আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় – কৃত্রিম খাদ্য, উৎস ও ব্যবহার, প্রাণিজ খাদ্য ও উদ্ভিদজাত খাদ্য
কৃত্রিম খাদ্য, উৎস ও ব্যবহার, প্রাণিজ খাদ্য ও উদ্ভিদজাত খাদ্য
কৃত্রিম খাদ্য
মাছ দেহের বৃদ্ধির জন্য খাবার গ্রহণ করে থাকে। সাধারণভাবে পুকুরে আয়তনের তুলনায় কম পারিমাণে মাছ থাকলে তাদের খাদ্যের জন্য কম প্রতিযোগিতা করতে হয়। কিন্তু মাছ চাষ বলতে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে অধিক পারিমাণে মাছ পেতে হলে বা উৎপাদন অধিক পারিমাণে পেতে হলে শুধু প্রাকৃতিক খাবারের ওপর নির্ভরশীল হলেই চলবে না। আর তাই পর্যাপ্ত পারিমাণ মাছের বৃদ্ধির জন্য বাইরে থেকে তৈরি খাবার পুকুরে প্রয়োগ করতে হয়।
অল্প জায়গায় অধিক পারিমাণে মাছের বৃদ্ধির, তথা মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাইরে থেকে যে তৈরি খাবার দেয়া হয়, তাকেই কৃত্রিম খাদ্য (artificial feed) বলে। অন্যকথায়, বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ যথাযথ মাত্রায় সংরক্ষণ করে। কারখানায় বা গবেষণাগারে যে সম্পরক খাদ্য তৈরি করা হয়, তাকেই কৃত্রিম খাদ্য বলে।
সম্প্রতি বিভিন্ন প্রজাতির এবং বিভিন্ন বয়সের মাছের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কৃত্রিম খাদ্য বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন পোনা পালনের জন্য তৈরি কৃত্রিম খাদ্য “ট্রার্টার” মজুত পুকুরে মাছ চাষের জন্য কৃত্রিম খাদ্য গ্রোয়ার, ফিনিশার ইত্যাদি।
কৃত্রিম খাদ্যের উৎস
মাছের কৃত্রিম খাদ্য তৈরির বিভিন্ন উৎস রয়েছে। প্রাণিজ এবং উদ্ভিজ্জ উৎস হতেই অধিকাংশ কৃত্রিম খাবার তৈরি করা হয়। উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত উৎসগুলো হচ্ছে সয়াবিন, গম, ভুট্টা, চাউল। সরিষার খৈল, তিলের খৈল, তুলবীজের খৈল, বিভিন্ন ধরনের শাকশবজি, ঘাস, কলাপাতা, ক্ষুদেপানা, মালঞ্চ ইত্যাদি।
আর প্রাণিজ উৎসের মধ্যে ফিশ মিল, ট্রাশ ফিশ, রেশম কীট, শামুক, কেঁচো, গবাদি পশুর রক্ত ইত্যাদি উলে-খযোগ্য। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ খাদ্য উপাদানের সংমিশ্রণেও কৃত্রিম খাদ্য তৈরি করা হয়, এসব খাদ্য দানাদার, পিলেট বা নোডিউল হিসেবে পাওয়া যায়।
কৃত্রিম খাদ্যের ব্যবহার
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আমিষের চাহিদা প রণ, আত্নকর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য অধিক পারিমাণে মাছের উৎপাদন অতীব প্রয়োজন। আর অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদনের জন্য নিবিড় মাছ চাষ প্রয়োজন। নিবিড় মাছ চাষের ক্ষেত্রে কৃত্রিম খাবারের কোন বিকল্প নেই।
নিবিড় মাছ চাষ পদ্ধতিতে কম জায়গায় বেশি ঘনত্বে মাছ চাষ করা হয়। বিধায় সম্পূর্ণ রূপে কৃত্রিম খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। সুতরাং বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম খাদ্যের ব্যবহার অপরিহার্য। কৃত্রিম খাদ্য ব্যবহারের বেশ কতগুলো সুবিধাজনক দিক রয়েছে যেমন-
- কত্রিম খাদ্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদান একটি অন্যটির পরিপ রক হিসেবে কাজ করে। ফলে খাদ্যের ব্যবহার উপযোগিতা বৃদ্ধি পায় ও সুষম পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত হয়।
- যেসব খাদ্য উপাদান এককভাবে মাছ অপছন্দ করে সেগুলো অন্য অপছন্দনীয়, উপাদানের সাথে মিশিয়ে মাছের খাদ্যের উৎসের বিস্তৃতি ঘটানো যায়।
- বাইন্ডার ব্যবহারের ফলে খাদ্যদ্রব্য পানিতে সহজে গলে যায় না, ফলে অপচয় কম হয়।
- খাদ্য দ্রব্যের সাথে ঔষধ ব্যবহার করে মাছের রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
- কৃত্রিম খাদ্যের পরিবহণ ও সংরক্ষণ সুবিধাজনক।
প্রাণিজ খাদ্য
উদ্ভিজ্জ খাদ্য উপাদানের তুলনায় প্রাণিজ খাদ্যের পুষ্টিমান বেশি। প্রাণিজ খাদ্যে অধিক পরিমাণে আমিষ থাকে এবং প্রাণিজ আমিষ অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডে সমৃদ্ধ। প্রাণিজ খাদ্য সুষম পুষ্টি সরবরাহ করে মাছের দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। ফিশ মিল, বাজে মাছ (trash fish), রেশম কীট, শামুক, কেঁচো, গবাদি পশুর রক্ত ইত্যাদি মাছের প্রাণিজ খাদ্য।
সমুদ্রে মাছ ধরার সময় এমন অনেক মাছ ধরা পড়ে যেগুলো সাধারণত মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। এসব মাছকে শুকিয়ে গুড়া করে ফিশ মিল অথবা কাঁচা অবস্থায় ছোট ছোট টুকরা করে পিলেট তৈরি করা যায়। ফিশ মিলে ৫০-৬০ শতাংশ আমিষ থাকে। ফিশ মিল মাছের উত্তম সম্পরক খাদ্য। রেশম কীটের শুরু মাংসাশী মাছ সরাসরি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। রেশম কীটে ৪৯ শতাংশ আমিষ থাকে।
রেশম কীটের শুরু শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। শামুক-ঝিনুকের মাংসালো অংশ মাংসাশী ও রাক্ষুসে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শামুকের মাংসে ১৫-২০ শতাংশ আমিষ থাকে। প্রতিদিন যেসব গবাদি পশু জবাই করা হয় সেগুলোর রক্ত পরিত্যক্ত অবস্থায় নষ্ট হয়ে যায়। এসব রক্ত হিমায়িত করে বা শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়।
গবাদি পশুর রক্ত সরাসরি অথবা চালের কুঁড়া, গমের ভূষি ইত্যাদির সংগে মিশিয়ে শুকানো যেতে পারে। পশুর রক্ত মাছের উত্তম খাদ্য। শুকনো রঙে ৮২ শতাংশ আমিষ থাকে। শুকনো রক্ত অন্য উদ্ভিদ খাদ্যের সাথে মিশিয়ে মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে।
উদ্ভিদজাত খাদ্য
নিচে প্রধান প্রধান কয়েকটি উদ্ভিজ্জ খাদ্য প্রব্যের বর্ণনা দেওয়া হলো-
দানাদার খাদ্য
বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সয়াবিন, গম, ভূট্টা, চাউল ইত্যাদি ভেঙ্গে মাছকে খাওয়ানো যায়। সয়াবিনে প্রায় ৩৮ শতাংশ আমিষ থাকে। সয়াবিন ভাল করে গুড়া করে। পোনা মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সয়াবিন মাছের দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
গম ও ধানের ভাঙ্গা দানা প্রজননক্ষম গ্রাসকার্পের সম্পূরক খাদ্য হিসেবে খুবই উপযোগী। এসব দানায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভিটামিন ‘ই’ থাকে, যা মাছের গোনাডকে পরিপক্ক করে। গমের আটা দানাদার খাদ্যের বাইন্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
খৈল
বিভিন্ন ধরনের তৈলবীজ থেকে তেল সংগ্রহের পর যে উপজাত থাকে তাকেই থৈল বলে। সরিষার খৈল, তিলের খৈল, তুলাবীজের খৈল ইত্যাদি মাছের সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খৈল-এ সাধারণত ৩০-৪০ শতাংশ আমিষ থাকে। আমাদের দেশে সরিষার খৈল মাছের প্রধান সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। খৈলের মিহি গুড়া পোনা মাছের উত্তম খাদ্য।
কুঁড়া ও ভূষি
চাউলের কুঁড়া ও গমের ভূষি মাছের সম্পূরক খাদ্য হিসেবে বহুল প্রচলিত। কুঁড়া ও ভূষিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘বি’ এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমিষ, তৈলদ্রব্য ও শর্করা থাকে। এগুলো মাছের দ্রুত ও সুষম বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
সবুজ ঘাস
কিছু সংখ্যক জলজ ও স্থলভাগের তৃণজাতীয় উদ্ভিদকে মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। সবুজ ঘাস প্রধানত গ্রাসকার্পকে সম্পূরক খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। অনেক সময় তেলাপিয়াও সবুজ ঘাস খেয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের শাকশবজি, ঘাস, কলাপাতা, কচুরিপানা, ক্ষুদেপানা, কলমিলতা, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ ইত্যাদি সম্পূরক খাদ্য হিসেবে মাছকে দেওয়া যায়। সবুজ উদ্ভিদ সেলুলোজ ও ভিটামিনে সমৃদ্ধ। এছাড়া সবুজ উদ্ভিদে তৈলদ্ৰব্য, আমিষ এবং শর্করাও অল্প পরিমাণে থাকে।
আরও দেখুন :