আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ধানক্ষেতে চিংড়ি চাষ – যা সমন্বিত মৎস্যচাষ ব্যবস্থাপনা এর অন্তর্ভুক্ত।
ধানক্ষেতে চিংড়ি চাষ
পুকুরের পাশাপাশি ধান ক্ষেতেও চিংড়ি চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ধান ক্ষেতে গলদা চিংড়ির চাষ করে ভালো মুনাফা পাওয়া যায়। চিংড়ির জন্য কোনো বাড়তি খাবার না দিয়ে ধানক্ষেতে তিন চার মাসে হেক্টর প্রতি ১০০-২০০ কেজি এবং বাড়তি খাবার দিয়ে ২৫০-৩৫০ কেজি গলদা চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব। চিংড়ির চাষের আকর্ষণীয় দিকগুলো হলো –
- চিংড়ি কাঁটাবিহীন ও সুস্বাদু বলে সবার কাছে খুবই প্রিয়;
- এটি পানির তাপমাত্রা এবং লবণাক্ততার বিরাট তারতাম্য সহ্য করতে পারে;
- এর বৃদ্ধি খুবই দ্রুত;
- এককভাবে কিংবা অন্য কোন মাছের সাথে চাষ করা যায় ও
- দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে বছরের অধিকাংশ সময়েই এর পোনা পাওয়া যায়।
চাষ পদ্ধতি:
ধানক্ষেতে লাভজনকভাবে চাষ করার জন্য গলদা চিংড়ি সবচেয়ে ভালো। যেসব ধানী জমিতে পাঁচ-ছয় মাস বন্যার পানি থাকে সেখানে বোরো ধানের পর গলদা চিংড়ি চাষ করা যেতে পারে। ধানক্ষেতে চিংড়ি চাষের এ কার্যক্রম যুগপৎ পদ্ধতি বা পর্যায়ক্রম পদ্ধতিতে করা যেতে পারে।
ধানের সাথে চিংড়ি চাষ:
বোরো ধানের সাথে চিংড়ি চাষের সম্ভাবনাময় স্থানগুলো কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাক্ষণবাড়ীয়া জেলার হাওর এলাকাসমূহে। এসব স্থানে যেখানে জমিতে ৪-৬ মাস পানি থাকে সেসব জমিতে ধানের সঙ্গে সেচ ব্যবস্থা ছাড়াই চিংড়ি চাষ করা যেতে পারে ।
ধানের সাথে চিংড়ি চাষ করতে সব কাজকে চারটি প্রধান অংশে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হলো-
১. জমি প্রস্তুতকরণ;
২. মাটি কর্ষণ ও সার প্রয়োগ;
৩. ধানের চাষ;
৪. চিংড়ি চাষ ।
উল্লেখিত কাজগুলোর মধ্যে এক হতে তিন পর্যন্ত ধানক্ষেতে মাছ চাষের অনুরূপ হবে। তবে চিংড়ির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নির্গম নালা তৈরি, নালা বা চোঙের মুখে তারের জাল স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখতে
হবে।

চিংড়ির পোনার আকার :
কমপক্ষে ৫ সে.মি.।
পোনা মজুদের হার :
হেক্টর প্রতি ১০-১৫ হাজার (৪০-৬০টি প্রতি শতাংশ)
পানি ব্যবস্থা :
প্রথম দিকে পানি ৪-৬ ইঞ্চি গভীর হলে চলবে এবং এ গভীরতা ধান ও চিংড়ির বৃদ্ধির সাথে বাড়াতে হবে। শেষের দিকে পানির গভীরতা ১২ ইঞ্চি হবে। আগাছা পরিষ্কার করা এবং সার প্রয়োগের জন্য ক্ষেতের পানি কমাতে হবে। তখন চিংড়িগুলোকে নালা ও গর্ভের পানিতে রাখতে হবে।
খাবার প্রদান :
ধান ক্ষেতে চিংড়ি চাষে কোন বাড়তি খাবার না দিয়েও চিংড়ি উৎপাদন হতে পারে। চিংড়ি ধান ক্ষেতের শ্যাওলা, পোকা-মাকড়, লার্ভি ও পচনশীল দ্রবাদি খেয়ে থাকে। তবু কিছু খাবার প্রয়োগ করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চিংড়ি ছাড়ার মাস খানেক পর থেকে দেহের ওজনের ৩-৫% হারে খৈল ও ভুসি বা কুঁড়া ১ঃ১ অনুপাতে মিশিয়ে একদিন অন্তর অন্তর নালা বা গর্তে প্রয়োগ করতে হবে ।
চিংড়ি আহরণ :
ধান পাকা শুরু হলে ক্ষেতের পানি ধীরে ধীরে কমাতে হবে। এতে চিংড়িগুলো নালা ও গর্তে গিয়ে আশ্রয় নেবে । তখন প্রথমে ধান কেটে পরে চিংড়ি ধরতে হবে। চিংড়ি হাত দ্বারা, জাল দিয়ে ও ফাঁদ পেতে ধরা যায়। চিংড়ি বিক্রির আকারে না পৌঁছলে অর্থাৎ প্রতিটি অন্তত ৩৫ গ্রাম ওজনের না হলে ধান কাটার পরও চিংড়ি ক্ষেতে রেখে বড় করে নেয়া যেতে পারে ।
চিংড়ির ফলন :
বোরো ধানক্ষেতে (হাওর এলাকায়) চিংড়ি চাষ করলে বাড়তি খাবর ছাড়াই এর উৎপাদন হেক্টর প্রতি প্রায় ২০০ কেজি। খাবার দিলে উৎপাদন ৩৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে । আমন ধান ক্ষেতে বাড়তি খাবার ছাড়া চিংড়ির উৎপাদন হেক্টর প্রতি ১০০-১৫০ কেজি হয়। খাবার দিলে উৎপাদন ২০০-৩০০ কেজি হতে পারে ।
সাবধানতা
- ধানক্ষেতের পানি যেন শুকিয়ে না যায়, কিংবা এত কমে না যায় যে পানি বেশ গরম হয়ে ওঠে। উভয় অবস্থাতেই চিংড়ি মারা যেতে পারে;
- অতি বৃষ্টি অথবা অন্য কোন কারণে যেন পানি জমে আইল উপচে না যায় । পানি উপচে পড়লে পানির সাথে চিংড়ির বের হয়ে যাবে;
- পানি নির্গমণ পথে যেন তারের জাল বা বাঁশের বানা দৃঢ়ভাবে আটকে থাকে । অন্যথায় চিংড়ি পানির সাথে চলে যেতে পারে;
- ক্ষেতের পানি কমে গেলে সাপ, বড় ব্যাঙ, ইঁদুর, শিয়াল ইত্যাদি প্রাণী চিংড়িকে খেয়ে ফেলতে পারে
- চিংড়ি অধিক অক্সিজেন সংবেদনশীল। তাই সব সময় খেয়াল রাখতে হবে খড়কুটা বা অব্যবহৃত খাদ্য পচে যেন অক্সিজেন কমে না যায় ।
পর্যায়ক্রম পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ :
পর্যায়ক্রম চিংড়ি চাষের সম্ভাবনাযুক্ত স্থানগুলো হলো বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার নিচু বাইদ জমিগুলো। এসব জমি সচরাচর উঁচু আইল কিংবা জমি দ্বারা বেষ্টিত এবং বোরো ধান কাটার পর পতিত অবস্থায় থাকে। এরূপ সুবিধাপন্ন অন্যান্য এলাকাতেও পর্যাক্রমে ধান ও চিংড়ি চাষ করা যাবে। এ ধরনের চাষে চিংড়িকে এককভাবে অথবা অন্যান্য মাছের সাথে মিশ্রচাষরূপে উৎপাদন করা যেতে পারে । ধানের পরে চিংড়ির চাষ করতে সব কাজকে তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত করা যায়, এগুলো হলো-
১. জমি প্রস্তুতকরণ;
২. ধানের চাষ এবং
৩. চিংড়ি চাষ ।
উল্লেখিত কাজগুলোর মধ্যে জমি প্রস্তুতকরণ এবং ধানের চাষ দু’টি বিষয় ধানক্ষেতে মাছ চাষের প্রায় অনুরূপ হবে। এক্ষেত্রে যেহেতু জমিতে প্রচুর পানি থাকে সেহেতু জমিতে গর্ত খননের প্রয়োজন নেই। তবে চিংড়ি ধরার সুবিধার জন্য জমির নিচু স্থানে গর্ত রাখলে ভালো হয়। ধান কাটার সময় ধান এমনভাবে কাটতে হবে যাতে ক্ষেতে যথেষ্ট পরিমাণ ধান গাছের গোড়া বা নাড়া থেকে যায়। এগুলো পরে পচে গিয়ে চিংড়ির খাবার তৈরি হবে।
পোনার আকার :
চিংড়ি ২ ইঞ্চি।
রুই জাতীয় পোনা ৩-৪ ইঞ্চি ।
প্রতি শতাংশে পোনা মজুদের হার :
চিংড়ি ৬০-৭২টি।
সরপুঁটি ৮টি
রুই ২টি
পর্যাক্রম পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ :
পর্যাক্রম পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে পরিচর্যার ধরন যুগপৎ পদ্ধতির ন্যায় ৷
চিংড়ির ফলন :
এ পদ্ধতিতে এককভাবে গলদা চিংড়ির চাষ করলে হেক্টর প্রতি প্রায় ৪০০ কেজি চিংড়ি পাওয়া যাবে। মিশ্রচাষে প্রতি হেক্টর ১৫০-২০০ কেজি চিংড়ি এবং ৪০০-৫০০ কেজি মাছ পাওয়া যেতে পারে।
আরও দেখুনঃ