ক্ষতরোগের প্রতিকার

ক্ষতরোগের প্রতিকার – “মাছের স্বাস্থ্য পরিচর্যা” কোর্স বইটি বিশেষভাবে স্কুল অব এগ্রিকালচার এন্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট-এর বিএজিএড প্রোগ্রামের ছাত্রদের জন্য লেখা হয়েছে। আপনি জানেন, দূর শিক্ষণে শিক্ষকের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নেই। তাই পাঠের কোনো কঠিন বিষয় যেন আপনার বুঝতে অসুবিধা না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই কোর্স বইটি লেখা হয়েছে। কোর্স বইটির আঙ্গিক ও উপস্থাপনা তাই প্রচলিত পাঠ্যবই থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের। যেহেতু সরাসরি শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই কোর্স বইটি আপনাকে নিজে পড়ে বুঝতে হবে, তাই এটি কীভাবে পড়বেন প্রথমেই তা জেনে নিন। এতে কোর্স বইটি পড়তে ও বুঝতে আপনার সুবিধা হবে।

 

ক্ষতরোগের প্রতিকার

 

ক্ষতরোগের প্রতিকার

এ পাঠ শেষে আপনি-

  • চুন ও লবণ প্রয়োগে ক্ষত রোগের প্রতিকার করার পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
  • পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও ম্যালাকাইট গ্রীন ব্যবহার করে মাছের ক্ষতরোগ প্রতিকারের চেষ্টা করতে পারবেন।
  • ক্ষতরোগ প্রতিকারে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে দেখতে পারবেন।

নিঃসন্দেহে ক্ষতরোগ একটি মারাত্মক রোগ এবং স্বাদু পানির মাছ চাষে এ রোগ একটি প্রধান সমস্যা। দেশে বর্তমানে এ রোগের তীব্রতা এবং ব্যপকতা কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে কম পরিলক্ষিত হলেও এখন পর্যন্ত এ রোগ নির্মূল হয়নি। যেহেতু এ রোগের শুরুর কারণ এখন পর্যন্ত পরিস্কার ভাবে জানা যায় নি- তবে পারিবেশিক কারণে মাছের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে Aphanomyces invaderi নামক ছত্রাক রোগ জীবানুর আক্রমণের দ্বারা এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে বলে অনেকেই বর্তমানে বিশ্বাস করছেন।

অবশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে ভাইরাস কিংবা Aeromonas sp. ব্যাকটেরিয়া একক বা যৌথ ভাবে এ রোগ সৃষ্টির ব্যাপারে সহায়ক নয় এ কথা এখনও পর্যন্ত বাদ দেওয়া হয়নি। সুতরাং রোগটির ঘটক বস্তু (Causative agent) এখন পর্যন্ত মিশ্র কারণ বলেই প্রতীয়মান- তাই সঠিক ভাবে প্রতিকার পদ্ধতি বলা মুশকিল। আমাদের দেশের বেশীরভাগ তথ্য অনুযায়ী শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত (নভেম্বর- ফেব্রুয়ারী মাস) এ রোগের প্রাদুর্ভাব খুবই সাধারণ- অবশ্য এর বাইরেও এ ধরনের রোগ কোথাও কোথাও পরিলক্ষিত হয়েছে।

উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী এবং এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে যে সকল প্রতিকার পদ্ধতির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ত নিম্নে বর্ণিত হল। প্রকৃতপক্ষে ক্ষত রোগের প্রতিকার করতে হলে এর প্রতিরোধ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে-তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সংক্রমন বন্ধ করা এবং শীতকাল আসার পূর্বেই পুকুরে চুন ও লবণ (প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে) দিয়ে সাবধান থাকা। এর পর নিয়মিত জাল টেনে পরীক্ষা করে দেখা দরকার মজুতকৃত মাছে কোন প্রকার ক্ষত চিহ্ন বা ঘা দেখা যাচ্ছে কি না। এ ছাড়া আশেপাশের এলাকার পুকুরে মাছের এ ধরনে কোন রোগ দেখা দিয়েছে কি না তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

প্রতিকার করার একটি অসুবিধা হল Aphanomyces invaderi ছত্রাকটি কোষের অভ্যন্তরে অবস্থান করে বিধায় কোন ঔষধ প্রয়োগ করলে উপরের ক্ষত বা ক্ষতের উপরিভাগে অবস্থিত ছত্রাকগুলো মারা গেলেও ভিতরের গুলো সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায় এবং পরবর্তীতে আবার ক্ষতের সৃষ্টি করে।

 

Aphanomyces invaderi ছত্রাক দ্বারাআক্রান্ত মাছ পারিবেশিক প্রভাব ও অন্যান্য কারণের সংমিশ্রনে ক্ষতরোগের সৃষ্টি বলে এর প্রতিকার খুব জটিল।

 

 

Google News
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

চুনের ব্যবহার

রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে পানির পি.এইচ পরীক্ষা করে যদি প্রতিকূল অবস্থায় থাকে অর্থাৎ ৭ এর নীচে, তা হলে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন CaCO3 অথবা CaMg(CO3)2 প্রয়োগ করলে উপকার পাওয়া যায়। চুন দেওয়ার পূর্বে অবশ্যই ভিজিয়ে নিয়ে সমস্ত পুকুরে সমভাবে যাতে চুন ছড়ানো যায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে পানির অম্লীয় ভাব দূর হয় এবং অনেক রোগ জীবানু দমন হয়।

 

প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন ও ১ কেজি লবণ ব্যবহার উত্তম চিকিৎসা হিসেবে পরিচিত। তবে অবস্থা অনুযায়ী পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট এন্টিবায়োটিক বা ম্যালাকাইটগ্রীন দ্বারাও চিকিৎসা করানো যেতে পারে।

 

লবণের ব্যবহার

অনেকেই চুনের সাথে সমান অনুপাতে লবণ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন- সেই হিসেবে চুনের সাথে সাথে প্রতি শতাংশে ১ কেজি লবণ পানিতে পূর্বেই গলিয়ে নিয়ে তা সারা পুকুরে ছড়িয়ে দিতে পারলে উপকার পাওয়া যায়। বর্তমানে ক্ষত রোগের প্রতিকারের জন্য লবণ ও চুন নিয়ে নানাবিধ গবেষণা করে বিভিন্ন অনুপাতের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে-

যেমনঃ প্রতি শতাংশে           (চুন+ লবণ) ১ কেজি + ১ কেজি

১কেজি + ১/২কেজি            পুকুরে প্রয়োগের জন্য।

১/২ কেজি + ১/২ কেজি

১/২ কেজি + ১ কেজি

যেহেতু চুন ও লবণ সহজ লভ্য এবং পুকুরে প্রয়োগের দ্বারা ভবিষ্যতে ক্ষতির আশংকা নেই তাই চুন ও লবণের ব্যবহারই বাংলাদেশে ক্ষত রোগের প্রতিকারে অধিকতর গ্রহনীয়। অবশ্য সীমিত সংখ্যক মাছে এ রোগ দেখা দিলে সে জন্য অন্য রাসায়নিক দ্রব্যাদিও ব্যবহার করা যেতে পারে।

পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্বারা চিকিৎসা

পুকুরে প্রয়োগ ব্যয় বহুল তাই- আক্রান্ত মূল্যবান মাছকে ৫ পি.পি.এম দ্রবণে গোসল করালে উপকার পাওয়া যায়। তবে পাকা ট্যাংক বা ছোট পুকুরে বড় মাছ (মজুদকৃত) প্রজননের জন্য রাখা আক্রান্ত মাছকে চুন+ লবণের সহিত ৩ পি.পি.এম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশ্রিত করে প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

ম্যালাকাইট গ্রীন দ্বারা চিকিৎসা

আঘাত বা অন্য কোন প্রাথমিক পীড়নের দ্বারা মাছের শরীরে কোন ক্ষত দেখা দিলে শীতকালে তা ক্ষত রোগের আক্রমণের সহায়ক হয়। এ সকল ক্ষেত্রে সাধারণত ছত্রাকের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। এ সময় আক্রান্ত মাছকে ০.৫ পি.পি.এম থেকে ১ পি.পি.এম ম্যালাকাইট দ্রবণে ৫ মিনিট থেকে ১০ মিনিট কাল ডুবালে এ সকল আক্রমণের প্রতিকার পাওয়া যায়। পুকুরে ০.১৫ ০.২০ পি.পি.এম হারে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

 

ক্ষতরোগের প্রতিকার

 

এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে চিকিৎসা

ক্ষতরোগের ক্ষেত্রে Aphanomyces invaderi নামক ছত্রাক রোগজীবানু হিসেবে সনাক্ত হলেও এরোগের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার সংশ্লিষ্ট থাকার কথা অনেক বৈজ্ঞানিক স্বীকার করেন। কাজেই রোগের প্রাদুর্ভাব হলে কিছু এন্টিবায়োটিক খাবারের মাধ্যমে মাছে প্রয়োগ করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। সাধারণতঃ অক্সিটেট্রাসাইক্লিন বা টেরামাইসিন প্রতি কেজি মাছের জন্য ৭৫ মি.গ্রাম প্রত্যহ খাবারের সংগে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর্যন্ত খাওয়ালে ভাল ফল পাওয়া যায়। যা হউক ক্ষত রোগের প্রতিকার একটি জটিল ব্যাপার। উত্তম প্রতিকারের জন্য পূর্ব থেকে প্রতিরোধ ব্যবস্থাও এক সংগে চালিয়ে যেতে হবে।

অনুশীলন (Activity): কীভাবে ক্ষত রোগের প্রতিকার করা যায় তা সংক্ষেপে লিখুন।

সারমর্ম: ক্ষত রোগ স্বাদু পানির মাছের একটি মারাত্মক রোগ। বিভিন্ন মৎস্য খামার সহ পুকুর, খাল, বিলের প্রায় সব ধরনের মাছেই এর মড়ক লক্ষ্য করা গেছে। তবে বন্য মাছ হিসেবে শোল, টাকী, পুঁটি মাছ এবং চাষকৃত মাছের মধ্যে মৃগেল, রুই ইত্যাদিতে এ রোগের প্রভাব বেশী পরিলক্ষিত হয়েছে।

পানির পরিবেশ শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটু পরিবর্তন হওয়ার ফলে Aphanomyces invaderi নামক ছত্রাক মাছের কোষের অভ্যন্তরে আক্রমণের ফলে ক্রমশঃ ক্ষতের সৃষ্টি করে ফলে মাছের মৃত্যু ঘটে থাকে। তাৎক্ষনিক ভাবে মড়কের প্রতিকার করা বেশ কঠিন।

পূর্ব থেকে সাবধানতা অবলম্বন করলে বিশেষ করে পানির পরিবেশ ভাল রাখা এবং অন্য কোন স্থান থেকে সংক্রমন যাতে না হতে পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া। শীতের শুরু থেকে পুকুরে নিয়মিত মাছ পর্যবেক্ষন করে প্রতি শতাংশে ১/২ কেজি লবণ ও ১/২ কেজি চুন প্রয়োগ করলে এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। এ ছাড়া দু-একটি মাাছে রোগ (ক্ষত) দেখা দিলেই চুন ও লবণের পরিমাণ বাড়িয়ে দু-সপ্তাহ অন্তর প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন ও ১ কেজি লবণ দিতে হবে। অনেকে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, ম্যালাকাইট গ্রীন বা এন্টিবায়োটিকের উপদেশ দিয়ে থাকেন তবে প্রকৃত পক্ষে তা তত কার্যকর নয়।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment