আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় – খাদ্যের পরিমাণ এবং খাদ্য প্রদান পদ্ধতি, খাদ্যের আনুপাতিক হার ও মাছের বৃদ্ধি
খাদ্যের পরিমাণ এবং খাদ্য প্রদান পদ্ধতি, খাদ্যের আনুপাতিক হার ও মাছের বৃদ্ধি
খাদ্যের পরিমাণ
প্রতিদিন মাছের যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন হয় তার অংশবিশেষ মাছ প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহ করে থাকে। এ কারণে মাছের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করা বেশ জটিল। মাছের পুষ্টি চাহিদা মিটানোর লক্ষ্যে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিপ রক হিসেবে বাইরে থেকে খাদ্য দেওয়া হয়। মাছ প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে যে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে সেগুলোর প্রজাতি সংমিশ্রণ বহুবিধ ও বিচিত্রধর্মী এবং জীবনচক্র স্বল্পকালীন।
এ কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে মাছ কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে তা পরিমাপ করা খুবই কষ্টসাধ্য। এ সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মাছের পুষ্টি সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য বিজ্ঞানীরা অবগত হয়েছেন, যার সাহায্যে বিভিন্ন মাছের খাদ্য চাহিদা নিরূপণ করা যায়। খাদ্যের পারিমাণ নির্ভর করে মূলত উক্ত খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের ওপর। যে খাদ্যের পুষ্টিমান বেশি তা পরিমাণে কম লাগে। আর যে খাদ্যের পুষ্টিমান কম সে খাদ্য অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হবে।
মাছের গৃহীত খাদ্যের পরিমাণ হজম ও বিপাকের ওপর নির্ভর করে। বিপাকীয় কার্যক্রম তাপমাত্রার সাথে সম্পর্কিত। তাপমাত্রা বাড়লে বিপাকের হার বাড়ে এবং তাপমাত্রা কমলে বিপাকের হার কমে যায়। বছরের সব ঋতুতে তাপমাত্রা একরকম থাকে না বিধায় সব ঋতুতে খাদ্যের পরিমাণও সমান হয় না। সাধারণ নিয়ম হলো গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে এবং শীতকালে কম পরিমাণে খাদ্য প্রয়োজন হয়।
মাছের পুষ্টি চাহিদার ওপর ভিত্তি করে খাদ্যের পরিমাণ কম বেশি হয়ে থাকে। যে মাছের পুষ্টি চাহিদা যত বেশি সে মাছের খাদ্য চাহিদাও তত বেশি। প্রাকৃতিক খাদ্যের পর্যাপ্ততার ওপর খাদ্যের পরিমাণ নির্ভর করে। আবার একই প্রজাতির মাছের বিভিন্ন বয়সে গৃহীত খাদ্যের পরিমাণ ভিন্নরূপ হয়ে থাকে। সাধারণত কৈশরে মাছের খাদ্য চাহিদা বেশি থাকে।
জৈব ও অজৈব উভয় ধরনের সার প্রয়োগের মাধ্যমে পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন করা হলে কার্প জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে পুকুরে অবস্থিত মাছের মোট ওজনের ২-৪ শতাংশ হারে প্রতিদিন খাদ্য দিতে হয়। রুই জাতীয় মাছের খাদ্যে সর্বোচ্চ আমিষের চাহিদা ৩০-৩৫ শতাংশ। খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতির মাধ্যমে খাদ্যের সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করা: যায়।
এ ক্ষেত্রে পুকুরের অনেক স্থানে খাদ্য দিতে হবে এবং খাদ্য সরবরাহের ১ ঘন্টা পর খাদ্য দেওয়ার স্থান পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যদি উক্ত স্থানে এ সময়ের মধ্যে সব খাদ্য নিঃশেষ হয়ে যায়, তবে খাদ্যের পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে দিতে হবে। আর যদি খাদ্যের অংশ বিশেষ অব্যবহৃত থেকে যায়, তবে খাদ্যের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দিতে হবে।
সারণি ১ এ কার্পজাতীয় মাছের পোনা পালনের জন্য খাদ্য প্রদানের হার ও সারণি ২ এ পুকুরে মাগুরের পোনা পালনের জন্য খাদ্য প্রয়োগের হার দেখানো হলো।
সারণি ১ কার্পজাতীয় মাছের পোনা পালনের জন্য খাদ্য প্রদানের হার।
রেনু পোনা মজুদের ১ দিন পর থেকে নিরূপ হারে খাদা দিতে হবে।
- ১ম ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ১০ গুণ
- ২য় ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ১৫ গুণ
- ৩য় ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ২০ গু
- ৪র্থ ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ২৫ গুণ
- ৫ম ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ৩০ গুণ
- ৬ষ্ঠ ১০ দিন মজুদকৃত পোনার ওজনের ৩৫ গুণ
সারণি ২ পুকুরে মাগুরের পোনা পালনের জন্য খাদ্য প্রয়োগের হার

পুকুরে মাগুরের পোনা মজুদের ১ দিন পর থেকে নিরূপ হারে খাদ্য দিতে হবে।
- ১ম ১০ দিন পুকুরে মজুদ মাছের মোট ওজনের ১০% হারে
- ২য় ১০ দিন পুকুরে মজুদ মাছের মোট ওজনের ৮% হারে
- ৩য় ১০ দিন পুকুরে মজুদ মাছের মোট ওজনের ৬% হারে
- ৪র্থ ১০ দিন পুকুরে মজুদ মাছের মোট ওজনের ৫% হারে
- ৫ম-১২শ ১০ দিন পুকুরে মজুদ মাছের মোট ওজনের ৪% হারে
খাদ্য প্রদান পদ্ধতি
পুকুরের নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিদিন একই সময়ে খাদ্য দেওয়া উচিত। এর ফলে অল্প দিনের মধ্যে মাছ বুঝে যায় যে কোন স্থানে কোন সময়ে গেলে খাদ্য পাওয়া যাবে। খাদ্য দেওয়ার স্থান এবং সময় নির্দিষ্ট না হলে খাদ্যের অপচয় হতে পারে। প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য একবারে বা কয়েকবারে দেওয়া যায়। তবে একবারে খাদ্য দেওয়া হলে খাদ্য দ্রব্য অব্যবহৃত থেকে যেতে পারে।
ফলে খাদ্যের অপচয় হতে পারে এবং অবাঞ্ছিত বা খাদক মাছ ইত্যাদি এসে সেই খাদ্য খেয়ে নিতে পারে অথবা অব্যবহৃত খাদ্য পচে গিয়ে পুকুরের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত করতে পারে। এজন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ২ ভাগ করে একভাগ সকালে ও অন্যভাগ বিকেলে ২ বারে দেওয়া উচিত। এতে খাদ্যের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। মাছের খাদ্য পুকুরে ছিটিয়ে দেওয়া উচিত নয়। বড় মুখওয়ালা কোন পাত্রে বা ডালায় অথবা কাঠের পাটাতনে খাদ্য দিতে হবে।
খাদ্য দেওয়ার পাত্র বা পাটাতন পানির ১ মিটার গভীরতায় ডুবিয়ে দিতে হবে। ভাসমান খাদ্য দ্রব্য আয়তকার কোন ফ্রেমের ভিতর দিতে হবে। পুকুরে একস্থানে সব খাদ্য দেওয়া ঠিক নয়, তাতে খাদ্য গ্রহণে অধিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। খাদ্য একই সময়ে বেশ কয়েকটি স্থানে দেওয়া উচিত। তাতে খাদ্য গ্রহণে মাছের মধ্যে প্রতিযোগিতা কম হয় এবং সব মাছই খাদ্য গ্রহণের সমান সুযোগ পেয়ে থাকে। ফলে মাছের সুষম বৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।
মাছকে খাদ্য দেওয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, খাবারের সাথে মাছ পরিচিত কিনা। কার্প বা কই- কাতলা জাতীয় মাছ নতুন কোন খাদ্যোপাদান চিনতে এবং উক্ত খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হতে কয়েক সপ্তাহ সময় নেয়। একই স্থানে দীর্ঘদিন খাদ্য দেওয়া হলে অব্যবহৃত খাদ্যকণা পড়ে উক্ত স্থানে ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি হতে পারে। এজন্য ৩ মাস পর পর খাদ্য দেওয়ার স্থান পরিবর্তন করা যেতে পারে।
মাছের বৃদ্ধি
মাছের বৃদ্ধি বহুবিধ উপাদান বা নিয়ামকের ওপর নির্ভর করে। এর কতকগুলো অভ্যন্তরীণ উৎস যেমন- বংশানুক্রম, বৃদ্ধির হার, খাদ্য বস্তু থেকে পুষ্টি আহরণের সক্ষমতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত। অন্য নিয়ামকগুলো পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা থেকে উৎসারিত। যথা- পানির তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেন, খাদ্যের পরিমাণ, গুণগতমান ইত্যাদি।
মাছের দেহের ক্ষয়প রণ মাছের জীবনযাত্রা এবং আকারের ওপর নির্ভর করে। পরিবহণ, মাছ ধরা, ঘন ঘন জাল টানা ইত্যাদির চাপ ও বিশৃংখল অবস্থায় মাছের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। এতে মাছের শ্বাসকার্য পরিচালনার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ গুণ পর্যন্ত বেশি শক্তি ব্যয়িত হয়। ফলে মাছের বৃদ্ধি সাধনের জন্য শক্তির ঘাটতি দেখা দেয় ও বৃদ্ধি কমে যায়। একারণে সুষম বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য জলজ পরিবেশে বিঘ্ন সৃষ্টি করা বা মাছকে বিরক্ত করা উচিত নয়।
অন্যদিকে ছোট মাছের জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি স্থান ও বৃদ্ধির উপাদান বেশি পরিমাণে দরকার হয়, বিশেষকরে অক্সিজেন। যথাযথ বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য নির্দিষ্ট আকারের জলাশয়ে কোন একটি প্রজাতির বড় মাছ যে পরিমাণে (ওজন ভিত্তিক) মজুদ করা যাবে, ঐ একই প্রজাতির ছোট মাছ তার চেয়ে কম পরিমাণে। মজুদ করতে হবে। মাছ শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণী। মাছের শরীরের তাপমাত্রা পানির তাপমাত্রার সাথে উঠানামা করে।
তাই মাছের বৃদ্ধির হার তাপমাত্রার সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তাপমাত্রা বাড়লে মাছের বিপাকীয় কার্যক্রমের হার বেড়ে যায়। এতে মাছের খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা এবং প্রয়োজনও বেড়ে যায়। যথাযথ তাপমাত্রায় অধিক খাদ্য গ্রহণের সাথে সাথে পরিপাক ক্রিয়া ও নিঃসরণে কম সময় লাগে। ফলে অধিক পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়, কিন্তু ব্যয় হয় কম পরিমাণে। এতে মাছের বৃদ্ধি দ্রুততর হয়। কার্প জাতীয় মাছ ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দ্রুত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।
মাছের স্বাভাবিক জীবন যাপন ও বৃদ্ধির জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। অক্সিজেন খাদ্যদ্রব্য হজম ও বিপাকীয় কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পানিতে পরিমিত মাত্রার অক্সিজেন থাকলে খাদ্যের পরিবর্তন হার বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ খাদ্যে মাছ অধিক হারে বৃদ্ধি পায়। পুকুরের পানিতে ৮ নিযুতাংশ (PPM) হারে প্রবীভূত অক্সিজেন থাকলে মাছের বৃদ্ধির হার বেশি হয়।
জীবের প্রথম মৌলিক প্রয়োজন খাদ্য। মাছের ভালভাবে বেঁচে থাকা ও দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রথম প্রয়োজন পরিমিত পরিমাণে ও গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্যদ্রব্য। কার্প জাতীয় মাছের খাদ্যে ২৫-৩০ শতাংশ আমিষ থাকলে তাকে গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য বলা যায়। মাছ যে খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে তা হজম হয়ে শরীরে। বিশোষিত হয়। বিশোষিত খাদ্য বিপাকীয় ক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন করে, যা মাছের দেহের বৃদ্ধিসাধন ও ক্ষয়প রণ করে।
মাছের খাদ্য দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করা হলে, অর্থাৎ মাছ উপবাসে থাকলে মাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। তবে মাছের বৃদ্ধির একটি বিশেষ দিক হলো যে, খাদ্য দেওয়া শুরু করা হলে পুনরায় মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হতে থাকে।
আরও দেখুন :