গলদা চিংড়ি চাষের প্রকারভেদ | অধ্যায়-২ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – গলদা চিংড়ি চাষের প্রকারভেদ । যা ” গলদা চিংড়ি চাষ ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।

শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।

গলদা চিংড়ি চাষের প্রকারভেদ

 

গলদা চিংড়ি চাষের প্রকারভেদ | অধ্যায়-২ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২

 

স্বাদুপানির চিংড়িসমূহের একটি প্রজাতি গলদা চিংড়ি নামে পরিচিত। পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতের প্রায় ৪৫০ প্রজাতির চিংড়ি আছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৬৩ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায় (মিঠাপানিতে প্রায় ২৭টি এবং সমুদ্রে প্রায় ৩৬টি প্রজাতি)। এদের মধ্যে বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্পূর্ণ কয়েকটি স্বাদপানির চিংড়ি হলো গলদা চিংড়ি, ছটকা কাঁঠালিয়া, ছোহনো, ছোরিয়া, রদা, গোদা ইত্যাদি।

গলদা চিংড়ি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গ্রীষ্মম-ল ও ক্রান্তীয়ম-লের কাছাকাছি বেশি পাওয়া যায়। এ সমস্ত অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কাম্পুচিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন গুরুত্বপূর্ণ। এ সমস্ত দেশের নদী, হ্রদ, পাবনভূমি, হাওর-বাঁওড় ইত্যাদি এদের প্রাকৃতিক বাসস্থান। এরা নদী মোহনা হতে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত পরিভ্রমণে সক্ষম।

গলদা চিংড়ির চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। চাষ ব্যবস্থাপনা, খামারের আয়তন, পোনা মজুদের হার ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে চিংড়ি চাষ পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। সমগ্র বিশ্বে চিংড়ি চাষ পদ্ধতিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়; যথা (১) এক্সটেনসিভ পদ্ধতি, (২) আধানিবিড় পদ্ধতি ও (৩) নিবিড় চাষ পদ্ধতি। আমাদের দেশে সাধারণত (ক) সনাতনী চাষ (খ) স্বল্প উন্নত চাষ (গ) আধানিবিড় চাষ ও (ঘ) নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হয়।

(ক) সনাতনী চাষ পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে অন্য ফসল যেমন লবণ বা ধানের সাথে পর্যায়ক্রমে চিংড়ি চাষ করা হয়। চিংড়ি চাষের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে এটি সবচেয়ে পুরাতন এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ। এই চাষ পদ্ধতিতে সবচেয়ে কম পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে পরিকল্পিত উপায়ে চিংড়ি চাষ করা হয় না বা খামার নির্মাণ করা হয় না।

খামারের সুনির্দিষ্ট কোনো আকার নেই এবং এর তলদেশ অসমতল এবং পানি নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা থাকে না। খামারের পানি ও খাদ্য সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। তাই চাষ চলাকালে খামারে কোনো বাড়তি খাবার প্রয়োগ করা হয় না।

এ পদ্ধতিতে খামারের মাটি ও পানির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য চুন বা সার প্রয়োগ করা হয় না এবং পানি ব্যবস্থাপনারও কোনো সুব্যবস্থা থাকে না। এই চাষ পদ্ধতিতে খামারে চিংড়ির সাথে অন্যান্য মাছও একত্রে চাষ করা হয়। চাষের জন্য জমির চারপাশে ৩-৪ ফুট উঁচু করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়।

মাঘী পূর্ণিমার সময় জোয়ারের পানি ঢুকিয়ে খামার পানিতে পূর্ণ করা হয়। জোয়ারের এই পানির সাথে বাগদাসহ অন্যান্য চিংড়ি ও মাছের পোনা খামারে প্রবেশ করে। এর সাথে উপকূলীয় নদী থেকে সংগৃহীত বাগদার পোনা মজুদ করা হয়। এ পদ্ধতিতে সাধারণত প্রতি বর্গমিটারে ১-১.৫ টি হারে চিংড়ির মজুদ করা হয় এবং হেক্টর প্রতি ১০০ কেজি থেকে ২৫০ কেজি চিংড়ি উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট চিংড়ি খামারে প্রায় ৮৫ ৯০ ভাগ এই চাষ পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

(খ) বঙ্গ উন্নত চাষ পদ্ধতি

এটি কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং মধ্যম বিনিয়োগ সম্পন্ন চিংড়ি চাষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ কম ঝুঁকি- পূর্ণ, অধিক লাভজনক এবং কম প্রযুক্তি নির্ভরশীল হওয়ায় এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এই পদ্ধতিতে পানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, মাটি ও পানির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য চুন ও সার প্রয়োগ এবং রাক্ষুসে মাছ ও অবাঞ্ছিত জলজ প্রাণী নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়।

সাধারণত খামারের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হয়। প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এই চাষ পদ্ধতির খামারের আয়তন মাঝারী, আয়তকার এবং খামারের তলদেশ সমতল ও পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকে।

এই জাতীয় খামারে প্রতি বর্গমিটারে ৩৫টি হারে পোনা মজুদ করে হেক্টর প্রতি ৪০০-৫০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব। পানির লবণাক্ততা ও পোনার প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশে একই জমিতে দুটি ফসল উৎপাদন করা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫-২০% জমিতে এই পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে।

ফলে এই পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে খামারের পানির ব্যবস্থাপনা, রাক্ষুসে মাছ ও অবাঞ্ছিত জলজ প্রাণী দমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই জোয়ারের পানি খামারে ঢুকানোর সময় সূক্ষ্ম নেটের সাহায্যে পানি ছেঁকে উঠানো হয়। এই পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ কম প্রযুক্তি নির্ভরশীল হওয়ায় এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত, কম ঝুঁকিপূর্ণ ও লাভজনক।

গ) আধানিবিড় চাষ পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে সতর্কতার সাথে চিংড়ি চাষ করতে হয়। এই পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের জন্য বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয় এবং অধিক দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হয়। এই চাষ ব্যবস্থাপনায় পুকুর সঠিকভাবে ধৌত ও পরিষ্কার করা এবং চিংড়ি পোনার উপযুক্ত প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য পরিমিত পরিমাণে সার প্রয়োগ করা হয়।

পাম্প মেশিনের সাহায্যে পানি মজুদ ও শোধন করে খামারে পানি সরবরাহ করা হয় এবং খামারের পানিতে অক্সিজেন সরবরাহ, পানিতে হালকা স্রোত সৃষ্টি করা ও পুকুরের তলদেশ পরিষ্কার রাখার জন্য প্যাডেল হুইল ও এয়ার ইনজেক্টর ব্যবহার করা হয়। এছাড়া প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্যও খামারে প্রয়োগ করা হয়।

এই চাষ পদ্ধতিতে খামারে যাতে রাক্ষুসে মাছ ও অবাঞ্ছিত ক্ষতিকর জলজ প্রাণী প্রবেশ করতে না পারে। সেজন্য নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি ঢুকানো হয়। রাক্ষুসে মাছ ও অবাঞ্ছিত মাছ দমন করার জন্য অনেক সময় চা বীজের খৈল ব্যবহার করা হয়।

এই পদ্ধতিতে চাষ ব্যবস্থাপনায় খামারের আয়তন ২ হেক্টরের কম হওয়া উচিত এবং সাধারণত প্রতি বর্গমিটারের ৭-১৫টি হারে চিংড়ি পোনা মজুদ করা হয়। আধা নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি ৩-৫ টন চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব। পানির গুণাগুণ যেমন-লবণাক্ততা, তাপমাত্রা, ঘোলাতু, অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রেখে এই চাষ পদ্ধতিতে কাঙিক্ষত পর্যায়ে চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব।

 

গলদা চিংড়ি চাষের প্রকারভেদ | অধ্যায়-২ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২

 

(ঘ) নিবিড় চাষ পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল এবং নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়াজন হয়। নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:

  • এই পদ্ধতিতে ০.২৫-১.০ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট আয়তকার পুকুর ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
  • পুকুরে পানি প্রবেশ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য পৃথক সুইস গেইট ব্যবহার করা হয় এবং এজন্য পানি সরবরাহ খাল ও পানি নিষ্কাশন খাল থাকে। তাছাড়া সার্বক্ষণিক পানি সরবরাহের সুবিধার্থে পাইপ লাইন থাকে।
  • পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য পেডেল হুইল এবং পুকুরের তলদেশ পরিষ্কারের জন্য এয়ার ইনজেক্টর ব্যবহার করা হয়।
  • প্রতি বর্গমিটারে ২০-২৫ টি পোনা মজুদ করা হয়।
  • সম্পূরক খাদ্যের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের মাধ্যমে হেক্টর প্রতি ১০-২০ টন চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব।
  • বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের প্রয়োজনীয় পোনার শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ পোনা প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। ফলে নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় পোনা সরবরাহ করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এছাড়া বাংলাদেশে “ঘেরে চিংড়ি চাষ” এবং “লবণ উৎপাদন ও চিংড়ি চাষ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হয়ে থাকে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment