আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-পিটুইটারি গ্রন্থি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
পিটুইটারি গ্রন্থি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
প্রাকৃতিক পরিবেশে মাছ পরিপক্বতা লাভ করে ও ডিম দেয়। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের প্রজনন ক্ষেত্রসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে । হরমোন প্রয়োগে মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা হচ্ছে। কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহৃত হরমোন বিভিন্ন উৎস হতে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে মাছের পিটুইটারি গ্রন্থি অন্যতম উৎস। পিটুইটারি গ্লান্ড বা গ্রন্থিকে সংক্ষেপে পিজি (PG) বলা হয় ।
পিজি সংগ্রহের জন্য মাছ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়সমূহ : পিটুইটারি গ্রন্থি সংগ্রহের পূর্বে যে মাছ থেকে সংগ্রহ করা হবে সে মাছ সম্বন্ধে কিছু কিছু তথ্য জেনে নিতে হবে ।
দাতা মাছের বৈশিষ্ট্য :
যে মাছ থেকে পিটুইটারি গ্রন্থি সংগ্রহ করা হয় তাকে দাতা মাছ বলে। ব্রুড মাছকে প্রজননে প্রণোদিত করার ক্ষমতা অনেকাংশে দাতা মাছ নির্বাচনের উপর নির্ভরশীল। আর সে কারণেই দাতা মাছ সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্য জানতে হবে ।
ক) দাতা মাছের পরিপক্বতার ধাপ (Stage of maturity of the donor fish) :
কৃত্রিম প্রজননের জন্য সম্পূর্ণ যৌন পরিপত্ত্ব মাছ থেকে পিজি সংগ্রহ করতে হবে কারণ প্রজনন ঋতুতে একটি প্রজননক্ষম মাছের পিজি সব চাইতে বেশি কার্যকর বা কর্মক্ষম । প্রজননের পরে পিজির কার্যক্ষমতা কমে যায় । যে মাছ ডিম ছেড়ে দিয়েছে বা মাছের যৌনতা পরিপক্বতা নয় সে মাছের পিজির ক্ষমতা খুবই কম। দেশি কার্প জাতীয় মাছ যেমন রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদির পিজি মে-জুলাই মাসের মধ্যে সংগ্রহ করলে অধিক শক্তিশালী পিজি পাওয়া যায়। কমন কার্প বা কার্পিও মাছ একটি উল্লেখযোগ্য দাতা মাছ কারণ এরা প্রায় সারা বছর যৌন পরিপq থাকে। এ মাছে পিজির আকারও তুলনামূলকভাবে বড়।
খ) দাতামাছের অবস্থা (Condition of donor fish ) :
জীবিত বা সদ্য মেরে ফেলা হয়েছে এরকম মাছ থেকে পিজি সংগ্রহ করা অধিক ভালো । তাজা জীবিত মাছ অপর্যাপ্ত হলে যে সকল মাছ তাজা অবস্থায় কোল্ড স্টোরেজ রাখা হয়েছিল সে রকম মাছ থেকেও পিজি সংগ্রহ করা যাবে । যে মৃত মাছকে ১-৩° সে. তাপমাত্রায় ২৫ ঘণ্টা রাখা হয়েছিল সে রূপ মাছ থেকে কার্যকর পিজি সংগ্রহ করা যায় ।
গ) পিজির উৎস (Source of pituitary gland) :
পুরুষ অথবা স্ত্রী যে কোনো মাছ থেকেই পিজি সংগ্রহ করা যায়। যে মাছের পিজি ব্যবহার করা হবে ঐ একই প্রজাতির মাছ থেকে সংগৃহীত পিজি বেশি কার্যকর। একই প্রজাতির না হলেও সমগোত্রীয় যে কোনো মাছ থেকে ও পিজি সংগ্রহ করা যেতে পারে। এমনকি মাছ ছাড়াও অন্যান্য শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণীর পিজি ও মাছে প্রজননের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
ক্যাটফিশ বা মাগুর জাতীয় মাছের পিজি কার্প জাতীয় মাছের প্রজননে ব্যবহার করা যেতে পারে আবার তার বিপরীত ভাবেও সম্ভব। দূরসম্পর্কীয় মাছ থেকে সংগৃহীত পিজির ইনজেকশনের ভোজ বা মাত্রা একটু বাড়িয়ে দিতে হয় ।
পিজি সংগ্রহ পদ্ধতি :
পিটুইটারি গ্রন্থি সংগ্রহের জন্য মাছকে উপুড় করে অর্থাৎ পিঠ উপরে ও পেট নিচ অবস্থায় ধরে রাখতে হবে। এজন্য কাঠের ফ্রেম ব্যবহার করা যেতে পারে। মাথার খুলির কিছু অংশ উপর থেকে হাত করাত দিয়ে কেটে ফেলতে হবে। ছোট মাছের ক্ষেত্রে হাড় কাটার (bone cutter) দিয়েও খুলি তুলে ফেলা যায় । খুলি তুলে ফেলতেই মস্তিষ্কের উপর ধূসর চর্বি জাতীয় পদার্থ দেখা যাবে।
তুলা দিয়ে ধূসর পদার্থ পরিষ্কার করতে হবে। ইহাতে মস্তিষ্কের উপর পৃষ্ঠ পরিষ্কারভাবে দেখা যাবে। মস্তিষ্কের সামনের দিকে অবিস্থত অলফ্যাকটরি (নাসিকা) নার্ভ ও অপটিকা (চক্ষু) নার্ভ চিমটা দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। এখন মস্তিষ্কটিকে উঠিয়ে পিছনের দিকে ফেলে দিতে হবে। পিজি মস্তিষ্কের নিচের অপটিক কায়জমার (দুটি চক্ষু স্নায়ু একে অপরের বিপরীতে দিতে চলে যায় ফলে সেগুলো এক জায়গায় মিলিত হয়।
যাকে অপটিক কায়জমা বলে) পিছনে অপস্থিত। কোনো কোনো মাছের ক্ষেত্রে পিজি মস্তিষ্কের সাথে লেগে থাকে ফলে মস্তিষ্ক উঠানোর সময় ব্রেইনের সাথে পিজি ও উঠে আসে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মস্তিষ্ক উঠালে পিজি তার অবস্থানেই থেকে যায়। কার্প জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে পিজি একটি পাতলা পর্দা দ্বারা মস্তিষ্ক থেকে পৃথক থাকে ।
সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে মস্তিষ্ক ওঠানোর সময় পর্দাসহ পিজি ব্রেইনের সাথে মিশে না যায়। চিমটা দিয়ে পর্দাটি সাবধানে পিছনের দিকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এর ফলে পিজি উন্মুক্ত হবে পিজিটিকে সুক্ষ্ম চিমটা বা সুচের সাহায্যে খুব সাবধানে গর্ত থেকে তুলে কোনো পেট্রিডিশে ১০০% ইথানলে রাখতে হবে। পিজিটিকে অক্ষত রেখে এর গায়ে লেগে থাকা মাংসপেশি বা রক্ত পরিষ্কার করতে হবে। ক্ষতপ্রাপ্ত পিজির কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়।
বাণিজ্যিকভাবে এক সময়ে অনেক বেশি সংখ্যক মাছের মাথা থেকে পিজি সংগ্রহর জন্য বিদ্যুৎচালিত করাত ব্যবহার করা সুবিধাজনক। গর্ত করার জন্য গোলাকার করাত দিয়ে মাছের মাথার খুলির নির্দিষ্ট অংশ কেটে বের করে আনা হয় । মাছের মাথার সঠিক জায়গায় গর্ত করার সুবিধার জন্য একটি তক্তায় আগে ছিদ্র করে নিতে হয় ।
মাছের মাথাকে আটকাবার জন্য কাঠের ফ্রেম ব্যবহার করা হয়। ফ্রেমে মাছের মাথা রেখে ছিল করা তক্তা মাথার উপর চেপে ধরে তক্তার ছিদ্র অনুসারে বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে গর্ত করলে মাথার খুলি পিজিসহ গোলাকার টুকরা আকারে উঠে আসে। করাতের সাহায্যে মাছের মাথা হতে পিজি বের করে আনার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বড় মাছের জন্য বড় আকারের করাত এবং ছোট মাছের জন্য ছোট আকারে করাত ব্যবহার করা হয় ।
এক কেজি ওজনের মাছের জন্য ২.৫ সে.মি., ৩-৪ কেজি ওজনের মাছের জন্য ৪ সে.মি. এবং ৫-৬ কেজি ওজনের মাছের জন্য আরও বড় আকারের গোলাকার করাত ব্যবহার করা হয় । গোল করে কাটা টুকরা থেকে সহজেই কাঁচি ও চিমটা ব্যবহার করে পিজি পৃথক করা যায় ।
পিজি সংরক্ষণ :
পিজি অথবা পিজির নির্যাস কার্যকারিতাসহ বিভিন্ন সময়ের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। পিজি সংরক্ষণের জন্য
তিনটি প্রধান পদ্ধতি নিম্নে বর্ণিত হলো:
১. এবসোলিউট অ্যালকোহলে সংরক্ষণ
২. এসিটোন সংরক্ষণ
৩. তড়িৎ ফ্রিজিং-এর মাধ্যমে সংরক্ষণ
১) এবসোলিউট (১০০%) অ্যালকোহলে পিঞ্জি সংরক্ষণ :
পিজি সংগ্রহের সাথে সাথে এবসোলিউট অ্যালকোহলে রাখতে হয়। প্রতিটি গ্রন্থি শনাক্তকারী চিহ্নসহ আলাদা আলাদা ভায়াল (Vial) এ রাখতে পারলে ভালো হয়। তবে বেশি ভায়াল না থাকলে একসাথে রাখা যায় । ২৪ ঘণ্টা পর গ্রন্থি এবসোলিউট অ্যালকোহলে ধুয়ে আবার নতুন অ্যালকোহলে কোনো ঠাণ্ডা এবং ছায়াযুক্ত জায়গায় কক্ষ তাপমাত্রায় অথবা রেফ্রিজারেটরে ব্যবহার করার পূর্ব পর্যন্ত রাখতে হবে।
ভায়ালের মুখ অবশ্যই নিশ্চিদ্রভাবে বন্ধ করে দিতে হবে । ভায়ালে জলকণা প্রবেশ রোধকল্পে এগুলোকে একটি ডেসিকেটরে (Desiccator) রাখা যায় যেখানে পানিগ্রাহী পদার্থ যেমন ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড আছে। ডেসিকেটর কোনো ঠাণ্ডা কক্ষে অথবা রেগ্রিজারেটরে রাখাই উত্তম। এবসোলিউট অ্যালকোহল পিজিকে পানিশূন্য ও চর্বিমুক্ত করে ১০০% বিশুদ্ধ অ্যালকোহলে ব্যবহার করতে হবে কারণ হরমোন পানিতে দ্রবণীয়। দীর্ঘ সময়ের জন্য পিজি সংরক্ষণ করতে গেলে অ্যালকোহল মাঝে মধ্যে পরিবর্তন করে নতুন অ্যালকোহল নিতে হবে।
(২) এসিটোন পিজি সংরক্ষণ
এসিটোনেও পিজি সংরক্ষণ করা যেতে পারে তবে এতে রেফ্রিজারেটরের প্রয়োজন হয়। তাই যেখানে রেফ্রিজারেটরের নেই সেখানে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় না ।
মাছের মাথা থেকে পিজি সংগ্রহের সাথে সাথেই একে বিশুদ্ধ এসিটোন বা বরফশীতল এসিটোন রাখা হয় । ভায়ালগুলোতে এরপর কোনো রেফ্রিজারেটরে ৩৬-৪৮ ঘন্টার জন্য রাখা হয় । সম্পূর্ণ পানিশূন্য ও ফ্যাটশূন্য করার জন্য এ সময়ের মধ্যে ৮-১২ ঘণ্টার পর পর এসিটোন পরিবর্তন করতে হবে। এরপর পিজিকে ভায়াল থেকে বের করে ফিল্টার কাগজে শুকানো হয় এবং ওজন করে অন্য একটি স্টেরাইল ভায়ালে এসিটোন দিয়ে স্থানান্তর করা হয় । ভায়ালটিকে পরে রেফ্রিজারেটর ব্যবহার পূর্ব পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায় ।
৩) ত্বরিত ফ্রিজিং-এর মাধ্যমে পিজি সংরক্ষণ :
সদ্য সংগৃহীত পিজি সরাসরি ডিপফ্রিজে সংরক্ষণ করা যেতে পারে ।
সতর্কতা:
i) শুধুমাত্র পরিপত্ত্ব মাছ থেকেই গ্রান্ড সংগ্রহ করা উচিত।
ii) পচনশীল মাছ থেকে গ্রান্ড সংগ্রহ করা উচিত নয় ।
iii) গ্লান্ড সাবধানে তুলে আনতে হবে যাতে পিজি না ছিঁড়ে যায় ।
iv) গ্লান্ড কোনোভাবেই যেন পানির সংস্পর্শে না আসে।
প্রশ্নমালা-৩
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. পিজি কী?
২. পিজি কোথায় থাকে?
৩. পিজিতে কোন হরমোন থাকে?
৪. পিজি দ্রবণ থিতানোর জন্য কী যন্ত্র ব্যবহার
৫. পিজি কীভাবে সংরক্ষরণ করা হয়?
করা হয়?
৬. পিজি পেষার জন্য কী যন্ত্র ব্যবহার করা হয় ?
৭. পিজি চর্বিযুক্ত করার জন্য কী কী ওষুধ ব্যবহার করা হয়?
৮. অ্যালকোহলে সংরক্ষিত পিঞ্জি কত দিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়?
৯. এবসলিউট এলকোহল বলতে কী বুঝায়?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. পিটুইটারি গ্রন্থি সংগ্রহের জন্য মাছ নির্বাচনে কী কী বিষয় বিবেচনা করা হয়?
২. পিজি সংরক্ষণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
৩. পিজি দ্রবণ তৈরি সম্পর্কে লেখ ।
৪. পিজি সংগ্রহের ক্ষেত্রে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়?
৫. প্রণোদিত প্রজননে হরমোনের ভূমিকা কী?
বর্ণনামূলক প্রশ্ন
১. পিজি সংগ্রহ পদ্ধতি বর্ণনা কর?
২. পিজি সংরক্ষণ পদ্ধতি বর্ণনা কর?
আরও দেখুন: