Site icon Fisheries Gurukul [ মৎস্য গুরুকুল ] GOLN

নীলাভ দাগ রোগ, রক্তাল্পতা, থাইরয়েড টিউমার এবং চক্ষু প্রসারণ রোগ

নীলাভ-দাগ-রোগ,-রক্তাল্পতা,-থাইরয়েড-টিউমার-এবং-চক্ষু-প্রসারণ-রোগ

নীলাভ দাগ রোগ, রক্তাল্পতা, থাইরয়েড টিউমার এবং চক্ষু প্রসারণ রোগ – “মাছের স্বাস্থ্য পরিচর্যা” কোর্স বইটি বিশেষভাবে স্কুল অব এগ্রিকালচার এন্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট-এর বিএজিএড প্রোগ্রামের ছাত্রদের জন্য লেখা হয়েছে। আপনি জানেন, দূর শিক্ষণে শিক্ষকের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নেই। তাই পাঠের কোনো কঠিন বিষয় যেন আপনার বুঝতে অসুবিধা না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই কোর্স বইটি লেখা হয়েছে। কোর্স বইটির আঙ্গিক ও উপস্থাপনা তাই প্রচলিত পাঠ্যবই থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের। যেহেতু সরাসরি শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই কোর্স বইটি আপনাকে নিজে পড়ে বুঝতে হবে, তাই এটি কীভাবে পড়বেন প্রথমেই তা জেনে নিন। এতে কোর্স বইটি পড়তে ও বুঝতে আপনার সুবিধা হবে।

 

 

নীলাভ দাগ রোগ, রক্তাল্পতা, থাইরয়েড টিউমার এবং চক্ষু প্রসারণ রোগ

এ পাঠ শেষে আপনি-

নীলাভ দাগ রোগ

পোনা মাছে সাধারণত এই রোগ দেখা গেছে। পেটের নিচে বা কুসুম থলিতে ঈষৎ নীল বর্ণের দাগ দেখা দিয়ে যে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করে তাকেই নীলাভ দাগ রোগ বলে চিহ্নিত করা হয়। বিভিন্ন মাছের নিষিক্ত ডিম থেকে উদ্ভুত লার্ভা এই রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। এই রোগে লার্ভার দেহে পানি জমা হয়, স্বাভাবিক আকারের পরিবর্তন ঘটে ও কুসুম থলির (Yolk sac) রং এর পরিবর্তন ঘটে। এই রং এর পরিবর্তন উজ্জ্বল নীল হতে বাদামি হতে পারে।

কখনও কখনও কুসুম থলিতে সাদা দাগ দেখা যায়। এই রোগে লার্ভার মজুদে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে যদিও এ রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে পানিতে ভারী ধাতুর আয়ন এর অধিক ঘনত্ব, দ্রবীভূত এ্যামোনিয়ার উচ্চহার ও পরিসফুটন ট্রে (Hatching tray) তে কাঁকর এর পরিমাণ হ্রাস পেলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে। সুস্থ ও সবল প্রজননক্ষম মাছ ব্যবহার, পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ কারিগরি জ্ঞানের দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে এই রোগের প্রকোপ হ্রাস করা যায়।

 

মাছের দেহে রক্তাল্পতা নানা কারণে ঘটে থাকে। এর মধ্যে রোগ জীবাণুর আক্রমণ ও পুষ্টিহীনতা প্রধান। রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে পরিমিত পরিমাণ খাদ্য প্রয়োগ করে পারিবেশিক অবস্থা ঠিক রাখলে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যায় এবং মাছের দ্রুত বর্ধন সম্ভব হয়।

 

 

রক্তাল্পতা

রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা (Erythrocyte) ও হিমোগ্লোবিনের (Haemoglobin) মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে কমে গেলে মাছের দেহে এনিমিয়া (Anemia) বা রক্তাল্পতা দেখা দেয়। রক্তাল্পতা দেখা দিলে মাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়, মাছ দুর্বল ভাবে চলাফেরা করে, মাছের দেহে হরমোন ও বিভিন্ন এনজাইম এয় নিঃসরণ হ্রাস পায়। সর্বোপরি মাছের ওজন হ্রাস পায়। নিম্নলিখিত কারণে মাছের দেহে রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে-

১) রক্তে আয়রন এর পরিমাণ হ্রাস পেলে,

২) মাছের খাদ্যে পুষ্টির পরিমাণ হ্রাস পেলে,

৩ । মাছের খাদ্যে বিভিন্ন ভিটামিন (যেমন- ভিটামিন B6)ও মিনারেলের পরিমাণ হ্রাস পেলে;

৪) আঘাত জনিত কারণে মাছের রক্ত ক্ষরন হলে,

৫ ) ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ, যেমন হেমোরেজিক সেপটিমিয়া হলে,

৬) পরজীবীর আক্রমণ যেমন- আরগুলাস (Fish louse),

৭) ট্রিমাটোড (Trimatode) ও সেসটোড (Cestode) জাতীয় কৃমির আক্রমণ,

৮) পানিতে ভারী ধাতুজনিত দূষণ (Lead foxicity) এর কারণে,

৯) কিডনী ও যকৃতের কার্যকারিতা দীর্ঘ মেয়াদে হ্রাস পেলে।

মাছের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কারণে সৃষ্টি দীর্ঘ মেয়াদী রক্তাল্পতাজনিত রোগে উৎপাদন ব্যাপক হারে হ্রাস পায়, মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ও স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। মাছের রক্তাল্পতাজনিত সমস্যা প্রতিকারের জন্য খাদ্যে ভিটামিন (বিশেষত: B6), মিনারেল (বিশেষতঃ আয়রন) যোগ করা যেতে পারে।

বিভিন্ন ধরনের পরজীবীর আক্রমণ রোধ করতে হবে। পারিবেশিক দূষণ প্রতিরোধ করে স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। পরিশেষে বলা স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, পুষ্টিকর খাবার ও বিজ্ঞান সম্মত কারিগরি জ্ঞানের দক্ষ ব্যবহার করে এই সকল সমস্যার প্রতিকার করা সম্ভব।

থাইরয়েড টিউমার

টিউমার বা নিওপ্লাসিয়া (Neoplasia) হল কোন কলা (Tissue) বা কোষ গুচ্ছের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এই ধরনের কোষের সাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজনের ফলে কোষের পুন: পুন: বৃদ্ধিই টিউমার গঠনের প্রধান কারণ। টিউমারকে প্রধানতঃ বেনাইন (Benign) ও ম্যালিগন্যান্ট (Malignant) এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। গ্রন্থির বেনাইন টিউমারকে কোন কোন ক্ষেত্রে এডিনোমা ও ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকে এডিনোকার্সিনোমা বলা হয়ে থাকে।

থাইরয়েড টিউমার (এডিনোমা ও এডিনোকার্সিনোমা) সাধারণতঃ স্বাদু পানির মাছে দেখা যায় তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সামুদ্রিক মাছেও এই রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। থাইরয়েড হাইপারপ্লাসিয়া (Goiter) ও প্রকৃত নিওপ্লাসিয়ার মধ্যে পার্থক্য করা খুবই কঠিন। মাছের থাইরয়েড ফলিকল (Folicle) গুলো ঢাকনা বিহীন (Non encapsulated) এবং বহি: থাইরয়েড টিস্যুগুলো বিভিন্ন অঙ্গে দেখা যায়।

থাইরয়েড টিউমারের ফলে থাইরয়েড ফলিকলগুলো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে হালকা গোলাপী রং ধারণ করে। থাইরয়েডের এই বৃদ্ধি শ্বসন অঞ্চলের পৃষ্ঠীয় দেশে দেখা যায়, যা গিল আর্চ (Gill arch) সমূহ ভেদ করে অপারকুলামের বাইরেও চলে আসতে পারে। এরা কলয়ডীয় বা অকলয়ডীয় অবস্থায় সারিবদ্ধভাবে ফলিকল তৈরি করতে পারে যা সূতার মতন গঠন তৈরি করে এবং অবিভক্ত এ্যনাপ্লাষ্টিক (Anaplatic) কোষ এর গুচ্ছ তৈরি করে চতুপার্শ্বের টিস্যু সমূহকে ভেদ করে।

সাধারণত: খাদ্যে অজৈব আয়োডিনের পরিমাণ কম বা অভাব এর ফলে থাইরয়েড টিউমার হয়ে থাকে তবে বংশানুক্রমিকভাবেও এই রোগ হতে পারে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে থাইরয়েড টিউমার গঠনের সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। খাদ্যে আয়োডিন যোগ করে অথবা এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে এই রোগের প্রকোপ কমান যায়।

সোডিয়াম আয়োডাইট (Nai) অথবা সোডিয়াম ক্লোরাইড (Nacl) এর সাথে আয়োডিন (12) মাছের খাদ্যে প্রয়োগ করে ভাল ফল পাওয়া যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ভিটামিন B5 বা প্যান্টোথেনিক এসিড (Pantothenic Acid) এর অভাবে মাছে থাইরয়েড হাইপারপ্লাসিয়া (Thyroid hyperplasia) নামক টিউমার গলায় দেখা দেয়, এতে মাছ শ্বাসকষ্ট পায়। মাছকে খাদ্যের সাথে এই ভিটামিন মিশ্রিতকরে খাওয়ালে আরোগ্য লাভ করে।

 

দু’টো প্রধান কারণে মাছের থাইরয়েড গ্রন্থি সংলগ্ন অঞ্চলে টিউমার দেখা দেয়- একটি আয়োডিনের অভাব অপরটি ভিটামিন B5 এর অভাব, উভয় ক্ষেত্রেই মাছের খাদ্যের সহিত সকল উপাদান প্রয়োগ করলে আরোগ্য লাভ করে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

চক্ষু প্রসারণ রোগ

মাছের চক্ষু প্রসারণ রোগ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- এক্সোপথালমিয়া (Expothalmia), চোখ ফুলা রোগ (Pop-eye), চক্ষু প্রসারিত রোগ (Potroted disease)। বিভিন্ন কারণে এই রোগ হতে পারে, যেমন- ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণের ফলে, পরজীবীর আক্রমণের ফলে ও ভিটামিনের অভাবজনিত কারণে।

নানা ধরনের ভাইরাসের কারণে মাছে চক্ষু প্রসারণ রোগ হতে পারে। এই সকল ভাইরাসের মধ্যে Channel Catfish Virus (CCV) এবং Spring Viraemia of carp Virus (SVCV) কার্প জাতীয় মাছে এধরনের রোগ সৃষ্টি করে থাকে। এই সকল ভাইরাস আক্রান্ত মাছের চোখ ফুলে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মনে হয় চক্ষু কোটর থেকে বাহিরে বেরিয়ে এসেছে। CCV জনিত চক্ষু প্রসারণ রোগ এর চিকিৎসার জন্য CCV ভাইরাস দিয়ে তৈরি ভ্যাক্সিন ব্যবহার করা যেতে পারে।

ব্যাকটেরিয়াল সেপটিসিমিয়া রোগ হলেও এ রোগের সম্ভাবনা থাকে তখন এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ খুবই উপযোগী (পাঠ ৪.২ অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে)। এছাড়া দূষণমুক্ত পরিবেশ ও দক্ষ স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই রোগের প্রকোপ কমানো যায়। কিছু কিছু প্রটোজোয়ান পরজীবীর আক্রমণেও চক্ষু প্রসারণ রোগ মাছে দেখা দিতে পারে। এই সকল পরজীবীর মধ্যে Myxosoma hoffmoni স্বাদু পানিরমাছে অধিক হারে আক্রমণ করে।

আবার অনেক ধরনের Eye-fluke যেমন Diplostomum spathaceum চক্ষু প্রসারণ রোগের অন্যতম কারণ। এই সকল পরজীবীর আক্রমণে চোখ অস্বাভাবিকভাবে বাইরে বেরিয়ে আসে ও ফোলা অবস্থায় থাকে। সহ্য করা সময় পর্যন্ত লবণ (Nacl) পানির দ্রবণে (১.২%) অসুস্থ মাছকে গোছল করালে ভাল ফল পাওয়া যায়। এছাড়া ১৫ ppm ফরমালিন অথবা ৫ ppm KMno4 দ্রবণে সহ্য করতে পারে এমন সময় পর্যন্ত গোছল করান যেতে পারে।

রেটিনল (Retinol) বা ভিটামিন “A” এর অভাবজনিত কারণে মিউকাস নিঃসরণকারী এপিথেলিয়াল কলা (Tissue) গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারণে মাছের চোখে প্রদাহ ও চক্ষু প্রসারণ রোগ হতে পারে। ভিটামিন A -এর উৎস যে B-ক্যারোটিনয়েড এর অভাবে চোখের নরম তন্ত্র ও কলায় (Soft tissue) প্রদাহ দেখা দিতে পারে যার ফলে মাছের চোখ ফুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। ভিটামিনের অভাবজনিত চক্ষু প্রসারণ রোগের চিকিৎসার জন্য মাছের খাদ্যে ভিটামিন A যোগ করে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।

 

চক্ষু প্রসারণ রোগ নানা কারণে হয়ে থাকে তার মধ্যে রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে ঐ সকল রোগের প্রভাবে চক্ষু প্রসারিত হয়। কোন কোন পরজীবীর সরাসরি আক্রমণে এ রোগ হয়- আবার ভিটামিন “A” এর অভাবে এ রোগ হয়ে থাকে।

 

 

অনুশীলন (Activity): নীলাভ দাগ রোগ, রক্তাল্পতা, থাইরয়েড টিউমার ও চক্ষু প্রসারণ রোগে প্রতিকার পদ্ধতি সংক্ষেপে লিখুন।

সারমর্ম: মাছের লার্ভা নীলাভ দাগ রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। এই রোগে লার্ভার দেহে পানি জমা হয় ও কুসুম থলির রং পরিবর্তিত হয়ে উজ্জ্বল নীল বা বাদামি হতে পারে। সুস্থ, সবল প্রজননক্ষম মাছ ব্যবহার ও দূষণমুক্ত পরিচ্ছন্ন হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা এই রোগের ঝুঁকি কমায়। থাইরয়েড টিউমারের প্রধান কারণ হলো খাদ্যে আয়োডিন ও ভিটামিন B5এর অভাব।

থাইরয়েড টিউমারের ফলে থাইরয়েড ফলিকল গুলো ফুলে যায় ও গোলাপী রং ধারণ করে এবং গিল আর্চ ভেদ করে অপারকুলামের বাইরে চলে আসে। খাদ্যে সোডিয়াম আয়োডাইড (Nal) বা সোডিয়াম ক্লোরাইডের সাথে আয়োডিন (12) এবং ভিটামিন B5 যোগ করে মাছকে খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়।

রক্তে লোহিত রক্ত কণিকাও হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে মাছের দেহে রক্তাল্পতা দেখা যায়। সাধারণত আয়রন (Fe) ও ভিটামিন (B5) এর কারণে রক্তাল্পতা দেখা যায়। খাদ্যে Fe সমৃদ্ধ খাবার ও ভিটামিন B6 ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যায়। ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া বা পরজীবীর আক্রমণে অথবা ভিটামিন A- এর অভাবজনিত কারণে চক্ষু প্রসারণ রোগ হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী ভিটামিন প্রয়োগ করে এবং রোগ জীবাণুর চিকিৎসা করলে এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

আরও পড়ুনঃ

Exit mobile version