Site icon Fisheries Gurukul [ মৎস্য গুরুকুল ] GOLN

বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের শ্রেণিবিন্যাস

বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের শ্রেণিবিন্যাস

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের শ্রেণিবিন্যাস – যা বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ এর অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের শ্রেণিবিন্যাস

 

 

আমাদের দেশ বিপুল জলসম্পদে সমৃদ্ধ । দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পুকুর-দিঘি, ডোবা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও নদ-নদী। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় থেকে মৎস্য উৎপাদের ক্ষেত্রে বিশ্বে ৪র্থ এবং অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে ৫ম স্থান অধিকার করেছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য সম্পদ আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। প্রকৃতি অনুসারে দেশে বিদ্যমান জল সম্পদকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যথা-

১. অভ্যন্তরীণ জলসম্পদ, এবং ২. সামুদ্রিক জলসম্পদ ।

১. অভ্যন্তরীণ জলসম্পদ

আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের পরিমাণ পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয়। চীন এবং ভারতের পরেই আমাদের অভ্যন্তরীণ জলসম্পদের অবস্থান। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৪৫.৭৬ লক্ষ হেক্টর। অভ্যন্তরীণ জল সম্পদকে আবার দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় । যথা-

ক. অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, এবং খ. অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়।

ক. অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় আবহমান কাল থেকেই বিভিন্ন প্রকার মৎস্য প্রজাতিতে সমৃদ্ধ । আমাদের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে রয়েছে ২৬০ প্রজাতির দেশী মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি। অতীতে এসব উৎস হতে দেশের মোট আহরিত মাছের অধিকাংশ পাওয়া যেত । অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়কে আবার নদী ও খাড়ি অঞ্চল, হাওর ও বিল, প্লাবনভূমি এবং কাপ্তাই হ্রদ ইত্যাদি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে ।

 

নদী ও খাড়ি অঞ্চল :

অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে একটি বড় অংশ হলো নদ-নদী, মোহনা ও খাড়ি অঞ্চল । গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনাসহ অসংখ্য ছোট বড় নদ-নদী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে  প্রবাহিত। সংখ্যার দিক থেকে দেশের মোট ২৩০টি নদ-নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার। এসব নদ-নদীর মোহনা, খাড়ি অঞ্চল ও সুন্দরবনসহ এলাকার মোট আয়তন প্রায় ২৬.৩১ লক্ষ হেক্টর।

 

হাওর ও বিল :

হাওর হচ্ছে নিচু জলাভূমি, যেখানে বর্ষাকালে ৬ থেকে ৭ মাস পানি থাকে। প্রতিটি হাওড়েই বেশ কিছু বিল এবং খাল থাকে । বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ এলাকায় সর্বাধিক হাওর এবং বিলের অবস্থান ।  এসব হাওর এবং বিল মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। শুষ্ক মৌসুমে বিল ও হাওর এলাকায় প্লাবনভূমির মাছ এসে জমা হয় । ফলে এখন এসব জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায় ।

 

প্লাবনভূমি :

বাংলাদেশের কোনো কোনো বিস্তৃত এলাকা বছরে ৪ থেকে ৮ মাস পর্যন্ত কমবেশি প্লাবিত থাকে । এ সকল প্লাবিত এলাকা প্লাবনভূমি নামে পরিচিত। দেশে প্লাবনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৮.৩৩ লক্ষ হেক্টর।  এসব প্লাবনভূমি মৎস্য প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্লাবনভূমিতে বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণ রুই জাতীয় মাছের পোনার পাশাপাশি কই, শিং, মাগুর প্রভৃতি মাছ প্রাকৃতিক উপায়েই জন্মায় এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে অধিক ফসলের আশায় ধানক্ষেতে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে প্লাবনভূমিতে রুই জাতীয় ও অন্যান্য মাছের ডিম ও ডিম পোনার উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে।

দেশে বর্তমানে প্লাবনভূমিতে মাছের বার্ষিক গড় উৎপাদন প্রতি হেক্টরে মাত্র ২৮৯ কেজি। বর্তমানে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ এবং নাটোর জেলার বেশ কিছু এলাকায় বর্ষাপ্লাবিত নিচু ধানী জমিতে সমাজভিত্তিক মাছচাষ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এ ব্যাপারে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা গেলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্লাবনভূমিতে মাছচাষের ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে ।

 

কাপ্তাই হ্রদ :

কাপ্তাই হ্রদ বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাশয়, যা মাছচাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকল্পে সৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদ, যার আয়তন প্রায় ৬৮,৩০০ হেক্টর। কর্ণফুলী নদীর উপর ১৯৬১ সালে কাপ্তাই নামক স্থানে বাঁধ দেওয়ার ফলে এ হ্রদের সৃষ্টি হয় । রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা মিলে কাপ্তাই হ্রদের অবস্থান। পাহাড়ী উপত্যকা নিমজ্জিত হয়ে এ হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে এ হ্রদের তলদেশ বেশ অসমান। এ হ্রদের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৫ মিটার এবং সর্বনিম্ন গভীরতা ৯ মিটার।

জৈবিক উৎপাদনে সমৃদ্ধ বিধায় এ হ্রদ মৎস্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে । তবে হ্রদের তলদেশ বেশ অসমান এবং তলদেশে বড় বড় কাঠের গুড়ি থাকায় হ্রদের মাছ আহরণ বেশ কঠিন। বেড়জাল, ফাঁসজাল এবং বড়শি দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ থেকে মাছ আহরণ করা হয়ে থাকে । বর্তমানে এ হ্রদ হতে বাৎসরিক মাছ আহরণের পরিমাণ প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার মেট্রিক টন।

 

 

গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

খ. অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়

মৎস্য চাষের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে এসব বদ্ধ জলাশয় ব্যবহৃত হয়। হেক্টর প্রতি উৎপাদনের দিক থেকে এসব জলাশয় সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল। তবে এখন পর্যন্ত সব বদ্ধ জলাশয় আধুনিক উপায়ে মাছচাষের আওতায় আসেনি। অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়কে নিম্নবর্ণিতভাবে ভাগ করা যায়। যথা- পুকুর-দিঘি, বাঁওড় ও উপকূলীয় চিংড়ি খামার, ইত্যাদি ।

 

পুকুর-দিঘি :

দেশে প্রায় ১৯ লক্ষ পুকুর-দিঘি রয়েছে, যার আয়তন ৩.০ লক্ষ হেক্টরের কিছু বেশি। দেশের পুকুর-দিঘির অধিকাংশই গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের জন্য খনন করা হয় । এছাড়া গ্রামীণ লোকজনের বসবাসের
প্রয়োজনে ঘর-বাড়ি ও রাস্তা নির্মাণের জন্য মাটি কাটার ফলে অনেক পুকুরের সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে এসব পুকুর বা জলাশয়ে পরিকল্পিত উপায়ে মাছচাষ হচ্ছে। আবার পুকুরে মাছচাষ অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় সম্প্রতি নতুন নতুন অনেক পুকুর খনন করা হচ্ছে। ফলে দেশে বর্তমানে পুকুর ও দিঘির সংখ্যা ও আয়তন ১৯৮৪ সালে জরিপকৃত হিসাবের চেয়ে বেড়েই চলেছে। বর্তমানে পুকুর-দিঘি হতে মাছের বার্ষিক গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ২৮৩৯ কেজি।

 

বাঁওড় :

প্রবহমান নদী অনেক সময় নানাবিধ প্রাকৃতিক কারণে মূল গতিপথ পরিবর্তন করে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়। এসব রূপান্তরিত বদ্ধ জলাশয়কে বাঁওড় বলে । এদের আকৃতি অনেকটা ঘোড়ার খুরের মত বলে, এদেরকে অশ্ব-খুরাকৃতি জলাশয় বা ইংরেজিতে অক্সবো লেক (Ox-bow lake) বলে । বাঁওড় সৃষ্টির একটি বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে, ব-দ্বীপ অববাহিকার নদীসমূহ সময়ের কাল প্রবাহে পলিতে ভরাট হয়ে আসে এবং পরবর্তীতে কোন প্লাবনে ক্ষীণ ধারার নদীগুলো তার মূল গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলে।

প্রাকৃতিক দুর্বিপাক বা প্লাবনে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হলেও পূর্ববর্তী গতি ধারার গভীরতম অংশের বাঁকগুলো বদ্ধ জলাশয় হিসেবে থেকে যায়। পরবর্তীতে এ ধরনের জলাশয়গুলো বর্তমানে বাঁওড় নামে পরিচয় বহন করে। বাংলদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তর ফরিদপুর, যশোর এবং কুষ্টিয়া জেলায় ছোট বড় নানা আকারের প্রায় ৬০০টি বাঁওড় আছে। এসব বাঁওড়ের আয়তন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর। যশোর জেলার বাঁওড়ে হেক্টর প্রতি মাছের বার্ষিক গড় উৎপাদন প্রায় ৯০০ কেজি।

 

উপকূলীয় চিংড়ি খামার :

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলীয় জেলাগুলোর বিস্তীর্ণ এলাকায় আধা-লবণাক্ত পানি জোয়ার-ভাটায় ওঠানামা করে। দক্ষিণাঞ্চলের এসব জমিতে জোয়ারের পানি আটকে রেখে চিংড়ি চাষ করা হয় । উপকূলীয় এলাকার চিংড়ি খামারে এভাবে লবণাক্ত পানি আটকে রেখে চিংড়ি চাষকে ঘেরে চিংড়ি চাষ বলে। জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি যাতে ধানক্ষেতে প্রবেশ করে ধান চাষের ক্ষতি করতে না পারে এজন্য উপকূলীয় নদীর পাড় ঘেষে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণ করেছে। এসব বাঁধকে বেড়ি বাঁধ (Polder) বলে ।

বাঁধে স্থাপিত সুইচগেটের সাহায্যে চিংড়ি চাষের জমিতে জোয়ারের সময় লোনা পানি ঢুকিয়ে বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয় । বাংলাদেশের উপকূলীয় চিংড়ি খামারের আয়তন প্রায় ২.১৮ লক্ষ হেক্টর। দেশের মৎস্য সম্পদ হতে রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে চিংড়ি থেকে। বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৪২৮৩ কোটি টাকা আয় হয় এবং এর মধ্যে শুধু চিংড়ি রপ্তানি থেকে আয়ের পরিমাণ ৩৫৯৯ কোটি টাকা ।

 

 

২. সামুদ্রিক জলসম্পদ

আমাদের সামুদ্রিক জলসম্পদ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর ৪৮০ কিলোমিটার সমুদ্র উপকূল মৎস্য সম্পদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপকূল বরাবর মহীসোপানের দিকে ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকাকে একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা বলা হয় ।

যার আয়তন ১.৬৪ বর্গ কিলোমিটার। বিশাল এ সমুদ্র এলাকায় ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ২৫ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া, ১২ প্রজাতির শিরোপদী বা সেফালোপোড়া, ৩০১ প্রজাতির শামুক-ঝিনুকসহ বিভিন্ন প্রজাতির তিমি, ডলফিন, তারামাছ, স্পঞ্জ, কচ্ছপ, শৈবাল, প্রবাল ইত্যাদি বিদ্যমান। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ দেশের মোট মৎস্য সরবরাহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। দেশের বার্ষিক মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ আসে সামুদ্রিক আহরণ থেকে ।

 

আরও দেখুন:

Exit mobile version