পরিবেশ ও তার প্রভাবসমূহ

পরিবেশ ও তার প্রভাবসমূহ – “মাছের স্বাস্থ্য পরিচর্যা” কোর্স বইটি বিশেষভাবে স্কুল অব এগ্রিকালচার এন্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট-এর বিএজিএড প্রোগ্রামের ছাত্রদের জন্য লেখা হয়েছে। আপনি জানেন, দূর শিক্ষণে শিক্ষকের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নেই। তাই পাঠের কোনো কঠিন বিষয় যেন আপনার বুঝতে অসুবিধা না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই কোর্স বইটি লেখা হয়েছে। কোর্স বইটির আঙ্গিক ও উপস্থাপনা তাই প্রচলিত পাঠ্যবই থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের। যেহেতু সরাসরি শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই কোর্স বইটি আপনাকে নিজে পড়ে বুঝতে হবে, তাই এটি কীভাবে পড়বেন প্রথমেই তা জেনে নিন। এতে কোর্স বইটি পড়তে ও বুঝতে আপনার সুবিধা হবে।

মাছের স্বাভাবিক জীবন ধারণের মাধ্যম পুকুর বা জলাশয়ের পানি। জলাশয়ের প্রতিটি স্তরে যে বন্য মাছ (Wild fish) থাকে তা অন্যান্য চাষযোগ্য মাছের জন্য রোগের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। মাছ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীও (যেমন- শামুক) বিভিন্ন পরজীবীর পোষক (Host/Carrier) হিসেবে পরিচিত। বিষাক্ত ব্লুম সৃষ্টিকারী ফাইটোপ্লাংকটনের জন্যও মাছ অসুস্থ হতে পারে। বিভিন্ন নীলাভ-সবুজ শৈবাল (যেমন (Microcystis sp.) এর প্রাচুর্যতা মাছের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

এছাড়াও তাপমাত্রা, PH, লবণাক্ততা, অপদ্রব্য, দূষণ ইত্যাদি ভৌত-রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলেও মাছ রোগাক্রান্ত হতে পারে, এমনকি মাছ মারাও যেতে পারে। অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত পুষ্টির সরবরাহ ও ভিটামিনের স্বপ্নতা মাছকে দুর্বল ও অসুস্থ করে তোলে। স্বাস্থ্যসম্মত দূষণমুক্ত পরিবেশে মাছ সুস্থ ও সবল থাকে। সর্বোপরি পুষ্টিককর খাদ্য, বৈজ্ঞানিক ও দক্ষ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় রোগের প্রকোপও হ্রাস পায়।

এ ইউনিটের বিভিন্ন পাঠে পরিবেশ ও তার প্রভাবকসমূহ নীলাভ দাগ রোগ, রক্তাল্পতা, থাইরয়েড টিউমার, চক্ষু প্রসারণ রোগ, ইয়োকস্যাক রোগ ও ডিম রোগ, আভ্যন্তরীণ অঙ্গাদির রোগ, একটি মাছ/চিংড়ি ব্যবচ্ছেদ করে আক্রান্তকরণ শনাক্তকরণ ইত্যাদি বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

 

পরিবেশ ও তার প্রভাবসমূহ

 

পরিবেশ ও তার প্রভাবসমূহ

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • পরিবেশ বলতে কী বুঝায় তা বলতে ও লিখতে পারবেন।
  • পরিবেশ, পোষক ও রোগজীবাণুর প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
  • পরিবেশের প্রভাবকগুলো চিহ্নিত করতে পারবেন।
  • মাছের রোগ সৃষ্টি করতে পরিবেশের প্রভাবকগুলোর প্রভাব সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
  • পরিবেশের প্রভাবকজনিত কারণে মাছের রোগ নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপ নিতে পারবেন।

পরিবেশ

কোন জীবের পরিবেশ হলো তার অবস্থানের পারিপার্শ্বিক অবস্থা। মাছ বা জলজ প্রাণীর পরিবেশ হলো তার বাসস্থানের পারিপার্শ্বিক অবস্থা অর্থাৎ পানি এবং তার সংশ্লিষ্ট ভৌতিক রাসায়নিক ও জৈবিক অবস্থা। মাছে রোগ সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহ ৩.১ পাঠে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অত্র পাঠে পরিবেশ ও তার প্রভাবকসমূহ সম্বন্ধে আরো বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।

মাছে বা চিংড়িতে রোগ সৃষ্টিকারী সর্ব প্রধান দু’টি প্রভাবকের প্রতিক্রিয়া বা সম্পর্ক নিম্নের চিত্রের সাহায্যে দেখানো হলো (চিত্র:৪৪)। মাছে রোগ সৃষ্টিতে পরিবেশের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। পরিবেশের প্রভাবকসমূহের ক্রিয়ার ফলে রোগজীবাণু সহজেই মাছে রোগ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়।

 

মাছে রোগ সৃষ্টিতে পরিবেশের একটি বিশেষ প্রভাব রয়েছে। পরিবেশের প্রভাবকসমূহ রোগজীবাণুর সহায়তায় মাছে সহজেই রোগের সৃষ্টি করতে সক্ষম।

 

পরিবেশ ও তার প্রভাবসমূহ
পোষক, পরিবেশ ও রোগজীবাণুর সম্পর্ক বা প্রতিক্রিয়া

 

পারিবেশিক প্রভাবকসমূহ ও তাদের প্রভাব

পানিতে বসবাসকারী মাছ বা চিংড়ি বা যে কোন জলজ প্রাণীর ক্ষেত্রে পানির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক প্রভাবক সমূহ উৎপাদনের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। মাছের বা চিংড়ির বা জলজ যে কোন প্রাণীর রোগ সৃষ্টিতে এ সকল প্রভাবকসমূহের ক্ষতিকর ও অস্বাভাবিক প্রভাব অনেকাংশে দায়ী। নিম্নে এ সকল প্রভাবক ও মাছের ওপর এদের প্রভাব সম্বন্ধে আলোচনা করা হল। এর সংগে উদ্ভূত সমস্যা বা রোগের প্রতিকার করার উপায়ও উল্লেখ করা হলো।

১। ভৌত প্রভাবক (Physical Factor)

ভৌত প্রভাবকের মধ্যে তাপমাত্রা, সূর্যালোক এবং পানির ঘোলাত্ব গুরুত্বপূর্ণ।

তাপমাত্রা (Temperature)

ভৌত প্রভাবকগুলোর মধ্যে পানির তাপমাত্রা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মাছের বর্ধন, রোগজীবাণুর অবস্থান এবং এদের বংশ বিস্তার পানির তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। অধিক তাপের ফলে মাছ পীড়নের মধ্যে পতিত হয় যার ফলে রোগজীবাণু আক্রমণের সুযোগ পায়। আবার দীর্ঘ্য সময় যাবৎ নিম্ন তাপমাত্রায় মাছ শীতল অভিঘাত (Cold Shock) এর শিকার হয়। ফলশ্রুতিতে মাছের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রক্তে কোষ ভাঙ্গন দেখা দেয়।

সর্বোপরি রোগজীবাণুগুলোর আক্রমণের ক্ষমতা তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণ সরূপ-ব্যাকটেরিয়াজনিত “কলামনারিস রোগ” ১৫০ সে. এর নিচে পানির তাপমাত্রা থাকলে তা মাছে দেখা দেয় না। আবার ব্যাকটেরিয়াল গিল রোগ ২১০ সে. এর উপর তাপমাত্রা থাকলে দেখা দেয় না। সুতরাং তাপমাত্রা মৎস্য রোগ সৃষ্টি বা বিস্তারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পানি পরিবর্তনের মাধ্যমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করা যেতে পারে।

 

পারিবেশিক ভৌত প্রভাবকসমূহের মধ্যে পানির তাপমাত্রা, সূর্যালোক এবং পানির ঘোলাতু মাছে রোগ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

 

সূর্যালোক (Sun Light)

সূর্যালোকের প্রভাবে পুকুরের পানির তাপমাত্রা প্রভাবিত হয়। কিছু কিছু মাছের ডিম ও লার্ভা সূর্যালোকের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। অধিকন্তু তীব্র সূর্যালোকের প্রভাবে অনেক মাছের পৃষ্ঠদেশ, মাথা ও পাখনায় ক্ষতের সৃষ্টি করে। পুকুরে কিছু পদ্ম বা শাপলা গাছ, পাড়ে কিছু নারিকেল গাছ লাগিয়ে কিছুটা ছায়ার ব্যবস্থা করা যায়- তবে বেশি ছায়া যেন না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

ঘোলাতু (Turbidity)

ঘোলাতু পানির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করে। মাছের ফুলকায় ঘোলাত্বের কনা জমে শ্বাস কষ্টের সমস্যা ঘটায়, মাছের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায় এবং ত্বকে ঘোলাত্বের কনার ঘর্ষণে ক্ষতের সৃষ্টি করে ফলে রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। কিছু শেহড়া গাছের ডাল এবং চুন (১/২ কেজি প্রতি শতাংশে) মিশালে ঘোলাত্ব কমে যায়।

 

Google News
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

২। রাসায়নিক প্রভাবক (Chemical Factor)

পানির রাসায়নিক প্রভাবকের প্রভাবে মাছ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, মাছের মৃত্যু ঘটতে পারে- তা ছাড়া পরোক্ষভাবে রোগজীবাণুর আক্রমণে সহায়তা করে। এদের মধ্যে দ্রবীভূত অক্সিজেন, পি. এইচ, দূষক, অ্যামেনিয়া, নাইট্রাইট এবং হাইড্রোজেন সালফাইড গুরুত্বপূর্ণ। এ সকল প্রভাবক গুলো মৎস্য উৎপাদনে যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো। একই সংগে সমস্যাগুলোর সমাধানের উপদেশ ও উল্লেখ করা হলো।

দ্রবীভূত অক্সিজেন (Dissolved Oxygen, O2)

বেঁচে থাকার জন্য অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় মাছেরও অক্সিজেন একান্ত প্রয়োজন। মাছ এই অক্সিজেন পানি থেকে সংগৃহীত করে থাকে যা সাধারণত পানির আন্তঃআনবিক স্থানে সম্পৃক্ত অবস্থায় থাকে। পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কম বেশি হওয়ার ফলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয় এমনকি অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে।

অনেক মাছ দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ৪ পি.পি.এম. এর নিচে গেলেই অস্বস্তিকর অবস্থায় লাফালাফি শুরু করে- খাবি খায়, পানির উপর ভেসে থাকতে চায়- এ অবস্থাকে হাইপোক্সিয়া (Hypoxia) বলে। আর কম হলে অর্থাৎ ২৫০ সে. তাপমাত্রায় ২.৮ পি.পি.এম. এর নিচে অক্সিজেনের মাত্রা গেলে মাছ মারা যাওয়া শুরু করে। আর এভাবে দীর্ঘ সময় অক্সিজেনের অভাব দেখা দিলে তাকে অ্যানোক্সিয়া (Anoxia) বলা হয়।

যা হউক অক্সিজেনের অভাব দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে হরা (Hora) টেনে বা জাল টেনে পানি নেড়ে দিতে হবে। সম্ভব হলে পচনশীল পাতা বা ডাল পালা থাকলে তা পরিষ্কার করতে হবে। কিছু নূতন পানি যোগ করতে পারলে উত্তম। এ ছাড়া অনেকে ২ পি.পি.এম. হারে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট (KMnO4) পুকুরে প্রয়োগ করার উপদেশ দেয়। মাছের জন্য ৫-৮.৫ পি.পি.এম. অক্সিজেন পানিতে দ্রবীভূত থাকা উত্তম।

 

রাসায়নিক প্রভাবক-গুলোর মধ্যে দ্রবীভূত অক্সিজেন, পি এইচ, দূষক, অ্যামোনিয়া, ন্যাইট্রাইট এবং হাইড্রো-জেন সালফাইড অতি গুরুত্বপূর্ণ।

 

গ্যাস এম্বোলিজম/গ্যাস বাবুল রেগে (Gas Embolism/Gas Bubble Disease)

পানিতে অক্সিজেন বা নাইট্রোজেন গ্যাসের আধিক্য হেতু মাছে এ রোগ হয়ে থাকে যাতে মাছের মৃত্যুও ঘটতে পারে। দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ১০ পি.পি.এম. বা তার অধিক হলে এ রোগ দেখা দিতে পারে। আবার বায়োবীয় গ্যাসের চাপ বিশেষ করে নাইট্রোজেন গ্যাস পানির গ্যাসের সহিত অসম চাপে পানিতে আধিক্য দেখা দেয় ফলে মাছের পোনা বা লার্ভার ডিম্ব থলের উপরে, মুখে গ্যাসের বুদ বুদ দেখা দেয়।

বড় বড় মাছের ত্বকে বা আঁইশের উপরেও গ্যাসের বুদ বুদ দেখা দেয়। এর ফলে মাছের কোষের অভ্যন্তরের রক্ত কনিকা ভেঙ্গে যেতে পারে এবং মাছের তখন মৃত্যু ঘটে। এ অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য যদি এয়ারেশন করা হয় তাহলে তা কমিয়ে অথবা বন্ধ রাখতে হবে। মৃদুভাবে পানি নেড়ে গ্যাস বের করার সুবিধা করতে হবে।

পি এইচ (pH)

পানির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব পি.এইচ এর উপর নির্ভরশীল। প্রায় সকল মাছের জন্য অনুকূল pH মাত্রা হচ্ছে ৬.৫-৮.৫। পানির pH ৬.৫ এর নিচে যেতে থাকলে বিশেষ করে ৫ এর নিচে গেলে অম্লত্ব বেশি হয় এবং এ অবস্থায় মাছ এসিডোসিস (Acidosis) এ পতিত হয়। ফলে মাছ ক্ষুধা মন্দা, ওজন হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি সমস্যায় ভুগে।

আবার pH খুব বেড়ে গেলে (৯ এর চেয়ে বেশি হলে) মাছে যান্ত্রিক ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থাকে অ্যালকালোসিস (Alkalosis) বলা হয়। এসিডোসিস দেখা দিলে pH এর মাত্রা অনুযায়ী পুকুরে প্রতি শতাংশে ১/২-১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করলে প্রতিকার পাওয়া যায়। আবার অ্যালকালসিস হলে পুকুরে ১/২-১ কেজি লবণ প্রতি শতাংশে দিলো উপকার পাওয়া যায়। অনেকে আমগাছের ডাল এবং তেঁতুল গাছের ডাল পানিতে ডুবিয়ে রাখার পরামর্শ দেন।

দূষক (Pollutant)

পারিবেশিক প্রভাবকগুলোর মধ্যে দূষক অত্যন্ত মারাত্মকভাবে সকল শ্রেণীর মাছসহ জলজ প্রাণীর ক্ষতি সাধন করে এবং পরিশেষে মাছের মৃত্যু ঘটে এমনকি ১০০% মাছ মারা যেতে পারে। নানা ধরনের দূষক হতে পারে এবং সে অনুযায়ী মাছের উপর প্রভাবও বিভিন্ন হতে পারে।

বিষজাতীয় দ্রব্য-বিশেষ করে কৃষিতে ব্যবহৃত ইনসেকটিসাইড, শত্রুতামূলক বিষ প্রয়োগ, কারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য পোড়া তেল, ভারী ধাতব বস্তু, পয়ো-নর্দমাবাহিত ময়লা ইত্যাদি পুকুর বা নদীতে পড়লে পানি দূষিত হয় এবং এই দূষণের ফলে মাছের মৃত্যু ঘটে অথবা রোক্ষভাবে উপাদান হ্রাস পায়, রোগজীবাণুর আক্রমণ সহজ হয়।

দূষণের প্রতিকার করার চেয়ে উত্তম ব্যবস্থাপনার দ্বারা যাতে দূষক পুকুরের পানিতে না আসতে পারে তার ব্যবস্থা করা। দূষকের দ্বারা মাছের মৃত্যু ঘটানো বুঝতে পারলে মাছ সরিয়ে ফেলা উত্তম। পরবর্তীতে পানি বদল করা সম্ভব হলে ভালো। কিছু দিন অপেক্ষা করে বিষক্রিয়া বন্ধের পর পুনরায় মাছ ছাড়া যেতে পারে।

 

পুষ্টিজনিত রোগ ও তার প্রতিকার

 

অ্যামোনিয়া (Ammonia, NH3,)

অদ্রবীভূত অ্যামোনিয়া মাছের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। পানিতে এর পরিমাণ ০.১১ পি.পি.এম. এর বেশি হলেই মাছ বা চিংড়ি উভয়ের জন্যই অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে এবং ০.২ পি.পি.এম. এর উর্ধ্বে গেলে মাছের ফুলকায় শ্বাস কার্য্যের ব্যাঘাত ঘটে এবং মৃত্যুর কারণ হয়। অ্যামোনিয়ার আধিক্যের সময় নাইট্রোজেন জাতীয় সার (যেমন- ইউরিয়া) দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। ঘন ঘন জাল টেনে দিতে পারলে ভাল আর এয়াবেশন করতে পারলে উত্তম- বিশেষ করে হ্যাচারির জন্য এ সকল ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। পি, এইচ এবং পানির তাপমাত্রা বেশি হলে এ গ্যাস আরো বিষাক্ত হয়।

নাইট্রাইট (Nitrite, NO2)

নাইট্রাইটও একটি নাইট্রোজেন জাতীয় পদার্থ। পানিতে এর পরিমাণ ২.৪ পি.পি.এম এর উর্ধ্বে গেলে মাছ ও চিংড়ি উভয়ের জন্য ক্ষতি করে। বিশেষ করে হ্যাচারীতে পোনা উৎপাদনের ক্ষেত্রে নাইট্রাইটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এর আধিক্য দেখা দিলে এয়ারেশন করা উচিত। এবং নাইট্রোজেন জাতীয় সার- যেমন ইউরিয়া প্রয়োগ আপাততঃ বন্ধ রাখতে হবে।

হাইড্রোজেন সালফাইড (Hydrogen Sulphide, H2S)

পুকুরের তলদেশে গাছের পাতা, আবর্জনার পচন, অব্যবহৃত মাছের খাদ্য পচনের ফলে- বিশেষ করে চিংড়ি চাষে কালোমাটি (Black Soil) জমে গেলে হাইড্রোজেন সালফাইডের আধিক্য দেখা দেয়। আবার যে সকল পুকুরে এসিড সালফেট সংযুক্ত মাটি থাকে সে ক্ষেত্রেও এই গ্যাসের আধিক্য দেখা দিতে পারে। চিংড়ি ও মাছ উভয় ক্ষেত্রেই এর পরিমাণ ০.০৩ পি.পি.এম এর উর্ধ্বে গেলেই তা বিষাক্ত বলে বিবেচিত হয়।

পি এইচ এর মাত্রা পানিতে কম থাকলে তখন এ গ্যাস আরও বিষাক্ত হয়। পুকুরের তলদেশে যেন ময়লা, আবর্জনার পচনের সূযোগ না হয় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। মাটির গুণাগুণ দেখে পুকুর তৈরি করা উত্তম যেখানে এসিড-সালফেট মাটির পরিমাণ খুবই সামান্য বা নেই। এ ছাড়া তাৎক্ষনিক প্রতিকার হিসেবে পানি পরিবর্তন করে দিতে পারলে উত্তম এবং সেই সাথে কিছু চুন (১/২ কেজি/শতাংশ) প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

৩। জৈবিক প্রভাবক (Biological Factor)

জৈবিক প্রভাবকসমূহের মধ্যে জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদ যা একই পরিবেশে মাছের সংগে অবস্থান করে। এদের ক্ষতিকর এবং উপকারী উভয় প্রকার প্রভাবই মাছের বৃদ্ধি এবং স্বাভাবিক জীবন-যাত্রার ওপর প্রতিফলিত হয়।

জলজ প্রাণী (Aquatic Animal)

জলজ প্রাণীর ছোট বড় নানা ধরনের প্রাণীই পানির পরিবেশে বাস করে। একটি পারিবেশিক চেইন তৈরি করেই পরিবেশে বাস্তু সাংস্থানিক (Ecological) সমসতার মাধ্যমে তাদের জীবন কাটায়। এই ভারসাম্যের সমতা হারিয়ে অনেক সময় এক জীব অন্য জীবের ক্ষতি সাধন করে এবং মাছ ও তার স্বীকার হয়। বড় বড় প্রাণী বা মাছ ছোট ছোট মাছ বা পোনা মাছকে শিকার করে- উদাহরণ হিসেবে সাপ, উদ, বোয়াল মাছ, শোল, গজার ইত্যাদি।

অনেক ক্ষুদ্র প্রাণী যেমন জুওপ্লাংকটন মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। আবার ক্ষুদ্র প্রাণী অনেক মাছের প্যারাসাইট এবং রোগ জীবাণু হিসেবে ক্ষতি করে। যা হউক মাছ চাষের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে অবাঞ্চিত প্রাণীকে সরিয়ে ফেলতে হয়-অথবা বিষ প্রয়োগে (রোটেনন, ০.৫ ১ পি.পি.এম হারে) মেরে ফেলা এবং তৎপর জাল টেনে পুকুর পরিষ্কার করা।

জলজ উদ্ভিদ (Aquatic Plant)

জলজ প্রাণীর মত জলজ উদ্ভিদের মধ্যে ছোট বড় নানা রকম উদ্ভিদ মাছের ক্ষতি এবং উপকার উভয়ই করে থাকে। কোন ভাবেই পুকুরে কচুরী পানা, ডুবন্ত বা ভাসমান শেওলা বা উদ্ভিদ অতিরিক্ত হতে দেয়া উচিত নয়। অবশ্য ক্ষুদ্র উদ্ভিদ বা ফাইটোপ্ল্যাংকটন (Phytoplankton) মাছের সরাসরি খাদ্য। কিন্তু এদের আধিক্য বা ব্লুম হওয়াটাও মাছের জন্য ক্ষতিকারক।

অনেক সময় এ সকল ব্লুম থেকে বিষাক্ত জিনিস নিঃসৃত হয় যা মাছের মৃত্যু ঘটাতে পারে। উদাহরণ সরূপ পুকুরে মিক্রোসিষ্টিস (Microcystis) এর ব্লুম, সমুদ্রে ঘটিত রেড টাইড মাছের জন্য মারাত্মক ক্ষতি করে। উদ্ভিদ জাতীয় ক্ষুদ্র জীব- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক মাছের রোগ জীবাণু হিসেবে রোগ সৃষ্টি করে যা ইতি পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। আবার ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়া ঠিকমত না হলে পুকুর বা মাছ চাষ উপযোগী পানিতে তার উর্বরতা বৃদ্ধি পায়না বা ঠিক থাকেনা।

অনুশীলন (Activity): পরিবেশ বলতে কী বুঝায়? মাছে রোগ সৃষ্টিতে পরিবেশ, রোগজীবাণুর সম্পর্ক উল্লেখ করুন। মাছের ওপর পরিবেশের প্রভাব গুলোর আলোচনা করুন

সারমর্ম: মাছ, চিংড়ি বা জলজ প্রাণীর পরিবেশ হলো পানি। পানির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক প্রভাবক পানিতে বসবাসকারী মাছের ওপর উপকারী ও ক্ষতিকর উভয় ধরনের প্রভাব ফেলে। ক্ষতিকর। প্রভাবে মাছের রোগ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়- ফলে রোগ জীবাণু সহজভাবে আক্রমণ করে মাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করতে পারে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ১০০% মৃত্যু ঘটাতে পারে। ভৌত প্রভাবকগুলোর মধ্যে তাপমাত্রা, সূর্যালোক এবং ঘোলাত্ব গুরুতপূর্ণ।

তাপমাত্রার কম বেশির প্রভাবে রোগ জীবাণুর আক্রমণের তারতম্য ঘটে, সূর্যালোকের সরাসরি প্রভাবে মাছে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে এবং ঘোলাত্বের প্রভাবেও মাছের শরীরে যান্ত্রিক ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং ফুলকায় শ্বাসকার্য্যের ব্যাঘাত ঘটে। রাসায়নিক প্রভাবকগুলোর মধ্যে দ্রবীভূত অক্সিজেন, পি-এইচ, দূষক, অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট এবং হাইড্রোজেন সালফাইড উল্লেখযোগ্য। অক্সিজেনের অভাবে মাছ মারা যেতে পারে আবার আধিক্যে গ্যাস বাক্ত রোগ হয়।

পি. এইচ. এর মাত্রা ৬.৫-৭.৫ এর কম বা বেশি হলে মাছের স্বাভাবিক বর্ধন ব্যাহত হয়। এমনকি এসিডোসিস বা অ্যালকালোসিস রোগে পতিত হয়। দূষক সরাসরি মাছের মৃত্যু ঘটাতে পারে। তদ্রুপ অ্যামোনিয়া ০.১১পি.পি.এম., নাইট্রাইট ২.৪ পি.পি.এম. এবং হাইড্রোজেন সালফাইড ০.০৩ পি.পি.এম এর উর্ধ্বে গেলে মাছ বা চিংড়ির জন্য বিষাক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটাতে পারে।

জৈবিক প্রভাবকও উপকার এবং অপকার উভয় প্রকার প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে রোগজীবাণু হিসেবে, অথবা ফাইটোপ্লাংকটন অনেক সময় ব্লুম করে মাছের জন্য ক্ষতি সাধন করে। যা হউক এ সকল পারিবেশিক প্রভাবকগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মাছ ও চিংড়িকে রক্ষা করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

আরও পড়ূনঃ

Leave a Comment