আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – চিংড়ির খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাক প্রক্রিয়া । যা ” গলদা চিংড়ির জীববিদ্যা ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
চিংড়ির খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাক প্রক্রিয়া
চিংড়ির খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাক প্রক্রিয়া
চিংড়ি সাধারণত প্রথম ও দ্বিতীয় চলনপদের সাহায্যে খাদ্য ঘরে এবং মুখছিদ্রের সম্মুখে নিয়ে আসে। এই ক্রিয়ায় তৃতীয় ম্যাক্সিলিপেড সাহায্য করে থাকে। চিংড়ি ম্যান্ডিবুলের সাহায্যে খাদ্যবস্তু টুকরা টুকরা করে এবং পরে মোলার প্রসেস দ্বারা খাদ্যবস্তু চূর্ণ-বিচূর্ণ করে অন্ননালী দিয়ে কার্ডিয়াক পাকস্থলীতে প্রবেশ করে। অন্ননালী ও কার্ডিয়াক পাকস্থলী পেশীর সংকোচন ও প্রসারণের ফলে খাদ্য কার্ডিয়াক পাকস্থলীতে আসে।
অতঃপর চূর্ণ-বিচূর্ণ খাদ্য কণাগুলো কার্ডিয়াক পাকস্থলী থেকে পাইলোরিক পাকস্থলীতে প্রবেশ করে। হেপাটোপ্যানক্রিয়াস গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত পাচকরস যকৃৎ-অগ্নাশয় নালী দিয়ে পাইলোরিক পাকস্থলীতে খাদ্যের সাথে মিশ্রিত হয়। এই পাচকরস মিশ্রিত খাদ্য হেস্টেট প্লেটের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় ব্রিস্টল এবং কমবেড প্লেট দ্বারা খাদ্য আরও ছোট ছোট অংশে পরিণত হয়।
পাইলোরিক পাকস্থলীতেও খাদ্য পরিপাক হয়। পাইলোরিক পাকস্থলীর ফিল্টার প্লেটের সাহায্যে পরিশ্রত তরল খাদ্য যকৃত-অগ্নাশয়ের নালীর ছিদ্রপথ দিয়ে যকৃৎ-অগ্নাশয়ে প্রবেশ করে এবং এখানে খাদ্য শোষিত হয়। যকৃৎ অগ্নাশয় গ্রন্থি হজম এবং খাদ্যের সার অংশ শোষণের কাজ করে থাকে।
পাইলোরিক পাকস্থলীর অবশিষ্ট খাদ্যরস ও কঠিন অপাচ্য খাদ্য মধ্য অন্ননালীতে প্রবেশ করে। মধ্য অন্ননালী অন্ত্রেও তরল খাদ্যের মূলরস শোষিত হয় এবং খাদ্যের অপাচ্য অংশ মলরূপে সাময়িকভাবে মলাশয়ে জমা থাকে এবং পরে পায়ুপথ দিয়ে দেহের বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়।
চিংড়ির জননতন্ত্র (Reproductive system)
চিংড়ি একলিদ বিশিষ্ট প্রাণী। যৌন জননের (Sexual reproduction) দ্বারা প্রাণী সাধারণত বংশ বৃদ্ধি করে থাকে। যৌন জননের জন্য প্রাণীদেহে কয়েকটি বিশেষ অঙ্গ থাকে। এই অঙ্গ থেকে জননকোষ অর্থাৎ শুক্রাণু অথবা ডিম্বাণু সৃষ্টি হয়। এদের প্রাথমিক জনন অল বা গোনাড (Gonad) বলা হয়।
জননকোষ প্রাথমিক জনন অঙ্গ থেকে সৃষ্টি হয়ে কয়েকটি নালীর মধ্য দিয়ে পরিশেষে ছিদ্র পথে দেহের বাইরে চলে আসে। এই নালীগুলোকে জন নালী (Genital duct) ও ছিদ্রগুলোকে জনন মিত্র (Gonopores) বলা হয়। এগুলোকে গৌণ জনন অঙ্গ (Secondary reproductive organ) বলা হয়। এই প্রাথমিক ও লৌগ জনন অঙ্গের যারা সৃষ্ট জননতন্ত্রের সাহায্যে প্রাণীকূল জনন ক্রিয়া সম্প্র করে থাকে। এই অঙ্গতন্ত্রকে জননতন্ত্র (Reproductive system) বলা হয়।
পুংজননতন্ত্র (Male reproductive system)
চিংড়ির পুংজননতন্ত্র নিম্নলিখিত অলগুলো দ্বারা গঠিত:
ক) শুক্রাশয়, খ) শুক্রনালী, গ) শুক্রবসি ও ঘ) পুংজনন দ্বিদ্র
ক) শুক্রাশয়(Testes): চিংড়ির দেহে একজোড়া শুক্রাশয় থাকে। এটা নরম ও লম্বা। শুক্রাশয় হৃদযন্ত্রের নিচে এবং যকৃত অগ্নাশয় গ্রন্থির ঠিক উপরে অবস্থান করে। শুক্রাশয়ের অগ্রভাগগুলো পরস্পর যুক্ত ও রেচনখলি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঙ্গে অসংখ্য লবিউল (Lobules) দেখা যায়। এ লবিউলের ভিতরে স্পারমেটোসাইটস থেকে একটি করে স্পারমাটোজোয়া (Spermatojoa) তৈরি হয়। একটি পরিগবন্ধু শুক্রকীট (Sperm) দেখতে অনেকট খোলা হাতার মতো।
খ) শুক্রনালী (Vaan deferentia): চিংড়িতে একজোড়া শুক্রনালী দেখা যায়। প্রতিটি শুক্রাশয়ের পশ্চাদপ্রাপ্ত থেকে একটি করে নালী বের হয়, একে শুক্রনালী বলে। শুত্রনালীর প্রথমাংশ একসাথে কু-লাকারে জড়িয়ে থাকে এবং এই অংশ যকৃত অগ্নাশর প্রন্থির উপরে অবস্থান করে এবং পরবর্তী অংশ বক্ষ প্রাচীরের মাধ্যমেই শুক্রকীট গুক্রাশয় থেকে পুংজনন ছিদ্রের দিকে অগ্রসর হয়।
গ) শুক্রথলি (Seminal vesicles)ঃ প্রতিটি শুক্রনালী পঞ্চমপদ উপাদের গোড়ায় এসে কিঞ্চিৎ স্ফীত যয়ে ক্লাব আকৃতির (Club shaped) গলিতে পরিণত হয়, এই থলিকে শুক্রথলি বলে। শুক্রথলিতে শুক্রকীটগুলো একত্রে দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে। এগুলোকে স্পারমাটোফোরস (Spermatophores) বলে।
ঘ) পুজেনন মিন্ন (Maie genital aperture): অরুখদি অত্রনালীর মাধ্যমে পঞ্চম চলন উপাদের পোড়ায় অবস্থিত একটি ছিদ্র পথে উন্মুক্ত হয়। এই ছিন্ন পথকে পুংজনন ছিদ্র বলা হয়। পুজেনন ছিদ্রটি একটি ঢাকনা দ্বারা জাবৃত থাকে। এই ছিদ্রপথে স্পারমাটোফোর দেহের বাইরে চলে আসে।
স্ত্রী জননতন্ত্র (Female reproductive system)
চিংড়ির স্ত্রী জননতন্ত্র ডিম্বাশয়, ডিম্বনালী ও স্ত্রীজনন ছিদ্র সমন্বয়ে গঠিত
ক) ডিম্বাশয়(Ovaries): স্ত্রী চিংড়ির প্রধান জনন অঙ্গ ডিম্বাশয় হৃৎপিন্ডের নিচে ও যকৃত অগ্নাশয়ের পিছনে উপরের দিকে অবস্থান করে এবং সম্মুখের দিকে রেনাল স্যাক বা রেচনথলি ও পশ্চাৎদিকে উদর খন্ডক পর্যন্ত বিস্তৃত। ডিম্বাশর দুইটি সামনে ও পিছনের দিকে যুক্ত থাকে এবং মধ্যভাগে পরপর পৃথক হয়ে একটি ছোট ফাঁক সৃষ্টি করে। ডিম্বাশয়ের বিতরেই ডিম্বাণুর সৃষ্টি হয়। ডিম্বাণুগুলো গোলাকার কোড বিশেষ। পরিপক্ক ডিমে সাইটোপ্লাজমের কুসুমদানা ও মাঝখানে বড় নিউক্লিয়াস থাকে।
খ) ডিম্বনালী (Ovidueta): পাতলা প্রাচীর দ্বারা ডিম্বনালী আবৃত থাকে। ডিম্বনালীর উৎপত্তি ডিম্বাশয়ের মধ্যভাগের বাহির অংশ থেকে হয়। এই নালীর প্রথম ভাগ অর্থাৎ উৎপত্তিস্থল স্ফীত হয় কিন্তু ক্রমশ সরু হয়ে বক্ষ প্রাচীর বরাবর অীয় দেশে তৃতীয় চলনপদের দিকে অগ্রসর হয়ে কক্সার পোড়ায় অবস্থিত স্ত্রী জনন ছিদ্র পথে উন্মুক্ত হয়। জিম্বাশয়ে উৎপন্ন ডিম্বাণু ডিম্বনালীর মাধ্যমে স্ত্রীজনন ছিদ্র দিকে অগ্রসর হয়।
গ) স্ত্রীজনন ছিদ্র (Female genital apertures): ডিম্বনালী চিংড়ির তৃতীয় চলনপদের গোড়ার ভেতরের দিকে উঁচু স্থানে ছিদ্রপথে বাইরে উন্মুক্ত হয়। এই ছিদ্রকে স্ত্রীজনন ছিদ্র বলা হয়। স্ত্রীজনন জিদ্র দিয়ে ডিম্বাণু দেহের বাইরে নির্গত হয়।

জীবনচক্র
গলদা চিংড়ির জীবনচক্রে ৪টি প্রধান অবস্থা রয়েছে। যেমন-ডিম, লার্ভা, পোস্ট লার্তা ও পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি।
ভিস: স্ত্রী গলদা চিংড়ির ডিমের রং প্রথমে কমলা থাকে এবং পর্যায়ক্রমে ১৮-২১ দিনে কালচে ধূসর রং ধারণ করে। ২৮° সে তাপমাত্রায় ডিম ফুটতে প্রায় ১৮-২১ দিন সময় লাগে। গলদা চিংড়ির ভিম সর্বদা রাতের বেলা ফোটে, কখনো দিনের বেলায় ফোটে না। ডিম ফোটার পর স্ত্রী চিংড়ি সন্তরণ পদ নেড়ে লার্ভাগুলোকে পানিতে ছড়িয়ে দেয়। ডিম থেকে লার্ভা বের হতে ২ রাত পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
লার্ভা : লার্ভা দেখতে অনেকটা পোকার মত। এরা লেজ উপরে এবং মাথা নিচে রেখে চিৎ হয়ে ভাসতে থাকে। এ অবস্থায় এরা আধা লবশাক্ত (১২-১৫ পিপিটি) পানিতে অবস্থান করে এবং প্রাণিকণা খেতে শুরু করে। লার্ভা অবস্থা শেষ হতে ৩০-৪৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
পোস্ট লার্জ পোস্ট-লার্তায় পৌঁছানোর পর এদের স্বভাব পরিবর্তন হয়। তখন এদেরকে পূর্ণাঙ্গ চিংড়ির মতো দেখার এবং নদী, খাল বা বিলের পাড়ের কাছে তলদেশে হামাগুড়ি দিয়ে যাঁটে। এ অবস্থায় এরা অপেক্ষাকৃত বড় খাদ্য টুকরা (উদ্ভিদ ও প্রাণিজ) খেতে পারে। পোস্টলার্ভার সবণাক্ততা সহনশীলতা বিস্তৃত।
পোস্টলার্তা অবস্থায় আসার ৭-১৫ দিনের মধ্যে (১.৫ সেমি.) এরা মিঠা পানির দিকে চলে আসতে শুরু করে। এ অবস্থায় এরা নদী স্রোতের বিপরীতে নদীর পাড় বরাবর অগ্রসর হতে থাকে। প্রায় ৩০ দিনের মধ্যে পোস্টলার্ভা কিশোর চিংড়িতে (৩ সেমি) পরিণত হয়। ২-৩ মাস বয়সে (৬-৭ সেমি) এরা তরুণ এবং এর আরও ৩-৪ মাস পরে প্রাপ্ত বয়স্ক চিংড়িতে পরিণত হয়।
লার্ভার ধাপসমূহ
হ্যাচারিতে লার্ভা ঠিকভাবে বড় হচ্ছে কি না এবং খোলস পরিবর্তন হচ্ছে কি না তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়। পানি ব্যবস্থাপনাসহ খাদ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানির তাপমাত্রা, পানির গুণাগুণ এবং খাদ্য পুষ্টির উপর লার্ভার ধাপ পরিবর্তন এবং রূপান্তরের সময় নির্ভরশীল।
লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ চিংড়িতে রূপান্তরের (Metamorphosis) পূর্বে লার্ভা ১১টি ভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে। প্রথম পর্যায়ে চক্ষুর (Rostrum) আগা থেকে লেজের (Tclson) শেষ মাখার দৈর্ঘ্য ২ মিমি এর কম থাকে। রূপান্তরের সময়ে এর দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৭ মিমি। অপর পৃষ্ঠায় গলদা চিংড়ির লার্ভা অবস্থার ১১টি পর্যায়ের বা ধাপের শনাক্তকরণ সহজ সহায়ক সংকেত এবং চিহ্নিত চিত্র দেয়া হলো।
পানির তাপমাত্রা ২৮-৩০° সে, রাখতে পারলে ২৫ দিনেই লার্ভা থেকে পাস্ট লার্ভা রুপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের চলমান আবহাওয়ায় প্রায় ৩০ দিন সময় লাগে। ১১ নং দশা পর্যন্ত লাভা পানিতে চিৎ হয়ে অর্থাৎ বুক উপরে রেখে সাঁতার কাটে বা চলাচল করে।
পিএল বা জুকেনাইল অবস্থায় এরা বুঝ নিচের দিকে রেখে বড় চিংড়ির ন্যায় চলাচল করে। পিএস-এর পর্যায় শনাক্তকরণের জন্য বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করা যায়। এ সময় লার্ভার খাদ্য গ্রহণ প্রবণতা তার খাদ্যনালী ও পাকস্থলী পরীক্ষা করে খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা ও খাদ্যের প্রকার নির্ধারণ করা যায়।
এছাড়া এ সময় পোনার পরজীবী সংক্রমণ এবং অন্য অন্য রোগের তথ্যাদিও সংগ্রহ করা যায় এবং এর প্রেক্ষিতে ব্যবস্থানি গ্রহণ করা যায়। এ জাতীয় পর্যবেক্ষণ প্রতিদিন পরীক্ষাগারে অভিজ্ঞ লোক দ্বারা সম্পাদন করতে হয়।
আরও দেখুনঃ