আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-কৃত্রিম প্রজননের জন্য পিজি দ্রবণ তৈরি ইনজেকশন প্রয়োগ ও প্রণোদিত প্রজনন
কৃত্রিম প্রজননের জন্য পিজি দ্রবণ তৈরি ইনজেকশন প্রয়োগ ও প্রণোদিত প্রজনন
হরমোন দ্রবণ তৈরি ও ইনজেকশন প্রয়োগ মাছের ইনজেকশন দেওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পিজি দিয়ে হরমোন দ্রবণ তৈরি করতে হয় । প্রথমে ব্রুড মাছের ওজন অনুপাতে কী পরিমাণ পিজি দরকার হবে তা হিসাব করতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিমাণ/সংখ্যক পিজি ভায়াল থেকে বের করে একটি ফিল্টার কাগজের উপর ১-২ মিনিট রাখা হয় যাতে অ্যালকোহল শুকিয়ে যায় ।
এসিটোনে সংরক্ষিত পিজি সরাসরি ভায়াল থেকে টিস্যু হোমাজিনাইজারে স্থানান্তর করা হয় । সামান্য পাতিত পানি বা ০.৩% সাধারণ লবণ দ্রবণসহ পিজিকে একটি টিস্যু হোমাজিনাইজারে নেয়া হয় ।পরিষ্কার নদী বা পুকুরের পানি যার পিএইচ নিরপেক্ষ তাকে ও দ্রবণ মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে ।
টিস্যু হোমাজিনাইজারে পিজিকে একটি দণ্ডের সাহায্যে পেষণ করা হয় যাতে পিজি যতটুকু সম্ভব ব্যবহৃত মাধ্যমে মিশে যায়। পেষণকৃত পিজিতে প্রয়োজনীয় ঘনত্ব পাওয়ার জন্য দরকার হলে আরও পানি দ্রবণ যোগ করতে হতে পারে। কী পরিমাণ মাছকে ইনজেকশন দেওয়া হবে তার উপর নির্ভর করবে কতটুকু দ্রাবক ব্যবহার করতে হবে । মনে রাখতে হবে দ্রবণ যেন খুবই ঘন বা খুবই পাতলা না হয় ।
সাধারণ ২-৩ মি. গ্রাম পি.জি ০.১ মি.লি দ্রবণে দ্রবীভূত করা হয়। অর্থাৎ প্রতি মি. লি দ্রবণে ২০-৩০ মি. গ্রাম পিজির দ্রবীভূত করা হয় । এ মাত্রা প্রয়োজনে কমানো বা বাড়ানো যেতে পারে । মাছের আকারের উপর নির্ভর করে সর্বোচ্চ ১ মি.লি. এবং সর্বনিম্ন ০.১ মি.লি. দ্রবণে ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ একটি প্রজননকারী মাছেকে ৪৫ মিলিগ্রাম পিজি ইনজেকশন দিতে হবে। যদি প্রতি ০.১ মিলি লিটারে ৩ মিলিগ্রাম পিন্ধি দ্রবীভূত করা হয়, তাহলে ৪৫ মি. লি. গ্রাম পিজির জন্য ১.৫ মি. লি দ্রাবকের প্রয়োজন হবে । কিন্তু যেহেতু পূর্বে বলা হয়েছে যে একটি মাছের জন্য সর্বোচ্চ ১ মি. লি গ্রাম দ্রবণ ব্যবহার করা উচিত সেক্ষেত্রে প্রতি ০.১ মি. লি. এ ৫ মি. লি গ্রাম পিজির দ্রবণ তৈরি করতে হবে।
ফলস্বরূপ মোট হরমোন দ্রবণের পরিমাণ হবে ০.৯ মি.লি. পিজির সাসপেনসহ হোমোজিনাইজার থেকে একটি সেন্ট্রিফিউজ মেশিনের টিউবে স্থানান্তর করা হয়। ঢালার পূর্বে হোমোজিনাইজার ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে যাতে করে থিতানো গ্রন্থিকণা ভালোভাবে দ্রবণে মিশে যেতে পারে। এরপর স্রবণসহ টিউবটি একটি হস্তচালিত অথবা বিদ্যুৎচালিত সেন্ট্রিফিউজ মেশিনে স্থাপন করা হয়।
মেশিন চালনা করলে অদ্রবণীয় কণা টিউবের তলার জমা হবে এবং পরিষ্কার দ্রবণ উহার উপর অবস্থান করবে। ইনজেকশন দেওয়ার জন্য একটি পরিষ্কার সিরিজের সাহায্যে টিউবের উপরিভাগের স্বচ্ছ প্রবণ সেন্ট্রিফিউজ টিউব হতে তুলে নেয়া হয় ।
পিজি ইনজেকশনের ডোজ বা মাত্রা
পিজি দ্রবণের সঠিক ডোজ নির্ধারণ করা কৃত্রিম প্রজননের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্প মাত্রা কোনো কোনো সময় কার্যকরী নাও হতে পারে আবার অধিক মাত্রা অপ্রাপ্ত ডিম ছাড়তে বাধ্য করে যার ফলে ডিম পরিষ্কার পরিস্ফুটনের অনুপাত উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। হরমোনের মাত্রা নির্ধারণী সেসব অনুঘটক বিদ্যমান তার মধ্যে মাছের বয়স, আকার এবং যৌন পরিপক্বতার অবস্থা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করা খুবই কঠিন কারণ অনেক সময় দেখা যায় যে একই প্রজাতির একই বয়সে এবং একই আকারের মাছের মধ্যেও যৌন পরিপকৃতার তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। আবার যে সমস্ত পিজি ব্যবহার করা হবে সেগুলোর কার্যকারিতার মধ্যে ও পার্থক্য থাকতে পারে বা থাকাই স্বাভাবিক ।
যে প্রজননকারী মাছকে ইনজেকশন দেওয়া হবে তার ওজনের উপর ভিত্তি করে ইনজেকশনের পিজির পরিমাণ হিসাব করা হয় । অনেক সময় যৌন পরিপক্বতার মধ্যে ভারতম্য হেতু একই আকারের মাছকে একই পরিমাণ ইনজেকশন দিলে ফলাফলের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।
ডিম যদি পরিপক্ক না হয় অথবা ডিম যদি ডিম্বথলিতে মিশে যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছে তাহলে অধিক মাত্রায় ইনজেকশন দিলেও ভালো ফল পাওয়া যায় না বা মাছ কখনো ডিম ছাড়ে না। অভিজ্ঞতার আলোকে ব্রুড মাছ নির্বাচন করে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ইনজেকশন দিলে ৬০-৭০% ক্ষেত্রে মাছ প্রজনন করে থাকে ।
দেখা গেছে যে যদি প্রাথমিক পর্যায়ে একটি স্বল্পমাত্রার ইনজেকশন এবং ৪-৬ ঘণ্টার পর অপেক্ষাকৃত অধিক মাত্রার ইনজেকশন দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। শুধুমাত্র স্ত্রী মাছে ২টি ইনজেকশন দেওয়া হয় । তবে পুরুষ মাছে তলপেটে চাপ দিলে যদি ভালো মিস্ট (শুক্রাণু) না বের হয় তাহলে পুরুষের ক্ষেত্রেও ২টি ইনজেকশন দিতে হবে ।
যদি পিজি ওজন করার জন্য কোনো নিখুঁত ব্যালেন্স না থাকে তাহলে সংখ্যা হিসাবে ও পিজি ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে । এক্ষেত্রে একই প্রজাতির একই আকারের পরিপক্ক মাছ থেকে সংগৃহীত ১-৩টি পিজি এক জোড়া ব্রুড মাছকে ইনজেকশন দেওয়া হয় ।
হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ পদ্ধতি :
সাধারণত অন্তঃমাংসপেশীয় ইনজেকশন দ্বারা হরমোন ব্রুড মাছে প্রয়োগ করা হয় । এছাড়া অন্তঃগহবরীয় ইনজেকশনের মাধ্যমেও হরমোন প্রয়োগ করা যেতে পারে । ইন্ট্রাপেরিটোনিয়াল ইনজেকশন শ্রেণী পাখনা বা বক্ষ পাখনার গোড়ায় দেওয়া হয়। তবে এ পদ্ধতিতে মাছের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে যখন স্ত্রী মাছের ডিম্বাশয় অতিরিক্ত পরিপক্ক ডিম ধারণের জন্য বর্ধিত হয়। এছাড়া পরপর প্রয়োগকৃত ইন্ট্রোপেরিটোনিয়াল ইনজেকশন বিশেষ করে যখন পিজি দ্রবণ ছাঁকা হয় না, তখন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে ।
অন্যদিকে ইন্ট্রামাসকুলার ইনজেকশন প্রয়োগ পদ্ধতি সহজতর ও বেশি কার্যকর। এ ইনজেকশন সাধারণত লেজের অঞ্চলে অথবা পৃষ্ঠ পাখনার নিচে এবং পার্শ্বরেখার উপরের অংশে প্রয়োগ করা হয়। দুটো ইনজেকশন ক্ষেত্রে উভয় পার্শ্বে ১টি করে দেওয়া হয়। ইন্ট্রামাসকুলার ইনজেকশনের জন্য একটি আঁইশের নিচে প্রথমে দেহের সমান্তরাল এবং পরে ৪৫° কোণে সূচ প্রবেশ করানো হয়।
২ সিসি মাপের হাইপোভা সিরিঞ্জ হরমোন ইনজেকশন দেওয়ার জন্য সহজতর উপযোগী। B.D.H সূচ নং ২২ দ্বারা ১-৩ কেজি ওজনের মাছকে, ছোট আকারের মাছকে ১৯ নং সূচ দিয়ে সহজেই ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে ।
চাষযোগ্য মাছের প্রণোদিত প্রজনন :
মৎস্য চাষ উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো নিয়মিতভাবে সঠিক মানের পোনা সরবরাহ করা। হ্যাচারিতে প্রণোদিত উপায়ে প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনা করে উন্নত ও সঠিক মানের পোনা উৎপাদন করেই মৎস্য চাষের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা যায়। আর সঠিক মানের পোনা উৎপাদনের জন্য প্রধান কাজই হলো প্রত্যেকটি হ্যাচারিতে সঠিক গুণাগুণ সম্পন্ন প্রচুর পরিমাণে জেনেটিকভাবে বিশুদ্ধ ব্রুড মাছ মজুদ এবং পরিচর্যা করা ।
আমাদের দেশে বর্তমানে ৮৯টি সরকারি হ্যাচারি আছে যেখানে ১৪৭৭৫ কেজি রেণু উৎপাদন হয় এবং ৮১৩টি বেসরকারি মৎস্য হ্যাচারি আছে যেখানে ৫৯৪৮৩৯ কেজি রেণু উৎপাদন হচ্ছে । চাষযোগ্য বিভিন্ন মাছের প্রণোদিত প্রজনন কৌশল নিম্নে দেওয়া হলো ।
রুই, কাতলা, মৃগেল, মাছের প্রণোদিত প্রজনন : বর্তমানে দেশে রুই জাতীয় মাছের চাহিদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে ।
আর তাই মৎস্য চাষে রুই জতীয় মাছের উন্নতমানের পোনা সঠিক আকার ও সময় মতো জোগান দেওয়ার জন্য মাছের প্রণোদিত প্রজনন করা হয়। মার্চের শুরু থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত রুই ও মৃগেল মাছের প্রণোদিত প্রজনন করা হয় । মার্চের আগেই এসব মাছ দৈহিক ভাবে প্রজনন উপযোগী হয়ে যায়। তবে কাতলা একটু বিলম্বে অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসে প্রজনন উপযোগী হয় । রুই জাতীয় মাছের প্রণোদিত
প্রজনন কৌশল নিম্নে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলো :
১. ব্রুড মাছ সংগ্ৰ
i) প্রাকৃতিক উৎস হতে অর্থাৎ নদ-নদী, প্লাবন ভূমি প্রভৃতি জলাশয় থেকে বন্য জাতের রুই জাতীয় মাছ
সংগ্রহ করা হয় ।
ii) হ্যাচারিতে দ্রুত বর্ধনশীল পোনা সংগ্রহ করতে হয় ।
iii) ব্রুড ব্যাংক হতে রুই জাতীয় মাছের ব্রুড সংগ্রহ করা হয় ।
iv) এক হ্যাচারি থেকে অন্য হ্যাচারিতে ব্রুড আদান-প্রদান অর্থাৎ ব্রুড বিনিময় করে ।
২. ব্রুড মাছ পালন
i) ব্রুড মাছ মজুদের পূর্বেই মজুদ পুকুরটি শুকিয়ে প্রয়োজনীয় মেরামত করে অতিরিক্ত কাদা সরিয়ে ফেলতে হবে। শতাংশ প্রতি ১-১.৫ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে । প্রতি শতাংশে ৫-৭ কেজি গোবর, টিএসপি ২০০ গ্রাম ও ইউরিয়া ১০০ গ্রাম হারে প্রয়োগ করে ব্রুড মজুদ কাজ সম্পন্ন করতে হবে ।
ii) মজুদ ঘনত্ব সঠিক মাত্রায় অর্থাৎ প্রতি শতাংশে ৬-৮ কেজি হলে ভালো হয়। মজুদ কালে পুকুরের তিনটি স্তরের মাছই মজুদ করলে খাদ্যের অপচয় হয় না। সুযোগ থাকলে প্রজাতি অনুযায়ী বা পুরুষ-স্ত্রী মাছ আলাদা পুকুরে পালন করলে ভালো ফল পাওয়া যায় ।
iii) প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি মাছের দেহ ওজনের ৩-৫% হারে ২০-২৫% আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য দৈনিক দুইবার প্রয়োগ করতে হবে ।
iv) ব্রুড মাছের রোগ-বালাই যাতে না হয় সে জন্য মাঝে মাঝে জাল টেনে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে ।
৩. ব্রুড মাছ বাছাই
i) ব্রুড মাছের সঠিক নির্বাচনের উপর প্রণোদিত প্রজননের সফলতা নির্ভর করে । মাছ বাছাইয়ের ব্যাপারটি মূলত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল। ব্রুড মাছ বাছাইয়ে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। পুকুরে মজুদ সব মাছ একত্রে পরিপক্ব হয় না। এজন্য ব্রুড বাছাই এর সময় পুকুরে জাল টেনে একটা একটা করে মাছ পরীক্ষা করা হয় ।
স্ত্রী মাছের পেট যথেষ্ট স্ফীত ও নরম, পায়ু পথ স্ফীত, কিছুটা সম্প্রসারিত, লাল বা গোলাপি বর্ণের হলে বুঝতে হবে ব্রুডটি যথেষ্ট পরিপক্ক হয়েছে। পুরুষ ব্রুড মাছের পেট চিকন থাকে। তবে পেটে হালকা চাপ দিলে সাদা দুধের মত শুক্র বা মিল্ট বেরিয়ে আসে। নিচের ছকে প্রজনন উপযুক্ত ব্রুড মাছের বৈশিষ্টসমূহ দেওয়া হলো :
বাছাইয়ের সময় জাল টানা, মাছ ধরা এবং পুকুর থেকে হ্যাচারির চৌবাচ্চার আনার সময় খুব সাবধান হওয়া দরকার যাতে মাছ কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। যে মাছগুলো পরীক্ষা করার পর আবার ছেড়ে দেওয়া হয় তখনও খুব সতর্ক থাকতে হয়। যাতে মাছ কোনো কষ্ট না পায়। অনেক সময় জালের মাছ একর করার সময় খুব লাফালাফি শুরু করে দেয়।
এমতাবস্থায় খুব ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে হবে। লাফ মেরে ওঠা মাছের আঘাতে জাল টানায় নিয়োজিত মানুষ যেন আহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। ব্রুড মাছের পুকুর হতে প্রজননের জন্য বাছাইকৃত মাছ হ্যাচারির চৌবাচ্চা পর্যন্ত আনার জন কাপড়ের বা জালের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার সুবিধাজনক।
দূরবর্তী পুকুর হতে ব্রুড আনয়নের সময় অবচেতন করে আনতে হবে। অবচেতন করার জন্য প্রতি লিটার পানিতে একফোঁটা ক্লোভ অয়েল (Clove Oil) মিশিয়ে ব্রুড মাছ পরিবহন করা যেতে পারে। তবে ওষুধ প্রয়োগের যাত্রা প্রজাতি ভেদে ও পানির তাপমাত্রার উপর কম বা বেশি হতে পারে। বাছাইয়ের সময় বিভিন্ন প্রজাতির স্ত্রী মাছের জন্য বিষণ সংখ্যায় পুরুষ মাছ
নেওয়া হয় । তবে ওজনের দিক থেকে স্ত্রী মাছের ওজনের দেড় গুণ পরিমাণ পুরুষ মাছ হলে ভালো হয় । অর্থাৎ ২ কেজি ওজনের স্ত্রী মাছের জন্য ১.৫ কেজি ওজনের ২টি পুরুষ মাছে ৩ কেজি ওজনের হতে হবে। প্রজননের জন্য মাছ বাছাই করার ১-২ দিন পূর্বে ব্রুড মাছের পুকুরে খাদ্য প্রদান বন্ধ রাখতে হয় এবং জাল টেনে মাছকে অভ্যস্ত করে নিতে হয় । মাছ বাছাই করে হ্যাচারির চৌবাচ্চায় ৫-৮ ঘণ্টা রেখে দিতে হয় যাতে হ্যাচারির পানিতে ব্রুড মাছ অভ্যস্ত হতে পারে।
১. হরমোন প্রয়োগ
প্রণোদিত প্রজননে ব্যবহৃত হরমোন বিভিন্ন উৎস হতে পাওয়া যায় এবং এগুলো বাজারে বিভিন্ন নামে প্রচলিত যেমন :
i) মাছের পিটুইটারি গ্রন্থি বা পিজি
ii) এইচসিজি (H.C.G) যেমন সুমাছ (ভারত), কোরোলন (হল্যান্ড)
iii) ওভাপ্রিম
iv) এলআরএইচএ (LRHA) ইত্যাদি
মৎস্য প্রজননে হরমোনের প্রয়োগ মাত্রা বিভিন্ন প্রজাতির জন্য বিভিন্ন হয়ে থাকে। কোনো কোনো মাছে শুধু পিজি আবার কোনো কোনো মাছে পিজি এবং এইচসিজি দুটোই প্রয়োগ করতে হয় । প্রজনন কাল, আবহাওয়া, তাপমাত্রা, ব্রুড মাছের পরিবর্তন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে হরমোন প্রয়োগ কম বা বেশি হতে পারে। তবে রুই, মৃগেল, কাতলা মাছের প্রণোদিত প্রজননে হরমোনের উৎস হিসেবে পিজি ব্যবহার করা হয় । পিটুইটারি গ্লান্ড বা পিজিতে গোনাডোট্রপিন হরমোন বিদ্যমান থাকে যা মাছের প্রজননকে প্রভাবিত করে
৫. হরমোনের মাত্রা
রুই, মৃগেল, কাতলা মাছের প্রণোদিত প্রজননে হরমোনের উৎস হিসেবে পিজি ব্যবহার করা হয়। হ্যাচারি পরিচালনার জন্য পিজি সংগ্রহ করা একটি ব্যয়বহুল খাত, সে কারণে সঠিক মাত্রায় পিজি ব্যবহার করলে একদিকে যেমন মাছের প্রজনন ভালোভাবে সম্পন্ন হবে অন্যদিকে পিজির অপচয়ও রোধ হয় ।
পিজি বা হরমোনের মাত্রা নির্ভর করে ব্রুড মাছের ডিম্বাশয়ের পরিপক্বতা এবং পানির তাপমাত্রার উপর । অপরিপক্ব ব্রুড মাছও তুলনামূলক ঠাণ্ডা আবহাওয়ার ক্ষেত্রে হরমোন বা পিজি একটু বেশি মাত্রায় ব্যবহার করতে হয়। তাই মাছের পরিপক্বতা ও আবহাওয়াগত কারণে প্রজনন মৌসুমের বিভিন্ন মাসে পিজি বা হরমোনের মাত্রা কম বেশি হয়ে থাকে।
সাধারণভাবে রুই, কাতলা মাছের প্রণোদিত প্রজননের জন্য স্ত্রী মাছের প্রতি কেজি ওজনের জন্য ৮-১৬ মিলিগ্রাম এবং পুরুষ মাছের প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১-৪ মিলিগ্রাম পিজি ব্যবহার হয়ে থাকে। স্ত্রী মাছের ক্ষেত্রে মোট হরমোনের পরিমাণকে তিন ভাগে ভাগ করে মোট দুইবারে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। প্রথম ইনজেকশনের ৬ ঘণ্টা পর দ্বিতীয় বা শেষ মাত্রা প্রয়োগ করা
হয় । পুরুষ মাছকে এসময়ে অর্থাৎ স্ত্রী মাছের দ্বিতীয় ইনজেকশনের সময় ১-৪ মিলিগ্রাম পিজি প্রতি কেজি ওজনের জন্য একমাত্র ডোজ হিসেবে দেওয়া হয়। প্রণোদিত প্রজননে হরমোন মাত্রার ভিন্নতা কম বেশি হওয়া নির্ভর করে ব্রুড মাছের পরিপক্বতা, আবহাওয়া এবং হ্যাচারি পরিচালকের অভিজ্ঞতার নিম্নে পরবর্তী দুটি ছকে ব্রাক বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) কর্তৃক সুপারিশকৃত রুই জাতীয় মাছের প্রজননে মাস ওয়ারী পিজি প্রয়োগের মাত্রা দেওয়া হলো :
৬. প্রবণ তৈরি
বাছাই করা ব্রুড মাছের প্রজাতি অনুসারে পুরুষ ও স্ত্রী মাছের ওজন একটি খাতায় লিখে রাখা হয় । এই হিসাব থেকে প্রতিটি মাছের কতটুকু পিজি প্রয়োজন তা নির্ণয় করা হয়। পূর্বে সংগৃহীত এবং এলকোহল/অ্যাসিটোনে সংরক্ষিত পিজি হতে প্রয়োজনীয় সংখ্যাক পিজি নিয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে চেপে চেপে শুকিয়ে নিতে হবে ।
এসিটোন সংরক্ষিত পিজি সরাসরি সূক্ষ্ম পাল্লা দিয়ে মেপে নিতে হয় । এবারে পিজিকে টিসু হোমোজিনাইজার বা হামান দিস্তা (মর্টার) দিয়ে ভালোভাবে পিষতে হবে। পেষার সময় সামান্য পরিমাণে ডিস্টিলড ওয়াটার বা পরিশ্রুত পানি দিতে হবে। পানি এমনভাবে দিতে হবে যাতে প্রতি কেজি ব্রুড মাছের দেহে ০.৩ মিলি গ্রামের বেশি দ্রবণ প্রবেশ না করে।
প্রয়োজনীয় পরিমাণ পরিশ্রুত পানি দিয়ে ভালোভাবে দ্রবণ তৈরি করে ৩০ মিনিট ধরে একটি টেস্টটিউবে রেখে দিতে হবে। ভালোভাবে থিতানোর জন্য সেন্ট্রিফিউজ মেশিন ব্যবহার করা যেতে পারে। থিতানো দ্রবণ থেকে তলানিটুকু বাদ দিয়ে পরিষ্কার দ্রবণ ইনজেকশনে ব্যবহার করা যেতে পারে ।
৭. ইনজেকশন দেওয়ার পদ্ধতি
সূক্ষ্ম সুচ ব্যবহার করে সিরিঞ্জের সাহায্যে মাছকে ইনজেকশন দেওয়া হয়। ২০-২২ নম্বর সুচ ব্যবহার সুবিধা জনক । মাছের দেহে বিভিন্ন স্থানে মাংসপেশিতে বা দেহ গহ্বরে ইনজেকশন দিতে হয় । রুই, কাতলা মাছের
ক্ষেত্রে বক্ষ পাখনার গোড়ার নিচের দিকে নরম স্থানে ইনজেকশন দেওয়া হয়। ইনজেকশন দেওয়ার সময়
সতর্ক থাকতে হবে যাতে সুচ দ্বারা মাছের শরীরের ভিতরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। ব্রুড মাছকে
আলতো করে ধরে ভেজা কাপড়ে জড়িয়ে স্পঞ্জের প্যাডে রেখে সাবধানতার সাথে ইনজেকশন দেওয়া হয় ।
অনেকে মাছকে পানির মধ্যে রেখেই ইনজেকশন দিয়ে থাকেন।
৮. ইনজেকশনের সময়
ইনজেকশন দেওয়ার সময় এমন ভাবে নির্ধারণ করা হয় যাতে প্রজনন পরিচালনাকারীর সুবিধা হয়। সাধারণত সকাল ৯টার মধ্যে জাল টেনে মাছ বাছাই করে হ্যাচারির চৌবাচ্চায় বিশ্রামের জন্য রেখে দিতে হবে । ৬-৭ ঘন্টা হ্যাচারির পানিতে অভ্যন্তকরণের পর বিকাল ৪টার দিকে প্রথম ইনজেকশন দেওয়া হয় ।
সাধারণত স্ত্রী মাছকে ২টি ইনজেকশন এবং পুরুষ মাছকে স্ত্রী মাছের ২য় ইনজেকশনের সময় একটি মা ইনজেকশন দেওয়া হয়। স্ত্রী মাছকে ১ম ইনজেকশন দেওয়ার ৬ ঘন্টা পর অর্থাৎ রাত ১০টার দিকে ২য় ইনজেকশন দেওয়া হয় । এসময় পুরুষ মাছকে একমাত্র ইনজেকশনটি দেওয়া হয় ।
৯. প্রজনন পদ্ধতি
হরমোন ইনজেকশন দেওয়ার পর স্ত্রী মাছের ডিম্বাশয়ের দ্রুত পরিবর্তন হয় এবং ডিম ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হয়। রুই, কাতলা, মৃগেল প্রভৃতি মাছ হ্যাচারির চৌবাচ্চায় সহজেই ডিম ছেড়ে দেয়। আবার বিদেশি কাপ যেমন : সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প এরা সহজে ডিম ছাড়ে না। তাই এরা ২য় ইনজেকশনের পর যখন ডিম ছাড়ার উপযুক্ত হয়, তখন এসব ব্রুড মাছের পেটে সামান্য চাপ প্রয়োগ করলে ডিম ও শুক্রাণু বেড়িয়ে আসে । তাই এদের প্রজনন আচরণ অনুসারে হ্যাচারিতে ২ পদ্ধতিতে প্রজনন ঘটানো হয় যথা :
i) সহজাত প্রক্রিয়া
ii) চাপ প্রয়োগ প্রক্রিয়া
i) সহজাত প্রক্রিয়া
স্ত্রী ব্রুড মাছকে ২য় ইনজেকশন এবং পুরুষ মাছকে ১ম ইনজেকশন দিয়ে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে একত্রে প্রজনন হাপায় রাখা হয় । বড় হ্যাচারিতে সার্কুলার ট্যাংকে অনেকগুলো ব্রুড মাছ একত্রে রাখা হয় । প্রতিটি স্ত্রী মাছের জন্য ২টি করে পুরুষ মাছ রাখা হয়। এভাবে রাখার পর তাদের প্রজনন উপযোগী পরিবেশ যেমন পানির প্রবাহ সৃষ্টি, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ (২৫ সে- ৩১.৫ সে ) পর্যাপ্ত দ্রবীভূত অক্সিজেনসমৃদ্ধ পরিষ্কার পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়।
পরিপক্ক ব্রুড মাছ এবং উপযুক্ত পরিবেশ হলে এ প্রক্রিয়ায় প্রজনন ভালো হয় এবং ডিম নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে । স্ত্রী মাছকে ২য় ইনজেকশন দিয়ে পুরুষ মাছের সাথে রাখার ৪-৮ ঘণ্টার মধ্যে স্ত্রী মাছ ডিম দিতে শুরু করে, স্ত্রী মাছ ডিম দেওয়ার সময় হলে পুরুষ মাছ তাদের তাড়া করে, এভাবে পানিতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। স্ত্রী মাছের ডিম দেওয়ার সাথে সাথে পুরুষ মাছ ডিমের উপর শুক্রাণু ছাড়ে।
ডিম ছাড়ার ঘণ্টাখানেক পরে ব্রুড মাছকে সরিয়ে নেয়া হয়। প্রজননকৃত মাছকে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা এক্রিয়াবিন ১-২ মি.গ্রাম / লিটার দ্রবণে গোসল করিয়ে পৃথক পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয় । নিষিক্ত ডিম ফুলে সাগু দানার মতো দেখায়। এবার হাপা থেকে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে ডিম ফুটানো জারে বা বোতলে দেওয়া হয় । সার্কুলার ট্যাংকে প্রজনন ঘটালে ব্রুড মাছ ফেলার পর এখানেই ডিম ফুটানো হয় । এই ক্ষেত্রে ব্রিডিং ট্যাংকই ইনকুবেশন ট্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।
খ. চাপ প্রয়োগ প্রক্রিয়া :
চাপ প্রয়োগ করে প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন শ্রমসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যেসব মাছ সহজাত প্রক্রিয়ায় প্রজনন করে না বা প্রজনন করানো সম্ভব হয় না তাদের জন্য চাপ প্রয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় । সিলভারকার্প, বিগহেড কার্প বা অনেক সময় রুই, কাতলা মাছকেও চাপ প্রয়োগ দ্বারা প্রজনন ঘটানো হয় । অনেক সময় পুরুষ ব্রুড কম থাকলেও চাপ প্রয়োগ প্রয়োগ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে ।
চাপ প্রয়োগ পদ্ধতিতে দ্বিতীয় ইনজেকশনের পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে আলাদা আলাদা হাপা বা চৌবাচ্চায় রাখা হয়। অক্সিজেনসমৃদ্ধে পানিরপ্রবাহ ও তাপমাত্রা ঠিক থাকলে ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে স্ত্রী মাছ ডিম দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায় । এজন্য ডিম দেওয়ার সময় হয়েছে কিনা তা ২য় ইনজেকশনের ৪ ঘণ্টা পর থেকে সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। স্ত্রী মাছ ২-৪ টা ডিম দিলেই বুঝতে হবে যে, এখনই চাপ প্রয়োগ করতে হবে ।
আলাদা করে মাছ ধরে প্লাস্টিকের শুকনা গামলা বা ট্রের উপর ধরে পেটে হালকা চাপ দিলে সহজেই ডিম বের আসে । এমনভাবে চাপ দিতে হবে যাতে মাছ না মারা যায়। একই সময় দ্রুততার সাথে ইনজেকশন দেওয়া পুরুষ মাছকে ধরে পেটে চাপ দিলে শুক্র বের হয়ে আসবে । এই শুক্র সংগৃহীত ডিমের উপর নিতে হবে এবং পরিষ্কার পালক বা নরম তুলি দিয়ে শুক্র ডিমের সাথে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হয়। মিনিটখানেক মিশানোর পর ডিম পরিষ্কার পানিতে কয়েকবার ধুয়ে নিতে হবে। ধোয়ার পর নিষিক্ত ডিম ঘণ্টাখানেক রেখে দেওয়া হয় যখন ডিমগুলো পানির সংস্পর্শের ফলে প্রায় ৩০-৪০ গুণ পর্যন্ত বড় হয়ে যায় । এবার ডিমকে ডিম ফুটানোর জার বা বোতলে দিয়ে দেওয়া হয় ।
আরও দেখুন: