মাত্রায় কুয়াল প্রস্বণে ১ ঘন্টা রেখে জীবাণুযুক্ত করে নিতে হয়। এরপর ব্রিডিং গ্রাউন্ডে ৩-৪ দিন পরিচর্যা করা হয়। এ সময় পুরুণ্য ও স্ত্রী চিংড়ি জালালা রাখা হয় এবং এ সময় অভ্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে কুঁচো চিংড়ি, শামুক, কিসুক, কুইজ যা কঁকড়ায় মাংস, গরু বা খাসির কলিজা ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়। এরপর পুরুষ ও স্ত্রী চিংড়িকে ১০১ অনুপাতে স্যাচুরেশন ট্যাংকে সজুদ করা হয়। স্যাচুব্রেশন ট্যাংকের একি বর্গমিটাতে ৩০০-৪০০ গ্রাম চিংড়ি মজুন করা যায়।
গুণগতমান সম্পন্ন চিংড়ির পিএল তৈরির লক্ষ্যে সুস্থ-সবল মাদার শ্রিম্প একান্ত অপরিহার্য। কাজেই মাদার শ্রিম্প নির্বাচনের জন্য সংগৃহীত চিংড়ির নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি নজর দিতে হবে:
ক) মাদার শ্রিম্প অবশ্যই স্বাস্থ্যবান এবং রোগমুক্ত হতে হবে,
খ) সবল এবং কর্মতৎপর হবে
গ) উজ্জ্বল বর্ণ,
ঘ) যতটা সম্ভব বড় এবং পরিপক্ক হবে।
উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন চিংড়ি থেকে উৎপাদিত সার্ভার বেঁচে থাকার হার ও বৃদ্ধি সন্তোষজনক হয়ে থাকে।
পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম পাওয়ার উদ্দেশ্যে মজুদ ট্যাংক ব্যবস্থাপনার জন্য যে বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে তা নিম্নরূপ-
ক) মজুদ ট্যাংকে পানির গভীরতা ১ মিটার রাখতে হয়।
খ) প্রতিদিন সকালে ও বিকালে ৪০% থেকে ৫০% পানি পরিবর্তন করতে হয়।
গ) ট্যাংকের তলদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হয় এবং ট্যাংকের উপরিভাগে ঢাকার ব্যবস্থা থাকতে হয় বা ট্যাংক ঘরের মধ্যে রাখতে হয়।
ঘ) প্রজনন কার্য ত্বরান্বিত করার জন্য মজুদ ট্যাংকে যতটা সম্ভব ঝরনার ব্যবস্থা থাকতে হবে, ফলে চিংড়ি যৌন কার্য সম্পাদনে বেশি তৎপর হয়।
ঙ) মাদার শ্রিম্প এর দেহের ওজনের ৫% হিসেবে সম্পূরক খাদ্য প্রতিদিন সকালে ও বিকালে প্রয়োগ করতে হয়। বিকালে সব ধরনের ভাজা খাদ্য প্রয়োগ করা ভালো। মাদার শ্রিম্প-এর খাদ্য হিসেবে কাটা মাছ, শামুক-ঝিনুকের মাংস, গরু বা খাসির কলিজা, কুচো চিংড়ি ও পরিপক্ক আর্টিমিয়া অন্যতম।
চ) প্রতিদিন খাদ্য দেয়ার পূর্বে সাইনিং প্রক্রিয়ায় ট্যাংকের তলদেশ থেকে অতিরিক্ত খাবার বা চিংড়ির মলমূত্র পরিষ্কার করে নিতে হয়। উল্লেখ্য প্রতি দু দিন পর ট্যাংকের তলদেশ এবং গাত্র ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। ব্রড শ্রি মজুদ করার পূর্বে ২০ পিপিএম ফরমালিন দ্রবণের সাহায্যে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
স্বাস্থ্য পরিচর্যা
হ্যাচারিতে প্রতিপালিত মা চিংড়ি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এসব রোগ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও এককোষী প্রাণীর আক্রমণে চিংড়ি পোনায় সংক্রামিত হয়ে থাকে। হ্যাচারিতে রোগের প্রাদুর্ভাব বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এগুলোর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে হ্যাচারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না রাখা, হ্যাচারিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রবাদি জীবাণুমুক্ত না রাখা, সঠিক পরিমাণে বিভিন্ন ট্যাংকের পানি পরিবর্তন না করা, খাদ্যের মান ঠিক না থাকা, পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের স্বল্পতা প্রভৃতি। হ্যাচারি জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহের উপর গুরুত্ব দিলে সাধারণত পোনা রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। বিষয়গুলো হলো:
ক) হ্যাচারিতে ব্যবহৃত পানি ও যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত রাখা।
খ) প্রতিটি ট্যাংক থেকে সঠিক পরিমাণ পানি পরিবর্তন করা।
গ) প্রতিটি ট্যাংকের তলদেশ নিয়মিত পরিষ্কার করা।
ঘ) ভালো গুণাগুণ সম্পন্ন খাদ্য সঠিক মাত্রায় সরবরাহ করা।
ঙ) পোনা উৎপাদন কার্যক্রম শুরুর পূর্বে ও উৎপাদন কার্যক্রম শেষে ট্যাংকসমূহ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। জীবাণুমুক্ত করা।
চ) পানিতে সব সময় বায়ু সরবরাহ নিশ্চিত রাখা।
ছ) পানির তাপমাত্রা সঠিক পর্যায়ে রাখা।
মা চিংড়ি ব্রিডিং ট্যাংকে মজুদের পূর্বে স্বাস্থ্য পরীক্ষা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে নিচের সারণিতে উল্লেখিত পরীক্ষাগুলো করা যেতে পারে।
সারণি: চিংড়ি স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য
ক্রমিক নং | পরীক্ষণীয় বিষয় | শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য |
১ | সংগৃহীত মাদার শ্রিম্প MBV দ্বারা আক্রান্ত কিনা | চিংড়ির বিপাকীয় বর্জ্য পদার্থ MBV এর ইনক্লসান বডি দেখা যায় |
২ | চিংড়ির ফুলকা বিকৃত, নোংরা বা অপরিচ্ছন্ন কিনা | চিংড়ির খোলস পরিবর্তন এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না |
৩ | চিংড়ির ত্বকের উপর রক্তের দাগ বা সাদা দাগ আছে কিনা | চিংড়ির খোলস পরিবর্তনে পীড়নের সৃষ্টি হয় এবং খোলস পরিবর্তনের মাধ্যমে দুর্বল চিংড়ির রূপান্তর হয় |
৪ | ইউরোপড ফোলা আছে কিনা | চিংড়ি দেহের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ লক্ষ্য করা যায় এবং আঘাতের চিহ্ন দেখা যায় |
৫ | সঠিকভাবে চিংড়ি খোলস পরিবর্তন করছে কিনা | চিংড়ির দেহাবরণীর উপর শেওলা বিদ্যমান থাকে |
৬ | চিংড়ির দেহাবরণীর উপর কালো দাগ বিদ্যমান কিনা | স্থানীয়ভাবে ব্যাকটেরিয়াদ্বারা আক্রান্ত |
৭ | চিংড়ির উপাঙ্গ বা এন্টেনা ভেঙে গেছে কিনা | ত্রুটিপূর্ণ পরিবহন পদ্ধতি বা ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা আক্রান্ত |
৮ | দেহের আকৃতি স্বাভাবিক কিনা | ডিম দেয়ার উপযুক্ত বড় আকৃতির মাদার শ্রিম্প সাধারণত বেশি ডিম দিয়ে থাকে |
৯ | দেহের বর্ণ স্বাভাবিক কিনা | উজ্জ্বল বর্ণের চিংড়ি সাধারণত রোগমুক্ত |
আরও দেখুনঃ