আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় – খনিজ উপাদান ও তার চাহিদা
খনিজ উপাদান ও তার চাহিদা
খনিজ উপাদান
খনিজ উপাদান হলো প্রাণীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অজৈব রাসায়নিক পদার্থ যা প্রাণীর দেহের বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য দরকার হয়। প্রায় ২০ প্রকারের অজৈব পদার্থ বা খনিজ উপাদান বিভিন্ন প্রাণী, মাছ ও চিংড়ির জন্য প্রয়োজন হয়। খনিজ উপাদানগুলো মাছের শরীরের এনজাইম, হরমোন এবং আমিষের জৈব অনুঘটক বা বায়োক্যাটালিষ্ট (Biocatalyst) হিসেবে কাজ করে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস হাড়ের গঠনে প্রয়োজন, কিন্তু লৌহ রক্তের লোহিতকণিকার একটি উপাদান। খনিজ উপাদন মাছের অভিশ্রবন প্রক্রিয়ার জন্যও খুবই প্রয়োজন। সাধারণত খনিজ পদার্থসম হকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন মুখ্য উপাদান (Macro- elements) ও গৌণ উপাদান (Micro-elements)। প্রতি কিলোগ্রাম মাছের খাবারে যে সকল খনিজ উপাদানের পরিমাণ ১০০ গ্রাম বা এর অধিক, সে সকল খনিজ উপাদানকে মুখ্য উপাদান বলে।
যেমন- ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্লোরিন এবং ফসফরাস। কোন কোন খনিজ উপাদান মাছের জন্য খুব অল্প পরিমাণে দরকার হয়। মাছের প্রতি কিলোগ্রাম খাবারে যে সকল খনিজ উপাদানের পরিমাণ ১০০ গ্রামের কম সে সকল খনিজ উপাদানকে গৌণ উপাদান বলে। যেমন- লোহা, তামা, ম্যাগানিজ, দস্তা, কোবাল্ট, মোলিবডেনাম, ক্রোমিয়াম, সেলিনিয়াম, ক্লোরিন, আয়োডিন এবং নিকেল।
মুখ্য উপাদানসম
ক্যালসিয়াম
ক্যালসিয়ামের প্রধান প্রধান কার্যসমূহ নিচে প্রদান করা হলো-
- এটি মাছের হাড়, তরুণাস্থি এবং চিংড়ির বহিঃখোলসের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান।
- এটি রক্ত জমাট বাঁধতে ভূমিকা রাখে।
- এটি কতগুলো প্রধান এনজাইমের সক্রিয়ক। এনজাইমগুলো হলো প্যাংক্রিয়াটিক লাইপেইজ, (Pancretic lipase), এসিড ফসফাটেজ (acid phosphatase) ইত্যাদি।
উৎস : চুনাপাথর, ঝিনুকের খোলস, হাড়ের গুঁড়া, চিংড়ির দেহ ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়।
ফসফরাস
ফসফরাসের প্রধান প্রধান কাজগুলো হলো নিম্নরূপ-
- এটি হাড়ের গঠন, তরুণাস্থি এবং চিংড়ির খোলসের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান।
- এটি শক্তির রূপান্তরে এবং বিপাকক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে থাকে।
- এটি ফসফোলিপিড, নিউক্লিক এসিড, কেজিন, এটিপি (ATP) ইত্যাদির অতি প্রয়োজনীয় উপাদান।
- অজৈব ফসফেট প্রাণীর শরীরের অম্লক্ষারীয় ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উৎস : রক ফসফেট, হাড়ের চূর্ণ, ফিশ মিল, মুরগির রক্ত, মুরগির শুকনো বিষ্ঠা, চালের কুঁড়া, গমের কুঁড়া ইত্যাদি থেকে ফসফরাস পাওয়া যায়।
ম্যাগনেশিয়াম
এটির প্রধান প্রধান কাজগুলো হলো নিম্নরূপ –
- এটি হাড়ের গঠন, তরুণাস্থি এবং চিংড়ির খোলস গঠনের জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান।
- ম্যাগনেশিয়াম অনেকগুলো এনজাইমের সক্রিয়ক। যেমন – কাইনেজ (Kinase). মিউটেজেস্ (Mutases) ইত্যাদি।
- এটি কোষ মধ্যস্থিত অ-ক্ষারক ভারসাম্যতা রক্ষায় এবং কার্বোহাড্রেট, আমিষ ও চর্বির বিপাকক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উৎস : মাংস এবং হাড় চূর্ণ, চালের কুঁড়া, সর্যমুখীর বীজ, তিল, চিংড়ির মাংস, কাঁকড়ার চূর্ণ, মুরগির শুকনা বিষ্ঠা ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম পাওয়া যায়।
সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্লোরিন
এ তিনটি খনিজ উপাদান মাছের শরীরের তরল পদার্থে এবং নরম কলার মধ্যে থাকে। সোডিয়াম ও ক্লোরিন শুধুমাত্র শরীরের তরল পদার্থের মধ্যে দ্রবীভূত থাকে। এ উপাদানগুলো অভিশ্রবনীয় চাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এরা পানির বিপাক ক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে এবং শরীরে অম্ল-ক্ষারীয় ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে।
উৎস : ঘন মৎস্য দ্রবণ, চিংড়ির চূর্ণ, সাদা ফিশ মিল, ইক্ষুর শুকনো গুড়, সয়াবিন মিল, চালের কুঁড়া ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে এ উপাদানগুলো পাওয়া যায়।
সালফার
সালফারের প্রধান প্রধান কাজগুলো নিরূপ
- এটি অনেকগুলো প্রধান অ্যামাইনো এসিডের (মিথিওনিন, সিসটিন) গুরুত্বপূর্ণ উপাদান
- সালফেট হিসেবে এটি বহু জৈব পদার্থের উপাদান।
- অনেকগুলো মূখ্য এনজাইমের কো-এনজাইম এবং গ-টাথিয়ন এবং তাদের কার্যকারিতা মুক্ত সালফারের এর ওপর নির্ভরশীল।
- এটি মাছের শরীরের বিষক্রিয়ার প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
উৎস : ফিশ মিল, মুরগির ডিম এবং পাখির পাখনা দিয়ে তৈরি ফিদার মিলে প্রচুর পরিমাণ সালফার থাকে।

গৌণ উপাদানসমূহ
লৌহ
লৌহের প্রধান প্রধান কাজ নিরূপ –
- এটি হিমোগোবিনের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান।
- এটি অনেক এনজাইমের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। যেমন সাইটেক্রোম ক্যাটালেজ। ইত্যাদি।
- এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন এবং ইলেকট্রন স্থানান্তরের কাজের জন্য প্রয়োজন।
উৎস : রক্ত, নারিকেল চূর্ণ, মাংস ও অস্থি চূর্ণ, কাঁকড়া চূর্ণ, চালের কুঁড়া, মুরগির শুকনো বিষ্ঠা ইত্যাদি ও পাওয়া যায়।
কপার
কপারের প্রধান প্রধান জৈব ক্রিয়া নিচে প্রদত্ত হলো-
- এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে জারন বিজারন এনজাইম পদ্ধতিতে ভূমিকা রাখে।
- এটি লৌহের বিপাকক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট থেকে হিমোগে-বিন সংশ্লেষণ করে রক্তকণিকা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
- কপার মেলানিন তৈরিতে ভূমিকা রাখে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। এছাড়াও এটি হাড় গঠনে ও বিভিন্ন কলা গঠনে সাহায্য করে থাকে।
উৎস : ঘন মাছের প্রবণ, ইক্ষুর শুকনো গুড়, তুলার বীজ, কাঁকড়া চূর্ণ, সয়াবিন মিল এবং মুরগির শুকনো বিষ্ঠায় কপার পাওয়া যায়।
ম্যাংগানিজ
ম্যাংগানিজের জৈব ক্রিয়ায় বিবরণ নিচে দেয়া হলো-
- এটি শরীরে এনজাইমের সক্রিয়ক উত্তেজক হিসেবে কাজ করে থাকে। এনজাইমগুলো ফসফেট স্থানান্তরে সাহায্য করে। এটি বিশেষ করে সাইট্রিক এসিড চক্র, ক্ষারীয় ফসফাটেজ এবং হেক্সোকাইনেজ জাতীয় এনজাইমকে সক্রিয় করতে ভূমিকা রাখে।
- এটি পাইরুভেট কার্বোক্সিলেজের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- অনেকগুলো এনজাইমের উপাদান হিসেবে ম্যাংগানিজ হাড়ের গঠনে, রক্তকণিকা পুনর্গঠনে, শর্করার বিপাক ক্রিয়ায় এবং মাছের প্রজনন চক্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
জিঙ্ক
জিঙ্ক মাছের জন্য অতি প্রয়োজনীয় গৌণ খনিজ পদার্থ। এর জৈব ক্রিয়ার বিবরণ সংক্ষেপে নিরূপ :
- এটি ৮০ টির অধিক ধাতব এনজাইমের (metalloenzyme) গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- এটি বহু এনজাইমের কো-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে থাকে। এগুলো মধ্যে আরজিনো ও ইনোলেজ অন্যতম ।
- জিঙ্ক একটি সক্রিয় উপাদান হিসেবে চর্বি, আমিষ ও শর্করা বিপাকক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
- এটি হরমোনের সাথে ভূমিকা রাখে বলে কেহ কেহ মনে করেন।
- এটি ক্ষতস্থান শুকাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
উৎস : মুরগির হ্যাচারির শুকনো খাবার, ক্যানডিডা ইস্ট, শুকনো মাছের প্রবণ, ফিশ মিল, মুরগির শুকনো বিষ্ঠা, গমের কুঁড়া, সূর্যমূখী বীজ দ্বারা তৈরি খাদ্য ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ জিঙ্ক পাওয়া যায়।
কোবাল্ট
কোবাল্টের জৈবক্রিয়ার বিবরণ নিচে প্রদত্ত হলো –
- এটি সাইয়ানোকোবাল্যামিন (ভিটামিন বি-১২) এর একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে রক্তকণিকা গঠনে এবং স্নায়ুকোষের রক্ষণাবেক্ষণে ভূমিকা পালন করে।
- এটি বিভিন্ন এনজাইম পদ্ধতিতে উত্তেজক সক্রিয়ক হিসেবে কাজ করে থাকে বলে কেহ কেহ বিশ্বাস করে থাকেন।
উৎস : নারকেলের শাঁস, তিসি, ফিশ মিল, তুলাবীজ এবং সয়াবিনে কোবাল্ট পাওয়া যায়।
আয়োডিন
আয়োডিন থায়রয়েড হরমোনে থায়রক্সিন ও ট্রাই-আয়োডো থায়ারোবিন এর একটি অপরিহার্য উপাদান।
- এটি বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে থাকে।
- এর অভাবে মাছের ও অন্যান্য প্রাণীর গলগন্ড রোগ দেখা যায়।
উৎস : সাধারণত সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য খান্য দ্রব্যে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে। সমুদ্রের শৈবাল, অন্যান্য উদ্ভিদ এবং চিংড়ি ও কাকড়ার শরীরে প্রচুর আয়োডিন থাকে।
আরও দেখুন :