আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – জৈব পেস্টিসাইড । যা ” গলদা খামার প্রস্তুতকরণ ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
জৈব পেস্টিসাইড
জৈব পেস্টিসাইড
রাক্ষুসে মাছ ও অবাঞ্ছিত প্রাণী দমনের জন্য বিভিন্ন ধরনের জৈব ও অজৈব বা রাসায়নিক পোস্টসাইড ব্যবহার করা হয়। কিন্তু যে কোনো ধরনের পেস্টিসাইড পুকুরে প্রয়োগ করা ঠিক নয়। কারণ কিছু কিছু পেস্টিসাইড আছে, যেগুলো প্রয়োগের ফলে মৃত মাছ খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে এবং পুকুরের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
তাছাড়া এসব পেস্টিসাইডের বিষক্রিয়া দীর্ঘদিন যাবৎ থাকে। এতে চিংড়ি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য বারবার জাল টেনে মাছ ধরে ফেলা এবং পুকুর শুকানো সবচেয়ে ভালো। যদি পুকুর সম্পূর্ণরূপে শুকানো সম্ভব না হয় তবে সে ক্ষেত্রে জৈব পেস্টিসাইড হিসেবে রোটেনন, মহুয়ার খৈল, চা বীজ খৈল, তামাকের গুড়া প্রভৃতি ব্যবহার করা যায়। জৈব পেস্টিসাইড ব্যবহারে সুবিধাসমূহ নিচে দেয়া হলো:
- পোনা মজুদের পূর্বে জৈব পেস্টিসাইড ব্যবহারের ফলে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ এবং ক্ষতিকর পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি বসে প্রাপ্ত হয়। ফলে মজুদকৃত গোনার মৃত্যুহার অনেক কমে যায়।
- জৈব পেস্টিসাইড মাছের ফুলকার কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। ফলে মাছ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় এবং মাছের দেহে কোনো বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় না। এভাবে মৃত মাছ খেলে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না।
- এদের বিক্রিয়া অল্প সময়ের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে এরা জৈব সার হিসেবে কাজ করে। ফলে চিংড়ি চাষির আর্থিক সাশ্রয় হয়।
- পরিমিত মাত্রায় জৈব পেস্টিসাইড ব্যবহারের ফলে পুকুরের পানি ব্যবহার উপযোগী থাকে।
- পুকুরের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় না।
- কোনো কোনো পেস্টিসাইড যেমন- রোটেনন, চা বীজ খৈল ইত্যাদি চিংড়ি চাষকৃত পুকুরে প্রয়োগ করেও রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দমন করা যায়।
জৈব পেস্টিসাইড প্রয়োগ পদ্ধতি
পুকুরের পানির আয়তন ও গভীরতা জেনে সুবিধামতো পেস্টিসাইড নির্বাচন করে নিম্নে বর্ণিত ছক অনুযায়ী পরিমাণ জেনে নিচের নির্দেশিত উপায়ে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
পানিতে জৈব পেস্টিসাইড ব্যবহারের মাত্রা
পেস্টিসাইড | কেজি/হে/মি | কেজি/একর/মি | গ্রাম/শতকমিশ | গ্রাম/ঘনমিটার | গ্রাম/ঘনফুট |
১. রোটেনন | ২০-৩০ | ৮-১২ | ৮০-১২০ | ২-৩ | ০০৭ |
২. চা বীজ খৈল | ৪০ | ১৬ | ১৬০ | ৪ | ০.১১ |
৩. তামাকের গুড়া | ২০০-৪০০ | ৮০-১৬০ | ৮০০-১৬০০ | ২০-৪০ | ০.৮৫ |
*পানির গভীরতার পরিমাণ
রোটেনন প্রয়োগ পদ্ধতি
রোটেনন এক ধরনের হালকা বাদামি রং এর পাউডার জাতীয় পদার্থ। ডেরিস নামক এক ধরনের গাছের শিকড়। থেকে রোটেনন তৈরি করা হয়। পাহাড়ি এলাকায় এ জাতীয় গাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। রোটেনন প্রয়োগে মৃত মাছ খেলে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না।
নির্ধারিত পরিমাণ রোটেনন পাউডারের কিছু অংশ অল্প পরিমাণ পানিতে মিশিয়ে ছোট ছোট বল তৈরি করে পুকুরের গভীর পানিতে নিক্ষেপ করতে হবে। এর ফলে কাদার নিচের ও উপরিভাগের প্রাণীসমূহ মারা যাবে। অবশিষ্ট পাউডার বেশি পানিতে গুলে পাউডারের দ্রবণ সমস্ত পুকুরে উত্তমরুপে ছিটিয়ে দিতে হবে। সূর্যালোকে এই পাউডারের বিষক্রিয়া তাড়াতাড়ি শুরু হয় বিধায় বৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এই পাউডার পুকুরে প্রয়োগ করা ভালো।
চা বীজ খৈল প্রয়োগ পদ্ধতি
রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দমনের জন্য জানা মতে ক্যামেলিয়া প্রজাতির চা বীজ খৈল সবচেয়ে ভালো। এই পেস্টিসাইড প্রয়োগে পুকুরের চিংড়ি ও প্রাকৃতিক খাদ্যের কোনো ক্ষতি হয় না। ফলে পুকুরে চিংড়ি চাষ করা অবস্থায় এই পেস্টিসাইড পুকুরে ব্যবহার করা যায়।
নির্ধারিত মাত্রায় চা বীজ খৈল প্রয়োগ করলে পুকুরের পানিতে অবস্থিত রোটিফার, কপিপাড়ে প্রভৃতি খাদ্যকণার কোনো ক্ষতি হয় না এবং পেস্টিসাইড সহজেই পচনশীল এবং ২-৩ দিনের মধ্যে এর বিষক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া চা বীজ খৈলের অবশিষ্ট অংশ পুকুরে সার হিসেবে কাজ করে।
নির্ধারিত পরিমাণ চা বীজ খৈল প্রায় ২৬ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এর ফলে স্যাপোনিন নামক বিষাক্ত পদার্থ পানিতে দ্রবীভূত হয়। পরে এই দ্রবণ আরও বেশি পানির সাথে মিশিয়ে পুকুরের সমস্ত পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। এই দ্রবণ পুকুরের পানিতে প্রয়োগের ৩০ মিনিট সময়ের মধ্যেই সাধারণত মাছ মরতে শুরু করে।
এই দ্রবণ প্রয়োগের সময় পানির গভীরতা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত অর্থাৎ পানির গড়ীরতা একই মাত্রায় রাখলে দ্রবণের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। এই দ্রবণ অয়োগের সময় পুকুরের পানির গভীরতা যতদূর সম্ভব কম রাখলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এরপর মৃত মাছ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
তাম্যকের গুড়া প্রয়োগ পদ্ধতি
সিগারেট বা বিড়ি ফ্যাক্টরি থেকে তামাকের গুড়া সংগ্রহ করে অল্প পরিমাণ পানিতে ভিজিয়ে রাখলে নিকোটিন নামক বিষাক্ত পদার্থ পানিতে দ্রবীভূত হয়। নিকোটিন মিশ্রিত দ্রবণ বেশি পানিতে মিশিয়ে পুকুরের সমস্ত পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর কিছু সময়ের মধ্যেই এর বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
সাধারণত শামুক, ঝিনুক ও ককড়া দমনের জন্য তামাকের গুড়া ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে পুকুরের পানি নিষ্কাশন করে কাদার উপরিভাগে তামাকের গুড়া প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। দিনের তাপমাত্রা বেশি থাকলে এবং রৌদ্রময় দিনে এই পেস্টিসাইড প্রয়োগ করলে এর বিষক্রিয়া তাড়াতাড়ি শুরু হয়। জৈব পেস্টিসাইড ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
- জৈব পেস্টিসাইড প্রয়োগের ফলে মৃত মাছ সম্ভাব্য অল্প সময়ের মধ্যে পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে নতুবা এই মাছ পচে পুকুরের পরিবেশকে নষ্ট করে ফেলতে পারে
- পেস্টিসাইড প্রয়োগের পর এর বিষক্রিয়া প্রশমনের জন্য কমপক্ষে ৭ দিন পুকুরের পানি ব্যবহার না করা ভাল
- বিষক্রিয়া দ্রুত সংগঠিত হওয়ার জন্য রৌদ্রময় দিনে পেস্টিসাইড ব্যবহার করা ভালো এবং রৌদ্রময় দিনে এর বিষক্রিয়াও তাড়াতাড়ি প্রশমিত হয়।
- পেস্টিসাইড প্রয়োগের সময় শরীরে যাতে না লাগে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
- পেস্টিসাইড প্রয়োগের সময় নির্ধারিত প্রয়োগ মাত্রার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে যেন এর ব্যবহার নির্ধারিত মাত্রার কম বা বেশি না হয়।
অজৈব পেস্টিসাইড প্রয়োগ পদ্ধতি
অজৈব বা রাসায়নিক পেস্টিসাইড প্রয়োগ করেও রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ এবং প্রাণী দমন করা যায়। সাধারণত রাক্ষুসে মাছ দমন করতে এনড্রিন, থায়োডিন, বিচিং পাউডার, ফসটক্সিন প্রকৃতি রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ সব রাসায়নিক দ্রব্যের বিষক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী, মৃত মাছ খাওয়া যায় না এবং গৃহস্থালির স্বাভাবিক কাজকর্মে পুকুরের পানি ব্যবহারও নিরাপদ নয়।
এ সব পেস্টিসাইডের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য সম্পূর্ণরূপে ক্ষধ্বংস হয়ে যায় এবং এদের বিষক্রিয়া প্রশমিত হতে কমপক্ষে ২-৩ সপ্তাহ সময় লাগে। তাছাড়া অজৈব পেস্টিসাইড প্রয়োগের ফলে মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস পায়। এ সব কারণে পেস্টিসাইড হিসেবে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করাই ভাল।
ফসটক্সিন/কুইকফস/সেলফস প্রয়োগ পদ্ধতি
এই পেস্টিসাইড বাজারে ট্যাবলেট হিসেবে পাওয়া যায়। এই ট্যাবলেট সমানভাবে সমস্ত পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। তারপর জাল টেনে পুকুরের পানি ওলট-পালট করে দিতে হবে। এই ট্যাবলেট প্রয়োগের ১-২ ঘণ্টা পর মাছ মরে ভাসতে শুরু করে এবং সাথে সাথে এ সব মৃত মাছ উঠিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ঔষধের বিষক্রিয়া ৭-১০ দিন স্থায়ী হয়। কম গভীর পুকুরে এর কার্যকারিতা বেশি।
প্রয়োগ মাত্রা
পানির আয়তন (শতাংশ) | পানির গড় গভীরতা | ট্যাবলেট সংখ্যা |
১ | ৩০ সে.মি (১ ফুট) | ১ টি |
১০ | ৩০ সে.মি (১ ফুট) | ১০টি |
৩৩ | ১.৫ মিটার (৫ ফুট) | ১৬৫ টি |
৫০ | ১.৫ মিটার (৫ ফুট) | ২৫০ টি |
বিচিং পাউডার প্রয়োগ পদ্ধতি
বিচিং পাউডার পানির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করতে হবে। তারপর এই দ্রবণ সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটেয়ে দিতে হবে। এই দ্রবণ ছিটানারে ৩০ মিনিট পর জাল টেনে পানি ওলট-পালট করে দিতে হবে যাতে বিচিং পাউডারের দ্রবণ পুকুরে ভালাভাবে মিশে।
এরপর ভাসতে শুরু করলে জাল টেনে সমস্ত মাছ পুকুর থেকে তুলে ফেলতে হবে পুকুরে বিচিং পাউডারের বিষক্রিয়া ৮-১০ দিন পর্যন্ত থাকে। বিচিৎ পাউডার প্রয়োগের ফলে পুকুরের সমস্ত মাছ ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুক, পরজীবী প্রাণী ও অন্যান্য রোগজীবাণু মারা যায়। বিচিং পাউডার পুকুরে চুনের কাজও করে। ফলে পুকুরে বিচিং পাউডার প্রয়োগ করলে চুন ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই।
প্রয়োগ মাত্রা
মাছ ও অন্যান্য প্রাণী দমনের জন্য ৫ নিযুতাংশ হারে ক্লোরিন প্রয়োগ করা হয়। বিচিং পাউডারে ৩০-৬০% ক্লোরিন থাকে। সুতরাং পুকুরে পাউডার প্রয়োগের পূর্বেই ৫ নিযুতাংশ হারে মোট কী পরিমাণ পাউডারের প্রয়োজন তা বের করে নিতে হবে। অথবা নিচে বর্ণিত ছক অনুযায়ী বিচিং পাউডার পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
পানির আয়তন (শতাংশ) | পানির গড় গভীরতা | পাউডারের পরিমাণ |
১ | ৩০ সে.মি (১ ফুট) | ৯০০ গ্রাম |
১০ | ৩০ সে.মি (১ ফুট) | ৯ কেজি |
৩৩ | ১.৫ মিটার (৫ ফুট) | ১৫০ কেজি |
৫০ | ১.৫ মিটার (৫ ফুট) | ২৫০ কেজি |
আরও দেখুনঃ