একটি মাছ / চিংড়ির ব্যবচ্ছেদ করে রোগাক্রান্ত অবস্থা শনাক্তকরণ – “মাছের স্বাস্থ্য পরিচর্যা” কোর্স বইটি বিশেষভাবে স্কুল অব এগ্রিকালচার এন্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট-এর বিএজিএড প্রোগ্রামের ছাত্রদের জন্য লেখা হয়েছে। আপনি জানেন, দূর শিক্ষণে শিক্ষকের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নেই। তাই পাঠের কোনো কঠিন বিষয় যেন আপনার বুঝতে অসুবিধা না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই কোর্স বইটি লেখা হয়েছে। কোর্স বইটির আঙ্গিক ও উপস্থাপনা তাই প্রচলিত পাঠ্যবই থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের। যেহেতু সরাসরি শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই কোর্স বইটি আপনাকে নিজে পড়ে বুঝতে হবে, তাই এটি কীভাবে পড়বেন প্রথমেই তা জেনে নিন। এতে কোর্স বইটি পড়তে ও বুঝতে আপনার সুবিধা হবে।
একটি মাছ / চিংড়ির ব্যবচ্ছেদ করে রোগাক্রান্ত অবস্থা শনাক্তকরণ
এ পাঠ শেষে আপনি-
- একটি মাছ ও একটি চিংড়ির দেহের বর্হিভাগে কোন রোগের আক্রমণ হলে তা শনাক্ত করতে পারবেন।
- রোগ আক্রান্তকরণ শনাক্তকরণের জন্য যে কোন মাছ ও চিংড়ির ব্যবচ্ছেদ করতে পারবেন এবং আভ্যন্তরীণ অঙ্গাদির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
- আক্রান্ত মাছ ও চিংড়ির হিস্টোলোজিক্যাল নিরীক্ষণের জন্য নমুনা সংগ্রহ করতে পারবেন।
- মাছ ও চিংড়ির বহিস্থঃ ও আভ্যন্তরীণ অঙ্গ থেকে ব্যাক্টেরিয়া পৃথকীকরণের জন্য নমুনা সংগ্রহ করতে পারবেন।
- পরজীবী আলাদা করতে পারবেন।
কোন মাছ বা চিংড়ি রোগাক্রান্ত শনাক্তকরণের জন্য মাছ ও চিংড়ির নমুনা সংগ্রহের পর ভাল করে বাহ্যিক অবস্থা নিরীক্ষন করতে হয়। যদি ঘা, ক্ষত, অস্বাভাবিক বর্ণ, বা অস্বাভাবিক স্বাস্থ্য মনে হয় তা হলে তা রেকর্ড করতে হয়। এছাড়া অনেক বহি:পরজীবী শরীরের উপরের অংশে লেগে থাকে যেমন Argulus, Lernaea (মাছের ক্ষেত্রে) এবং চিংড়ির ক্ষেত্রে Cymothoa (Isopod)। যা হউক আভ্যন্তরীণ অঙ্গাদির অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য এদের ব্যবচ্ছেদ করে দেখতে হয়।
হিস্টোলোজী করে বিভিন্ন অঙ্গের কলার রোগাক্রান্ত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা রোগের কারণ নির্ণয়ের একটি ভাল উপায়। তবে সুনির্দিষ্টভাবে রোগের কারণ নির্ণয়ের জন্য পরজীবী, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা ভাইরাসকে আলাদা করে এদের চিহ্নিত করা উত্তম উপায়। তবে তা জটিল, ব্যয় বহুল এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক কৃত্রিম মিডিয়ামে পৃথকীকরণ ও কালচার করা যায়- কিন্তু ভাইরাসকে Cell Line বা টিস্যুকালচার করে পরীক্ষা করা হয় যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আবার পরজীবী আলাদা করা সহজ এবং কোন মিডিয়াম ছাড়াও পরীক্ষা করা যায়। এখন একটি মাছ ও একটি চিংড়ি ব্যবচ্ছেদ করে রোগ শনাক্তকণের পদ্ধতি দেখানো ও আলোচনা করা হলো।
মাছ ও চিংড়ির রোগা-ক্রান্ত অবস্থা শনাক্তকরণের জন্য বহিস্থ ও আভ্যন্তরীণ উভয় অঙ্গাদির পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। এর জন্য ব্যবচ্ছেদ করে আভ্যন্তরীণ অঙ্গ দেখতে হবে এবং হিস্টোলজি করে কলার অবস্থা নিরীক্ষা করতে হবে। ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক কৃত্রিম মিডিয়ামে এবং ভাইরাসকে টিস্যুকালচার করে পরীক্ষা করতে হয়। পরীক্ষার জন্য তেমন কোন মিডিয়ামের প্রয়োজন হয়না।

ব্যবচ্ছেদ করার উপকরণ
মাছ বা চিংড়ির ব্যবচ্ছেদের জন্য ব্যবহৃত সাধারণ প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো নিম্নের চিত্রের সাহায্যে উল্লেখ করা হলো-







মাছ ও চিংড়ির বহির্ভাগ পর্যবেক্ষণ
একটি মাছের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত (চিত্র ৫২) ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মাছের পিছন ও সামনের (পেটের) দিক কোন পরজীবী বা ঘা আছে কি-না অথবা বর্ণ অস্বাভাবিক কি-না তা রেকর্ড করতে হবে। অনুরূপভাবে একটি চিংড়িরও সামনের ও পিছনের বহির্ভাগ (চিত্র ৫৫ ৫৭) ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ক্যারাপেসে কোন দাগ বুঝা যায় কি-না তা ভাল ভাবে নিরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করে পরজীবী বা কোন ধরনের ক্ষত আছে কি-না লক্ষ্য করে তা রেকর্ড করতে হবে।
একটি মাছের বহির্ভাগ ও আভ্যন্তরীণ অঙ্গাদির রোগ শনাক্তকরণ পদ্ধতি দেখানো হলো-

DF= পৃষ্ঠ পাখনা (Dorsal Fin)
CF= পুচ্ছ পাখনা (Caudal Fin)
AF= পায়ু পাখনা (Anal Fin)
H = হৃৎপিন্ড (Heart)
L = লিভার (Liver)
St= পাকস্থলী (Stomach)
PC = পাইলোরিকসিকা (Pyloric Caeca)
In= অস্ত্র (Intestine)
K = কিডনী (kidney)
G = ফুলকা (Gills)
PF= শ্রোণী পাখনা (Pectoral Fin)



মাছের ব্যবচ্ছেদকরণ ও আভ্যন্তরীণ অঙ্গাদির পর্যবেক্ষণ
বহির্ভাগ পর্যবেক্ষণের পরেই ৭০% ইথাইল অ্যালকোহলে ভিজিয়ে তুলা দ্বারা মাছের পেটের অংশ (পায়ু থেকে ফুলকার সংলগ্ন বরাবর) ভালোভাবে মুছে নিয়ে চিমটা দ্বারা ধরে কাঁচি দ্বারা ভাল ভাবে কেটে পরিষ্কার করতে হবে। যাতে সকল আভ্যন্তরীণ অঙ্গ দৃশ্যমান হয়। ফুলকা দেখার জন্য উপরের কানকোয়া উঠিয়ে ফেলতে হবে। বডিক্যাভিটি ও এর অভ্যন্তরে অবস্থিত সকল অঙ্গের উপরিভাগে যদি কোন পরজীবী বা রোগ লক্ষণ পাওয়া যায় তা রেকর্ড করতে হবে। তদ্রুপ ফুলকার জন্যও করতে হবে (চিত্র ৫২)।
পর্যবেক্ষণ ভালোভাবে করা অতি প্রয়োজন, তা বহির্ভাগ বা আভ্যন্তরীণ অঙ্গ উভয়ই। ম্যাগনি-ফাইং গ্লাস এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। আর রেকর্ডও সতর্কতার সহিত করতে হবে।
চিংড়ির ব্যবচ্ছেদকরণ ও আভ্যন্তরীণ অঙ্গাদির পর্যবেক্ষণ
চিংড়ি যেহেতু একটি অমেরু দন্ডী প্রাণী তাই এর ব্যবচ্ছেদ পিছন দিক থেকে করা সহজ ও সঠিক। ব্যবচ্ছেদের পূর্বে অবশ্য তার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নিঃসৃত তরল (রক্ত মিশ্রিত) যার নাম হিমোলিক্ষ তা পরীক্ষার জন্য চিত্র ৫৫, ৫৬ অনুযায়ী সংগ্রহ করতে হবে। এর পর ক্যারাপেস অপসারণ করতে হবে খুব যত্নের সহিত এবং তখন গুরুত্বপূর্ণ আভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন হেপাটোপ্যাংক্রিয়াস, লিম্ফয়েড অঙ্গ, হৃদপিন্ড ইত্যাদির ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণকরে রেকর্ড করতে হবে।
ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের আক্রমণ শনাক্তকরণের জন্য নমুনা সংগ্রহ
বহির্ভাগ ও ব্যবচ্ছেদের দ্বারা আভ্যন্তরীণ অঙ্গাদি পর্যবেক্ষণের দ্বারা রোগাক্রান্ত অবস্থার একটি সাধারণ অবস্থা চিহ্নিত করা সম্ভব। প্রকৃত রোগ জীবাণু শনাক্তকরণের জন্য এদের বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে পৃথকীকরণ করে ধাপে ধাপে সুনির্দিষ্ট ভাবে শনাক্ত করতে হবে।
এজন্য বিশেষ গবেষণা থাকা বাঞ্ছনীয় এবং সেই সাথে প্রয়োজনীয় উপকরণও যথেষ্ট থাকা দরকার। ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাবে জন্য পূর্বেই প্রস্তুতকৃত কালচার মিডিয়ামে ব্যবচ্ছেদের সময় নমুনা সংগ্রহ করতে (চিত্র ৫৩, ৫৮ অনুযায়ী) হবে। এ ব্যাপারে যাতে সংক্রমণ না হয় তার জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
হিস্টোলজী পদ্ধতির মাধ্যমে মাছ ও চিংড়ির রোগ শনাক্তকরণ
এ পদ্ধতির মাধ্যমে কলা ও কোষের যে পরিবর্তন হয় (রোগাক্রান্ত হলে) তা চিহ্নিত করা যায়। এমনকি ঐ সকল আক্রান্ত অঙ্গের কলাতে যদি কোন রোগ জীবাণু থাকে তা চিহ্নিত করা যায়। তবে এ পদ্ধতির জন্যও একটি সাধারণ ল্যাবরেটরী দরকার যেখানে টিস্যু কাটার ব্যবস্থা করা যায়। এজন্য একটি মাইক্রোটোম মেশিন থাকা দরকার। আর প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্যাদি, মোম, রং করার প্রয়োজনীয় উপকরণও থাকা দরকার।
মাছ কিংবা চিংড়ি থেকে ব্যাকটেরিয়ার জন্য নমুনা গ্রহনের পর পরই আক্রান্ত অঙ্গসহ অন্যান্য অঙ্গ থেকে হিস্টোলজী করার জন্য নমুনা (চিত্র ৫৪, ও ৬০) আলাদাকরে ১০% নিউট্রাল বা বাফারড্ ফরমালিন অথবা শুধু ১০% ফরমালিন দ্রবনে কমপক্ষে একঘন্টা রেখে ফিক্স করতে হয়। এরপর টিস্যুগুলো পাতলা থেকে ঘন এলকোহল দ্রবনে ডিহাইড্রেশন করে জাইলিনে পরিষ্কার করা হয়।
অত:পর গলিত মোমে এদের স্থানান্তর করা হয়। এরপর ঘন মোমের মধ্যে টিস্যু গুলো আলাদা আলাদা স্থাপন করে শক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে মাইক্রোটোমের সাহায্যে অত্যন্ত পাতলা (৪-৫ µm) করে কেটে তা স্নাইডে স্থাপন করা হয়। স্লাইড গুলো ঈষৎ উষ্ণ করে (৬০°C) মোমগুলো অপসারণ করে Hematoxylene এবং Eosin (H & E) অথবা প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষ রং দ্বারা রঞ্জিত করা হয়। এরপর স্লাইডগুলো শুকানোর পর মাইক্রোসকোপের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করে রেকর্ড করা হয়। এভাবে স্বাভাবিক টিস্যুর সংগে তুলনা করে রোগাক্রান্ত অবস্থা শনাক্ত করা হয়।
হিস্টোলজী পদ্ধতির মাধ্যমে রোগাক্রান্ত কলার অবস্থা শনাক্তকরণ করা যায়। এছাড়া রোগ-জীবাণু গুলো প্রাথমিক ভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয় বলে এ পদ্ধতিটি একটি অতি প্রয়োজনীয় পদ্ধতি।
অনুশীলন (Activity) : একটি কার্পজাতীয় মাছ ও একটি চিংড়ির বহির্ভাগে রোগাক্রান্ত অবস্থা পর্যবেক্ষণের পদ্ধতি লিখুন। এদের ব্যবচ্ছেদ করার পদ্ধতি লিখুন এবং আভ্যন্তরীণ অঙ্গাদির রোগাক্রান্ত অবস্থা শনাক্ত করার পদ্ধতি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করুন।
সারমর্মঃ রোগাক্রান্ত অবস্থা শনাক্তকরণের জন্য আভ্যন্তরীণ অঙ্গাদির অবস্থা পর্য্যবেক্ষণ করা একান্ত জরুরী। তা ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে রোগজীবাণু শনাক্ত করতে হলে এদর আলাদা করে নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। এজন্য চাই মাছ হউক বা চিংড়ি হউক প্রয়োজনে তা ব্যবচ্ছেদ করে বিশেষ বিশেষ অঙ্গ থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে হয়।
মাছের ক্ষেত্রে দেহের উপরিভাগ, ফুলকা, লিভার, কিডনী অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আর চিংড়ির জন্য হেপাটোপ্যাংক্রিয়াস, লিম্ফয়েড অঙ্গ, হৃদপিন্ড, ক্যারাপেসের অভ্যন্তর ভাগ অতি গুরুত্বপূর্ণ। রোগজীবাণুর মধ্যে অতি আণুবিক্ষনিক ভাইরাস টিস্যু কালচার বা Cell Line এ কালচার করে পরীক্ষা করতে হয়।
ব্যাক্টেরিয়া বা ছত্রাক কৃত্রিম কালচার মিডিয়ামে পরীক্ষা করা যায়। পরজীবীগুলো কালচার মিডিয়াম ছাড়াই মাইক্রোসকোপের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব। হিস্টোলজী পদ্ধতির মাধ্যমে মাছ বা চিংড়ির বিভিন্ন অঙ্গের কলার রোগাক্রান্ত অবস্থা শনাক্ত করতে পারা যায়।
আরও পড়ুনঃ