আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – গুড অ্যাকোয়াকালচার প্রাকটিসেস বা ভালো চাষ অনুশীলনের এর গুরুত্ব। যা ” গলদা চিংড়ি সংরক্ষন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
গুড অ্যাকোয়াকালচার প্রাকটিসেস বা ভালো চাষ অনুশীলনের এর গুরুত্ব
গুড অ্যাকোয়াকালচার প্রাকটিদেস না ভালো চাষ অনুশীলনের গুরুত্ব
খামারে উৎপাদিত মাছ/চিংড়ির গুণগত মান ও নিয়াপরার বিষয়টি চাবি, বিক্রেতা, প্রক্রিয়াজাতকরণকারী বা রপ্তানিকারক ও বিদেশি ক্রেতাসহ সংশিষ্ট সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব বলে বিবেচিত। গুণগতমান ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রাথমিক উৎপাদন থেকে শুরু করে বিদেশি ক্রেকার নিকট রপ্তানি করা পর্যন্ত স্ব স্ব ক্ষেত্রে সংশিষ্ট সকলকে কমবেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়।
মাছ/চিংড়ি চাষ, মাছ/চিংড়ি খরা, প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য বিপণন, পরিবহন, রঙানির জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিদেশি ক্রেতার নিকট প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিকরণ- সকল ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আবার ধাপগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজের জন্য মাছ/চিংড়ি চাষি, বিক্রেতা ও প্রক্রিয়াজাতকরণকারীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকা অপরিহার্য।
কারণ মাছ/চিংড়ির গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই চাধি কর্তৃক চাষের ক্ষেত্রে ভালো চাষ অনুশীলন বা ওড অ্যাকোয়াকালচার প্রাকটিসেস অনুসরণ করা হয়েছে কী সে বিষয়াট প্রক্রিয়াজাতকরণকারীকে নিশ্চিত হতে হবে। কেবলমাত্র আহরণোত্তর পরিচর্যার উপর গুরুত্ব দিলেই মাছ, চিংড়ির গুণগতমান ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান সম্ভব হবে না। আহরণোত্তর পরিচর্যার পাশাপাশি প্রয়োজন চাষ পর্যায়ে কঠোরভাবে গুড অ্যাকোয়াকালচার প্রাকটিসেন বা ভালো চাষ অনুশীলন অনুসরণ করে নিরাপদ মাছ/চিংড়ি উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব।
চাষ পর্যায়ে অনাদরণীয় যে সকল কার্যাবলি সঠিকভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা হলে পণ্য হিসেবে মাছ/চিংড়িব গুণগতমান ও খাদ্য-নিরাপয়ার (Food Safety) বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ বা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় তাকে গুড অ্যাকোয়াকালচার প্রাকটিস বলা হয়। অর্থাৎ চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নিয়মগুলোকেই ‘গুড অ্যাকোয়াকালচার প্রাকটিস বা জিএপি’ বলা হয়। চাষ পর্যায়ে সংশিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও কার্যক্রমগুলোর জন্য অনুসরণীয় গুড অ্যাকোয়াকালচার প্রাকটিস বা ভালো চায় অনুশীলন এর বাপসমূহঃ
(১) খামারের অবস্থান: চাষের জন্য জলাশয় নির্বাচনের সময় চাষিকে সংশিষ্ট জমির অতীত ব্যবহার এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। কারণ জমির অতীত ব্যবহার মাটির রাসায়নিক উপকরণের উপর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পূর্বে কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয়েছে, এমন জমিতে বিভিন্ন কীটনাশক ও আগাহনাশকের অবশেষ (Residue) বিদ্যমান থাকে।
এরূপ জমিতে মাছ/চিংড়ি খামার স্থাপন করলে উক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিকের অবশেষ মাছ, চিংড়ির বৃদ্ধিতে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে এবং উৎপাদিত মাছ/চিবড়িকে ভোজার জন্য বিপদজনক করে তোলে। একইভাবে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, পশুপাখির বিচরণ, বা বায়ুবাহিত দূষণের (যেমন- রাসায়নিক স্প্রে) মত বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে আশপাশের পরিবেশর মাছ/চিংড়ি খামারের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
অনেক সময় গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামার, শিল্প ও কলকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা ইরানির মত মারাত্মক উৎস সংলগ্ন স্থানে মাছ/চিংড়ি খামার তৈরি করা মোটেও সমীচীন নয়। কোনো মাছ/চিংড়ি খামার কৃষিক্ষেত, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামার, জনবসতি বা বক্তির সন্নিকটে স্থাপন করা উচিত নয়।
এরূপ স্থানে খামারের স্থান নির্বাচন করতে হলে চাষিকে মাছ চিংড়ি খামারের ওপর স্থাপনাগুলোর ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে স্থান নির্বাচন করতে হবে। নিয়মিত কীটনাশক ও সার ব্যবহার করা হয় এমন ধরনের নিবিড় কৃষিচাষ পদ্ধতির জমি মাছ/চিংড়ির বৃদ্ধিতে এবং মাছ/চিংড়িয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত মানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি – করতে পারে। রাসায়নিক দূষণে দূষিত পানিতে উৎপাদিত মাছ/সিড়ি ভোক্তার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
(২) চাষে ব্যবহৃত পানি: মাছ/চিংড়ি খামায়ের পানির মান উৎপাদনাধীন মাছ/চিংড়ির স্বাস্থ্য, গুণগতমান এবং খাদ্য-নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। সুষিত পানি যেমন মাছ/চিংড়ি মৃত্যুর কারণ হয় তেমনি তা মাছ/চিংড়ির বৃদ্ধিরেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। দূষিত পানি উৎপাদিত মাছ/চিংড়িয় দেয়ে অতিকর রাসায়নিকের অবশেষ (Residue) জমা করে ও ক্ষতিকর জীবাণুর দূষণ ঘটায়। পরিশেষে এই অবশেষ এবং ক্ষতিকর জীবাণু জোন্ডার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হ্যাজার্ড হিসেবে দেখা দেয়। পানির উৎনটি দূষিত হলে খামারের পানিও দূষিত হবে।
মাছ/চিংড়ি খামারের স্থান নির্বাচনের সময় তাই ভালো পানির উৎসের বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। ভারী ধাতুসমূহ (Heavy metals), বিভিন্ন কীটনাশক ও কৃষি-রাসায়নিক দ্রব্য, শিল্প কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য এবং কলিফর্ম ও স্যালমোনেলা জীবাণু মূলত পানি দূষণের জন্য দায়ী। ভারী ধাতুগুলোর অন্যান্য উৎসের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক উৎসটি হলো শিল্প কারখানার বর্জ্য
(৩) আশপাশের পরিবেশ। মাছ/চিংড়ি খামারের আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ভালো অবস্থায় রাখলে সরাসরি আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এর ফলে নিরাপত্তা সম্পর্কিত অনেক বিপদের সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনা যায়। চাষ পর্যায়ে অনেক সময় ভূমিক্ষয় বা ভূমিধস ঘটে থাকে যা চাষির জন্য সরাসরি আর্থিক ক্ষতির কারণ হয় ও পানিতেও রাসায়নিক ও জীবাণুর দূষণ ঘটায়।
জলাশয়ের চারদিকে পরিকল্পিত উপায়ে গাছ লাগালে ভূমিক্ষয় বা ভূমিধস রোধ করার পাশাপাশি জলাশয়ে রাসায়নিক ও জীবাণুঘটিত দূষণও রোধ করা যায়। এ ছাড়া জলাশয় ও আশপাশ থেকে ঝোপঝাড়, অতিরিক্ত জলজ আগাছা ও ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলা দরকার। মাছ/চিংড়ি খামারে বন্য প্রাণীর বিচরণ নিয়ছণ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এনা একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
ইঁদুর, ছুঁচো, বেজি, ভোঁদড়, বিভিন্ন পাখি ও অন্যান্য বন্য প্রাণী বিভিন্ন ক্ষতিকর জীবাণু (যেমন স্যালমোনেলা, ইকলি, ইত্যাদি) সংক্রমণের উৎস। সরাসরি জলাশয়ে বা জলাশয়ের আশপাশে অথবা মাছ/চিংড়ির খাবার তৈরি বা সংরক্ষণ করা হয় এমন স্থানের নিকটে মলমূত্র ত্যাগ করা উচিত নয়।
এর ফলে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর জীবাণু (যেমন-স্যালমোনেলা, ই.কলি, ইত্যাদি) পানিতে বা খাবারে মিশে পরিশোরে উৎপাদিত মাছ/চিংড়িতে সংক্রমিত হয়। খামারে উৎপাদিত মাছ/চিংড়ির এই সংক্রন্দণ আহরণোত্তর পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে ভোক্তার নিকট পৌছায় এবং ভোক্তার স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়।
ইলুর জাতীয় প্রাণী অনেকগুলো রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুর বাহক। এদের যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হলে এরা খুব সহজেই খাদ্যকে সংক্রমিত করতে পারে। খাদ্য প্রস্তুত ও সংরক্ষণ এলাকায় এদের বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক।
(৪) স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস/হাইজিন প্রাকটিস: মাছ/চিংড়ি খামারে স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস বলতে মূলত মানুষের মল ও অন্যান্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ থেকে উদ্ভুত রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু নিয়ন্ত্রণ বা পশুপাখির মল ও বজোর সার হিসেবে ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করা বুঝায়। এ ক্ষেত্রে কন্যপায়ী বা উষ্ণ রক্তের প্রাণীর বর্জ্য বা মল মারাত্মক রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু বহন করে যা মাছ/চিংড়ির খামারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
মাছ চিংড়ি খামারে, বিশেষ করে জলাশয়ে এবং সংলগ্ন এলাকায় স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস মেনে চললে পানিতে মলমূত্রের দূষণকে ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব। মাছ/চিংড়ি খামারে কর্মরত পাকজনকে কোনে অবস্থাতেই পুকুরের পানিতে, পাড়ে, পুকুর সংলগ্ন এলাকায়, খামারের পানির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয় এমন সব জলাশয়ে (যেমন- নদী, খাল, ইত্যাদি) মলমূত্র ত্যাগ করতে দেয়া যাবে না।
মলমূত্র খামার সংলগ্ন স্থানে ত্যাগ করলে মলমূত্র বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে পড়তে পারে। মলমূত্র ত্যাগের জন্য খামার এবং পানির উৎস থেকে নিরাপদ দূরত্বে জলাবদ্ধ পায়খানা (প্যাট্রিন) তৈরি করতে হবে। পায়খানাগুলোকে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে যেন মলাধার থেকে দূষিত তরল পদার্থ কোনোভাবেই জলাশয়ে চুইয়ে না পড়ে।
মানুষসহ সকল স্তন্যপায়ী প্রাণী ও উষ্ণ রক্তের প্রাণীব মলে বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু থাকে। এ জন্য পুকুরে অপরিশািেধত মল ও বিষ্ঠাকে সার হিসেবে ব্যবহার মাছ/চিংড়ির গুণগতমান ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ভাই মাছ, চিংড়ির পুকুরে উল্লিখিত উৎসের জৈব সার ব্যবহার না করাই উত্তম।
(৫) মাছ/চিংড়ির খাদ্য সম্পর্কিত যত্ন ও সতর্কতা। মাছ/চিংড়ি একটি দামি পণ্য হওয়ায় চাষ পর্যায়ে এর যথাযথ দৈহিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য বাড়তি খাবার দেয়া প্রয়োজন। তবে অধিক বৃদ্ধির প্রত্যাশায় চাষি অনেক সময় সঠিক নিয়ম অনুসরণ না করেই খাবার ব্যবহার করে থাকে।
অত্যধিক লাকের আশায় চাষি নিম্নমানের খাবার ব্যবহার করে থাকে। ফলে সার্বিক খাদ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। নিম্নমানের খাদ্য এবং খাদ্যের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে মাছ/চিংড়ির পাশাপাশি ভোক্তার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে পড়ে।
চাষ পর্যায়ে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য বিভিন্ন কাঁচা খাবার, যেমন- শামুক ও ঝিনুকের মাংস, মরা মাছ, মরা প্রাণীয় মাংস ও নাড়িভুঁড়ি, স্কুইড, কাঁকড়া চূর্ণ, ইত্যাদি মাছ/চিংড়ির খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করা হয়। এ ধরনের খাবার ব্যবহারে চাষিরা বেশি উৎসাহী, কারণ এতে খরচ কম। কিনতু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের কাঁচা খাবার বিভিন্ন ধরনের রাগজীবাণু দ্বারা সংক্রমিত থাকে, যেমন- স্যালমোনেলা, ভি. কলেরা, ই, কলি, ইত্যাদি।
এ ধরনের খাবার প্রয়োগের ফলে খুব সহজেই মাছ/চিংড়িতে সংক্রমিত হয়। এ ধরনের কাঁচা খাবার খুব সহজেই পানিকে দূষিত করে পানিয় স্বাভাবিক গুণাগুণকে নষ্ট করে ফেলে। এর ফলে মাছ/চিংড়ির ব্যাপক মড়কও দেখা দিতে পারে। তবে এ সমস্ত কাঁচা খাবার ভালোভাবে সিদ্ধ করে ব্যবহার করলে সম্ভাব্য রোগজীবাণুর সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হবে।

(৬) ঔষধের ব্যবহার: প্রাণীকূলের রোগ নিরাময়ের জন্য বিভিন্ন ঔষধের অপব্যবহার প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চাষ পর্যায়ে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক মাছ/চিংড়ির রোগ নিরাময়ে সহায়ক হলেও এর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার চাষির জন্য বিপদ ডেকে আনে।
এর অনিয়ন্ত্রিত ও দীর্ঘ ব্যবহার মাছ/চিংড়ির দেছে অ্যান্টিবায়োটিকের অবশেষ (Residue) জমা করে এবং মাছ/চিংড়ির মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। চাষ পর্যায়ে অতীতে ব্যবহৃত কতিপয় অ্যান্টিবায়োটিক মানবদেহে ক্যানসারের মত মারাত্মক রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হওয়ায় বর্তমানে সেগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এছাড়া চাষ পর্যায়ে অনুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ঔষধের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনর জারী করা হয়েছে। চাষাধীন মাছ/চিংড়ি খামারে নিয়োজিত কর্মী, পরিবেশ ও ভোক্তার স্বাস্থ্যের উপর ঔষধের ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।
এক্ষতিকর প্রভাব প্রশমনের জন্য ঔষধ প্রয়োগ, মাত্র নির্ভরণ এবং এর অবশেষ নিঃশেষের সময় (withdrawl time) মেনে চলার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পাশাপাশি স্টোরে ঔষধ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের পর অবশিষ্টাংশ এবং খালি প্যাকেট বা পাত্র ফেলে দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। চাষ পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ঔষধের অনুমোদিত একক তালিকা প্রণয়ন করা এখনও সম্ভব হয়নি।
এক্ষেত্রে দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন ঔষধের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে উৎপাদিত মাছ/চিংড়ি পৃথিবীর বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে, যেমন- ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডা, জাপান ও অন্যান্য দেশ। তাই চাষ পর্যায়ে ঔষধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে উল্লিখিত দেশসমূহের অনুমোদনেয় বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
(৭) মাছ/চিংড়ির আহরণপূর্ব মূল্যায়ন চাষের সময় সাধারণত প্রত্যেক চাথি নির্দিষ্ট সময় অন্তর মাছ/চিংড়ির আকার, পরিমাণ ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। এটি এক ধরনের রুটিন চেক, যা উত্তম চষে ব্যবস্থাপনার জন্য খুবই প্রয়োজন। চাষ পর্যায়ে মাছ/চিংড়ি ধরার আগে এই রুটিন চেক মাছ/চিংড়ির গুণগতমান ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মূল্যায়নের একটি বাড়তি সুযোগ তৈরি করে দেয়।
খামারে উৎপাদিত মাছ/চিংড়ির গুণগতমান এবং খাদ্য-নিরাপত্তার বিষয়টি কাঙ্ক্ষিত স্ট্যান্ডার্ড অর্জন করা সম্ভব হয়েছে কিনা মাছ/চিংড়ি করার পূর্বে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য মাছ, চিংড়ি আহরণের ৭-১০ দিন আগে মাছ/চিংড়ির গুণগতমান পরীক্ষা করা উচিত। কারণ আহরণের পর মাছ/চিংড়ির গুণগতমান এবং খাদ্য-নিরাপত্তা সম্পর্কিত ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তখন চাঙ্গি বা প্রক্রিয়াজাতকরণকারীর পক্ষে আর তেমন কিছু করার সুযোগ থাকে না। পক্ষান্তরে আহরণপূর্ব পরীক্ষায় বা মূল্যায়নে ত্রুটি ধরা পড়লে পুকুরে প্রয়োজনীয় সংশোধন ব্যবস্থা প্রয়োগ করে দম্ভাব্য সমস্যা এড়িয়ে চলা সম্ভব।
(৮) আহরণের সময় অনুসরণীয় প্রাকটিসসমূহ: খামারে চাষকৃত মাছ/চিংড়ি আহরণের কাজটি কতগুলো ধাপের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। এগুলো উৎপাদিত চূড়ান্ত পণ্যের গুণগতমান ও খাদ্য-নিরাপত্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করাতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো হলো:
- খাবার কমিয়ে দেয়া/বন্ধ করে দেয়া।
- আহরণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, উপকরণ ও কর্মী প্রস্তুত রাখা।
- হ্যান্ডলিং ও পরিবহন।
জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং গুণগতমান সংরক্ষণের জন্য উল্লিখিত ধাপগুলোর নির্ধারিত কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হবে। আহরণ ও বিক্রয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য চাষির উচিত সম্ভাব্য ক্রেতার সাথে আলোচনা সাপেক্ষে মাছ চিংড়ি আহরণের দিনক্ষণ ঠিক করা।
মাহ/চিংড়ি আহরণের কাজটি সাধারণত নোংরা ‘অবস্থায় হলেও মাছ/চিংড়ি রাখার কাজে ব্যবহৃত পাত্রগুলোকে ভালোভাবে পরিষ্কার ও জীবাণুযুক্ত করে দিতে হবে। কারণ, নোংরা পাত্রের গায়ে লেগে থাকা ময়লা ও পূর্বের মরা মাছ/চিংড়ি থেকে নতুন মাছ/চিংড়িতে জীবাণু সংক্রমণ ঘটতে পারে। মাছ/চিংড়ি রাখা ও পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত সকল বাকেট, টাব ও অন্যান্য
পাত্রকে যথাযথভাবে পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মাছ/চিংড়ি আহরণের কাজে যে সমস্ত ব্যাক্তিকে নিয়োজিত করা হবে তাদেরকে অবশ্যই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। বিশেষ করে সংশিষ্ট ব্যক্তির হাতে কোনো কাটা যা বা দূষিত ক্ষত থাকবে না। আহরণের পর সরাসরি হাত দিয়ে মাছ/চিংড়ি হ্যান্ডলিং না করে দস্তানা (হ্যান্ড গ্লোভস) পরে হ্যান্ডলিং করা সবচেয়ে ভালো।
(৯) পরিচর্যা এবং পরিবহনের জন্য প্রস্তুতি ও পরিবহনের পূর্বে মাছ্যাচংড়িকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এরপর থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় পৌঁছানো পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গুণগতমানের প্রকৃত অবনতি শুরু হয়। তাই প্রস্তুতির এই পর্যায়ে অনেক বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হয়। এ পর্যায়ে চাষির করণীয় কাজগুলো নিম্নরূপ।
- ইতোপূের্বে সাময়িকভাবে সংরক্ষিত মাছ/চিংড়িকে পানযোগ্য পানি দিয়ে তৈরি কুচি বরফের মধ্যে রাখতে হবে। পরিষ্কার ও জীবাণুযুক্ত প্লাস্টিকের বাক্সের মধ্যে প্রথমে বরফের একটি স্তর,। তারপর মাষ/চিংড়ির একটি স্তর, তারপর আবার বরফ, এভাবে সাজাতে হবে।
- পরিবহনের সময় এবং পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা বিবেচনা করে বরফ ও মাছ/চিংড়ির অনুপাত নির্ধারণ করতে হবে। সাধারণত মাছ চিংড়ি ও বরফের অনুপাত হবে ১:১। দিনের তাপমাত্রা ও দূরত্বের বিবেচনায় প্রয়োজনে করফের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
- পরিবহনের সময় মাছ/চিংড়িতে কেন চাপ না লাগে সেজন্য উপযুক্ত ডিজাইনের শক্ত প্লাস্টিকের বাজে মাছ/চিংড়ি পরিবহন করতে হবে। উপযুক্ত ডিজাইনের বাক্স উপর্যুপরি সাজিয়ে রাখলেও নিচের বাক্সের মাত্র। চিংড়িতে একটুও চাগ পড়েনা। পক্ষান্তরে বাকেটের ওপর বাকেট রাখলে উপরের বাকেটের চাপে নিচের বাকেটের মাছ/চিংড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
- ইনস্যুলেটেড (তাপ নিরোধক) ট্রাকে বা জ্যানে করে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মাছ/চিংড়িকে ডিপো/আড়তে/সার্ভিস সেন্টারে/সরাসরি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- পরিবহনের পর পরিবহন যান ও মাছ/চিংড়ির বাক্স উপযুক্ত সাবান, ডিটারজেন্ট ও জীবাণুনাশক দিয়ে ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে ফেলতে হবে।
আরও দেখুনঃ