আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় -নার্সারিতে চুন প্রয়োগ। যা “বাগদা চিংড়ির নার্সারি ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
নার্সারিতে চুন প্রয়োগ
পুকুরে অবাঞ্চিত ও রাক্ষুসে মাছ দমনের পরবর্তী ধাপ হলো চুন প্রয়োগ। মাটির উর্বরতা শক্তির উপর চিংড়ির ফলন নির্ভরশীল বিধায় মাটির শোধন ও উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য পুকুরে চুন প্রয়োগ করা প্রয়োজন। পুকুরে চুন প্রয়োগ করলে একসঙ্গে অনেকগুলো উপকার পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রধান প্রধান গুণাবলিগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. চুন চিংড়ির চাষের পরিবেশকে অর্থাৎ মাটি ও পানির অম্লত্ব ও ক্ষারত্বকে নিরপেক্ষ করে। পানির অম্লীয় ও ক্ষারকীয় গুণকে ভারসাম্যের মধ্যে রাখে তথা পানির পিএইচ চিংড়ি চাষের অনুকূল অবস্থা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পানির পিএইচ ৭.৫-৮.৫ এর মধ্যে থাকলে সেই পুকুরে চিংড়ির বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হয়।
২. চুন বাফার দ্রবণ হিসেবে মাটি বা পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. চুন প্রয়োগের ফলে পুকুরের মাটি থেকে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকারক উপাদানসমূহ তথা খনিজ পদার্থ বা মিনারেলস (যা পানির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক) অতি সহজেই মুক্ত হয়ে পানিতে মিশে। ফলে পুকুরের স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যায়, যা চিংড়ির প্রাকৃতিক খাবার তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৪. চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর এমন ধরনের রোগ বিস্তারের উৎস, রোগ জীবাণু এবং রোগজীবাণু পরিবাহক পরজীবীসমূহকে চুন ধ্বংস করে তথা জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে।
৫. চুন পানিতে বিদ্যমান অতিরিক্ত জৈব কণা ও কাদাকে অধঃক্ষেপ না করে পানিকে পরিষ্কার রাখতে তথা দূর করতে সহায়তা করে। এর ফলে পুকুরে পর্যাপ্ত আলোর অনুপ্রবেশ নিশ্চিত হয়, ফলে সালাকেসংশেষণের মাধ্যমে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়।
৬. পুকুরের তলদেশে সঞ্চিত বাজে গ্যাস দূর করে।
৭. চুনের ক্যালসিয়াম চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধিতে বিশেষ করে প্রজনন কালে জুণের বর্ধন ও খোসা গঠনে সহায়তা করে।
৮. চুন পানিতে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে পানির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তথা পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যমালা ফাইটোপ্ল্যাংকটুন ও জুপ্ল্যাংকটন তৈরি করে পানির বর্ণ সবুজ করতে সহায়তা করে।
৯. জৈব পদার্থসমূহ ভেঙে গিয়ে মাটির ও পানির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে।
১০. প্রয়োজনীয় উপকারী জীবাণুদের বংশ বৃদ্ধিতে ও জৈব পদার্থসমূহের সুষ্ঠু পচনের জন্য চুন সহায়তা করে।
১১. চুন পুকুরের পানিতে তন্ত্রময় অ্যালজি থেকে মুক্ত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
১২. সালাকেসংশ্লেষণের জন্য পর্যাপ্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরির মাধ্যমে চুন পানিতে অক্সিজেন স্বল্পতার মাত্রাকে কমিয়ে আনে। সালাকেসংশেষণ প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধির মাধ্যমে চুন পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
১৩. চুন প্রয়োগের ফলে জৈব পদার্থের পচন ক্রিয়া দ্রুত হয় এবং পুকুরের তলদেশ থেকে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বের করে দেয় এবং পুকুরের তলার মাটি নিরপেক্ষ হয়।
১৪. চুন পুকুরের পানিতে বিদ্যমান অতিরিক্ত ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম এবং পটাসিয়াম-এর বিষক্রিয়া দূর করে এবং পানিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ফলে জলজ পরিবেশ থেকে জটিল যৌগসমূহ গ্রহণণাপযাগৌ হয়।
১৫. চুন প্ল্যাংকটনের বৃদ্ধির জন্য কাদায় আবদ্ধ ফসফরাসকে মুক্ত করে দেয়।
১৬. চুন মাটি এবং পানির মধ্যে সালফিউরিক অ্যাসিডের মত অত্যন্ত ক্ষতিকারক পদার্থের স্থায়ী বন্ধ হওয়াকে প্রতিরোধ করে।
১৭. চুনের অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম পুকুরে সার হিসেবে কাজ করে।
১৮. চুন প্রয়োগে পানির ঘালোত্ব দূর হয়। ফলে পুকুরে সালাকেসংশেষণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
১৯. চুন থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম চিংড়ির খালস তৈরির একটি অন্যতম উপাদান। ক্যালসিয়ামের অভাবে। অনেক সময় চিংড়ির খোলস বদল হয় না বা বিলম্বিত হয়। এমনকি খোলস বদল হলেও তা শক্ত হতে দেরি হয়, ফলে চিংড়ির দেহ দীর্ঘক্ষণ নরম থাকে। চুনের ক্যালসিয়াম চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

চুনের প্রকারভেদ
বাজারে বিভিন্ন ধরনের চুন পাওয়া যায়, যেমন- পাথুরে চুন, পোড়া চুন, কলিচুন ইত্যাদি। এছাড়াও শামুক ও ঝিনুকের খোলস পুড়িয়েও এক ধরনের চুন পাওয়া যায়, তবে এগুলো চিংড়ি চাষের পুকুরে ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যায় না। এর সবগুলোই ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ। বাজারে প্রাপ্ত চুনসমূহ হলো?
ক) পাথুরে চুন
খ) পোড়া চুন
গ) কলি চুন
ঘ) ডলোমাইট
ঙ) জিপসাম
প্রয়োগের মাত্রা পানি ও মাটির পিএইচ, পুকুরের খাটির ধরণ, (যেমন- বেলে, দোআঁশ, এঁটেল), পুকুরের বয়স, চুনের প্রকার ও গুণাগুণ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের উপর চুন প্রয়োগের মাত্রা নির্ভর করে। কাদা মাটি, এঁটেল মাটি ও লাল মাটির পুকুরে স্বাভাবিক মাত্রায় চেয়ে একটু বেশি চুন প্রয়োজন হয়। ঘের দীর্ঘ দিন আগাছা ও পচা আবর্জনায় পূর্ণ থাকলে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে চুন বেশি দরকার হয়। সাধারণত শতাংশ প্রতি এক কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হয়। পোড়া চুনের ক্ষমতা পাঙ্গুরে চুলের দ্বিগুণ এবং কলিচুনের ক্ষমতা পাখুত্রে চুনের দেড় গুণ ।
পিএইচ-এর উপর ভিত্তি করে চুন প্রয়োগের মাত্রা
পিএইচ মান | ৩-৫ এর মধ্যে | ৫-৬ এর মধ্যে | ৬-৭ এর মধ্যে |
পোড়া চুদের পরিমাণ | ৬ কেজি/শভাংল | ৪ কেজি/শতাংশ | ১-২ কেজি/শতাংশ |
ব্যবহার পদ্ধতিক্ত পুকুর তৈরির সময় প্রয়োজনীয় চুন একটি মাটির চাড়ি বা পামলার মধ্যে কমপক্ষে ১২-২৪ ঘন্টা আগে জ্বলে নিতে হবে। তারপর প্রয়োজনীয় চুন পাড়সহ সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। চুল ব্যবহারের সময়কাল হলো চাষ দেয়ার ২-৩ দিন পর অখবা বিষ প্রয়োগের ৭-৮ দিন পর।
সতর্কতা
- ভেজানোর সময় চুল ফুটতে থাকে তাই এ সময় সতর্ক থাকুন।
- পোড়া চুন এবং কলিচুন অত্যন্ত ক্ষারীয় তাই এটি ব্যবহারে পিএইচ দ্রুত বেড়ে যায়। এজন্য পুকুর গুকানো অবস্থায় তা ব্যবহার করা নিরাপদ।
- চুন ব্যবহারের সময় নাক ও মুখ পামছা দিয়ে বেধে নিতে হবে এবং বাতাসের অনুকূলে ছিটাতে হবে। পাস্টিকের বালতিতে চুদ ওলানো যাবে না।
- চুন শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে। ব্যবহারের পর পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে। রাখতে হবে।
আরও দেখুনঃ