আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – চিংড়ির পোনা মজুদ। যা ” পোনা মজুদ ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
শিক্ষাক্রম উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণীত পাঠ্যপুস্তকসমূহ পরিবর্তনশীল চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং আত্মকর্মসংস্থানে উদ্যোগী হওয়াসহ উচ্চশিক্ষার পথ সুগম হবে। ফলে রূপকল্প-২০২১ অনুযায়ী জাতিকে বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রশিক্ষিত করে ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে আমরা উজ্জীবিত।
চিংড়ির পোনা মজুদ
পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে খামারে পোনা ছাড়ার পর পরই অনেক সময় ব্যাপকভাবে পোনা যারা যায়। সাধারণত পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাবেই এ ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক উৎস থেকে চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা হয় এবং দূর-দূরান্ত থেকে এসব পোনা পরিবহন করে এনে খামারে মজুদ করা হয়।
ফলে পরিবেশের পরিবর্তন ক্লেশ, পোনার ক্লেশ এবং খামারের পানিতে খাপ খাওয়ানো বা অভ্যস্তকরণ ঠিকমত না হওয়ার ফলে পোনা মারা যায়। তাই পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনার মূল বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিলে মজুদকালে পোনার মৃত্যুহার যথেষ্ট পরিমাণে কমানো সম্ভব। মজুদ ব্যবস্থাপনার মূল বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
ক. পোনা শনাক্তকরণ,
খ. পোনার উৎস ও সংগ্রহ পদ্ধতি,
গ. পোনা আহরণ ও গণনা,
ঘ. পোনা টেকসইকরণ ও পরিবহন, এবং
ড. পোনা শশাধন, পরিবেশ সহনশীলকরণ ও ছাড়া।
ক. পোনা শনাক্তকরণ
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, সাগর এলাকা, নদ-নদী ও খাল-বিলে বিভিন্ন প্রকার চিংড়ি পোনার উৎসস্থল। চাষের জন্য বিশেষ করে লোনা পানির বাগদা চিংড়ির পোনা এবং মিঠা পানির গলদা চিংড়ির পোনা প্রাকৃতিক উৎস নির্ভর। প্রাকৃতিক উৎস থেকেই মূলত এসব চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করা হয়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে এসব পোনা সংগ্রহের সময় অন্যান্য বিভিন্ন প্রজাতির পোনা ধরা পড়ে। বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ির পোনা থেকে বাগদা ও গলদা চিংড়ির পোনা শনাক্ত করে আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়। এজন্য বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি পোনার শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্যের ওপর সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। নিম্নে বিভিন্ন প্রকার চিংড়ি পোনার শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করা হলো:
১. বাগদা চিংড়িঃবাগদা চিংড়ির পোস্ট লাভা বা পিএল অন্যান্য চিংড়ির পোস্ট লার্ভার চেয়ে আকারে বড় হয়। দেহের গঠন সরু এবং লম্বাটে হয়ে থাকে। চক্ষু তুলনামূলকভাবে বড়। পিএল-এর দেহের দৈর্ঘ্য। বরাবর লেজ পর্বত বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। জুভেনাইল অবস্থায় এই দাগ সবুজ বর্ণ ধারণ করে এবং পেটের দিকে তখন এটি একটি কাঠির মত দেখায়। খড়গ বা গুড় সোজা এবং ডপাটি সামান্য উপর দিকে বাঁকানো থাকে। খড়গের উপর তলে ৫টি দাঁত দেখা যায়। ১ম তিন জোড়া পায়ের শেষ প্রাতে ছোট চিমটা আছে। ২য় পা ১ম পায়ের চেয়ে সামান্য লম্বা এবং ৩য় পায়ের চাইতে ছোট বা সমান।
২. ঢাকা চিড়ি: এই চিংড়ির পোনা বাগদা চিংড়ির পোনার চেয়ে আকারে অনেক ছোট। এদের দেহের রং, খাচ্ছ সাদা এবং রোল্ট্রামের অগ্রভাগ গালোপী রঙের হয়ে থাকে। পুচ্ছ পাখনা এবং টেলসনে অস্পষ্ট লালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। চক্ষু দত্ত হালকা হলুদ বর্ণের এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ উদয় খণ্ডে অধ্যবর্তী পৃষ্ঠ কাঁটা থাকে। রোস্ট্রীমের উপরিভাগে ১ টি মাত্র দাঁজ দেখা যায় এবং এই রোট্রান চক্ষু ছড়িয়ে সম্মুখের দিকে প্রসারিত। এয়া পাত্রের পা ঘেঁষে দ্রুত সাঁতার কাটে এবং নাড়াচাড়া অনুভব করলে লাফাতে চেষ্টা করে, সাধারণত এরা সাঁতায়ের সময়ে খড়ের মাঝামাঝি সামান্য উঁচু করে সাঁতার কাটে।
৩. বাবা চামা চিংড়িঃ এই চিংড়ির পোনার দেহের রং সাদাটে তবে স্বচ্ছ নর। এদের শরীরে অবস্থিত লালচে রঙের দাগগুলো গাড় বর্ণের। এন্টেনা ও অ্যান্টিনিউলের গুড়গুলো লাল বর্ণের হয়ে থাকে। ডানায় ৩-৪টি রঞ্জন কণা খাকে। এদের রোস্ট্রীম ঢাকা চিংড়ির মতই লম্বাও পাতলা তবে ঢাকার যত মাথার খোলদের ওপর অতটা বিস্তৃত বা উঁচু নয়। সাঁতার কাটার সমর এরা মাখা ও লেজের দিক পর্যত লম্বা রেখে পৃষ্ঠদেশ কিছুটা বাঁকিয়ে সাঁতার কাটে।
৪. বাগভারা চিংড়ি: এই পোনা দেখতে অনেকটা বাগদা চিংড়ির পোনার মত, তবে তুলনামূলক- ভাবে বাগদা গোনার চেয়ে আকারে ছোট। রোস্ট্রীমের উপরিভাগে ৪-৫ টি দাঁত আছে। গোনার উদরের তলদেশে ৪-৫টি লালচে বাদামি রঙের ফোটা ফোটা দাগ থাকে। অষ্ঠ উদয় খরকের পিঠের দিকে একটি কাঁটা থাকে। এদের তলপেটে পিছন দিকে ইংরেজি এম অক্ষরের মত নীলাত কালো দাগ দেখা যায়।
৫. হন্নি চিংড়িঃ এরা দেখতে অনেকটা হরিণা চিংড়ির মত এবং দেহের রং অনেকটা বাসামি বা খয়েরি রতের। গুদের বৃন্তে লালচে ধরনের রঞ্জন কণা থাকে। এদের রোস্ট্রাম। ত্রিকোণাকৃতির এবং এর উপরিভাগে ৪-৭টি দাঁত থাকে। চক্ষু বৃত্তের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত। উদর খঞ্চকের পাশের নিচের দিকে লাল ইটের মত ডোরা এবং ইউরোপডড ও লেজে দাগ থাকে।
৬. কেরানী চিংড়ি: এদের রোস্ট্রীম ছোট, অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ ও ত্রিকোণাকৃতির। রোস্ট্রামের উপরিভাগে ৩-৪টি দাঁত থাকে, তবে নিচের টি দিকে কোনো দাত থাকে না। ক্যারোপসে ২ ৩টি এপিগ্যাস্ট্রিক কাটা খাকে। ইউরোপভড়ের ডানার একটি বাদামি ফোটা দাগ থাকে। এদের শরীরে এ্যান্টিনাল ও হেপাটিক কাটা দেখা যায়। এন্টিনিউলার পেডাংকলের অগ্রভাগ রঙিন এবং এদের লেজে ছাগে ছাপে দাগ থাকে।
৭. গোসা চিংড়িঃ এদের রোট্রাম ছোট, তীক্ষ্ণ এবং ত্রিকোণাকৃতির। রোস্ট্রীমের উপরিভাগে ২টি দাঁত থাকে। দেহের রং বাদামি এবং উদরের তলদেশে ১-২টি বাদামি ফোটা দাগ থাকে। প্রতিটি উদর খণ্ডক ও টেলসনের মধ্যাংশে পাঢ় বর্ণের দাগ বিদ্যমান।
৮. যাযাক্তারা চিংড়িঃ এই চিংড়ির পোনার রোস্ট্রাম সরু, লম্বা, সোজা এবং চক্ষুপুঞ্জের মাফ্যান্যি পর্যন্ত বিস্তৃত। রোস্ট্রীদের উপরিভাগে ২টি দাঁত থাকে। এন্টিনিউলার পেডাংকলের রং হালকা খয়েরি। দেহের য়ং বালামি এবং উদর যথকে কোনো পৃষ্ঠ কাটা নেই। টেলসে নর কিনারা, প্রাপ্ত ও পশ্চাৎ পার্থে (৮+১+৮) যেটি ১৭টি কাটা থাকে।
৯. গাবা চিংড়িঃ এই চিংড়ির পোলায় সেহ অনেকটা গোলাকৃতি এবং মোটা ধরনের। সড়ক অপে দেহের অন্য অংশের চেয়ে বড়। রোস্ট্রীনের উপরিভাগে ৫-৭টি ৩ নিচের দিকে। ৬-১০টি দাঁত থাকে। দেহের রং সাদা মাখনের মত।
১০. গলদা চিংড়িঃ গলদা চিংড়ির পিএস দেখতে স্বচ্ছ এবং পিএল এর মাথার খোলস-এর উপর ২-৫টি সম্বালম্বি কান বর্ণের বন্ধন থাকে। ক্রমাখয়ে গলদা বড় হতে থাকলে উক্ত বন্ধন বিলুপ্ত হয়ে পেটের প্রতিটি গজের সংবাগেস্থলে বলয়। দেখা যায়। পিএল পর্যায়ের বয়স ৩০-৩৫ দিন এবং দৈর্ঘ্য ১-১.৫ সেমি হয়। গলদা চিংড়ির রোট্রাম বাঁকানো এবং উপরে নিচে খাঁজ কাটা থাকে। পাওলো বেশ লম্বা হয় এবং ১ম ও ২য় জোড়া পা ডিমটাযুক্ত।
১১. ছটকা চিংড়ি: এদের শিহাবেক্ষ অংশে লম্বালম্বি অস্পষ্ট দাগ থাকে। উদর অঞ্চলের পার্শ্বীয় অংশে ক্ষুদ্র বিন্দুর সমন্বয়ে গঠিত দাগ পরিলক্ষিত হয়। এই দাগগুলো সারিবদ্ধ ও নিয়মিতভাবে বিন্যস্ত। এই চিংড়ির পোনার রোস্ট্রামটির দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত ছোট।
খ. পোনার উৎস ও সংগ্রহ পদ্ধতি
দুটি উৎস থেকে বাগদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা যেতে পারে। উৎস দুটি হচ্ছে প্রাকৃতিক উৎস ও হ্যাচারি বা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র। বাংলাদেশে মূলত প্রাকৃতিক উৎস থেকে বাগদার পোনা সংগ্রহ করা হয়।
১. প্রাকৃতিক উৎস
সাধারণত ‘জো’ ‘বা’ ‘গোণ’ কালীন সময়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বাগদার পোনা পাওয়া যায়। ডিসেম্বর-এপ্রিল মাসের মধ্যে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার ২য়-৫ম দিনের জোয়ার-ভাটার সময় পানির ওঠা-নামা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এই জোয়ার-ভাটায় পানির সর্বোচ্চ ওঠা-নামাকে খুলনা অঞ্চঞ্চে গান্থে এবং কক্সবাজার অঞ্চল্ডেঙ্গে (tidal fluctuation) বলা হয়।
এই জোয়ার আরম্ভ হওয়ার পর ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম ঘণ্টাই পোনা আহরণের সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, মহেশখালী, চকোরিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী জেলার মহিপুর, রাঙাবালি, খেপুপাড়া ও ভালো জেলার চরকচ্ছপিয়া, ঢালচর, চর কুকরি-মুকড়ি এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বাগদার পোনা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় সারা বছরই বাগদার পোনা পাওয়া যায়। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সবচেয়ে বেশি পোনা ধরা পড়ে। বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের কয়েকটি উপকূলীয় নদীতে পোনা আহরণের ওপর বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত গবেষণার ফলাফল নিচের সারণিতে দেখানো হলো:
সারণি: দক্ষিণাঞ্চলীয় নদীসমূহে বাৎসরিক গড় লবণাক্ততার মাত্রা ও পোনা ধরার হার
নদীর নাম | লবণাক্ততার মাত্রা (পিপিটি) | বাগদা | অন্যান্য চিংড়ি | মৎস্য প্রজাতি | জুপাংটন |
ইছামতি (সাতক্ষিরা) | ১-১৬ | ০.৬১ | ৬৮.৯৩ | ৫.৩৬ | ২৫.১০ |
কাকশিয়ালি | ১-১৭ | ০.৭৩ | ২৮.৯৭ | ৭.০৬ | ৬৩.২৪ |
কালিন্দি | ১-১৮ | ১.৭৯ | ৪১.৬৭ | ১০.২২ | ৪৬.৩২ |
খোলপেটুয়া | ৯-২৩ | ০.৬৬ | ২০.৩০ | ৪.৩০ | ৭৪.৭৪ |
মাদার | ৭-২২ | ১.০৯ | ২৬.৮২ | ৫.৩৪ | ৬৬.৭৫ |
পশুর (বাগেরহাট) | ০-১৫ | ২.২৯ | ২৭.৬৭ | ১০.৮১ | ৫৯.২৩ |
মংলা | ০-১৫ | ২.১৭ | ৪৫.১৬ | ১০.৮৫ | ৪১.৮২ |
পানগুচি | ০-০৫ | ২.২৬ | ২৮.২৪ | ১৮.১২ | ৫১.৩৮ |
মোট গড় | ১.৪৫ | ৩৫.৯৭ | ৯.০১ | ৫৩.৫৭ |
এই গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখা যায়, সাতক্ষীরা অঞ্চলে একটি বাগদার পোনা সংগ্রহ করতে ৩৮ টি অন্যান্য প্রজাতির চিংড়ি, ৩টি মৎস্য প্রজাতি ও ৫৬ টি বিভিন্ন প্রজাতির জুপ্ল্যাংকটন ধ্বংস হয়, যা ক্রমান্বয়ে উপকূলীয় নদীসমূহের
জীব-বৈচিতাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলছে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত পোনা চাষের ক্ষেত্রে অসুবিধাসমূহ হলো।
ক) এই পোনার সাথে অন্যান্য চিংড়ির পোনা এবং রাক্ষুসে মাছের পোনা থাকে।
খ) একই বয়সের ও একই আকারের পোনা পাওয়া যায় না।
গ) সময়মত পর্যাপ্ত পরিমাণে পোনা পাওয়া যায় না।
ঘ) আহরণ ও পরিবহনজনিত চাপে অনেক সময় পোনা মারা যায়।
ঙ) পোনা শনাক্তকরণ, গণনা ও পরিবহনের সময় অসতর্কতার ফলে অনেক পোনার অঙ্গহানি হয়ে থাকে। ফলে এসব অসুস্থ পোনা থেকে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন পাওয়া যায় না।
চ) অত্যন্ত দুর্গম এলাকায় এই পোনা আহরণ করা হয়ে থাকে, ফলে এসব পোনা সংগ্রহ করা বেশ কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ।
২. হ্যাচারি বা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র
আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের পূর্বশর্ত হচ্ছে সময়মত পর্যাপ্ত পরিমাণে নির্ভেজাল পোনার প্রাপ্তি। সময়মত উন্নতমানের পোনা কেবল কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র থেকেই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে চিংড়ি হ্যাচারি শিল্প এখনও নানা কারণে বিকাশ লাভ করেনি বললেই চলে। আমাদের দেশে হ্যাচারিতে বাগদার পোনা উৎপাদন এখনও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে খুবই স্বল্প মাত্রায় উৎপাদিত হচ্ছে যা চাহিদার তুলনায় একেবারেই নগণ্য।
হ্যাচারিতে উৎপাদিত গোনা ঢাঘের ক্ষেত্রে সুবিধাগমূহ নিম্নরূপঃ
ক) সময়মত ও চাহিদামত পর্যাপ্ত পরিমাণে পোনা পাওয়া যায়।
খ) একই আকারের ও বয়সের পানা পাওয়া যায়।
গ) সুস্থ-সবল পোনা পাওয়া যায়।
ঘ) নির্ভেজাল বাগদার পোনা পাওয়া যায়। এতে অন্য কোনো চিংড়ি বা রাক্ষুসে মাছের পোনা থাকে না।
ঙ) হ্যাচারি থেকে সহজেই পোনা অন্যত্র পরিবহন করা যায়।
চ) বাগদার পালো শনাক্তকরণে কোনো সমস্যা হয় না।
গ. পোনা আহরণ ও গণনা
১. পোনা আহরণ
প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে চিংড়ি পানা আহরণ করা হয় এবং বিভিন্ন আহরণ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত উপকূলীয় এলাকায় বেহুন্দী জাল, ছাঁকনি জাল, ঠেলা জাল ও টানা জালদ্বারা চিংড়ির পানা ধরা হয়। বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণের সময় পোনার মৃত্যুহার ও পোনার পীড়ন যাতে কম হয় এবং অন্যান্য চিংড়ি ও মাছের পোনার মৃত্যুহার কমানো তথা উপকূলীয় নদীসমূহের জীব-বৈচিত্য সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য কতকগুলো বিষয়ের ওপর লক্ষ্য রাখা দরকার। পোনা ধরার সময় লক্ষ্যণীয় বিষয়সমূহ হলোঃ
ক) পোনা ধরার জাল থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর পোনা সরিয়ে ফেলতে হবে। পোনা শনাক্তকরণ ও বাছাই এর কমপক্ষে ১ ঘন্টা পর পোনা গণনা করা উচিত যাতে পোনা পাত্রের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
খ) পোনা মজুদের পাত্র ঠান্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থানে সযত্নে রাখতে হবে এবং পাত্রের মুখ ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে কারণ অন্ধকারময় পরিবেশ পোনার জন্য কম পীড়াদায়ক।
গ) পোনা মজুদ পাত্রের পানি ঘন ঘন বদলানো এবং বেশি ঘনত্বে পোনা রাখা ঠিক নয়।
ঘ) আহরিত পোনা থেকে বাগদার পোনা আলাদা করে অন্যান্য মাছ ও চিংড়ির পোনা যত্ন সহকারে পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। অন্যান্য চিংড়ির পোনা ও মাছ কোনো ক্রমেই মাটিতে ফেলা উচিত নয়।
২. পোনা গণনা
আমাদের দেশে সাধারণত প্রাকৃতিক উৎস অর্থাৎ নদী বা সাগরে যেসব পোনা আহরণ করা হয় সেসব পোনা ঝিনুক দিয়ে একটি একটি করে গণনা করা হয়। কিন্তু এভাবে বেশি পোনা গণনা করা অসুবিধাজনক। বিশেষ করে এতে পোনার ওপর পীড়ন পড়ে বলে পোনার মৃত্যুহার বেশি হয় এবং গণনা করতে সময়ও অনেক বেশি লাগে। ফলে পরিবহনকালে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। অল্প সময়ে বেশি পোনা গণনার জন্য নিম্নেক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়?
ক) ৩০০ অথবা ৫০০ লিটারের গোলাকার ট্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানিদ্বারা পূর্ণ করে তাতে গণনার জন্য। প্রয়োজনীয় পোনা ছাড়তে হবে।
খ) তারপর ট্যাংকের পানি প্যাডেলদ্বারা ওপর নিচ ঘুরাতে হবে।
গ) দ্রুত ১ লিটার পানি নিয়ে তাতে কতটা পোনা আছে তা ভালোভাবে গণনা করতে হবে। এভাবে উপর্যুপরি কয়েকবার এক লিটার করে পানি নিয়ে পোনা গণনা করতে হবে এবং গড়ে এক লিটার পানিতে কি পরিমাণ পোনা আছে তা হিসাব করে বের করে নিতে হবে। এরপর ট্যাংকে মোট যত লিটার পাশি আছে তা দিয়ে এফ লিটায় গালিতে ফি গয়িযাগ শোলা আছে তাফে রূণ খয়ালে মোট পোলায় সংখ্যা বের হবে।
উদাহরণ: ধরা যাক একটি গোলাকার ট্যাংকে মোট ৫০০ লিটার পানি আছে। প্রথম গণনায় ১ লিটার পানিতে ৪৩০ টি, দ্বিতীয় গণনায় ১ লিটার পানিতে ৪২০টি এবং তৃতীয় গণনায় ১ লিটার পানিতে ৪৫০টি পোনা পাওয়া গেল। তাহলে প্রতি এক লিটার পানিতে গড়ে (৪৩০+৪২০+৪৫০) / ৩ = ১৩০০/৩ = ৪৩৩ টি পোনা পাওয়া গেল। তাহলে ট্যাংকে মোট পোনার সংখ্যা ৪৩৩ ৫০০= ২১৫০০ টি।
এছাড়া আমাদের দেশে বিশেষ করে কক্সবাজার এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক বাগদার পোনার নার্সারি গড়ে উঠেছে। এসব নার্সারিতে প্রাকতিক উৎস থেকে আহরিত পোনা সংগ্রহ করে মজদ করা হয় এবং ৩-৪ পোনা নার্সারিতে বিশেষ যত্নে বা ব্যবস্থাধীনে রাখা হয়। তারপর এসব পোনা বিক্রি করে দেওয়া হয়। এসব নার্সারিতে নির্দিষ্ট আয়তনের এবং একই রঙের ২০-৩০টি গাস্টিকের গামলায় সমপরিমাণ পানি দিয়ে সারিবদ্ধভাবে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখা হয় এবং পোনা গণনা করা হয়।
বাগদা চিংড়ির ভালো ও খারাপ পিএল এর বৈশিষ্ট্য নিচের সারণিতে উল্লেখ করা হলোঃ
পর্যবেক্ষন বিষয় | ভালো পিএল | খারাপ পিএল |
দেহের রং | হালকা বাদামি বা স্বচ্ছ | লালচে বা নীল |
খোলস | পরিষ্কার | নোংরা |
আচারণ (সমপরিমাণ লবণাক্ত ও মিঠা পানির পিশ্রণে) | ৩০-৪৫ মিনিট বেঁচে থাকে | মারা যাবে |
আচারণ (গোলাকার পাত্রে স্রোত সষ্টি করলে) | স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটে | পাত্রের মাঝখানে জমা হয় |
ঘ. পোনা টেকসইকরণ ও পরিবহন
১. পোনা টেকসইকরণ
পরিবহনের সময় পোনার মলমূত্র ত্যাগের ফলে পরিবহন পাত্রে যাতে কোনো গ্যাস (অ্যামোনিয়া) সৃষ্টি না হয় সেজন্য পোনাকে একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে না খাইয়ে রেখে পেট খালি করা হয় এবং পোনা যাতে প্রতিকূল অবস্থার সাথে সহনশীল হতে পারে সে জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এটাই শোনা টেকসইকরণ।
এক কথায় প্রতিকূল অবস্থার সাথে সহনশীল করে পোনাকে টেকসই করে দেয়াটাই হলো টেকসইকরণ। টেকসই করে শোনা পরিবহন করলে অধিক দূরত্বে পরিবহন করা যায় এবং পোনার মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে যায়। টেকসইকরণ পদ্ধতিসমূহ
ক) পুকুরে হাপার মধ্যে বেড় জাল দিয়ে পোনা ধরার পর জালের মধ্যে রেখে ১০-১৫ মিনিট পোনাকে ঝাপটা দিয়ে পুনরায় পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। পোনা পরিবহনের অন্তত ৫-৭ দিন পূর্ব থেকে ২-৩ দিন অন্তর দিনে একবার এই কাজটি করতে হবে। পরিবহনের কমপক্ষে ৮ ঘন্টা পূর্বে পোনা ধরে হাপার মধ্যে রাখতে হবে। এই সময় কোনো ধরনের খাবার হাপায় দেয়া যাবে না।
খ) গোলাকার ট্যাংক বা সিস্টার্নে পোনা বিক্রির আগের দিন জাল দিয়ে পোনা ধরে ট্যাংক বা সিস্টার্নে রেখে পানির ফোয়ারা দিতে হবে কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা। এই সময় সিস্টার্নে কোনো ধরনের খাবার দেয়া যাবে না।
গ) যশোর পদ্ধতি: পোনা বিক্রির আগে যে পুকুরে গোনা টেকসই করা হয় তাকে পাকাই পুকুর বলে। পাকাই পুকুরের আয়তন ১০-৩০ শতাংশ এবং গভীরতা ৩-৪ ফুট হয়। পাকাই পুকুরে পোনা টেকসই করতে ৩-৪ দিন সময় লাগে। চালাই বা লালন পুকুর থেকে পাকাই পুকুরে পোনা স্থানান্তরের আগের দিন জাল টেনে পেনাকে পানির ঝাপটা খাওয়ানোর পর শতাংশ প্রতি ১ কেজি পচানো সরিষার খৈল প্রয়োগ করা হয়।
ফলে পুকুরে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। পরদিন ভােের পোনা যখন পানির উপরে ভেসে খাবি খেতে শুরু করে তখন জাল টেনে পোনা এক সাথে জড় করে প্রায় আধা ঘন্টা পানির ঝাপটা খাওয়ানোর পর পাকাই পুকুরে পোনা স্থানান্তর করা হয়। এই সময় শতাংশে ৬০০০ টি পোনা মজুদ করা হয়।
পাকাই পুকুরে তার পরের ২ দিন একই পদ্ধতিতে পানির মধ্যে জাল টেনে পানির ঝাপটা খাওয়ানো এবং প্রতি ১ কেজি পচানো সরিষার খৈল ছিটানো হয়। যদি দূরবর্তী স্থানে পোনা পরিবহন করতে হয় তবে চাষিরা কখনও কখনও শতাংশ প্রতি ১৫০ গ্রাম হারে চুন প্রয়োগ করে থাকেন।
পরিবহনের দিন সকালে জাল টেনে পোনা এক সাথে জড় করে প্রায় আধা ঘণ্টা পানির ঝাপটা খাওয়ানোর পর কৃত্রিম স্রোতেক ব্যবস্থা করা হয়। গ্রোভের বিপরীতে যে সমস্ত পোনা চলে আসে সেগুলোকেই পরিবহনের জন্য। নির্বাচিত করা হয়।
২. পোনা বা পিএল পরিবহন
চিংড়ি পোনার পরিবহন যনত্ব মূলত জাত, আকার, ওজন, তাপমাত্রা, শারীরতাত্ত্বিক অবস্থা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। সাধারণভাবে ৩৬ ইঞ্চি ২০ ইঞ্চি আকারের পলিথিন ব্যাগ, ২০-৪০ লিটার ধারণক্ষমতার হাড়ি এবং ২০০ লিটার ধারণক্ষমতার ড্রাম চিংড়ি পোনা পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। চিংড়ি পিএল-এর (গলদা ও বাগদা) পরিবহন ঘনত্ব নিচের সারণিতে উল্লেখ করা হলো।
সারণি: চিংড়ি পিএল-এর পরিবহন ঘনত্ব
পরিবহন পদ্ধতি | বয়স | পরিবহন ঘনত্ব | পরিবহন সময় | মন্তব্য |
অক্সিজেন ভর্তি পলিথিন ব্যাগ | ১০-১৫দিন | ১০০০-১২০০টি/ব্যাগ ১৫০০-২০০০টি/ব্যাগ ২৫০০-৩০০০টি/ব্যাগ | ১৮-২৪ ঘন্টা
১২-১৬ ঘন্টা ৫-৬ ঘন্টা |
ব্যাগের ১/৩ অংশ পানি এবং ২/৩ অংশ অক্সিজেন থাকতে হবে |
সনাতন পদ্ধতি | ১০-১৫দিন | ২৫০-৫০০টি/লিটার পানিতে | ১-১.৫ঘন্টা | – |
আরও দেখুনঃ