আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-চাইনিজ কার্পের প্রণোদিত প্রজনন
চাইনিজ কার্পের প্রণোদিত প্রজনন
সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ও বিগহেড কার্পকে চাইনিজ কার্প বলা হয় । আমাদের দেশি অর্থাৎ রুই, কাতলা, মৃগেল মাছের মতো চাইনিজ কাপও পুকুরে ডিম দেয়না । তাই হ্যাচারিতে এদের প্রণোদিত প্রজনন করা হয় । ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চাইনিজ কার্প-এর প্রণোদিত প্রজনন করা যায় । সিলভার কার্প বিগহেড কার্প ও গ্রাস কার্প-এর প্রণোদিত প্রজননের উল্লেখযোগ্য ধাপসমূহ এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১। ব্রুড মাছ সংগ্রহ :
i) প্রাকৃতিক উৎস থেকে অর্থাৎ নদ-নদী বা প্লাবন ভূমি প্রভৃতি থেকে বন্য জাতের রুই জাতীয় মাছ সংগ্রহ করা হয় ।
ii) হ্যাচারিতে দ্রুত বর্ধনশীল পোনা সংগ্রহ করে ।
iii) ব্রুড ব্যাংক হতে ব্রুড সংগ্রহ করে ।
iv) এক হ্যাচারি থেকে অন্য হ্যাচারিতে ব্রুড আদান-প্রদান অর্থাৎ ব্রুড বিনিময় করে ।
২। ব্রুড মাছ পালন :
i) ব্রুড মাছ মজুদের পূর্বেই মজুদ পুকুরটি শুকিয়ে প্রয়োজনীয় মেরামত করে অতিরিক্ত কাদা সরিয়ে ফেলতে হবে । শতাংশপ্রতি ১-১.৫ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে । প্রতি শতাংশে ৫-৭ কেজি গোবর, টি এস পি ২০০ গ্রাম ও ইউরিয়া ১০০ গ্রাম হারে প্রয়োগ করে ব্রুড মাছ মজুদ কাজ সম্পন্ন করতে হবে ।
ii) মজুদ ঘনত্ব সঠিক মাত্রায় অর্থাৎ প্রতি শতাংশে ৬-৮ কেজি হলে ভালো হয় । মজুদকালে পুকুরের তিনটি স্তরের মাছই মজুদ করলে খাদ্যের অপচয় হয় না। সুযোগ থাকলে প্রজাতি অনুযায়ী বা পুরুষ ও স্ত্রী মাছ আলাদা পুকুরে পালন করলে ভালো ফল পাওয়া যায় ।
iii) প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি মাছের দেহ ওজনের ৩%-৫% হারে ২০%-২৫% আমিষ যুক্ত উন্নত মানের খাদ্য দৈনিক ২ বার প্রয়োগ করতে হবে । গ্রাস কার্পের জন্য নরম ঘাস, ক্ষুদিপানা, তরিতরকারির বর্জ্যপাতা কুচিকুচি করে কেটে মাছের দৈহিক ওজনের শতকরা ২০-২৫ ভাগ দৈনিক পুকুরে দেওয়া আবশ্যক ।
iv) ব্রুড মাছের রোগ-বালাই যাতে না হয় সে জন্য মাঝে মাঝে জাল টেনে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে ।
৩। ব্রুড বাছাইকরন :
যথেষ্ট সংখ্যক ব্রুড থেকে প্রজননের জন্য ব্রুড বাছাই করতে হবে। সাধারণত সিলভার ও বিগহেড কার্পের জন্য দুই বছরের বেশি বয়সের এবং দুই কেজির উপর ওজন এমন ব্রুড প্রণোদিত প্রজননের জন্য উত্তম । তবে গ্রাস কার্প তিন কেজি বা তার চেয়ে বেশি হলে ভালো। সকালের দিকে ব্রুড পুকুরে জাল টেনে একটা একটা করে মাছ হাতে ধরে বাছাই করা হয় ।
সব মাছ একত্রে পরিপক্ক হয় না তাই অধিকতর উপযুক্ত ব্রুডগুলোকে আগে প্রজননের জন্য বাছাই করা হয় । স্ত্রী মাছের পেট স্ফীত ও নরম হয়, পায়ুপথ কিছুটা উদগত ও স্ফীত । পুরুষ মাছের পেট চিকন । পেটে হালকা চাপ দিলে মিল্ট বের হয়ে আসে । গ্রাস কার্প মাছের পেটে পর্যাপ্ত ঘাস থাকে তাই এদের স্ত্রী মাছের পরিপক্বতা নির্ণয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন । সিলভার ও বিগহেড কার্প নরম প্রকৃতির মাছ । তাই জালের ঘষা লেগে যাতে মাছ আহত না হয় সেদিকে বিশেষ সতর্ক থাকা দরকার ।
৪। হরমোন প্রয়োগ
চাইনিজ কার্প মাছের প্রণোদিত প্রজননে হরমোন হিসেবে পিজি ও এইচসিজি দুটোই ব্যবহার করা যায় । তবে কেউ কেউ শুধুমাত্র এইচসিজি দিয়েই প্রজনন করান আবার কেউ কেউ পিজি ও এইচসিজি একত্রে প্রয়োগ করেন। পিজি ব্রুড মাছের শরীরের ওজন অনুপাতে মি. গ্রাম মাত্রায় প্রয়োগ করা হয় । পক্ষান্তরে এইচসিজি ব্রুড মাছের শরীরের ওজন অনুসারে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট (International Unit বা IU) মাত্রায় ব্যবহার করা হয় ।
৫। হরমোন মাত্র
চাইনিজ কার্প জাতীয় মাছে পিজি ও এইচসিজি উভয় প্রকার হরমোনই ব্যবহার করা হয়। মাছের প্রজনন অঙ্গের পরিপক্বতা ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে হরমোন মাত্রায় কম বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া একজন অভিজ্ঞ মৎস্য প্রজননকারী তার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ অনুসারে হরমোনের মাত্রার কার্যকরী ডোজ ঠিক করে নিতে পারেন ।
পরবর্তী ছকে চাইনিজ কার্প জাতীয় মাছের প্রজাতি অনুযায়ী হরমোনের মাত্রা দেওয়া হলো :
৬। দ্রবণ তৈরি :
প্রজননের জন্য বাছাই করা মাছের স্ত্রী ও পুরুষ মাছের প্রজাতি অনুসারে সংখ্যা ও ওজন একটা খাতায় লিখে রাখতে হবে। এবারে ওজন অনুযায়ী পিজি ও এইচসিজি দ্রবণ তৈরি করে নিতে হবে। পিজি দ্রবণ তৈরির পদ্ধতি ইতিমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। এইচসিজি পাউডার আকারে কাচের ভায়ালে বা কাগজের প্যাকেটে প্যাক করা থাকে এবং হরমোনের পরিমাণ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিটে লেখা থাকে। এইচসিজি পাউডার ডিস্টিলড ওয়াটারে দ্রবীভূত করে সেন্ট্রিফিউজে থিতিয়ে নেয়া হয়। থিতানো দ্রবণ ইনজেকশনের জন্য ব্যবহার করা হয় ।
৭ । ইনজেকশন দেওয়ার পদ্ধতি :
চাইনিজ কার্প জাতীয় মাছকে মাংসপেশির ভিতর ইনজেকশন দেওয়া হয়। সূক্ষ্ম সুচ ব্যবহার করে পৃষ্ঠ পাখনার নিচে মাংসপেশিতে বা লেজে ইনজেকশন দেওয়া হয়। হরমোন দ্রবণ এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে প্রতি কেজি মাছের দেহে ০.২ থেকে ০.৩ মি.লি. এর বেশি দ্রবণ প্রবেশ না করে । অনেক সময় ইনজেকশন দেওয়ার আগে মাছকে অবচেতন করে নেয়া হয়।
অবচেতন করার জন্য এমএস ২২২ বা কুইনালডিন ব্যবহার করা হয় । ব্রুড মাছ বাছাইয়ের পর হ্যাচারির পানিতে ৬-৭ ঘণ্টা খাপ খাওয়ানোর পর প্রথম ইনজেকশন দেওয়া হয়।
এই কার্যক্রম এমনভাবে শুরু করা হয় যাতে সকালে ঠাণ্ডার মধ্যে জাল টানার কাজ হয়ে যায়। মাছের বিশ্রামের পর ইনজেকশনের সময় এমন ভাবে নির্ধারণ করা হয় যাতে গভীর রাতে কষ্ট করে জাগতে না হয় । ইনজেকশন দেওয়ার সময় হ্যাচারিতে অন্তত তিনজন কর্মীর উপস্থিত থাকা প্রয়োজন ।
৮। প্রজনন পদ্ধতি :
চাইনিজকার্প সহজাত পদ্ধতিতে প্রজনন করে না এজন্য সর্বদা এদের পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে পৃথক পৃথক চৌবাচ্চায় রাখা হয় । সর্বশেষে ইনজেকশন দেওয়ার পর ৬-৭ ঘণ্টার মধ্যে স্ত্রী মাছের দুই একটা ডিম বেরুতে শুরু করে। ডিম বেরুতে থাকলেই বুঝাতে হবে ওভুলেশন এর সময় হয়েছে। ওভুলেশন হচ্ছে স্ত্রী মাছের ডিম্বাশয়ের ডিমগুলো পূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হওয়া এবং ডিমগুলো সব আলাদা আলাদা হয়ে মাছের জননেন্দ্রিয় দিয়ে সামান্য চাপে বের হয়ে আসার অবস্থা।
ঠিকমতো ওভুলেশন হলে স্ত্রী মাছকে সাবধানে ধরে প্লাস্টিকের গামলায় স্ট্রিপিং করে ডিম সংগ্রহ করা হয় । একইভাবে পুরুষ মাছকে ধরে পেটে চাপ দিয়ে সংগৃহীত ডিমের উপর শুক্র মিন্ট সংগ্রহ করা হয়। পাখির পালক দিয়ে ডিমের সাথে শুক্র ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এবারে অল্প অল্প করে পানি মিশিয়ে ডিম নাড়াচাড়া করে ডিম ধুয়ে ফেলতে হবে।
এভাবে ৩-৪ বার ধুয়ে ফেলার ফলে অতিরিক্ত শুক্রাণু পানির সাথে চলে যায়। এভাবে ধুয়ে ফেলার পর আধা ঘণ্টা পর্যন্ত ডিমগুলো পরিষ্কার পানির মধ্যে রেখে দিতে হয়। স্ট্রিপিং করার সময় মাছ ধরা ও আনার কাজের জন্য অন্তত তিন জন কর্মী থাকা দরকার । অনেকে স্ট্রিপং করার সময় মাছকে অবচেতন করে থাকে । স্ট্রিপিং পদ্ধতিতে ডিম বেশি পাওয়া যায় এবং ভালো ভাবে নিষিক্ত হয় ফলে রেণু বেশি উৎপন্ন হয় । ২-৩ বছর বয়সের ২-৫ কেজি ওজনের সিলভার কার্পের স্ত্রী ব্রুড থেকে গড়ে প্রতি কেজি দেহ ওজনের ১৫০০০০-৩০০০০০টি ডিম পাওয়া যায় । ২-৩
বছরের ৩-৭ কেজি ওজনের বিগহেড কাপের স্ত্রী ব্রুড থেকে প্রতি কেজি দেহ ওজনের জন্য ১০০০০০ – ১২৫০০০ টি ডিম পাওয়া যায় । ২-৩ বছরের ১.৫-৪ কেজি ওজনের গ্রাস কার্প থেকে প্রতি কেজি দেহ ওজনে ৪৫০০০ – ১১৫০০০টি ডিম পাওয়া যায় ।
৯। ডিম ফুটানো
নিষিক্ত ডিম পানিতে ভিজে ফুলে বড় বড় হয়ে যায়। এবারে নিষিক্ত ডিমকে ১-১.৫ কেজি হারে প্রতিটি হ্যাচিং জারে স্থানান্তর করা হয়। প্রথম ঘণ্টা দুয়েক পানিপ্রবাহের মাত্রা প্রবাহপ্রতি মিনিটে ১১-১৫ লিটার রাখা হয়। এরপর ৮-১০ ঘণ্টা সময় হ্যাচিং জারে পানির প্রবাহ একটু কমিয়ে দিতে হবে। এ সময়ে ডিমের মধ্যে ভ্রূণ ক্রমে বৃদ্ধি লাভ করে এবং ডিমের মধ্যে মোচড় দিয়ে নড়াচড়া করে ।
ভ্রূণের বৃদ্ধি লাভ পানির তাপমাত্রার সাথে কম-বেশি হয় । সাধারণত ২৭° সে. – ৩০° সে. তাপমাত্রায় নিষিক্ত হওয়ার ১২-১৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে রেণু বের হয় । রেণু ফুটে বের হলে আবার পানির প্রবাহ বাড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে ডিমের খোসা ও অনান্য দূষিত পদার্থ সহজে ধুয়ে যেতে পারে। সব ডিম ফুটে গেলে এবং যাবতীয় ময়লা ও ডিমের খোসা পরিষ্কার হয়ে গেলে পানি-প্রবাহের মাত্রা কমিয়ে মিনিটে ৭-৮ লিটার করা হয়। এ ভাবে আরও ২০-৩০ ঘণ্টা পর্যন্ত রেণু কে হ্যাচিং জারে রেখে দেওয়া হয় ।
আরও দেখুন: