আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় খাদ্য জালিকা – যা মাছচাষে প্রতিবেশের বিভিন্ন নিয়ামকের প্রভাব এর অন্তর্ভুক্ত।
খাদ্য জালিকা
খাদ্যশক্তির উৎস উদ্ভিদকে বিভিন্ন জীবে ভক্ষণ করে এবং ঐ সব জীবকূল আবার অন্যের দ্বারা ভক্ষিত হয়ে খাদ্য শক্তির হস্তান্তর ঘটায় একেই খাদ্য শিকল বা খাদ্যচক্র বলে। প্রতিটি খাদ্য শিকল ইকোসিস্টেমে একক বা আলাদাভাবে বিরাজ করে না। খাদ্য শিকলগুলো নানাভাবে একে অন্যের সাথে জড়িত। ফলে খাদ্য-শিকল একটি বা একাধিক জালের মতো নেটওয়ার্ক তৈরি করে। খাদ্য শিকলসমূহের মাঝে বিদ্যমান পারস্পরিক এ যুক্তির ধরনকেই (Inter Looking Pattern) খাদ্য জালিকা বলে।

খাদ্য পিরামিড
খাদ্য শিকলের মাধ্যমে খাদ্য শক্তি স্থানান্তরের সময় প্রায় বেশিরভাগ খাদ্য শক্তি নষ্ট হয়। ফলে উৎপাদনে যে খাদ্য শক্তি সঞ্চিত হয় খাদ্যশক্তি স্থানান্তরের সময় পরবর্তী ভক্ষক খাদ্য স্তরে তার অনেক কম খাদ্যশক্তি প্রাপ্ত হয়। খাদ্যশক্তি যতবারই স্থানান্তরিত হয় ততই খাদ্য শক্তির পরিমাণ কমতে থাকে। ফলে খাদ্য শিকলের শেষ মাথার দিকে খুবই কম খাদ্যশক্তি প্রাপ্ত হয় । এ বিষয়টি চিত্রে অঙ্কন করলে “পিরামিড এর আকৃতি নেয় বলে একে খাদ্য পিরামিড বলে।
প্রতিবেশের জীবকূল
জৈব উৎপাদনের জীবকূল পুকুরের বিভিন্ন অংশে অবস্থান করে। এসব জীবকে এদের অবস্থান অনুযায়ী তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. ভাসমান জীবকূল,
২. তলদেশের জীবকূল, এবং
৩. জলজ উদ্ভিদকূল
১. ভাসমান জীবকূল
ভাসমান জীবকূলের মধ্যে প্ল্যাংকটন অন্যতম। প্ল্যাংকটন হলো এক ধরনের আণুবীক্ষণিক প্রাণী বা উদ্ভিদ জাতীয় অণুজীব । এসব অণুজীব পানিতে ভাসমান বা ঝুলন্ত অবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যমান থাকে এবং পানির প্রাথমিক উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে । পুষ্টিগত দিক থেকে প্ল্যাংকটনকে মূলত: দুই ভাগে ভাগ করা যায়-
ক. উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন, ও
খ. প্রাণী প্ল্যাংকটন
ক. উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন :
এ জাতীয় প্ল্যাংকটনের উদাহরণ হলো- স্পাইরোগাইরা, নেভিকুলা, অ্যানাবেনা, ফেকাস, সিনেডেসমাস ইত্যাদি।
খ. প্রাণি প্ল্যাংকটন :
এ জাতীয় প্ল্যাংকটনের উদাহরণ হলো- ড্যাফনিয়া, সাইক্লপস, রোটিফেরা, ময়না, ফিলিনিয়া ইত্যাদি ।
মাছচাষে ভাসমান জীবকূলের প্রভাব :
মাছচাষে ভাসমান জীবকূল তথা প্ল্যাংকটন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । চাষযোগ্য অনেক মাছ আছে যারা খাদ্য ও পুষ্টির জন্য সরাসরি উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনের ওপর নির্ভরশীল। যেমন- সিলভার কার্প মাছ। আবার এমন কিছু মাছ আছে যারা মূলত প্রাণী প্ল্যাংকটনের ওপর নির্ভরশীল । যেমন- বিগহেড, কাতলা প্রভৃতি । প্ল্যাংকটন শুধু মাছের খাদ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হয় না ।
এমন কিছু কিছু প্ল্যাংকটন আছে যারা বাতাস থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন আবদ্ধ করতে পারে। যেমন- ব্লু-গ্রীন অ্যালজি। তবে পুকুরে এদের আধিক্য খুব বেশি থাকলে এক সময় সেগুলো পচে গিয়ে পুকুরের পানির গুণাগুণ নষ্ট করে ফেলতে পারে । তাই পানিতে প্ল্যাংকটনের পরিমাণ বিশেষ করে উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনের পরিমাণ প্রয়োজনীয় সীমার মধ্যে রাখা উচিত । এর জন্য পরিমাণ মতো সার প্রয়োগ করা দরকার। কোনো ক্রমেই মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগ করা উচিত নয়।

২. তলদেশের জীবকূল
পুকুরের পানির তলদেশে কাদার উপরিভাগে বা কাদার মধ্যে বসবাসকারী জীবকূল কে বেহুোজ (Benthose) বলে । যেমন- কাইরোনোমিড লার্ভা, টিউবিফেক্স, শামুক, ঝিনুক প্রভৃতি এ স্তরের প্রাণী ।
মাছচাষে তলদেশের জীবকূলের প্রভাব :
তলদেশীয় জীবকূল বা বেস্থোজ মাছচাষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন- মৃগেল, কমন কার্প, মিরর কার্প, ব্ল্যাক কার্প, শিং, মাগুর প্রভৃতি মাছ পুকুরের তলদেশের খাদ্য খেয়ে থাকে। যেসব পুকুরের গভীরতা ৬ ফুটের কম ঐ সমস্ত পুকুরে বেশি পরিমাণে বেছো জন্মায় পক্ষান্তরে ৬ ফুটের বেশি গভীরতা সম্পন্ন পুকুরে এসব প্রাণী কম পরিমাণে জন্মায়। বেন্থোজ জাতীয় প্রাণী পুকুরের তলা থেকে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস যুক্ত করতে সহায়তা করে যা প্ল্যাংকটন উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
পক্ষান্তরে পুকুরে শামুক ও ঝিনুক বেশি পরিমাণে থাকলে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস কমে যায় বা মাছ ও চিংড়ির হাড়, খোলস নরম হয়ে যায়, ফলে বৃদ্ধি ব্যহত হয়। পুকুরে নিয়মিত জৈব সার প্রয়োগ করে তলদেশের প্রাণীর পুষ্টি ত্বরান্বিত করা যায়। পুকুর প্রস্তুতির সময় তলদেশে হালচাষ করে জৈব সার ও খৈল মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিলে বেহোজ জাতীয় প্রাণিকূলের উৎপাদন ভালো হয় ।
৩. পুকুরের প্রতিবেশে বিভিন্ন প্রকারের জলজ উদ্ভিদ ও শ্যাওলা থাকে। সচরাচর পুকুরে প্রাপ্ত জলজ উদ্ভিদকে নিচে বর্ণিত উপায়ে ভাগ করা যায়। যেমন-
ক. শ্যাওলা জাতীয়, যথা- স্পাইরোগাইরা, ইউরিনা ইত্যাদি;
খ. অর্ধডুবন্ত উদ্ভিদ, যথা- শাপলা, পানিফল ইত্যাদি;
গ. ভাসমান উদ্ভিদ, যথা- কচুরিপানা, টোপাপানা ইত্যাদি;
ঘ. নির্গমনশীল উদ্ভিদ, যথা- আড়াইল, বিষকাটালী ইত্যাদি।
ঙ. লতানো জলজ উদ্ভিদ, যথা- কলমিলতা, হেলেঞ্চা ইত্যাদি।

মাহচাবে জলজ উদ্ভিদের প্রভাব :
অধিকাংশ জলজ উদ্ভিদ মাছচাষের জন্য ক্ষতিকর। কেবলমাত্র এককোষী শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদের পরিমিত পরিমাণ উপস্থিতি মাছচাষের জন্য ভালো। অন্যান্য সকল প্রকার জলজ উদ্ভিদ পানি ও মাটি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে। ফলে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন উৎপাদন ব্যবহৃত হয়। অবশ্য কিছু কিছু জলজ উদ্ভিদের নরম অংশ মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন- হাইড্রিলা, ভ্যালিসনেরিয়া জাতীয় উদ্ভিদ গ্রাসকার্প মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার অ্যাজোলা ও ক্ষুদিপানা সরপুঁটি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পুষ্টি গ্রহণ ছাড়াও জলজ উদ্ভিদ পুকুরে সূর্যালোক প্রবেশে বাধা প্রদান করে ও রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু এবং রাক্ষুসে প্রাণীর আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। ফলে পুকুরের প্রাথমিক উৎপাদন তথা মাছের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে অগভীর পুকুরে সূর্যালোকের হাত থেকে যাহকে রক্ষার উদ্দেশ্য অল্প সময়ের জন্য সীমিত সংখ্যক লতানো জলজ উদ্ভিদ, যেমন- কলমিলতা, হেলেঞ্চা প্রভৃতি রাখা যেতে পারে ।
প্রতিবেশের ভৌত ও রাসায়নিক নিয়ামক :
জলজ প্রতিবেশের মাধ্যম হচ্ছে পানি। আর পানিকে ধারণ করে মাটি। মাটির গুণাগুণের ওপর তাই পানির গুণাগুণ অনেকাংশে নির্ভরশীল । প্রতিবেশের জৈব ও অজৈব উপাদানসমূহ পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়ার পর মাটিতে স্থিত হয়। জীবকূলের মৃত্যুর পর পচনক্রিয়ার ফলে দেহাবশেষ বিভিন্ন মৌলিক বা যৌগিক উপাদান হিসেবে মাটিতে মিশে যায়।
জীবকূলের পরবর্তী বংশধরদের বিকাশের প্রয়োজনে ঐসব উপাদান পুনঃচক্রায়িত হয়ে জীব উপাদানসমূহের কাজে লাগে। মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকা, খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণ, দৈহিক বৃদ্ধি, প্রজনন প্রভৃতি কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মাটি ও পানির ভৌত রাসায়নিক নিয়ামকসমূহের অনুকূল মাত্রা রয়েছে।
আরও দেখুন: