আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-পরজীবীঘটিত রোগ
এ পাঠ শেষে আপনি-
- বিভিন্ন পরজীবীঘটিত রোগের নাম বলতে পারবেন।
- কার্পজাতীয় মাছের পরজীবীঘটিত রোগের লক্ষণ বলতে পারবেন।
- পরজীবীঘটিত রোগের কারণ উল্লেখ করতে পারবেন।
সাধারণভাবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অণুজীব সংক্রমিত রোগের চেয়ে পরজীবীঘটিত রোগের সংক্রমণ অধিক পরিলক্ষিত হয়। পরজীবী সংক্রমণের তীব্রতার মাত্রা এবং পরজীবীঘটিত রোগের কারণ – ক্ষতির পরিমাণ জলাশয়ডেনে খুবই কম-বেশি হয়ে থাকে।
জলজ পরিবেশে মাত্রাতিরিক্ত জৈব পদার্থের উপস্থিতি এবং অধিক তাপমাত্রায় জৈব পদার্থের পচন পরজীবীঘটিত রোগের প্রধান কার্যকারণ। রোগজীবাণুর ধরন অনুযায়ী পরজীবীঘটিত রোগকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
১. এককোষী পরজীবীঘটিত রোগ (Protozoan disease)
২. বহুকোষী পরজীবীঘটিত রোগ (Metazoan disease)
পরজীবীঘটিত রোগ
প্রোটোজোয়াজনিত রোগ
কার্পজাতীয় মাছে প্রোটোজোয়াজনিত পরজীবীঘটিত রোগের প্রকোপ বেশি পরিলক্ষিত হয়। এককোষী পরজীবী মাছের বহিঃ এবং অন্তঃস্থ উভয় ধরনের পরজীবী হিসেবে রোগের সৃষ্টি করে থাকে। এধরনের পরজীবীতে আক্রান্ত মাছে অনেক সময় কোন লক্ষণ প্রকাশ পার না। আক্রান্ত মাছ আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায় এবং মারা যায়। সাধারণত নিম্নলিখিত প্রোটোজোয়াজনিত রোগ দেখা দেয়।
ক. সাদা দাগ রোগ (Ichthyophthiriasis)
খ. ট্রাইকোডাইনিয়াসিস (Trichodiniasis)
গ. ইকথায়োবোডোসিস (Ichthyobodosis) . ফোড়া রোগ (Boil disease)
সাদা দাগ রোগ
রোগ জীবাণু । ইকথায়োপথিডিয়াস মালটিফিলিস (Ichthyropthirius multiphilis) নামের এককোষী পরজীবী এরোগ ঘটায়।
রোগের বিস্তার
চাষোপযোগী মাছের জন্য খুবই অনিষ্টকারী রোগ। দেশী কার্পজাতীয় মাছে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। চীনা কার্গেও এ রোগের সংক্রমণ ঘটে থাকে। আঙ্গুলে পোনার ক্ষেত্রে এ রোগের সংক্রমণের তীব্রতা বেশি হয়। স্বাদু ও আধালোনা পানির পুকুরে সাদা দাগ রোগ পরিলক্ষিত হয়।
এ রোগের সংক্রমণ ও তীব্রতার মাত্রা ২৫ ২৬ সে. তাপমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। গ্রীষ্মকাল ও বসন্তকালে সাদা দাগ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। পুকুরে অতিরিক্ত সংখ্যায় মাছ মজুত এ রোগের একটি অন্যতম সহায়ক কারণ।
রোগের লক্ষণ
• মাছের এবং কানকোর বিন্দুর মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা ফোটা দেখা দেয়। রোগের তীব্রতা খুব বেশি হলে মাছের ত্বক সাদা কিল্লীতে ঢাকা পড়ে
• মাছের পারের পিচ্ছিল আবরণ কমে যায় ও স্বাভাবিক উজ্জ্বল্য হারায়।
• পরজীবী সংক্রমণের শুরুতে মাছ পানিতে লাফালাফি শুরু করে এবং কোন কিছুতে থাকে।
• আক্রান্ত মাছের পাখনা মুড়িয়ে যায়।
রোগের লক্ষণ
• মাছের ত্বকে ফোড়া বা বুদবুদ দেখা দেয়।
• ফুলকায় ক্ষতসৃষ্টি হয় এবং ফুলকা পচতে শুরু করে ।
• মাছের দেহ গাঢ় বর্ণ ধারণ করে।
• মাছ ক্ষীণকায় হয়ে যায়।
• মাছের পায়ুতে সিস্ট দেখা যায় ও পারু বিকৃত হয়ে যায় ।
• মাছ খুবই দুর্বল হয়।
কৃমিজাতীয় বহুকোষী পরজীবীঘটিত রোগ
বিভিন্ন প্রজাতির নেমাটোড, সেনটোড এবং জোকের সংক্রমণে মাছের কৃমিজাতীয় রোগ (Warm disease) সৃষ্টি হয়। এজাতীয় পরজীবী সাধারণত পুকুরে চাষাযোগ্য কার্পজাতীয় মাছের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক হিসেবে দেখা দেয় না। কৃমিজাতীয় পরজীবী মাছের অন্তঃ এবং বহিঃপরজীবী হিসেবে রোগ সৃষ্টি করে। কৃমিজাতীয় রোগের মধ্যে নিম্নবর্ণিত রোগসমূহ ভাষযোগ্য মাছের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
ক. ড্যাটাইলোগাইরোসিস (Dactylogyrosis)
খ. গাইরোড্যাটাইলোসিস (Gyrodactylosis)
ভ্যাকটাইপোগাইরোসি
এ রোগ ফুলকা কৃমি রোগ নামেও পরিচিত।
রোগজীবাণু
ড্যাটাইলোগাইরাস গণের কয়েকটি প্রজাতি এই রোগের সৃষ্টি করে। যথা- ডাকটাইলোগাইরাস ল্যামিলেটাস (Dactyogyrus lamellatus), ড্যাকটাইলোগাইরাস এরিসটিকথিস (D. aristicthys ), ডাটাইলোগাইরাস ড্যানটেটর (D. vastators) ইত্যাদি।
রোগের বিস্তার
এ রোগে প্রধানত মাছের ফুলকা আক্রান্ত হয়। কার্পজাতীয় মাছের ৪-৫ গ্রাম ওজনের পোনা মাছে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। সংক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে এ রোগে মাছের ব্যাপক মড়ক দেখা যায়। বসন্তের শেষে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। পানির তাপমাত্রা ২০-২৫° সেলসিয়াসের মধ্যে এরোগের দ্রুত বিস্তার ঘটে। সাধারণত সিলভারকার্প, বিগহেড কার্প ও গ্রাস কার্পে এ রোগ বেশি ঘটে।
রোগের লক্ষণ
• মাছের দেহে অধিক বিভ্রম সৃষ্টি হয়।
• ফুলকা ফুলে যায় ও ফুলকার রক্তক্ষরণ হয়।
• ফুলকা ও দেহের রং ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
• মাছের শ্বাস-প্রশ্বাসের হার খুবই দ্রুত হয়।
•কানকা খোলা থাকে।
•মাছের রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।
• মাছ দূর্বল হয়ে যায় এবং খুবই ধীরে ধীরে সাঁতার কাটতে থাকে।
গাইরোড্যাকটাইলোি
এ রোগ ত্বক কৃমি রোগ নামেও পরিচিত।
রোগজীবাণু
গাইরোড্যাকটাইলাস গণের কয়েকটি প্রজাতি (Gyrodactylus sp.) এই রোগের পরজীবী। রুইজাতীয় মাছের ৩-৪ গ্রাম ওজনের পোনা এই রোগের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। গ্রীস্মকাে রোগের প্রকোপ বেশি পরিলক্ষিত হয় সংক্রমণ মারাত্মক না হলে এ রোগ সহজে দৃষ্টি গোচর হয় না। এ রোগে পরজীবী মাছের ত্বক ও ফুলকা আক্রান্ত করে।
রোগের লক্ষণ
• আক্রান্ত মাছের ফুলকা দুমড়ে যায় এবং আস্তে আস্তে ছিড়ে যায়।
• আঁইশ ফুলে যায় ও লালচে বর্ণ ধারণ করে।
আক্রান্ত মাছ ছটফট করতে থাকে ও দ্রুত সাঁতার কাটতে থাকে।
• পরজীবীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাছ শক্ত কিছুতে গা ঘষতে থাকে।
• মারাত্মক আক্রান্ত মাছের চোখ ঘোলা হয়ে যায় ও মাছ অন্ধ হয়ে যায়।
•আক্রান্ত মাছের স্বাভাবিক উজ্জ্বল্য থাকে না।
•মাছের বর্ণ ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

মাছের উঁকুন
এজাতীয় পরজীবী মাছের পোনা, আঙ্গুলে পোনা ও বড় মাছ সব ধরনের মাছের ক্ষতি করে থাকে। নার্সারি পুকুর, লালন পুকুর ও মজুদ পুকুরে এই জাতীয় পরজীবীর সংক্রমণ ঘটে থাকে খোলসজাতীয় সন্ধিপন পরজীবীর মধ্যে দুটি পরজীবী মাছের উকুনজাতীয় রোগ ঘটায়। যথা-
ক. গার্ডিয়াসিস (Lernaeasis ) .
এই রোগ আংটা কৃমি রোগ নামেও পরিচিত।
রোগজীবাণু
পার্ণিয়া গণের কয়েকটি প্রজাতি এই রোগ সৃষ্টি করে থাকে।
মিরফ (Lernaea polymarpha),
পার্ণিয়া সিপ্রিনসিয়া ( L. Cyprinacea)
পার্ণিয়া টেনোফেরিনগে ডিনটিল (L) crenopharyngodontis).
রোগের বিস্তার
দেশী কার্পজাতীয় মাছ এবং চীনা কার্পে এ রোগের ব্যাপক প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়। মাছের জীবনচক্রের সব দশাতেই এ রোগের সংক্রমণ দেখা যায়। এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে এরোগের প্রকোপ বেশি ঘটে থাকে। পানির তাপমাত্রা ১৫-৩০ সেলসিয়াসের মধ্যে পরজীবীর সংক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।
আঙ্গুলে পোনা বা কৈশোর অবস্থায় ১-২ টি পরজীবীর সংক্রমণেই মাছের বৃদ্ধি হ্রাস পায় এবং অনেক সময় মাছের আকার বিকৃত হয়ে যায়। পার্ণিয়া প্রধানত ফুলকায় গোড়ায় সংক্রমণ করে। তবে সারা দেহেই সংক্রমণ বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ
• সংক্রমণের শুরুতে মাছ অস্বস্থিকর অবস্থা প্রদর্শন করে।
• মাছের খাদ্য গ্রহণের হার কমে যায় ও মাছ ক্ষীণকায় হয়ে যায়।
• মাছের আক্রান্ত অংশে প্রদাহ হয় ও ফুলে যায়।
• সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে মাছ ছুটাছুটি করতে থাকে।
• আক্রান্ত অংশে লালচে বর্ণ ধারণ করে।
• আক্রান্ত আশে যা হয়।
আরগুলোসিস
এই রোগ সাধারণভাবে মাছের উকুন নামে পরিচিত।
রোগজীবাণু
আরগুলাস গণের কয়েক প্রজাতির পরজীবী এই রোগ সৃষ্টি করে। যথা- আরগুলাস ফলিয়াসস (Argulus folieaceus), আরগুলাস করিগনি ( A. coregoni )
রোগের বিস্তার:
বহুকোষী পরজীবীঘটিত রোগের মধ্যে আরগুলোসিস মাছের প্রধান রোগ। কার্পজাতীয় মাছের দেশী ও বিদেশী সব প্রজাতিতেই এ রোগের সংক্রমণ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। পুকুরে মাছ চাষের ক্ষেত্রে এ রোগ প্রায়শ দেখা যায়। পরজীবী সংক্রমণের মাত্রা কম হলে মাছের খুব বেশি ক্ষতি হয় না।
এ রোগে অনেক সময় পরিপক্ক ও প্রজননক্ষম মাছের ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়। পুকুরের পরিবেশ খারাপ হলে এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। পুকুর পুরানো হলে এবং পচা কাদা বেশি থাকলে এ পরজীবীর সংক্রমণের মাত্রা ও তীব্রতা দুই-ই বৃদ্ধি পায়। মাছের জীবনচক্রের সব দশাতেই এ পরজীবীর সংক্রমণ ঘটে থাকে।
রোগের লক্ষণ
মাছ বিচলিত হয়ে দ্রুত ও অবিশ্রান্তভাবে সাঁতার কাটতে থাকে।
মাছের গায়ে পরজীবী আটকে থাকে।
মাছ পরজীবীর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য
আক্রান্তস্থলের চারপাশ লালচে বর্ণ ধারণ করে।
আক্রান্ত স্থানে ঘা সৃষ্টি হয় ও রক্তক্ষরণ হয়।
মাছের দেহ ক্ষীণ হয়ে যায় ও বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
মাছ অস্থিরভাবে লাফালাফি করতে থাকে।
সারমর্ম :
মাছ চাষের ক্ষেত্রে অণুজীব সংক্রমিত রোগের চেয়ে পরজীবীঘটিত রোগ বেশি পরিলক্ষিত হয়। জলজ পরিবেশে মাত্রাতিরিক্ত জৈব পদার্থের পচন পরজীবীঘটিত রোগের প্রাদূর্ভাব ঘটায়। জলাশয়ের পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে পরজীবী সংক্রমণের মাত্রা ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ খুবই কমবেশি হয়ে থাকে। পুকুর জলাশয়ে অতিরিক্ত জৈব পদার্থের উপস্থিতি এবং অধিক তাপমাত্রায় এসব জৈব পদার্থের পচনই মাছের পরজীবীঘটিত রোগের প্রধান কার্যকারণ।
আরও দেখুনঃ