আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – গলদা চিংড়ির রোগ ব্যবস্থাপনা । যা ” গলদা চিংড়ির রোগ ব্যবস্থাপনা ” অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ।
শিক্ষা জাতীয় জীবনের সর্বতোমুখী উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত-দক্ষ মানব সম্পদ। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমপরিবর্তনশীল অর্থনীতির সঙ্গে দেশে ও বিদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) স্তরের শিক্ষাক্রম ইতোমধ্যে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
গলদা চিংড়ির রোগ ব্যবস্থাপনা
জীবমাত্রই নানা প্রকার রোগ-ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তাই চিংড়ির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় না। সাধারণত চিংড়ি পুকুরে পরিবেশের ভারসাম্য অবস্থায় বসবাস করে। এই পরিবেশের যে কোনো পরিবর্তনের ফলে বা ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পড়ে।
ফলে চিংড়ির দেহে পরিবেশগতভাবে নানা ধরনের চাপ পড়ে এবং রাগজীবাণু দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। দূষিত পানি, অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা প্রভৃতি কারণে চিংড়ির পুকুরের পরিবেশের ওপর চাপ পড়ে। এর ফলে চিংড়িতে নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি হয়। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে চিংড়ির গুরুত্ব বিবেচনা করে আধুনিক চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণের পূর্বে চিংড়ির রোগবালাই চেনার উপায়, কারণ নির্ণয়, প্রতিরোধ বা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
জবা বাল ঢ রোগ হচ্ছে যে কোনো প্রাণীর দেহের অস্বাভাবিক অবস্থা যা বিশেষ কিছু লক্ষণ হিসেবে চিড়ি বেশ সৃষ্টিকারী) দ্বারা প্রকাশ পায়। অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় চিংড়ির মাঝেও নানা ধরনের রোগ বালাই হতে দেখা যায়। রোগ এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত অজ্ঞতা বা। অবহেলার কারণে প্রতি বছরই অনেক চাষির পুকুরে ব্যাপক আকারে চিংড়ি মারা। যায়। মৎস্য চাষি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
পরিবেশ ও চিংড়ির রোগবালাই
চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পরিবেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নানাবিধ কারণে চিংড়ির পুকুর দূষিত হয় এবং চিংড়ির স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়ে থাকে। চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় পুকুর বা খামারের জলজ পরিবেশ, চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু ও চিংড়ির মধ্যে একটি দুর্বল ভারসাম্য অবস্থা বিদ্যমান থাকে।
কোনো কারণে এ ভারসাম্য অবস্থার বিপর্যয় ঘটলে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর প্রভাব বৃদ্ধি পায় ও চিংড়ি রোগাক্রান্ত হয়ে থাকে। পানিই চিংড়ির জীবনধারণের একমাত্র পরিবেশ এবং পরিবেশের সাথেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে বাস করে। তাই পুকুরের জলজ পরিবেশগত অবস্থা যত ভালো হবে চিংড়ির স্বাস্থ্যও তত ভালো থাকবে।
চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষার উপযুক্ত জলীয় পরিবেশ
জলজ পরিবেশের চাপ, রাগেজীবাণু এবং চিংড়ির অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা। ব্যবস্থার পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলে রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। সে জন্য চিংড়ির রাগাক্রান্ত হওয়ার পিছনে একাধিক কারণ বা বিষয় কাজ করে। এখন পর্যন্ত যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে
- পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণের অবনতি- (পানির তাপমাত্রা, পচা জৈব পদার্থ, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি)
- প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ও খাদ্য প্রয়োগ
- বাইরে থেকে ময়লা ধোয়া দূষিত পানির প্রবেশ
- অধিক মজুদ ঘনত্ব
- বাইরে থেকে ময়লা ধোয়া দূষিত পানির প্রবেশ
- অধিক মজুদ ঘনত্ব
- প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব
- ত্রুটিপূর্ণ পরিবহন ও হ্যান্ডলিং
- প্রজীবী ও রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সংক্রমণ
নিচের প্রবাহ চিত্রের মাধ্যমে চিংড়ি রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা যায়:
চিংড়ির স্বাস্থ্যের ওপর জলীয় পরিবেশের গুণাগুণের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ চিংড়ির জন্য যত বেশি স্বাচ্ছন্দ্য হবে জলজ প্রাণী হিসেবে চিংড়ির জীবনধারণ তত বেশি পীড়নমুক্ত হবে। কারণ পরিবেশগত পীড়ন চিংড়িকে অধিকতর সংবেদনশীল করে তােেল। পুকুরের জলীয় পরিবেশ খারাপ হলে মাছ ও চিংড়ি দ্রুত মারা যায়। সে তুলনায় অন্যান্য রোগ সৃষ্টিকারী প্রাণী বা পুষ্টির অভাবজনিত কারণে চিংড়ির মড়ক হতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়।
চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষার উপযোগী পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ নিচের সারণিতে দেয়া হলোঃ
ভৌত-রাসায়নিক গুণাগু সহনশীল মাত্রা
তাপমাত্রা ২৫-৩১ সে
বচ্ছতা ২৫-৩৫ সেমি
পিএইচ ৭-৯
নাইট্রাইট <০.০০২ পিপিএম
হাইড্রোজেন সালফাইড <০.১ পিপিএম
ম্যাগনেসিয়াম ১০-১২ পিপিএম
খরতা ৪০-২০০ পিপিএম
লবণাক্ততা ৩-৪ পিপিটি (গলদার জন্য)
দ্রবীভূত অক্সিজেন ৫-৭ পিপিএম
মুক্ত অ্যামোনিয়া ০.০২৫ পিপিএম
নাইট্রেট ২০ পিপিএম
ক্যালসিয়াম ১০-১২ পিপিএম
লৌহ ০.০২ পিপিএম
ফসফরাস ০.১৫ পিপিএম
পানির উপরাক্তে ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণের পরিবর্তন হলেই চিংড়ির বাথ্য রক্ষাকারী পরিবেশ বিনষ্ট হয় এবং পরিবেশগত পীড়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে মাছের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বৃদ্ধির আশঙ্কা বেড়ে যায়। এজন্য চিংড়ি চাষের সফলতা অর্জনের লক্ষ্যে চিংড়ির জন্য অনুকূল পরিবেশ রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রোগের লক্ষণসমূহ
পোনা অবস্থায় কিংবা দেহ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অবস্থায় চিংড়ি রোগাক্রান্ত হতে পারে। চিংড়ি জীবিত থাকা অবস্থায় রোগাক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। কারণ চিংড়ি মৃত হলে লক্ষণগুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব নাও হতে পারে। রোগাক্রান্ত চিংড়ি শনাক্তকরণের সাধারণ লক্ষণসমূহ নিচে দেয়া হলো।
পর্যবেক্ষণ দ্বারা রোগ শনাক্তকরণ
– চিংড়ির খোলস বা শিরোরক্ষ অঞ্চলের ক্যারাপেসে (Carapace) কালো রং দেখা দেয়।
– পদ উপাঙ্গ, ইউরোপড এবং ক্যারাপেসে কালো দাগের সৃষ্টি হয়।
– বহিঃকংকাল হালকা সাদা বর্ণ ধারণ করে।
– চলন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অলসভাবে চলাফেরা করে।
– লাফ দিতে কিংবা দেহ বাঁকানো দেখা যায়।
– পুকুরের পাড়ের দিকে ভেসে থাকতে দেখা যায়।
– চিংড়ির ফুলকা বাদামি বর্ণ ধারণ করে।
– রোগাক্রান্ত চিংড়ি এলোমেলো বা অনিয়মিতভাবে সাঁতার কাটতে থাকে।
– রোগাক্রান্ত চিংড়ির দেহে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে কিছুটা বসে যায় কিনতু সুস্থ সবল চিংড়িতে এমন গর্ত হয় না।
– খাদ্যনালী কেটে দেখলে কোনো খাদ্যকণা দেখা যায় না।
– ফুলকা কমলা, হলদে, লাল, বাদামি কিংবা তামাটে রং ধারণ করে। ফুলকা স্বাভাবিক মনে হয় না, ফুলকা ছিড়ে যায়।
– চিংড়ির যকৃৎ অগ্নাশয় গ্রন্থিতে স্বাভাবিক রঙের পরিবর্তন ঘটে কিংবা হলুদ বর্ণ দেখা দেয়।
– চক্ষুদ- ছাই ও ঘোলাটে বর্ণ ধারণ করে।
– চিংড়ির খোলস ফ্যাকাসে ও শক্ত আকৃতির হয়ে যায়।
– চিংড়ি স্বাভাবিকভাবে লেজ সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করতে পারে না।
– রোগাক্রান্ত চিংড়ির চোখের বর্ণ সাদা হয়।
– চিংড়ির মাংসপেশির সংযোগস্থলে কিংবা লেজের নিম্নাংশের মাংস পেশিতে কালো দাগ বা লম্বা কালো আঁচড় দেখা যায়।
– উদর এবং শিরাক্ষে খোলসের সংযোগস্থলে বাদামি বর্ণের ফোটা দাগ বা ডোরা কাটা দাগ দেখা যায়।
– চিংড়ির লেজ লাল বর্ণ ধারণ করে থাকে এবং চিংড়ির বহিঃত্বক হালকা লাল বর্ণ ধারণ করে।
– চলন পদ উপাঙ্গ দেহের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
– লেজের অংশ বিশেষে ফোটা ফোটা দাগ দেখা যায় এবং কোনো কোনো অংশ স্ফীত হয়ে যায়।
পরিবেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে রোগ শনাক্তকরণ
– নিচে বর্ণিত লক্ষণসমূহ দেখে রোগাক্রান্ত চিংড়ি শনাক্ত করা যায়।
– পুকুরে চিংড়ি হঠাৎ মারা যেতে শুরু করলে।
– ভাের চিংড়ি পুকুরের পাড় ঘেষে অস্বাভাবিকভাবে চলাচল করলে।
– হঠাৎ পুকুরের পানির রঙের পরিবর্তন ঘটলে।
– পানির তাপমাত্রা ৩২° সে. এর উপরে হলে।
– দিনের বেলায় পানির উপর দিয়ে চিংড়ি দ্রুত সাঁতার কাটলে বুঝতে হবে পুকুরে অক্সিজেনের অভাব ঘটেছে।
– খামারের আশেপাশে পচা ডিমের মত গন্ধ পেলে বুঝতে হবে পুকুরের তলদেশে পচা জৈব পদার্থ রয়েছে।
– প্রচন্ড বাতাসের সময় পানির ওপরে ভাসমান স্তর পড়লে বুঝতে হবে পানিতে বেশি পরিমাণ জৈব পদার্থ আছে।
– পানির পিএইচ মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি হলে।
– পানির লবণাক্ততা হঠাৎ করে কম বা বেশি হলে।
– পানির স্বচ্ছতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি হলে।
রোগ ও রোগের কারণ
পরিবেশের পীড়ন চিংড়িকে অধিকতর সংবেদনশীল করে তালে। জলজ পরিবেশে চিংড়ি, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু এবং পরিবেশের মধ্যে একটি দুর্বল ভারসাম্য অবস্থা বিদ্যমান থাকে। কোনো কারণে এ ভারসাম্য অবস্থা বিঘ্নিত হলে রোগজীবাণুর জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
আর চিংড়ির জন্য বিপদসংকুল প্রতিকূল পরিবেশের উদ্ভব ঘটে। ফলে চিংড়ি, রাগজীবাণু ও পরিবেশগত পীড়নের পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়ায় চিংড়ির শরীরে সৃষ্ট অস্বাভাবিক অবস্থাকে রোগ বলা হয়।
পুকুরের জলজ পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুসমূহের জন্য অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে চিংড়ির রোগবালাই সৃষ্টি হয়। এসব রোগের ধরন, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুসমূহের প্রজাতি, প্রকৃতি ও আক্রমণের ধারা অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে। এ কারণেই রোগের লক্ষণও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। প্রকৃতি অনুযায়ী চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুসমূহকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(ক) ব্যাকটেরিয়া, (খ) ভাইরাস, (গ) ছত্রাক ও (ঘ) পরজীবী।
(ক) ব্যাকটেরিয়া
ব্যাকটেরিয়া খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুবীক্ষণিক জীব। এদের শরীরের ব্যাস সাধারণত ০.০০১ মিমি এর মতো হয়ে থাকে। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া খালি চোখে এদের দেখা যায় না। জলে, স্থলে, বাতাসে সর্বত্রই ব্যাকটেরিয়া বিদ্যমান। চিংড়ির পেশীকোষে সাধারণত প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে। তবে এদের গায়ে, পায়ে, ফুলকা ও খাদ্যনালীতে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। এসব ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে চিংড়ির দেহে বিভিন্ন প্রকার রোগের সৃষ্টি হয়। নিম্নবর্ণিত ব্যাকটেরিয়াসমূহ চিংড়িতে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে থাকেঃ
১. ভিবৃরিও ব্যাকটেরিয়া ও এই জাতীয় ব্যাকটেরিয়া চিংড়ির রক্তে প্রবেশ করে রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে। চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেলে চিংড়ি মারা যায়।
২. সিউডোমেনাস ব্যাকটেরিয়া ও এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ফলে চিংড়ির দেহের রং পরিবর্তিত হয়।
৩. কাইটিনাভেরাস ব্যাকটেরিয়া ও এরা চিংড়ির খোলস ও ক্যারাপেসকে আক্রান্ত করে। এদের আক্রমণের ফলে চিংড়ির খোলসে অসংখ্য কালো কালো দাগ দেখা যায়।
৪. ফিলামেন্টাস ব্যাকটেরিয়া ও চিংড়ির উদর খোলস, শিরাক্ষে ও পুচ্ছ পাখনা (Telson) অঞ্চলে এই। ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে থাকে। ফুলকা আক্রান্ত হলে চিংড়ির শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন ঘটে ফলে চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়।
(খ) ভাইরাস
ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে ভাইরাস আকারে অনেক ছোট। ভাইরাস সাধারণত ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। বাংলাদেশে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা যায়। সাধারণত চীনা “ভাইরাস” (CV) এবং সিস্টেমিক এক্টোডারমাল ও মেসাডোরমাল ব্যাকিউলা েভাইরাস সংক্ষেপে সাদা ভাইরাস নামে পরিচিত।
এরা চিংড়ির গায়ে সাদা দাগের সৃষ্টি করে। এছাড়া মনাড়েন ব্যাকিউলো ভাইরাস (MB) ও ই-টাইপ ব্যাকিউলা েভাইরাস (CBV) এর কারণে চিংড়িতে ভাইরাস রোগের সৃষ্টি হয়। নিম্নমানের খাদ্য প্রয়োগ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও দূষিত মাটি ইত্যাদির কারণেও ভাইরাসজনিত রোগ ছড়াতে পারে।
এই রোগের ফলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকা, লেজের অংশ অস্বচ্ছ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। অনেক সময় কোনো লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই ব্যাপক হারে চিংড়ি মারা যেতে থাকে।
(গ) ছত্রাক
সাধারণত ফুসেরিয়াম, স্যাপ্রোলেগনিয়া, লেজিনিডিয়াম, হেলিপস ও সাইরলপিডিয়াম নামক ছত্রাক দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয়ে থাকে। ছত্রাক সাধারণত চিংড়ির ফুলকায় আক্রমণ করে থাকে। ফলে চিংড়ি শ্বাসকষ্টে মারা যায়।
(ঘ) পরজীবী
বিভিন্ন প্রকার পরজীবী চিংড়ির রোগ সৃষ্টি করে থাকে। এসব পরজীবী চিংড়ির খোলস, ফুলকা ও বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে আক্রমণ করে থাকে। এই পরজীবী এককোষী বা বহুকোষী হয়ে থাকে। বহুকোষী পরজীবীর মধ্যে ট্রিমোটাড (Trematode), নেমোটাড (Nematode), সিস্টোড (Cestode) জাতীয় কৃমি দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
চিংড়িতে প্রোক্রিসটোনেলা (Prochristonella), প্যারাসিটোনেলা (Parachristonella) এবং রেনিবালবাস পিনাই (Renibulbus Penaei) ধরনের সিস্টোড বা ফিতাকৃমি দেখা যায়। এছাড়া চিংড়িতে তিন ধরনের উকুন (Shrimp Fluke) দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে অপারকলিডি (Opercodidae), মাইক্রোফলিডি (Microphollidae) ও একিনাস্টোমাটিডাস (Echinostomatidas)।
এককোষী প্রোটোজোয়া দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয়। এক্টোকমেনসেল প্রোটোজোয়া, প্রোটোজোয়া কমেনসেলস্, এপোস্টোম সিলিয়েট, গ্রেগারিন, মাইক্রোন্তোরিডিয়া প্রভৃতি এককোষী প্রাণী দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এছাড়া পরিবেশ দূষণ, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে চিংড়ি রোগাক্রান্ত হতে পারে।
নিচে চিংড়ির রোগর কারণসমূহ ও রোগ সৃষ্টির বিভিন্ন উপাদানের বর্ণনা দেওয়া হলোঃ
রোগের কারণ | রোগ সৃষ্টির অন্তর্নিহিত উপাদান |
ক) সংক্রমণ | ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস ছত্রাক পরজীবী |
খ) পরিবেশ দূষণ | অক্সিজেনের অভাব মাত্রাতিরিক্ত অ্যামোনিয়া মাত্রাতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেশি জৈব তলানি হঠাৎ তাপমাত্রার পরিবর্তন হঠাৎ লবণাক্ততার পরিবর্তন কীটনাশকের ব্যবহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদের আধিক্য |
গ) পুষ্টিহীনতা | প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব সুষম খাদ্যের অভাব সম্পূরক খাদ্যের অভাব অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ |
ঘ) ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি | পোনা উৎপাদনে ত্রুটি পরিবহন ত্রুটি আহত পোনা পোনা প্রতিপালনে ত্রুটি পুকুর তৈরিতে ত্রুটি |
সফলতা অর্জনের জন্য চিংড়ির রোগবালাই প্রতিরোধ ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ির রোগ প্রতিকার ব্যবস্থা যথেষ্ট জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। তাই চিংড়ির রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই উত্তম। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমেও রোগবালাই এর আক্রমণ থেকে চিংড়িকে রক্ষা করা সম্ভব।
সাধারণত সম্ভাব্য রোগবালাই হতে চিংড়িকে রক্ষা করার জন্য পূর্বাহ্নেই যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বলা হয়। রোগবালাই প্রাদুর্ভাবের কারণসমূহ বিশেষণের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।

রোগ প্রতিরোধের উপায়সমূহ
(ক) পরিবেশ উন্নয়ন
চিংড়ি চাষে পরিবেশের ওপর নিবিড় নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করা যাতে পরিবেশিক পীড়ন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পরিবেশের ওপর নিবিড় নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকগুলোর ওপর লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। যথা:
- পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন
- পিএইচ (pH) ও তাপমাত্রা
- ঘোলাজ্ব
- কীটনাশক
- পরিবেশে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট হাইড্রোজেন সালফাইড
- অ্যামোনিয়া
- কার্বন-ডাই-অক্সাইড
- শেওলাজাতীয় বিষাক্ত পদার্থ
- পুকুরের তলদেশে পুঞ্জীভূত জৈব পদার্থ প্রভৃতি
(খ) ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন
১. চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে উন্নত ব্যবস্থাপনা চিংড়ির রোগবালাই প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে সঠিক ঘনত্বে ও সঠিক পদ্ধতিতে চিংড়ির পোনা মজুদ করা যাতে পুকুরের পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ সহনশীল মাত্রায় বজায় থাকে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
এজন্য সুস্থ ও সবল পোনা সংগ্রহ করে তা পুকুরে মজুদ করা উচিত। এছাড়া ব্যবস্থাপনাজনিত পীড়ন নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে পোনা স্থানান্তরের সময় হাত দিয়ে পোনাকে স্পর্শ না করা, পোনা নাড়াচাড়া না করা, অধিক ঘনত্বে পোনা পরিবহন না করা এবং অধিক গরমে বা তাপমাত্রায় পোনা স্থানান্তর, পরিবহন ও পুকুরে মজুদ না করা প্রভৃতি বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার।
২. চিংড়ি খামারে বা পুকুরে অবাঞ্ছিত মাছ ও প্রাণীর প্রবেশ রোধ করে পুকুরকে বহিরাগত রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখা যায়। এজন্য পুকুরের আগমন ও নির্গমন নালা প্রয়োজনমত বন্ধ রাখা, পুকুরের পাড় বন্যার কবল থেকে রক্ষা করা, পুকুরে ক্ষতিকারক পাখি বসতে না দেয়া এবং কাপড় চোপড় না ধোয়া প্রভৃতি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা দরকার।
৩, বহিরাগত রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে জলাশয়কে মুক্ত রাখার জন্য পোনা সংগ্রহের জাল, পরিবহন পাত্র, চিংড়ি ধরার জাল প্রভৃতি ব্যবহারের পূর্বে ও পরে জীবাণুনাশক উপকরণ দ্বারা জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
৪. নিয়মিত পুকুর পর্যবেক্ষণ করা এবং কোনো কারণে মৃত বা রোগাক্রান্ত চিংড়ি তাৎক্ষণিকভাবে অপসারণ করা যাতে খামারের অন্য চিংড়ি রোগাক্রান্ত হতে না পারে। এছাড়া লক্ষণ অনুযায়ী রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
(গ) সুষম খাদ্য নিশ্চিতকরণ
১. চিংড়ির প্রয়োজনীয় পুষ্টিসাধন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বজায় রাখার জন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য। সরবরাহ নিশ্চিত করা। চিংড়ির মোট দৈহিক ওজনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করা, খাদ্যের গুণাগুণ পরীক্ষা করা এবং সময়মত খাবার দেয়া প্রভৃতি বিষয়ে লক্ষ রাখা।
২. নিয়মিত জাল টেনে চিংড়ির বৃদ্ধির হার এবং স্বাস্থ্য ও রোগবালাই পর্যবেক্ষণ করা।
৩. পুকুরে খাদ্য প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে বড় চিংড়ি পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলা। কারণ অপেক্ষাকৃত বড় চিংড়ি খাদ্য প্রতিযোগিতায় প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে।
রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধের তুলনামূলক সুবিধা
রোগ প্রতিরোধ | রোগ প্রতিকার |
তুলনামূলক সহজ | তুলনামূলক জটিল |
খরচ কম | খরচ বেশি |
চিংড়ির গুণগতমান ভালো | গুণগতমান খারাপ |
আর্থিকভাবে লাভজনক | আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি |
পরিকল্পনামাফিক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব | ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব নয় |
রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার কম | রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার বেশি |
পরিবেশ সহনীয় | পরিবেশ সহনীয় নয় |
টেকসই | টেকসই |
রোগ দমনের জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য
চিংড়ির রোগ দমনের জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে চুন, লবণ, পটাশ বা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, ম্যালাকাইট গ্রিন, মিথিলিন ক, ফর্মালিন, কুঁতে, বিভিন্ন ধরনের এন্টিবায়ািেটক প্রভৃতির ব্যবহার সর্বাধিক।
চুন
পুকুরে রোগমুক্ত পরিবেশ রক্ষার জন্য পানিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির পর্যাপ্ততা সৃষ্টির জন্য এবং বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে চুন ব্যবহার করা হয়। বাজারে বিভিন্ন ধরনের চুন পাওয়া যায়। কার্যকারিতা ও মূল্য বিবেচনায় পুকুরে সাধারণত পাথুরে চুন ব্যবহার করা হয়।
লবণ
বিভিন্ন বাহ্যিক পরজীবী দমনের জন্য সাধারণত খাওয়ার লবণ (Table Salt, NaCl) ব্যবহার করা হয়। সাধারণত পিপিএম, পিপিটি বা শতকরা দ্রবণ হিসেবে লবণ জলে চিংড়ি বা মাছকে গাসল (Bath) করানো বা চুবানা ে(Dip) হয়। পিপিএম (Parts Per Million) অর্থ দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ বা নিযুতাংশ। এক পিপিএম সমান এক লিটার পানিতে এক মিলিগ্রাম দ্রব্য। পিপিটি (Parts Per Thousand) অর্থ হাজার ভাগের এক ভাগ বা সহস্রাংশ অর্থাৎ এক পিপিটি হচ্ছে ১ লিটারে ১ সিসি বা ১ এমএল।
পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট (Potassium Permenaganate, KMnO4)
পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দেখতে বেগুনি রঙের কেলাসিড। জীবাণু মুক্তকারী দ্রব্য হিসেবে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াজনিত ও বহিঃপরজীবীজনিত রোগ দমনে পটাশ বা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ব্যবহার করা হয়। বাজারে ঔষধের দোকানে এই দ্রব্যটি সাধারণত পটাশ নামে পরিচিত। পটাশ সহজে পানিতে দ্রবণীয় এবং অল্পতেই পানি গাঢ় বেগুনি রঙের হয়ে যায়।
ম্যালাকাইট জিন (Malachite Green)
এটা এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য যা কেলাসিড অবস্থায় থাকে। শুষ্ক অবস্থায় পিঙ্গল বর্ণের ছোট ছোট কণা বা পাউডারের মতো দেখতে। বিভিন্ন ছত্রাক, বাহ্যিক পরজীবী ও ব্যাকটেরিয়া দমনে ম্যালাকাইট প্রিন ব্যবহার করা হয়। এটা সহজেই পানিতে দ্রবণীয় এবং অল্পতেই পানি গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়।
মিথিলিন ব্লু (Methelin Blue)
এটা নীল বর্ণের রাসায়নিক দ্রব্য যা কঠিন অবস্থায় পিঙ্গল বর্ণের থাকে। এই পদার্থ সহজেই পানিতে দ্রবণীয়। সাধারণত চিংড়ির কুলকা রোগ দমনে মিথিলিন ক ব্যবহার করা হয়।
ফরমালিন (Formalin)
সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ৪০% ফরমালডিহাইডের দ্রবণ ফরমালিন হিসেবে পরিচিত। এককোষী বহিঃপরজীবী ও মনোজেনেটিক ট্রিমোটাড দমনে ফর্মালিন ব্যবহার করা হয়। এছাড়া জীবাণুনাশক হিসেবেও ফর্মালিন ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
তুঁতে (Copper Sulphate, CuSO4)
তুঁতে নীল রঙের স্ফটিকাকার দ্রব্য। এই দ্রব্য সাধারণ মুদি বা ঔষধের দোকানে পাওয়া যায়। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগ নিয়ন্ত্রণে এঁতের দ্রবণ কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়।
অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotic)
ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য সাধারণত কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে সচরাচর টেট্রাসাইক্লিন (অক্সিটেট্রাসাইক্লিন), ক্লোরামফেনিকল প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। চিংড়ির রোগ দমনে খাদ্যের সাথে মিশিয়ে এসব ঔষধ প্রয়োগ করা হয়।
চিংড়ির সাধারণ রোগ
চিংড়ির রোগ চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল ব্যাপার। কারণ রোগ শনাক্তকরণ ও প্রতিটি চিংড়ির আলাদা আলাদাভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তারপরও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে তাদের চিকিৎসা বা রোগের প্রতিকার করা জরুরি হয়ে পড়ে। চিংড়ির রোগের সাধারণ লক্ষণীয়
সাধারণভাবে রোগাক্রান্ত চিংড়ির মধ্যে যে সমস্ত লক্ষণ ও আচরণ বেশি দেখা যায় সেগুলো হচ্ছেঃ
- ঠিকমত খাদ্য গ্রহণ করে না
- ধীর গতিতে চলাচল করে।
- এলোমেলোভাবে পানির উপর সাঁতার কাটতে থাকে।
- পাড়ের কাছাকাছি খাবি খায়, কখনও পাড়ে উঠে আসে
- খোলস নরম হয়ে যায়।
- ফুলকায় কালো দাগ দেখা যায়
- খোলসের উপর নীলাভ ম্যশেওলা জমে যায়।
- হটার অঙ্গ ও এন্টেনা খসে পড়ে অথবা বাঁকা হয়ে যায়
(১) অ্যান্টেনা ও সতরণ পদ খসে পড়া
কারণঃ ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ
লক্ষণঃ মজুদের ৩-৪ মাস পর এন্টেনা, সতরণগদ খণ্ডিত অথবা ঝরে পড়তে থাকে
প্রতিকার :
– সাময়িকভাবে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ
– পিএইচ পরীক্ষা করে ২৫০-৩০০
– গ্রাম/শতাংশ হারে ডলোমাইট প্রয়োপ
– সম্ভব হলে পানি পরিবর্তন
(২) শেল শক্ত হয়ে যাওয়া
কারণঃ পরিবেশগত; পিএইচ, লবণাক্ততা বা তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে খোলস পাল্টায় না, শক্ত হয়ে যায়।
লক্ষণ :
– খোলস স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে শক্ত
– বয়সের তুলনায় চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি কম
প্রতিকারঃ
– পানির পরিবেশ উন্নয়ন।
– পরিবেশের যে কোন হঠাৎ পরিবর্তন যেমন- পানির উচ্চতা বৃদ্ধি অথবা রাসায়নিক সার প্রয়োগ।
(৩) ক্যারাপেন ও শরীরের ওপর পাথর জমা
কারণ : পরিবেশগত যে কোনো প্যারামিটারের তারতম্যের কারণে এটা হয়ে থাকে। বিশেষ করে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে এটা বেশি হতে দেখা যায়।
লক্ষণ : করাত ও ক্যারাপেস অংশে ধূসর রঙের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাখর দেখা যায়
প্রতিকার : পুকুরের পানি পরিবর্তন -স্বাদু পানির সরবরাহ বৃদ্ধি -পানির গভীরতা বৃদ্ধি
(8) নরম খোলস বা স্পঞ্জের মত দেহ
চাষাবাদের মাঝামাঝি সময়ে প্রায়ই গলদা চিংড়ির এ রোগ দেখা দেয়।
কারণ :
– পানিতে ক্যালসিয়াম কমে যাওয়া
– অ্যামোনিয়া ও তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া
– পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব
– অনেকদিন পানি পরিবর্তন না করা
লক্ষণ :
– খোলস নরম হয়ে যায়
– পা লম্বা ও লেজ ছোট হয়
– দেহ ফাপা হয়ে পঞ্জের মত হয়
প্রতিকার :
– পুকুরে ২-৩ মাস অন্তর শতাংশ প্রতি ০.৫ কেজি হারে চুন প্রয়োগ।
– খাবারে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি
(৫) খোলস পাল্টানোর পর মৃত্যু
কারণ : খাদ্যে ভিটামিন বি-কমপেক্স, ফ্যাটি অ্যাসিড, আমিষ ও খতি দ্রব্যের অভাব
লক্ষণ :
– দেহ নরম থাকে এবং রং নীলাভ হয়ে যায়
–মৃত চিংড়ি রান্না করলে রং হালকা কমলা বর্ণ ধারণ করে। উল্লেখ্য যে, সুস্থ চিংড়ি রান্না করলে রং লাল হয়।
প্রতিকার : খাদ্যের সঙ্গে ৫০ মিলি গ্রাম/কেজি হারে ভিটামিন প্রিমিক্স (এমবাভিট জি) প্রয়োগ।
( ৬) গায়ে শেওলা পড়া
কারণ : খোলস পরিবর্তন না করা ও চিংড়ির চলাফেরার গতি কমে যাওয়া
লক্ষণ : চিংড়ি ধরার পর সারা দেহে সবুজ শেওলা দেখা যায়
প্রতিকার : পানি বাড়িয়ে দিতে হবে এবং রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
(৭) সুতালু ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ
কারণ : জৈব ও অজৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি, অক্সিজেনের পরিমাণ কম, পোনা মজুদ ঘনত্ব বেশি।
লক্ষণ : চিংড়ির ফুলকায় উলের মত আবরণ, ফুলকায় ফোটা ফোটা দাগ, পদ উপাঙ্গা খসে পড়া, কালো বর্ণ ধারণ করা।
প্রতিকারঃ কিউপ্রাস ক্লোরাইড ২পিপিএম/লিটার দ্রবণে ৩-৪ দিন চিংড়িকে ধৌত করা।
(৮) কালো ফুলকা রোগ
কারণ : ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণ
লক্ষণ : ফুলকায় কালো দাগ ও পচন, ফুলকায় জৈব পদার্থ জমে থাকা।
প্রতিকার : ফাংগাসে আক্রান্ত হলে অ্যাজালামোইসিনে গোসল করানো, ফিলামেন্টাস ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলে ফিউরাজলিডন দ্রবণে গোসল করা।
আরও দেখুনঃ