আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – পানি ব্যবস্থাপনা। যা ” পুকুরে গলদা চিংড়ি পোনা মজুদোত্তর ব্যবস্থাপনা ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
পানি ব্যবস্থাপনা
পানি ব্যবস্থাপনা
পানির গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় বজায় রাখা চিংড়ি চাষের সফলতার অন্যতম মূল চাবিকাঠি। সাধারণত পানি ব্যবস্থাপনা তথা পানির গুণাগুণ বজায় রাখার প্রধান কারণ হচ্ছে চিংড়ির বেঁচে থাকার হার বাড়ানো এবং দৈহিক বৃদ্ধি। পুকুরের পানির ভালো অবস্থা বলতে সাধারণত পানিতে পরিমিত অক্সিজেন ও অত্যন্ত কর্ম বর্জ্যের (Metabolites) পুঞ্জীভূত হওয়াকে বুঝায়।
এই বর্জ্যের উৎস হচ্ছে চিংড়ির পায়খানা, অভুক্ত খাদ্য, শেওলা এবং অন্যান্য অণুবীক্ষণিক জীব। চিংড়ি চাষ কালের তৃতীয় মাসে ভুরু খাদ্যের প্রায় ৩০% এবং চতুর্থ মাসে বা শেষ প্রাপ্তিকে প্রায় ৫০% বর্জ্য হিসেবে পুকুরের তলায় জমা হয়। এর ফলে ক্ষতিকর শেওলার উৎপাদন ত্বরান্বিত হয় এবং একটি পর্যায়ে এসব ক্ষতিকর শেওলা মারা গিয়ে পানি দূষিত করে তােেল।
ফলে চিংড়ির স্বাভাবিক জীবনযাপন এবং দৈহিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই পানির গুণগতমান বজায় রাখার উত্তম পদ্ধতি হলো নিয়মিতভাবে পুকুরের পানি পরিবর্তন করা। এর ফলে পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ বজায় থাকে, বিষাক্ত
বর্জ্য পদার্থ, অতিরিক্ত শেওলা ইত্যাদি দূরীভূত হয় এবং নতুন পানির সাথে নতুন পুষ্টিকর পদার্থসমূহ পুকুরে সঞ্চালিত হয়। চিংড়ি পোনা মজুদের পর এক সপ্তাহ। কোন পানি পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয় না।তবে প্রথম মাসে অমাবস্যা, পূর্ণিমার সময় একবার বা দুইবার পানি পরিবর্তন করা ভাল।
চিংড়ি চাষের পুরা েসময়ে পানে মজুদের ঘনত্ব, পানির গুণগতমান, লবণাক্ততা, প্যাংকটনের ঘনত্ব, দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, রোগের প্রাদুর্ভাব, খাদ্য প্রয়োগের পদ্ধতি ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে পানি পরিবর্তনের মোট পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত প্রত্যেকবার পানি পরিবর্তন করা হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ মাসে ৩-৫ দিন অন্তর পানি পরিবর্তন করা হয়। অনেক সময় প্রয়োজনানুসারে প্রতিদিন ১০% পানি পরিবর্তন করা হয়। নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে প্রতিদিনই ৩০% পানি Flow through পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা হয়।
পুকুরে চিংড়ির দেহের মোট ওজন অনুসারে প্রতিদিন কি পরিমাণ পানি পরিবর্তন করা উচিত তার তালিকা নিচে দেয়া হলোঃ
চিংড়ির মোট ওজন/ বর্গমিটার | প্রতিদিন পানি পরিবর্তরেন পরিমাণ |
২ গ্রামের কম | ০ |
২-১০ গ্রাম | ২ |
১০-২০ গ্রাম | ৩ |
২০-৪০ গ্রাম | ৫ |
৪০-৬০ গ্রাম | ৭ |
৬০-৮০ গ্রাম | ৯ |
৮০-১০০ গ্রাম | ১২ |
১০০-১২০ গ্রাম | ১৫ |
১২০-১৪০ গ্রাম | ১৮ |
১৪০ গ্রামের বেশি | ২০% এর বেশি |
প্রচলিত চাষ পদ্ধতিতে ভাটার সময় প্রয়োজনে পুকুরের অর্ধেক পানি বের করে দিয়ে জোয়ারের সময় পানি ঢুকানো হয়। সাধারণত জোয়ার ভাটার ওপর নির্ভর করে মাত্র ৫-৬ দিনে ৫০-১০০% পানি পরিবর্তন করা সম্ভব। আধা নিবিড় বা নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে পানি পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন রকমের পাম্প ব্যবহার করা হয় এবং জোয়ারের পানির ওপর কম নির্ভর করা হয়।
আধানিবিড় চাষ পদ্ধতিতে জোয়ারের সময় স্বাভাবিকভাবে পানি পরিবর্তন করা হয় তবে ভাটার সময় প্রয়োজনে পাম্প ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে পানি দুভাবে পরিবর্তন করা যায়। প্রথম পদ্ধতিতে প্রয়োজনমতো কিছুটা পানি বের করে দেয়া হয় এবং পরে সেই পরিমাণ পানি ঢুকানো হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে একদিক দিয়ে পানি প্রবেশ এবং অপর দিক দিয়ে পানি নিষ্কাশন করা হয়। এভাবে পানি পরিবর্তন করার পদ্ধতিকে Flow through system বলা হয়।
অধিক বৃষ্টিপাতের সময় পানি পরিবর্তন না করে পানি নিষ্কাশন গেটের মুখে ফলবোর্ড স্থাপন করে পুকুরের উপরের স্তরের পানি বের করে দেয়া উত্তম। এতে লবণাক্ততা হ্রাসের ঝুঁকি কমে যায়। সাধারণত পানিতে নিম্ন। বর্ণিত অবস্থাদি পরিলক্ষিত হলে পানি পরিবর্তন করার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
– সকাল (৬-৭ টা) ও বিকাল (৩-৪ টা)- এই দুই সময়ে পর্যবেক্ষণকৃত পিএইচের পার্থক্য ০.৫ থেকে অধিক বা পিএইচের মান ৮.৫ এর বেশি অথবা ৭.৫ এর কম হলে।
– পানির স্বচ্ছতা ৮০ সে দি এর বেশি অথবা ৩০ সেমি এর কম হলে।
-পানি অত্যধিক ভারী ও গাঢ় হয়ে গেলে।
-পানিতে অজৈব কণার পরিমাণ অধিক প্রতীয়মান হলে।
– পানির উপরিভাগে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী বুদবুদ দেখা গেলে।
-পানিতে আন-আয়োনাইজড অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গেলে।
-এয়ারেটর চালানো অবস্থায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কম হলে।
পানির গুণাগুণ সংরক্ষণ
পানির গুণাগুণ রক্ষার জন্য প্রধানত তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেন, পানির লবণাক্ততা, অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট, নাইট্রেট, খরতা ও ক্ষারত্ব, পিএইচ, হাইড্রোজেন সালফাইড প্রভৃতির ওপর বিশেষ নজর রাখা হয়। এসব প্রয়োজনীয় গুণাগুণ না থাকলে চিংড়ির বৃদ্ধি ও বাঁচার হার কমে যায়।
ক) তাপমাত্রা: তাপমাত্রা সমস্ত প্রাণীর জৈব বিপাক (Metabolism) ক্রিয়ায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জৈব ও রাসায়নিক ক্রিয়া যেমন বাড়ে ঠিক তেমনি তাপমাত্রা কম হলে সমস্ত ক্রিয়া কমে যায়। এই জন্য দেখা যায় ২০° সে. তাপমাত্রার চেয়ে ৩০° সে. তাপমাত্রায় জলজ প্রাণীকুলের অক্সিজেন চাহিদা, খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধির হার ইত্যাদি প্রায় দ্বিগুণ দ্রুততার সাথে বেড়ে যায়।
বাগদা চিংড়ির উৎপাদনের জন্য ২০-৩০° সে. তাপমাত্রা উত্তম। ২৫° সে. তাপমাত্রার নিচে চিংড়ির বৃদ্ধির হার কমতে থাকে এবং ২০° সে. এর নিচে প্রায় থেমে যায়। পানির তাপমাত্রা ১৩° সে, এর নিচে এবং ৩৪° সে. এর উপরে হলে চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা দিতে পারে। ভাপমাত্রা অত্যধিক কম বা বেশি হলে খাদ্য ও সার প্রয়োগ প্রয়োজন মত কম বা বেশি অথবা বন্ধ করে দিতে হবে এবং প্রয়োজন অনুসারে পানি পরিবর্তন করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সনাতন ও হালকা উন্নত পদ্ধতির চাষের পুকুরে পানির গভীরতা ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। ফলে এ সমস্ত খামারে গরমের সময় পানির তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় চিংড়ির আশয়ের জন্য খামারের ভিতরের পার্শ্বে চারিদিকে বা কোণাকুণি নালা থাকা প্রয়োজন। এছাড়া প্রয়োজনমতো পানি পরিবর্তন করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
খ) দ্রবীভূত অক্সিজেন: চিংড়ি চাষের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাগনা চিংড়ির অক্সিজেন চাহিদা বেশি। চিংড়ি চাষের পুকুরে ৫-৭ পিপিএম অক্সিজেন থাকা উত্তম। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ২.৫ পিপিএম এর নিচে নামলে চিংড়ি মারা যেতে শুরু করে এবং ১ পিপিএম এর কম হলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সমশ চিংড়ি মারা যাবে।
পানিতে অক্সিজেনের দ্রবীভূত হওয়ার পরিমাণ নির্ভর করে পানির তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও বায়ুচাপের ওপর। সাধারণত তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে পানিতে অক্সিজেনের দ্রবণীয়তা কমে যায়।
পানিতে অক্সিজেনের উৎস দুইটি, যথা- বাতাস ও সালোকসংশ্লেষণ। আর পানিতে অক্সিজেন ঘাটতি তিনভাবে হয়ে থাকে। যথা- ১. রাত্রিকালে উদ্ভিদের শ্বাস গ্রহণ ২. প্রাণীকূলের শ্বাস গ্রহণ এবং ৩. পচনশীল জৈব পদার্থের পড়ন। অক্সিজেন হ্রাসের কারণে চিংড়ির দৈহিক ক্লেশ, ক্ষুধামন্দা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস এবং দৈহিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে।
পুকুরে অক্সিজেন হ্রাসের লক্ষণ
– পানির উপর সরের মত বুদ্বুদ জমা হয়।
– পুকুরের তলা থেকে বুদ্বুদ আকারে গ্যাস উঠে
সাধারণত মেঘলা দিনে, খুব গরম পড়লে এবং মধ্যরাত থেকে ভারেবেলা পর্যন্ত পুকুরে অক্সিজেনের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়।
পানিতে সবুজ উদ্ভিদ কণার (ফাইটোপ্ল্যাংকটন) উপস্থিতিতে সূর্যালোকের প্রভাবে সালোকসংশ্লেষণ ঘটে থাকে। এই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার সময় ফাইটোপ্ল্যাংকটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। রাতের বেলায় যখন সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে তখন এয়া অক্সিজেন গ্রহণ করে ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে থাকে।
তাই যে সব পুকুরে ফাইটোপ্যাংকটনের আধিক্য বেশি থাকে সে সব পুকুরে সাধারণত বিকেল বেলায় অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে এবং ভারে বেলায় অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। ফাইটোপ্ল্যাংকটন সমৃদ্ধ পুকুরের পানির উপরিভাগে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে এবং তলদেশে কম থাকে।
অক্সিজেন স্বল্পতার প্রতিকার
নিম্নোক্ত উপায়ে পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়।
১. পানিতে ঢেউ এর সৃষ্টি করে যেমন। সাঁতার কাটা, বাঁশ পেটানো ইত্যাদি।
২. পুকুরে নতুন পানি সরবরাহ করে অর্থাৎ পানি পরিবর্তন করে।
৩. কৃত্রিমভাবে বাহু সঞ্চালন করে।
এয়ারেটর বা প্যাডেল হইল স্থাপন করে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়। পানিতে ওর সৃষ্টি রোধ, বর্জ্য বের করা এবং অক্সিজেন মাত্রা বাড়াতে এয়ারেটর অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। পুকুরের চারদিকেও টি ওয়ারেটর ব্যবহার করতে বর্জ্য পদার্থ সঠিকভাবে এক জায়পার জমা পড়ে। সবগুলো এয়ারেটর এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে সবগুলো এয়ারেটর একই দিকে ঘুরে, পাড় থেকে এদেরকে ৫-১০ মিটার দূরে এবং একটি থেকে অন্যটি ৩০-৩৫ মিটার দূরে স্থাপন করতে হবে।
গ) পানিজ লবণাক্ততাঃ গলদা মিঠা পানির চিংড়ি। মিঠা পানিতে এদের চাষ করা যায়। গলদা চিংড়ি ০ থেকে ০৪ পিপিটি লবণাক্ততাযুক্ত পানিতে চাষ করা যায়। পানির লবণাক্ততা বেশি হলে মিঠা পানি সরবরাহ করে পানির সবণাক্ততা কষাতে হবে। রিফ্রাক্টোমিটার বা স্যালাইনোথিটারের সাহায্যে পানির লবণাক্ততা পরিমাপ করা বার।
ঘ) অ্যামোনিয়াঃ পুকুরের তলদেশে পুঞ্জীভূত জৈব পদার্থের পচন ও জলজ প্রাণীর বিপাকীয় ক্রিয়ায় অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়। আধা নিবিড় ও নিবিড় চাষের পুকুরে সাধারণত হঠাৎ ব্যাপক হারে ফাইটোপ্যাংটনের মড়ক ও অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা পচনের কারণে অনায়নিত অ্যামোনিয়া উৎপাদিত হয়।
আয়োনিত (NH) ও অনায়নিত (NH) অবস্থায় অ্যামোনিয়া পানিতে বিদ্যমান থাকে। অনায়নিত অ্যামোনিয়া চিংড়ির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পুকুরের পানিতে অনায়নিত অ্যামোনিয়ার মাত্রা ০.০২৫ মিগ্রা/লিটার এর কম থাকতে হবে খা চিংড়ির জন্য সহনীয়। এতে চিংড়ি উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না।
পানিতে অনায়নিত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ০.১ পিপিএম এর বেশি হলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয় এবং ০.৪৫ পিপিএম এর বেশি হলে বৃদ্ধির হার অর্ধেকে নেমে আসে। সাধারণত পানির পিএইচ বৃদ্ধির সাথে সাথে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এজন্য পানির পিএইচ ৮.৫ এর বেশি থাকা উচিত নয়।
অ্যামোনিয়ার বৃদ্ধি পিএইচ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ফলে বিকাল বেলা পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেশি থাকে এবং ভোরে কম থাকে। পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের জন্য চিংড়ির মজুদ ঘনত্ব হ্রাস, অত্যধিক সার ও খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ এবং পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ঙ) নাইট্রাইট (NO₂) নাইট্রাইট হচ্ছে অ্যামোনিয়া ও নাইট্রেটের মধ্যবর্তী যৌগ। অনেক সময় এই যৌগ চিংড়ির ব্যাপক মড়ক ও বৃদ্ধির হার হাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় নাইট্রাইটের মাত্রা ০.১ পিপিএম এর নিচে থাকা চিংড়ির জন্য নিরাপদ। চিংড়ির ঘনত্ব হ্রাস ও পানি পরিবর্তন করে, জিওলাইট এবং চরম বিপর্যয়ের সময় ৩.৩ কেজি/শতাংশ/৩০ সৌম পানির গভীরতায় লবণ প্রয়োগ করে নাইট্রাইটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
চ) নাইট্রেট (NO₂): পানিতে নাইট্রেটের মাত্রা ২০ পিপিএম এর নিচে রাখা চিংড়ির জন্য উত্তম। নাইট্রেট চিংড়ির জন্য তেমন একটি বিষাক্ত নয়, বরং শেওলার জন্য একটি পুষ্টিকর উপাদান।
ছ) খরতা ও ক্ষারত্ব। খরতা ও ক্ষারত্বের মান হ্রাস বৃদ্ধি হলে পানির বাফারিং ক্ষমতা কমে যায় এবং পানির পিএইচ দ্রুত উঠানামা করে। এর হ্রাস বৃদ্ধির ফলে পুকুরে সার দিলে তা কার্যকর হয় না এবং চিংড়ির খোলস বদলানো বাধাপ্রাপ্ত হয়। খরতা ও ক্ষারত্বের মান ৪০-২০০ মিগ্রা/লিটার চিংড়ির জন্য ভালো। পুকুরের পানি পরিবর্তন করে এবং চুন বা জিপসাম প্রয়োগ করে পানির খরতা ও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
জ) পিএইচ। চিংড়ির জন্য পানির পিএইচ ৭.৫-৮.৫ উত্তম। পানির পিএইচ মান ৫ পিপিএম এর কম হলে এবং ৯.৫ পিপিএম এর বেশি হলে চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর। সাধারণত খামারে পানির পিএইচ, ফাইটোপ্ল্যাংকটন, অব্যবহৃত খাদ্যের চর্বি ও ময়লা-আবর্জনা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
দিনের বেলায় ফাইটোপ্ল্যাংকটন সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করার ফলে বিকাল বেলায় পুকুরের পানিতে পিএইচ বেড়ে যায় এবং রাতের বেলায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করার ফলে ভারে বেলা পিএইচ কমে যায়। পিএইচ এর দ্রুত উঠানামা চিংড়ির জন্য মোটেও ভালো নয়।
পানির অনুত্ব ও ক্ষারত্বের সূচক পিএইচ পানির উৎপাদন ক্ষমতা নির্দেশ করে। সাধারণত পোড়া চুন প্রয়োগের মাধ্যমে পিএইচ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অতি বর্ষণে পানির পিএইচ কমে যাওয়ায় চিংড়ির মৃত্যু হতে পারে। এ অবস্থায় প্রতি শতকে পোড়া চুন ৮০-১০০ গ্রাম বা ডলোমা- ছট ১৬০-২০০ গ্রাম ব্যবহার করতে হবে।
পান্দিয় পিএইচ কমে গেলে চিংড়ির উপর নিম্নোক্ত প্রতাবগুলো পরিলক্ষিত হয়ঃ
– চিংড়ির সেব থেকে সোডিয়াম ক্লোরাইড বেরিয়ে যার ফলে চিংড়ি দুর্বল হয়ে মারা যায়।
– চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং খাবারে অরুচিভাব দেখা দেয়।
– গুকুয়ে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়।
– পিএইচ ৪.৫-এর কম হলে চিংড়ির পীড়ন হয় এবং মৃত্যুহার বেড়ে যায়।
– কম পিএইচ-এর ফলে চিংড়ির খোলস নরম হয় এবং খোলস বদল করতে পারে না।
– পিএইচ এর মান কাছিক্ষত মাত্রার কমবেশি হলে চিংড়ির খাদ্য গ্রহণ প্রবণতা কমে যায়। পিএইচ কম হলে চিংড়ির রং কালো হতে পারে, অঙ্গহানি হতে পারে।
পাদির শিএইচ যেড়ে গেলে বিড়ির উপর নিম্নোক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়ঃ
– চিংড়ির ফুলকা ও চোখ নষ্ট হয়ে যায়।
– অক্ষিদ্রবণ (Osmoregulation) ক্ষমতা হ্রাস পায়।
– চিংড়ি খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়।
– চুন ৩ জিপসাম প্রয়োগ করে পানির পিএইচ বাড়ানো যায় এবং অ্যামোনিয়াম সালফেট (১ কেজি/পতাংশ) অথবা ছুঁতে (৬-১২ গ্রাম/শতাংশ/৩০ সেমি) প্রয়োগ করে পানির পিএইচ কমানো যায়।
ঝ) হাইড্রোজেন সালফাইড (H₂S): সাধারণত পচনশীল জৈব পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়া ও অক্সিজেদের খাটতির ফলে গুরুত্রের তলদেশে হাইড্রোজেন সালফাইড (H₂S) গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাস সৃষ্টির ফলে পুকুরের তলদেশের মাটিতে পচা ডিমের গন্ধ পাওয়া যায় এবং মাটির উপরিভাগে কালো আবরণের সৃষ্টি হয়।
পানিতে হাইড্রোজেন সালফাইডের মাত্রা ০.১-০.২ পিপিএম হলে চিংড়ি শরীরের ভারসাম্য হারায়, খাদ্য গ্রহণে অনীহাজাৰ দেখায় ফলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধিয় ব্যাঘাত ঘটে। হাইড্রোজেন সালফাইডের যাত্রা ১ পিপিএম-এর বেশি হলে চিংড়ির মড়ক আরস্ত হয় ।পুকুরে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি, সার ও খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা হ্রাস এবং পিএইচ এর মাত্রা বৃদ্ধি করে হাইড্রোজেন সালফাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পুকুরের পানি পরিবর্তনের মাধ্যমেও হাইড্রোজেন সালফাইডজনিত সমস্যা সমাধান করা যায়।
সার প্রয়োগ
উন্নত ব্যাপক পদ্ধতির চাষাবাদে সার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাকৃতিক খাদ্যের যোগান দেয়া হয়। পুকুরে সার প্রয়োগের ফলে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক খাদ্য ফাইটোপ্ল্যাংকটন উৎপাদিত হয়। সেকি ডিস্কের দৃশ্যমানতা ৩০-৩৫ সেমি এর বেশি হলে সার প্রয়োগ করা উচিত।
সার প্রয়োগের মাত্রা বিভিন্ন পুকুরে বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। পুকুরের পানিতে সেকি ডিস্কের দৃশ্যমানতার ভিত্তিতে সার প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত উন্নত ব্যাপক পদ্ধতির চাষাবাদে শতাংশ প্রপ্রতি ৮০-১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০-৩০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
এই মাত্রায় সার প্রয়োগের ৫-৬ দিনের মধ্যে সেক্কি ডিস্কের দৃশ্যমানতা না কমলে উপরাক্তে মাত্রার অর্ধেক পরিমাণ সার আবার প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত এই পদ্ধতিতে চাষের ক্ষেত্রে প্রতি ২ সপ্তাহ অন্তর অন্তর অর্থাৎ প্রতি পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময় পানি পরিবর্তনের পর সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। আধানিবিড় ও নিবিড় পদ্ধতির চাষে প্রথম ২ মাস প্রতিবার পানি পরিবর্তনের পর অল্প মাত্রায় ইউরিয়া ও টিএসপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
আরও দেখুনঃ