বাগদা চিংড়ির গুণগতমান সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ | অধ্যায়-২ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং ১

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – বাগদা চিংড়ির গুণগতমান সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ । যা ” বাগদা চিংড়ির গুণগতমান সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।

শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।

বাগদা চিংড়ির গুণগতমান সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ

 

বাগদা চিংড়ির গুণগতমান সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ | অধ্যায়-২ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং ১

 

চিংড়ির পচন ও পচনের কারণসমূহ

মাছ বা চিংড়ির মৃত্যুর পর যে প্রক্রিয়ায় বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন- স্বাভাবিক গঠন, স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ ইত্যাদির। অবনতি ঘটে তাকে পচনক্রিয়া বলে। পচন সংঘটিত হয় মূলত অণুজীবের কর্মতৎপরতা ও দেহ অভ্যন্তরস্থ জৈব পদার্থে বিদ্যমান এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে।

মাছ বা চিংড়ির মৃত্যুর পর তার পেশীতে পর্যায়ক্রমে সংঘটিত জটিল রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে দেহ শক্ত হয়ে যাওয়ার পরপরই পচন শুরু হয়। চিংড়ি আহরণ করার পর এবং প্রক্রিয়াজাত করার পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মাঝে নিম্নলিখিত কারণে চিংড়ির পচন হয়ে থাকেঃ

ক. এনজাইমের বিক্রিয়া ঘটিত পচন

খ. র‍্যানসিডিটি

গ. ব্যাকটেরিয়ার কর্মতৎপরতা ঘটিত পচন

ক. এনজাইমের বিক্রিয়া ঘটিত পচন

জীবিত অবস্থায় যেসব এনজাইম বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে সেগুলোমাছের মৃত্যুর পর দেহ অভ্যন্তরস্থ কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও চর্বির ব্যাপক ভাঙ্গন ঘটায়, ফলে দেহে পচন শুরু হয়। এই পচনকে স্বয়ংক্রিয় পচনও বলা হয়। এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে পেশী দুর্বল হয়ে যায়, ফলে ব্যাকটেরিয়ার কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়।

এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে পেশীর প্রোটিন ভেঙে বিভিন্ন অ্যাসিড ও নাইট্রোজেন ঘটিত পদার্থে রূপান্তরিত হয়, যা থেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী পদার্থ উৎপন্ন হয়।

খ. র‍্যানসিভিটি

চর্বিযুক্ত মাছের ক্ষেত্রে এ ধরনের রাসায়নিক পচন হয়ে থাকে। মাছের চর্বি অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড দ্বারা গঠিত হওয়ায় বাতাসের অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এগুলো জারিত হয়। এর ফলে মাছ বিবর্ণ হয়ে যায় এবং মাছ বা চিংড়ির স্বাদ বা গন্ধ অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। বিশুদ্ধ লবণ ব্যবহার করে চর্বিযুক্ত মাছ চিংড়ির র্যানসিভিটি কমানো যায়।

গ. ব্যাকটেরিয়ার কর্মতৎপরতা ঘটিত পচন

তাজা মাছের দেহে কোন ব্যাকটেরিয়া না থাকলেও মাছ বা চিংড়ির ফুলকা, অত্র ও ত্বকীয় শেশ্চয় প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া থাকে। এই ব্যাকটেরিয়া মাছ বা চিংড়ির পচনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জলীয় পরিবেশ ব্যাকটেরিয়ার ক্রমবিকাশের জন্য একটি উত্তম মাধ্যম, ফলে মাছ বা চিংড়ি আহরণের সময়ই ব্যাকটেরিয়া দেহের বিভিন্ন অংশে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে।

প্রকৃতিগতভাবেই মাছ বা চিংড়ি জীবিত অবস্থায় ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে দেহে একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বজায় রাখে, যা মৃত্যুর পর আর কার্যকর থাকে না। ফলে দেহ অভ্যন্তরস্থ এনজাইমের স্বয়ংক্রিয় বিক্রিয়ায় ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পেশী ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ উপযোগী হয় এবং বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ লাভ করে।

মাছ বা চিংড়ির দেহস্থিত ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও অবতরণ কেন্দ্র ও আহরণাত্তের পরিচর্যাকালীন সময়ে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া মাছ বা চিংড়ির দেহে প্রবেশ করে। মাছ বা চিংড়ির দেহে পচন সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো হলো- এ্যারামোব্যোক্টর, সিউডামোনোস, মাইক্রোকক্কাস ইত্যাদি।

পচন রোধের উপায়সমূহ

১. অণুজীব কর্তৃক সৃষ্ট পচনকে বাধা দেয়ার জন্য নিম্নেলেখিত কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে

ক) অণুজীবকে চিংড়ি বা খাদ্যে ঢুকাতে না দেওয়া বা দূরে রাখা।

খ) অণুজীবকে অপসারণ করা।

গ) অণুজীবের বৃদ্ধি ও কার্যাবলিতে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। যেমন- খুব ঠান্ডা করে বা শুষ্ক করে এনোরোবিক অবস্থা সৃষ্টি করে (অক্সিজেনের অভাব ঘটিয়ে), রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে ইত্যাদি।

ঘ) অণুজীবসমূহকে ধ্বংস করার মাধ্যমে।

২. চিংড়ির স্বপচন (Self decomposition) বন্ধকরণের লক্ষ্যে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-

ক) ড্রেসিং এর মাধ্যমে পরিপাকীয় এনজাইমের অপসারণ।

খ) সত্যিকারের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বাধা দেয়া বা বিলম্ব করা।

গ) চিংড়ির এনজাইমকে ধ্বংস করে বা সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করে।

ঘ) পোকা মাকড়, অন্যান্য প্রাণী, যান্ত্রিক কারণ ইত্যাদির ফলে খাদ্য বিনষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

নিম্ন তাপমাত্রায় মাছ বা চিংড়ি সংরক্ষন

তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে নিম্ন তাপমাত্রায় মাছ বা চিংড়ি সংরক্ষণ পদ্ধতিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

ক) শীতলীকরণ: এই প্রক্রিয়ায় মাছ বা চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা ০” সে এর কাছাকাছি আনা হয় এবং সপ্তাহখানেক পর্যন্ত মাছ চিংড়ির গুণগতমান ভাল অবস্থায় থাকে।

খ) হিমায়িতকরণ: এই প্রক্রিয়ায় মাছ বা চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা মাইনাস ৩০° থেকে মাইনাস ৪০° সে এর কাছাকাছি রাখা হয় এবং মাছ বা চিংড়ির গুণগতমান ৬ থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত ভালো অবস্থায় থাকে।

শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় চিংড়ি সংরক্ষণ

চিলিং বা শীতলীকরণ এমন একটি পদ্ধতি যে পদ্ধতিতে চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে হিমায়ন বিন্দুর প্রায় কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। তবে কখনই এর নিচে নয়। হিমায়ন বিন্দু বিভিন্ন প্রজাতিতে ০.৬০ থেকে ২° সে এর মধ্যে পরিবর্তিত হয়। তবে সচরাচর একে ১° সে ধরা হয়।

অতি শীতলীকরণ (Supper chilling)

চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে হিমায়ন বিন্দুর ঠিক নিচের তাপমাত্রায় নিয়ে আসাকে অতি শীতলীকরণ বুঝায়। এখানে চিংড়ির মাংস হিমায়িত হতে শুরু করে।

চিলিং এর উদ্দেশ্য

চিলিং সাধারণত চিংড়ি বা অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য সল্প সময়ের জন্য ব্রক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। কারণ এটি

ক) অণুজীবের বৃদ্ধির হারকে কমিয়ে দেয়।

খ) চিংড়ির মৃত্যুর পর বিভিন্ন বিপাকীয় কার্যাবলিকে হ্রাস করে।

গ) রাসায়নিক কর্মকাণ্ডের ফলে চিংড়ির পচনকে রোধ করে।

চিলিং বা শীতলীকরণ পদ্ধতি

চিংড়ি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে শীতলীকরণ সবচেয়ে পরিচিত সংরক্ষণ পদ্ধতি। সাধারণত চিংড়িকে স্বল্প সময়ের জন্য সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত নিম্নোক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে চিলিং করা হয়। যথা-

১. বরফের সাহায্যে চিংড়ি শীতলীকরণ

২. শীতল পানিতে চিংড়ি নিমজ্জনের মাধ্যমে

ক) রেফ্রিজারেটেড সামুদ্রিক পানি (Refrigerated Sea Water- RSW)

খ) শীতল সামুদ্রিক পানি (Chilled Sea Water- CSW)

৩. শুষ্ক বরফ (কঠিন CO,) এর মাধ্যমে

৪. শীতলীকরণ কক্ষে চিংড়ির উপর দিয়ে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহের মাধ্যমে

ক) সমুদ্রে বরফ দিয়ে চিংড়ি শীতলীকরণ (Chilling of fish with ice at sea)

খ) তুপাকারে শীতলীকরণ (Bulk chilling)

 

বাগদা চিংড়ির গুণগতমান সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ | অধ্যায়-২ | শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং ১

 

যেখানে চিংড়ি ধরা হয় এবং যে জলযানের মাধ্যমে চিংড়ি ধরা হয় তার উপর যে শীতলীকরণ করা হয় তাকে তুপাকারে শীতলীকরণ বলে। একটি উপযুক্ত ফিসরুম বিশিষ্ট ফিসিং ভেসেলে নিম্নরূপে চিংড়িকে মজুত করা হয়।

প্রথমে ফিসরুমের তলদেশ বরফ দিয়ে ১৯০ থেকে ১৯৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত গভীরভাবে আবৃত করে দিতে হয়। তবে বরফের গভীরতা বা পুরুত্ব নির্ভর করে ফিসরুমে ব্যবহৃত নিরোধক, জাহাজের দৈর্ঘ্য এবং সমুদ্রের পানির তাপমাত্রার উপর যদি ফিসরুম ধাতব পদার্থের তৈরি হয়।

যদি মেঝে অন্তরিত (insulated) না হয়, তবে তলায় বরফের স্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি করা হয়। তখন এই বরফের স্তরের উপর চিংড়ি রাখতে হবে। তারপর আবার চিংড়ির উপর বরফের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে চিংড়ির মধ্যে বরফের গুঁড়ো থাকবে।

প্রতিটি চিংড়ি একে অপরের সাথে লেগে থাকলে ঠান্ডা হতে যত সময় লাগবে তার চেয়ে কম সময় লাগবে যখন প্রতিটি চিংড়ি বরফের গুঁড়ো দিয়ে পৃথক থাকে। এরপর বরফের দ্বিতীয় স্তর দেওয়া হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আগেরগুলো ভর্তি না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত খুঁড়ো বরফ ছিটিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বরফের সর্বশেষ যে স্তরটি হয় তার পুরুত্ব ৫ সেন্টিমিটার হতে হবে।

প্রতি আধা মিটার পর পর বরফের সাপোর্ট দিতে হবে। চিংড়ির ব্যক্সে বা ফিসরুমে চিংড়ির স্তর বেশি হওয়া উচিত নয়। কারণ এতে অতিরিক্ত চিংড়ির চাপে তলার চিংড়ি ফেটে যেতে পারে এবং চিংড়ির দেহের তরল পদার্থ বের হয়ে আসতে পারে। ফলে চিংড়ি ওজনে কমে যেতে পারে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment